অন্যরকম_ভালোবাসা ? ইফা_আমহৃদ পর্ব::০৫

0
3635

অন্যরকম_ভালোবাসা ?
ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৫

পরপর দুইটা চড় খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে অনয়া।।
ভাবতে পারে নি তিথি তার গায়ে হাত তুলবে।।গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে।।। শতবার চেয়েও আটকাতে পারে নি সে।।মুখ ফুটে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না,,, নিজের কাজের জন্য বড্ড অনুসূচনায় ভূগছে।।আজ তার একটা ভুলের জন্য ইশরাকে হাজার যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে।। আরেকবার মারার জন্য হাত বাড়াতে নিলে,, এগিয়ে আসলো তার দিদা ।।তিথির হাত ধরে থামিয়ে দিলো।।শত হোক নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করেনি অনয়া।।দিদা কিছু বলতে নিলে,, হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয় তিথি।।চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলো…

— “” আজ শুধু তোর দায়িত্বহীনতার জন্য কতো গুলো মানুষ কে চিন্তায় ফেলে রেখেছিস হিসেব আছে ।।কি দোষ করছিলো ,, ছোট্ট বাবুটা ।।কেন আজ ইশরা আর তার সন্তানকে এভাবে কষ্ট পেতে হচ্ছে।।যদি আজ ওদের কিছু হয়ে যায় ,, তাহলে শুধু তুই দায়ি থাকবি।।(একটু থেমে আবার) ছোটবেলা থেকে একটা কথাই বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি ,, যে কাজটা করবি মন দিয়ে করবি ,, ভালোভাবে করবি ।। আর তুই কি বলতি,, কাজ ঠিকভাবে হলেই তো হলো ।।তোর কাজ তো ঠিকভাবেই হয়েছে ,, শুধু তোর কাছের জন্য আরেকজনকে সাফার করতে হচ্ছে”” ।।

আর বলতে পারলো না তিথি ।। বারবার গলা ধরে আসছে তার।।এই ছয় মাস ইশরা নিজের বাবা মায়ের কাছে ছিলো ।।কই তখন তো কোনো অঘটন ঘটলো না।।তাহলে কাল যখন নিজের বাবা মা ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে এলো ,, তখনই এইসব হতে হলো।।নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে ।।তাহলে কি তিথি সত্যিই ইশরার মা হয়ে উঠতে পারেনি।।তার ভাবনার মাঝে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে যায়।। বেড়িয়ে আসে একজন স্বল্প বয়সী নার্স।। নার্সকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় সবাই ।।ইশরার অবস্থা জানানোর পরিবর্তে দেয় এক হুংকার।।

— “হচ্ছে টা কি এখানে ।। আপনাদের যদি চেঁচামেচি করতেই হয় তাহলে বাড়িতে গিয়ে করুন এখানে নয়।।এটা হসপিটাল আপনাদের বাড়ি নয়।।ভুলে যাবেন না ,,এখানে অনেক পেশেন্ট এডমিট আছে ।। তাদের সমস্যা হয়।। তাছাড়া আপনাদের পেশেন্ট ও এখানে আছে ।। অন্তত নিজেদের পেশেন্টের কথা ভাবুন।।আই হোপ,, এটাই আমার প্রথম আর শেষ ওয়ার্নিং ।।দয়া করে চেঁচামেচি করবেন না”।।

কথাগুলো বলে আর কারো দিকে তাকালেন না তিনি।। দূরত্ব পায়ে ভেতরে ঢুকে গেল।। কেউ আর কোনো কথা বাড়ালো না।।যে যার যার নিজের জায়গায় আবার চলে গেলেন।। মাঝখানে কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ।।
এখনো সবাই আগের ভঙ্গিতে হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।।কারো মুখে কোনো কথা নেই।।টানা অনেকক্ষন বসে থাকায় কোমর ধরে গেছে সবার ।।তমোনা সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে ,, থামার নাম নিচ্ছে না।।তাকে থামানোর চেষ্টা করছে রৌদ্র জুবায়ের।। একদিকে মেয়ের চিন্তা অন্যদিকে তমোনার এভাবে কান্না করাতে হিমশিম খাচ্ছে সে ।।অবশেষে না পেরে দিলো এক ধমক।।

— “চুপ করবে।। এখানে ,,এভাবে মরা কান্না জুড়ে দেওয়ার কি আছে।। তোমার মেয়ে কি মারা গেছে।।এমনিতে নিজের মেয়ে আর নাতির চিন্তায় মরছি ,, আবার যোগ হয়েছে ছিঁচকাদুনে।।যদি মুখ থেকে আর একটা আওয়াজ বের হয় ,,তাহলে একবারে বাড়ি পাঠিয়ে দিবো ।।কথাটা মনে…!!

