অন্যরকম ভালবাসা শে ষ পর্ব

0
985

অন্যরকম ভালবাসা
৬ষ্ঠ পর্ব

” রিমি আমাদের ব্যাপারে একদমই কখনোই আসবেন না ” স্নেহা ঘুমের ঘরে বিড়বিড় করে আউড়াচ্ছে এই কথা। স্নেহার কথা শুনে আহসানের মনে হল ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। সে যেন বরফের মত জমে গেল। স্নেহা রিমির কথা জানল কি করে। দ্রুত আহসানের মাথা কাজ করা শুরু করল। নির্ঘাত কোন না কোন ভাবে স্নেহার সাথে রিমি যোগাযোগ করেছে। তাই হয়ত স্নেহা কাউকে কিছু না বলেই চলে এসেছে। হঠাৎই আহসানের প্রচুর রাগ হতে লাগল। রিমি এতটা নীচু কাজ করবে ও ভাবতেও পারে নি। পকেট থেকে ফোনটা বের করে সোজা রিমিকে কল দিল সে। দুবার রিং হয়ে কেটে গেল। তৃতীয় বারের বার কল রিসিভ করল রিমি।
___ ” হ্যাঁ আহসান বলো আমি অপেক্ষায় ছিলাম তোমার ফোন কলের। বেশি দেরি করেছ কল করতে”।
___ ” তুমি কখনোই শুধরাবে না রিমি “।
হিসহিসিয়ে বলে উঠলো আহসান। মনে হচ্ছিল রিমিকে পেলে ও যে কি করবে ও নিজেও জানে না।
___ ” মজার কথা হল তুমি এত দেরি করে জানলে কি করে।আমি তো ভেবেছিলাম দশ মিনিট এর মধ্যে কল আসবে আমার কাছে। সে যাই হোক আগেই বলেছিলাম তোমার বউয়ের কাছ থেকে শুনবো তুমি ফিজিক্যালি ফিট না অনফিট। কিন্তু তোমার বউ বড্ড সেকেলে। স্বামীকে খুব ভক্তি করে। কি ভাষণ রে বাবা শুনিয়ে দিল আমায়।”
___ ” শোনো রিমি এবার আমি বলি তুমি শোনো। মেয়েদের ভূষণ কি জানো। মেয়েদের ভূষন হল লজ্জা। আর সেই লজ্জাটাই তোমার নেই। তুমি জানো স্নেহাকে এখন পর্যন্ত আমি টাচই করি নাই। আর তুমি যে বয়ান গুলো দিচ্ছ সেগুলো স্নেহা কখনও আমাকে বলত না এটা আমার বিশ্বাস।”
___ ” বেশ ভাল বিশ্বাস আর হ্যাঁ টাচ করবে কি করে তুমি তো অক্ষম”।
হাসির ঝংকার তুলে বলল রিমি। শীতল কণ্ঠে বলল আহসান,
___ বিয়ের আগে যে মেয়েরা অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটাতে চায় তাদের প্রস্টিটিউড বলে রিমি। আর তুমি ঠিক তাই।
এটুকু বলেই কল কেটে দিল আহসান। কেন জানি না মনের ভিতর অসম্ভব এক ভাল লাগা কাজ করছে।অনেক দিনের না বলা কথা গুলো আজকে বলে দিয়েছে সে। জীবনে রিমি নামের অভিশাপটাকে আজকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্নেহাকে কি কি বলেছে কে জানে। আর মেয়েটা এতই অভিমান করেছে যে না বলেই চলে এসেছে। আহসান ফ্রেশ হয়ে এসে হাত মুখ মুছেই স্নেহার কম্বলের নিচে ঢুকলো। ও কখনও স্নেহাকে ইচ্ছা করে ধরে নি। আজকে কম্বলে ঢুকেই স্নেহাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসল। আবছা আলোয় খেয়াল করল চিকচিক করলে গালের উপরে চোখের পানির দাগ। বুকের ভিতরে হু হু করে উঠলো আহসানের। মেয়েটাকে কাঁদতে হয়েছে তাও আবার তার জন্য। স্নেহাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল আহসান।

