অপরিচিত পর্বঃ ১১
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
খান ভিলায় এসে অবাক চোখে বাড়িটা দেখছে আরফা। দুতলা বাড়ি হলেও বেশ বড়, ডিজাইনটা পুরনো হলেও অনেক সুন্দর আর বাড়ির এরিয়াটা দেখে খানিকটা অবাকই হলো আরফা। কারণ বর্তমানে ঢাকা শহরে বাড়িগুলো খুব কম জায়গা নিয়েই হয় কিন্তু এই বাড়িটা অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে হয়তো অনেক পুরনো বাড়ি তাই। আরফার কাছে মুজাহিদ সাহেবের দেওয়া কার্ড থাকায় বাড়িতে ঢুকতে সমস্যা হয়নি। বাড়ির সামনে এসে চারপাশটা দেখে কলিংবেলটা বাজালো। একটু পর একটা মেয়ে দরজা খোলে দিলো।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, কাকে চাই ?
আরফা বললো, আমি ডক্টর আরফা, আমাকে মুজাহিদ স্যার আসতে বলেছিলেন তার সাথেই দেখা করতে এসেছি।
মেয়েটা দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি ভেতরে বসুন আমি সাহেবকে বলছি।
আরফা বললো, ঠিক আছে।
আরফা গিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসলো আর চারপাশটা দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঠি ভড় দিয়ে হাজির হলেন মুজাহিদ খান।
আরফাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, আরে আরফা মণি যে, কেমন আছো ?
আরফা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি দাদাজান। আপনি কেমন আছেন ? আপনার শরীর কেমন আছে ?
মুজাহিদ খান বললো, বসো বসো।
আরফা আর মুজাহিদ খান দু’জনেই সোফায় বসলো আর মুজাহিদ খান আবার বললো, কয়েক ঘণ্টা আগে আসলেও হয়তো বলতাম বেশি ভালো নেই কিন্তু এখন আমি অনেক ভালো আছি আরফা মণি। তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না।
আরফা কিছু বুঝতে না পেরে বললো, দাদাজান আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন ?
গেস্ট রুম থেকে বের হতে হতে মেহরাব বললো, দাদাজান আমার একটু কেনাকাটা ছিলো, তাড়াহুড়ো করে আমার প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আনতে পারিনি।
গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে আরফা সামনে তাকিয়ে চমকে গেলো বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেহরাবের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে৷ শার্টের হাতা ফোল্ড করে মেহরাব সামনে তাকাতেই আরফাকে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কত বড় মিথ্যুক এই মেয়ে সেটা আজকের ম্যাসেজটা না দেখলে বুঝাই হতো না মেহরাবের। এখানে আসার আগে হসপিটালে বসে আরফা মেহরাবকে ম্যাসেজ করেছে আপনার দাদাজানের অবস্থা খুবই আশংকাজনক। এটা দেখে মেহরাবের রাগ আরো বেড়ে গেছে। একে তো এতো হয়রানি হয়েছে আরফার কথায় হুট করে বাংলাদেশে এসে তারপরও এ মিথ্যা বলেই যাচ্ছে।
আরফা তেতলাতে তেতলাতে বললো, আ,,আপনি এখানে ?
মেহরাব ব্যঙ্গ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আপনি আমাকে এখানে আনার জন্য এতো পরিশ্রম করলেন তাই না এসে পারি ?
মেহরাবের কথায় আরফার গলা শুকিয়ে আসছে ভয়ে। নিজেকে নিজেই গালি দিচ্ছে কী দরকার ছিলো এতো বাড়িয়ে বলার। এখন তো উপকার করতে গিয়ে নিজেই বিপদে পরবো মনে হচ্ছে।
মুজাহিদ খান বললো, হ্যাঁ আরফা মণি তোমার জন্য আমি আজ এতোবছর পর আমার দাদুভাইকে ফিরে পেলাম। এই ঋণ সুধ করতে পারবো না আমি কখনো। তোমার কথাই বলেছে মেহরাব এসে।
মেহরাব আবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো, আর আমিও কখনো ভুলতে পারবো না আপনার উপকার।
আরফা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, আ,,আমি আজ আসি দাদাজান আমার মা চিন্তা করবে আমার জন্য।
মুজাহিদ সাহেব বললেন, এই তো এখনি এসে আবার এখনই চলে যাবে ?