আর কিছু বলতে পারলো না।। তার আগেই অপারেশন থিয়েটারের উপরে থাকা লাইট অফ হয়েছে গেল।। বেরিয়ে এলো একজন সবুজ পোশাকধারী ডাক্তার ।।সবাই এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে চারপাশ দিয়ে ঘিড়ে ধরেন।। নিজের কৌতুহল মেটাতে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন রৌদ্র জুবায়ের।।

— “ডাক্তার আমার মেয়ে এখন কেমন আছে?? সিরিয়াস কিছু হয়নি তো”।।

— “আঘাত টা তেমন জোড়ালো নয়।। কিন্তু আঘাতটা পেটে লেগেছে ।। বুঝতেই পারছেন, ৬ মাসের প্যাগনেন্ট।।বেবী ভেতর থেকে ননস্টোপ আঘাত করছে।। আমাদের ধারনা দুর্ভাগ্যবশত,, বেবী উল্টে গেছে।।এমন একটা অবস্থায় এসে আমরা পৌঁছেছি, যেখানে এবোরশন করতে পারছি না,,না পারছি ডেলিভারি করতে।।দুটোতেই প্রচুন্ড পরিমাণ রিক্স আছে।।এদিকে একটু পর পর ব্যথা জ্ঞান হারাচ্ছে প্যাশেন্ট।।যদি ৮ মাস হতো তাহলে আমরা ডেলিভারি করার মতো রিক্সটা নিতাম।।
এতো কষ্টের পরেও যদি নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে না পারে ,, সো সেড!!

কথা বলতে বলতে চোখের কোণে অশ্রু জমেছে ,, সেগুলো মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিয়ে আবার বললো..

— আমাদের হসপিটালে এমন একজন ডাক্তার আছে ,, তিনি এই বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান সম্পূর্ণ।। কিন্তু তিনি প্রায় ৫ বছর হয়েছে রিটায়ার্ড করেছেন ।। তিনি খুব ভালো মানুষ ,, অন্য বিপদ শুনলে ছুটে আছে।। বর্তমানে ঢাকার বাইরে, নিজের মেয়ের বিয়েতে আছে।।আমি ফোন করেছিলাম সকালের মধ্যে এসে যাবে।।এখন কিছু টেস্ট করতে হবে ,,যাতে স্যার এসেই ব্যবস্থা নিতে পারে।।আর হে,, আপনাদের থেকে একজন এসে প্যাশেন্টের মনে সাহস জোগান ,, আমাদের সাহায্য করুন”” ।।

বলেই ডাক্তার আর ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলে গেলেন।। মুহুর্তের মধ্যে আবার নিরবতা ছেড়ে গেল।।
তিথি জোর করে অনয়া ,, তার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।।
_____________

এক ধ্যানে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে আয়ান।। চারপাশে কি হচ্ছে,, কোনো দিকে খেয়াল নেই তার।।কানে শুধু একটা কথাই বাজছে ,, — ” আয়ান,, আমাদের আয়রা””!! যেটা ইশরা শেষ বার বলেছিলো।। চোখের সামনে ভাসছে ইশরার পেটে হাত দিয়ে কাতরানোর দৃশ্যটা।। একবার যদি ভালোভাবে পরখ করে নিতো ।।। ইশরা কেন পড়েছিলো ,, তাহলে হয়তো সবাইকে এতো চিন্তায় থাকতে হতো না।।যখন ইশরা পড়ে গিয়েছিল ,,আয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে সবটা দেখেছে।।ইশরাকে হসপিটালে আনার কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো।।ছেলের এমন অবস্থা দেখে রৌদ্র জুবায়ের আর আজাদ আহম্মেদ ইশরাকে হসপিটালে নিয়ে আসে।।
আয়ানের চিন্তার মাঝে কাঁধে হাত রাখলো তিথি।। একবার তিথির দিকে তাকিয়ে আবার আগের ভঙ্গিতে বসে রইলো সে।। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে গালে রেখে বললেন..

— “অভি বাবা আমার,,, এভাবে চুপ করে থাকিস না।।ইশরার কিছু হয়নি।। কিন্তু মেয়েটা ভেতরে একা একা খুব কষ্ট পাচ্ছে।।তোকে ওর খুব প্রয়োজন।।যা বাবা ওর পাশে থাক ,,ওকে সাহস যোগা”।।

এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও আর চুপ থাকলো না ,, মাকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।।

— “মা সবকিছুর জন্য একমাত্র আমি দায়ি।। কেন আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম।কেন ইশুকে রেখে বাইরে গেলাম।। কেন কিছু পরখ না করে কোলে তুলে নিলাম”।।