ঘুম ভাঙতেই স্নেহা টের পেল সেই পরিচিত ঘ্রাণ। মনে হচ্ছিল খুব অশান্তিতে ঘুমিয়েছে এখন যেন ঘুমটা খুব প্রশান্তির হয়েছে। কিন্তু ঘ্রাণটা আসছে কোথা থেকে। চোখ খুলেই দেখলো আহসান ঠিক ওর পাশেই শুয়ে আছে। পাশেই শুয়ে আছে কি ও আহসানের বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। কতক্ষন স্নেহা চুপ করে থেকে বোঝার ট্রাই করল ঘটনা কি সত্যিই না স্বপ্নে দেখতেছে। কিন্তু আহসানের নিঃশ্বাস যখনই ওর গালের উপরে পড়ল তখন বুঝলো ঘটনা সত্যিই। কিন্তু রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা তো ওর রুম। ঘুম থেকে উঠে স্নেহার কিছুই মাথায় খেলছে না। একটু পরেই মনে পড়ল ও রাগ করে চলে এসেছিল এ বাসায়। এর পরেই মনে পড়ল রিমির কথা। কেন জানি না খুব কান্না পেতে লাগল স্নেহার। কোন মেয়ে সহ্য করবে তার স্বামীর সক্ষমতায় যদি কেউ প্রশ্ন তোলে। কেন জানি না ওপাশ ফিরে ফুঁপিয়ে উঠলো স্নেহা। কেঁপে কেঁপে যখন কাঁদতেছিল ও সেই কান্নার শব্দে জেগে উঠলো আহসান। ও দিক ফিরে থাকলেও সে স্পষ্ট বুঝতেছিল স্নেহা কাঁদতেছে। আলগোছে সে স্নেহাকে কাছে টেনে নিতে গেল। কিন্তু স্নেহা শক্ত হয়ে রইল। কেন জানিনা অভিমান আজ বাঁধ ভেঙ্গেছে ওর। বারবার শুধু মনে আসছে রিমি বলা প্রতিটি শব্দ গুলো।স্নেহা উঠে বসল পাশাপাশি আহসানও উঠে বসল। ও নিচে নামতে গেলেই আহসান হাত টেনে ধরল, ” কোথায় যাচ্ছ? ” প্রশ্ন করল আহসান। ” সেটা কি আপনাকে বলতে হবে? ” প্রশ্নের উওর প্রশ্ন দিয়েই দিল স্নেহা। আহসান বুঝলো স্নেহা খুব রেগে আছে। তাই আর কথা না বাড়িয়েই বলল,
___ ” স্নেহা কিছু কথা আছে যা আগেই বলা উচিত ছিল। কিন্তু অন্যকারো উপরে অভিমান করে বলি নাই। আমার এক্স ছিল রিমি। বাকি সব নিশ্চয়ই রিমি বলেছে। কিন্তু আমি বুঝি নাই যে ও অপমান করবে তোমাকে। আমি সরি। আর তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি কিরকমের। অন্তত এই কয়েকদিনে তোমার আইডিয়া হয়ে গেছে। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না রিমির সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করা তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কারণটা তো রিমি বলেছেই তোমাকে “।
এটুকু বলেই থামলো আহসান। স্নেহা ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল মানুষটা ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়েছে। স্নেহা কিছুই না বলে ঘড়ি দেখলো। প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। আহসান করুন নয়নে তাকিয়ে বলল” কিছু তো বলো স্নেহা”। হঠাৎই যেন স্নেহার বাঁধ ভেঙ্গে গেল অশ্রুসিক্ত চোখে আহসানের দিকে তাকিয়ে বলল ” যে মেয়েকে অন্য কারো কাছে তার স্বামীর পুরুষ্বত্তের প্রমান দিতে হয় সেই মেয়ের আর কিইবা বলার থাকে”।
আহসান যেন খুব অসহায় হয়ে পড়ল। কি বলে স্নেহাকে শান্তনা দেবে খুঁজেই পাচ্ছে না কোন কথা। স্নেহা মাথা নিচু করে বলল,
___ ” আমার কিছুই বলার নেই। আমার সব উওর আমি পেয়ে গেছি”।
___ ” তার মানে কি তুমি সব দোষ আমাকে দিচ্ছ?”
আহসান প্রশ্ন করল।