মেহরাব কথার মাঝেই বলে উঠলো, দাদাজান আমি আসছি আমার লেট হচ্ছে।
মুজাহিদ খান কিছু একটা ভেবে বললেন, দাদুভাই তুমি তো এখানে কিছু চেনো না তুমি বরং আরফাকে নিয়ে যাও ও তোমাকে হেল্প করতে পারবে।
আরফা জোর করে হেঁসে বললো, কিন্তু আমি কীভাবে,,,,
আরফার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহরাব বললো, ঠিক বলেছো দাদাজান উনি আমাকে অনেক হেল্প করতে পারবে। প্লিজ চলুন আমার সাথে।
মেহরাব এতো ভালো ব্যবহার করে আরফাকে কেনো নিয়ে যেতে চাইছে মুজাহিদ সাহেব সেটা বুঝতে না পারলেও আরফা ভালোই বুঝতে পারছে কিন্তু এখন আরফার ফাটা বাশে পা আটকে গেছে তাই বাধ্য হয়ে মেহরাবের সাথে যেতে রাজি হলো। যাওয়ার সময় মুজাহিদ খানের কার্ড বের করে দিয়ে দিলো মেহরাবকে। মেহরাবের কাছে যে কার্ড আছে সেটা বাংলাদেশে চলবে না। মেহরাব ড্রাইভ করছে আর আরফা পাশের সিটে বসে হাত কচলাচ্ছে। কানাডার রাস্তায় ড্রাইভ করে অভ্যস্ত তাই বাংলাদেশের রাস্তায় ড্রাইভ করতে একটু অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে আর রাস্তাও চেনা নেই তাই আরফার হেল্প নিতে হচ্ছে মেহরাবকে। আরফা রাস্তা বলে দিয়ে এখন চুপ করে বসে আছে আর মেহরাবও কিছু বলছে না।
আরফা আমতা আমতা করে বললো, আই এম সরি,,, আসলে আমার স্বাভাবিক ভাবে বলায় আপনি রিপ্লে দিচ্ছিলেন না আর এদিকে স্যারের সাথে আমার দেখা হলেই আমার কাছে অনুরোধ করতেন আপনাদের খুঁজে দিতে আর স্যারের শারিরীক কন্ডিশনও খুব একটা ভালো নয় তাই আমি বাধ্য হয়ে,,,,
মেহরাব রেগে বললো, তাই আপনি বাধ্য হয়ে একজন সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে দিবেন। আপনার কোনো ধারণা আছে আমি ঠিক কীভাবে এখানে এসেছি আমাকে কতটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ?
আরফা খানিকটা কেঁপে উঠলো মেহরাবের রাগি গলা শুনে পরক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, আপনি হয়তো স্যারের রিপোর্টগুলো দেখেননি তাই তাকে সুস্থ ভাবছেন। রিপোর্টগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন সে কতটা সুস্থ।
মেহরাব মনে মনে বললো, আমাকে যে হয়রানি করিয়েছেন তার জন্য কী আমি আপনাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো মিস আরফা ?
একটু পর আরফা কিছু একটা ভেবে বললো, এক মিনিট আপনি চিনলেন কীভাবে আমি আরফা ?
মেহরাব একবার বিরক্তি নিয়ে তাকালো আরফার দিকে তারপর সকালে গাড়িতে একসাথে যাওয়ার কথা বললো সেটা শুনে আরফা হা হয়ে গেলো। মেহরাব আবার বললো, আর তাছাড়াও ড্রয়িংরুমে দাদাজান আপনাকে এই নামেই ডেকেছিলো তাই চিনতে না পারার কী আছে ?
মেহরাবের উত্তর শুনে আরফা বোকা বনে গেলো সত্যি তো না চেনার কী আছে ? আরফা মনে মনে বললো, আরফা রে তুই দিনদিন গাঁধি হয়ে যাচ্ছিস।
মেহরাব বললো, আমি একটা গাড়ি কিনবো গাড়ির শো-রুম কোথায় ?
আরফা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে মেহরাবকে গাড়ির শো-রুমের রাস্তা দেখিয়ে দিতে লাগলো। আরফা যে শো-রুম দেখিয়ে দিয়েছে সেখানে মেহরাবের পছন্দ মতো কোনো গাড়ি নেই তাই সেখান থেকেই অন্য একটা শো-রুমের ঠিকানা নিয়ে সেখানে চলে গেলো। মেহরাব কালো রঙের একটা BMW কার কিনলো বাংলাদেশি দেড় কোটি টাকা দিয়ে। আরফা তো হা করে শুধু দেখছে। যে গাড়ি নিয়ে এসেছে সেটা বাড়ি নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললো মুজাহিদ খানকে আর তার নতুন কেনা গাড়ি নিয়ে মার্কেটের দিকে যেতে লাগলো। আরফা শুধু ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে গাড়িটা দেখছে। এতো দামী গাড়িতে এর আগে কখনো আরফা উঠেনি।
আরফা বিড়বিড় করে বললো, এতো টাকা দিয়ে একটা গাড়ি কেনার কোন মানে হয় ? গাড়ি হলো যাতায়াত করার জন্য আর সেটা করতে পারলেই হলো এতো দামী গাড়ির কী প্রয়োজন ? এই টাকাগুলো দিয়ে কতগুলো না খাওয়া মানুষের পেট ভড়তো।
আরফাকে বিড়বিড় করতে দেখে মেহরাব বললো, কিছু বললেন ?