আয়ানের কষ্টে তিথির বুকটাও বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।।এটা যে নিয়ম,, সন্তানের কষ্টে মায়ের কষ্ট হবে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আয়ানকে ইশরার কাছে পাঠালো।
ইশরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।। কিছুক্ষণের মধ্যে শরীরটা ভেঙ্গে পড়েছে।।চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।।আয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।। ইশরার পাশে বসলো।
ইশরার নিস্তেজ হাতটা নিজের হাতের মাঝে বন্দি করলো ,, একটু ঝুঁকে হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠ ছুয়ালো।।অন্যহাতে কপালে পড়া থাকা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সেখান ওষ্ঠ ছোঁয়ালো ।।

নিজের খুব কাজের কারো স্পর্শ পেয়ে নিভু নিভু চোখ খুলে তাকালো ইশরা।।আয়ানকে নিজের পাশে পেয়ে গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, ঠোঁটের কোণে
ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।। কিছু বলতে নিলে আয়ান ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো ,।।বললো,,
— “উঠে বসা বা কথা বলা‌।কোনোটাই দরকার নেই।। চুপ চাপ শুয়ে থাকো”।।
নিজের ক্যানেল লাগানো হাত আয়ানের হাতে বন্দী দেখে ,, অন্যহাত রাখলো হাত জোড়ার উপর।।আয়ানের হাতটা নিজের বুকে রেখে পরপর দুইবার চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস নিলো।। তারপর হাত সরিয়ে পেটের উপর রাখলো।
মুহুর্তেই হাত নামিয়ে নিলো আয়ান,, সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো ইশরা।। তাহলে আয়ান আজও বেবী টাকে মেনে নিতে পারে নি।।হলো তার উল্টোটা।। আয়ান ইশরার পেটের কাছের কাপড় সরিয়ে দিল।। পেটের কাছে নিজের কান বাড়িয়ে ,, কিছুক্ষণ কথা বললো ।। শেষে ডিপলি কিস করলো।। পুরোটা সময় ইশরা এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলো,, আয়ানের দিকে।। আয়ান মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো সেদিনের কথা।।

সেদিন:::

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে আয়ান।। যতক্ষণ পর্যন্ত না রিপোর্ট হাতে পাচ্ছে ,, ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি নেই আয়ানের।। ডাক্তার ,, মা,,দিদা বলছে ,, বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে।। কিন্তু আয়ানের মাথায় কিছু ঢুকছে না,, নতুন অতিথি এলে দরজা দিয়ে আসবে ,, ইশরার শরীর খারাপ কেন হবে।। আয়ানের এমন যুক্তিতে ইশরা শুধু হেঁসে কুটি কুটি হচ্ছে।।
অবশেষে এসে পৌঁছালো ডাক্তারের চেম্বারে।। অলরেডি রিপোর্ট রেডি করাই আছে ।।ডাক্তার বলছে ,, আয়ান বাবা হতে চলেছে।।কথাটা শুনে সেখানে নাচতে ইচ্ছে করছে তার।। আবার প্রচুর রাগ হচ্ছে ,, সবাই উপর ।। এতো বড় একটা ব্যাপারে কেউ এমন হেঁয়ালি করে।।বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখলো মেঘ বাইকে হেলান দিয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।। এগিয়ে গিয়ে আয়ানের হাত থেকে রিপোর্ট গুলো নিয়ে তৃপ্তিকর হাসি দিল।। মেঘের হাসি মানে বুঝলো না আয়ান ।।

— জানো আয়ান ,, আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুশি।।আমার শত জন্মের ইচ্ছে আজ পূর্ন হলো।। সবসময় চেয়েছিলাম,, আমার পরীর মতো একটা মেয়ে হবে ।।ইশরার মাঝে বেড়ে উঠবে সেই ছোট পরী।।দেখো হয়ে গেল।।

মেঘের কথার মানে বুঝলো না আয়ান।।আহাম্মকের তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।। কথাগুলো মাথার মধ্যে নেড়েচেড়ে কলার চেপে ধরলো মেঘের।।নাক বরাবর দিল এক ঘুসি।।

— সাহস কি করে হয় তোর ।।আমার ইশুর নামে বাজে কথা বলার ।। যেই কথাটা বলার চেষ্টা করছিস সেটা নিজের মধ্যে পুষে রাখ ,, বাইরে বের করার চেষ্টা করিস না।।তাহলে তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।।

বলেই কলার টেনে ঠিক করে দিলো আয়ান।।মেঘ আর কোনো কথা বাড়ালো না ।।ফোন টিপে একটা ভিডিও অন করে আয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলো।। ভিডিও টার কিছু অংশ দেখে চোখ মুখ শক্র করে ফেললো ।। রাগের মাথায় ফোনটা ভেঙ্গে ফেললো।।কোনো দিকে না তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল আয়ান।। আয়ান বেরিয়ে যাওয়ার পর বাঁকা হাসলো মেঘ।।

— Game start baby!! Just wait and watch !!

ভিডিওটা এমন ছিলো যে …..!!!

চলবে..??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here