___ ” কারোই কোন দোষ নেই দোষ আমার কপালের। নাহলে আর কারো সাথেই না আমার সাথেই কেন এমন হবে।”
আহসান চুপ করে কিছুক্ষন বসে থাকল। আসলে ও কি যে বলবে নিজেও জানে না। ওর কাছে স্নেহাকে দেওয়ার মত কোন উওরই নেই। আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে গায়ে শার্টটা গলিয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে সোজা বাসা থেকে অত রাত্রে বের হয়ে গেল। আহসানের বুকের যেন প্রচন্ড একটা ভার কাজ করছিল। কিছু না করেই কেন সে শাস্তি পাবে। গাড়ি যখন বাসার সামনে আসল রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়েই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকলো ও। ধীর পায়ে নিজের রুমে এসে তাকিয়ে দেখলো আজ রুমটা যে বড়ই নিস্তব্ধ। স্নেহাকে ছাড়া যে এই ঘর এতটাই অন্ধকার হয়ে যাবে সেটা আহসান নিজেও বোঝে নি। এই দুই দিনেই মেয়েটাকে এত এত আপন করে নেবে সেটা কখনোই ভাবতে ও পারে নি আহসান। গালে গরম ছোঁয়া অনুভব হতেই বুঝলো চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার মানে ও কারো জন্য কাঁদছে যা কি না অসম্ভব। আসলেই ভালবাসা গুলো বুঝি এমনই হয়। বাকি রাতটুকু আহসান বসে থেকেই কাটালো। দু চোখের পাতা এক মিনিটের জন্যও এক করে নি ও। শুধু এটাই ভেবেছে স্নেহা কি ওকে বুঝবে? ফিরে আসবে ওর কাছে। স্নেহাকে ছাড়া তো বেঁচে থাকা অসম্ভব ওর কাছে। সকালে রেডি হয়ে যখন নিচে নামল তখন তো ফিরোজা খানম আর নীলার চোখ কপালে উঠলো আহসান কে দেখে।
___ ” কি রে তুই, রাতে কখন আসলি? স্নেহা কই? ”
ফিরোজা প্রশ্ন করলেন ছেলেকে।
___ ” কি ব্যাপার স্নেহা কই আহসান ”
নীলাও একই প্রশ্ন করল আহসানকে। কিছুক্ষন চুপ থেকে আহসান বলল,
___ ” রিমি কালকে স্নেহার কাছে গিয়েছিল। এখন আসা না আসাটা স্নেহার নিজেস্ব ব্যাপার ”
এই বলেই দাঁড়িয়ে গেল আহসান। ফিরোজা আর নীলা দুইজন দুজনের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকল। দুজনেরই একই প্রশ্ন ” এখন কি হবে”।
যেতে যেতে পিছন ঘুরে আহসান বলে গেলো ” কাউকে কিচ্ছু বুঝাতে হবে না। যার ভাল লাগবে আসবে না লাগলে আসবে না। সাফ কথা”। প্রচন্ড অভিমানে ওর গলা ধরে আসল। সারাদিন অফিসে কারনে অকারনে অধিনস্তদের ঝাড়ি দিল। অহেতুক রাগারাগি করল। ডিউটি শেষে ইচ্ছা করল না বাসায় যেতে। গাড়ি নিয়ে সোজা স্নেহার হসপিটালের সামনে চলে গেল। একনজর স্নেহাকে দেখার আশায়। রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন স্নেহাকে দেখতে না পেলো একরাশ হতাশা নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় ঢুকেই দেখে ফিরোজা বেগম হাসাহাসি করতেছে অতশীর সাথে। মনে মনে আহসানের এত রাগ হল যে বলার মত না। বাড়ির বউ রাগ করে বাপের বাড়ির বাসিন্দা হয়েছে আর বাড়ির লোকদের কোন মাথা ব্যাথায়ই নেই। অতশীও মায়ের কথায় হেসে কুটিপাটি হচ্ছে। কি ফাজিল মেয়ে ছোট ভাবিটা পগারপার আর সে কিনা হিহিখিখি করছে।আহসানকে দেখেই ফিরোজা বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
___ ” দেখ দেখ কি মজার একটা সিরিয়াল হচ্ছে “।
___ ” মা স্নেহা বাসায় নেই আর তোমরা সিরিয়াল দেখে হাসতেছ? ”
হতাশ সুরে প্রশ্ন করল আহসান। ফিরোজা বেগম যেন তেলপোকা দেখছেন এমন এক্ক লুক দিয়ে বলল,
___ ” তোর বউ তোকে ছেড়ে গিয়েছে মুড খারাপ হলে তোর হবে আমাদের কি? ”
মায়ের কথায় সায় মিলালো অতশী। আহসানের এত এত রাগ হল যে বলার মত না। সোজা রান্না ঘরে গেল নীলার কাছে।। যেয়ে বলল ” দেখেছ ভাবি আমার বউ চলে গেছে আর মা বলছে তাতে কি হয়েছে “। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নীলা বলল, ” মা তো খারাপ কিছু বলে নাই আহসান। কথা কিন্তু সত্যিই “। রাগে ক্ষোভে আহসান পাগল প্রায়। গজ গজ করতে করতে রুমের দিকে চলল। বউ চলে গেছে তাই পুরো পৃথিবীই তার শত্রু হয়ে গেছে। রুমে ঢুকেই দেখলো লাইট অফ। শার্ট খুলতে খুলতে লাইট জ্বালিয়েই তার চক্ষু চড়ক গাছ।