আরফা বললো, না স্যার কী বলবো কিছু বলিনি।
মেহরাব অবাক হয়ে বললো, আমি আবার আপনার স্যার হলাম কখন ?
আরফা বললো, আপনি মেহরাব হেলথ কেয়ার হসপিটালের মালিক আর আমি সেখানে চাকরি করি তাহলে আপনি তো আমার স্যারই হলেন।
মেহরাব আর কিছু বললো না। নিজের প্রয়োজনীয় শপিং করা শেষে আরফাকে বললো নিজের বাড়ি চলে যেতে সে রাস্তা চিনে গেছে যেতে পারবে। আরফা তো আকাশ থেকে পড়লো। সারাদিন ঘুরিয়েছে কিছু খাওয়ার জন্য অফার পর্যন্ত করেনি এখন বলছে একা চলে যাও।
মেহরাব আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, কী হলো আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ? বাসায় যাবেন না ?
আরফা আর কিছু না বলে হনহনিয়ে বের হয়ে এলো আর তা দেখে মেহরাব বাকা হাঁসলো। সন্ধ্যা নেমে আসবে একটু পর এখন একটু শীত লাগতে শুরু করেছে মেহরাবের। শপিং ব্যাগগুলো গাড়ির পেছনের সীটে রেখে বাড়ির দিকে রওনা হলো। এদিকে আরফা গাড়ি পাচ্ছে না। ঢাকা শহরের এই এক সমস্যা সন্ধ্যা নামলেই বিশ টাকার ভাড়া হয় চল্লিশ টাকা আর একশো টাকার ভাড়া দুইশো টাকা। আরফার কাছে টাকা একটু কম আছে আজ আর আজই এমন ঝামেলায় পড়তে হলো। এদিকে দুপুরে খাওয়া হয়নি খিদে পেয়েছে খুব। অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি পেলো ভাড়াটা বাড়ি গিয়ে তারপর দিলো। রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।
এদিকে আরফার মা মেয়ের রাগী মুখ দেখে বললো, কী রে এতো রেগে আছিস কেনো ? আর আজ এতো লেট হলো কেনো ফোন করে কোন কাজের কথা বললি ?
আরফা বললো, আর বলো না এক অভদ্রের পাল্লায় পড়েছিলাম। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি খাবার দাও তাড়াতাড়ি বড্ড খিদে পেয়েছে।
আরফা ফ্রেশ হতে চলে গেলো আর তাইয়েবা মেয়ের জন্য খাবার রেডি করতে লাগলো। আরফা ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে তার ফোন বাজছে। হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার।
আরফা মিষ্টি স্বরে বললো, আসসালামু আলাইকুম কাকে চাই ?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আরফা আবার বললো, কে বলছেন আর কাকে চাই ?
এবারও উত্তর না আশায় আরফা বিরক্ত হয়ে বললো, কথা না বললে কল কেনো করেছেন যত্তসব ফাউল। আপনাদের মতো আমার এতো ফাউ সময় নেই তাই বাই।
আরু,,,,,,,
শব্দটা কানে যেতেই আরফা রোবটের মতো থেমে গেলো যেনো কেউ সুইচটা হঠাৎ অফ করে দিয়েছে। বেশ কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে থেকে কাঁপা গলায় বললো, কে বলছেন ?
ওপাশ থেকে শান্ত গলায় বললো, কেমন আছো আরু ? আমি বলছি ,,,,,
এবার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না আরফার। ওপাশের মানুষটা কে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সে।
এদিকে আরফাকে ঝামেলায় ফেলতে পেরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে মেহরাব। বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে প্রবেশ করলে ড্রয়িংরুমে মুজাহিদ খানকে বসে থাকতে দেখে রুমে না গিয়ে তার পাশে বসে পড়লো।
মুজাহিদ সাহেব নাতির দিকে তাকিয়ে বললো, ঢাকা শহর কেমন লাগলো দাদুভাই ?
মেহরাব হাসি মুখে বললো, জ্যামটা খুব বেশি তবে একদম খারাপ লাগেনি।
মুজাহিদ খান হঠাৎ বললো, আচ্ছা দাদুভাই তুমি এখনো বিয়ে করোনি কেনো ? নাকি করেছো আমার নাতবউকে নিয়ে আসোনি।
বিয়ের কথা শুনে মেহরাবের মুখের হাঁসি উধাও হয়ে গেলো। সাথে সাথে মনে পড়ে গেলো সিনথিয়ার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে এতো বছরে আজ প্রথম সারাদিনে একবারও সিনথিয়ার কথা মনে পড়েনি। সেটা ভেবে অনেক অবাক হলো সে। যাকে এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি আজ তার কথা একটা বারও মনে পড়লো না কীভাবে সম্ভব এটা ? হয়তো বেশি ঝামেলায় ছিলো তাই মনে পড়েনি এমন কিছু বলে নিজের মনকে বুঝালো মেহরাব।
চলবে,,,,,,