ঘরটা পুরোদস্তুর বাসর ঘরের মত সাজানো
মাঝে বিয়ের শাড়ি পরে স্নেহা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। ঠিক যেন বিয়ের কনে। হাঁ হয়ে আহসান দেখছে আর ভাবছে সবই কি সত্যি নাকি স্বপ্ন। পিছন থেকে তখনই নীলা আর অতশী এসে চিৎকার করে বলল ” সারপ্রাইজ”। আহসানের হতভম্ব ভাব তখনও কাটে নি। নীলা হেসে বলল ” দেখেছিস তোরা আমি বলেছিলাম না এইটা কঠিন শক খাবে তাই হয়েছে “। অতশী খিল খিল করে হেসে বলল ” ভাইয়া ছোট ভাবি সকালেই এসে পড়েছে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো তাই কিছু বলি নি। এখন কথা হল আমি আর বড় ভাবি এখানে ঘুমাবো তুমি মায়ের রুমে ঘুমাও”। এই বলে অতশী যখন স্নেহার বেডে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য রেডি হল আহসান নীলা আর অতশী দুইজনকেই বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। এক লাফে স্নেহার পাশে এসে বসে বলল ” সত্যিই তুমি এসেছ স্নেহা। একটা চিমটি দেও তো আমাকে”। স্নেহা সত্যিই আহসানের কড়ে আঙ্গুল তুলে কামড় দিল। আহসান আউক করে উঠলো
তাড়াতাড়ি স্নেহাকে ধরে বলল ” তুমি স্বপ্ন না সত্যিই। আচ্ছা কালকে রাতে আসলে নে কেন”।
___ ” একটু শাস্তি দিলাম আপনাকে। এই দুই দিন আমাকে দূরে রাখার জন্য “।
___ ” আর কখনও আমার থেকে একফোঁটাও দূরে রাখবো না “।
এই বলেই স্নেহাকে বুকে টেনে নিল। স্নেহা যেন লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগল। আহসানের বুকে মুখ লুকালো ও। স্নেহার মুখটা আলতো করে উঁচু করে ঠোঁটে একটা চুমু খেলো আহসান।চোখ বন্ধ করে উষ্ণতার পরশ নিল স্নেহা। আহসান লাইট অফ করে স্নেহাকে কোলে তুলে নিল। স্নেহা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলল ” কি করছেন”।
আহসান উওর দিল ” মানুষের প্রশ্নের উওর তো দিতে হবে নাকি যে স্বামী ঠিক আছে কি না”। স্নেহা আলতো করে আহসানের বুকে এক কিল মেরে বলল ” আপনি আসলেই যাচ্ছেতাই”।

এ যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল দুজনের জীবনের। সত্যিই এক অন্যরকম ভালবাসায় হারিয়ে গেল দুজনায়।

সমাপ্ত
#মারিয়া_আফরিন_নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here