অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১১

0
356

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১১)

#আরশিয়া_জান্নাত

ঘর আধার করে রকিং চেয়ারে বসে আছে অনীল। আবছা তিমির রাতে চোখের সামনে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার জীবনের প্রথম পাপ।
সদ্য রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো ২৪বছরের টগবগে যুবক। চারপাশে কতরকম সুযোগ, দলীয় নেতা হবার ক্ষমতা যতোটা না প্রখর তারচেয়ে অধিক প্রখর ছিল যার অধীনে ছিল তার প্রতিপ্রত্তির প্রভাব। রোজ ইচ্ছামতো পছন্দসই মেয়ে তুলে এনে ভোগ করা ছিল সেই নেতার ক্ষমতা শো করার এক অসুস্থ ধরন। সে বেশ গর্বের সাথে বলতো, বুঝলি অনীল পুরুষ মানুষের আসল পৌরুষত্ত্ব প্রকাশ পায় সে কয়টাকে চু*তে পারছে তাতে। যার যতো হেডাম সে ততো পাওয়ারফুল এসবে। আমার তো সবে ৪৫টা হলো। দেখি ক’টা পারি!

বড়ভাই ছোটমুখে বড় কথা বলি মনে কিছু নিবেন না আসলে জানার কৌতুহল হচ্ছে।

ক কি জানতে চাস?

ঢাকায় তো অলিতে গলিতে কত মাইয়ামানুষ খাড়ায়া থাকে। আপনি ওদের দিকে ফিরেও তাকান না। সবসময় দেখি ভদ্র পরিবারের মেয়েদের….

হাহাহা তুই আসলেই বুদ্ধিমান। জব্বর প্রশ্ন করছোস। শোন তাইলে রাস্তার মেয়েদের খাইয়া মজা নাই। বাসি মাল। কিন্তু ভদ্র মেয়েরা পিউর হয়। ওদের মজাই আলাদা।

ভালো মেয়েগুলার জীবন নষ্ট করা অন্যায় না?

ন্যায় অন্যায় মাপতে গেলে যৌবনের মজা নিতে পারবি না বেটা।

তখনই ভেতরের রুম থেকে একটা মেয়ের করুণ চিৎকার ভেসে আসে। অনীল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তখন সেই নেতা হাঁক ছেড়ে বলে, কুত্তার বাচ্চারা মাইয়া দেইখা হুশ নাই। সবকয়টা ঝাঁপাইয়া পড়ছোস। শামসু ঐ শামসু।

বস এমন সিরিয়াস অবস্থায় ডাইকেন না তো। মা*র যে তেজ। বি*ষা*লী মা*রে বশ করা যাইতাছে না।

অনীল উত্তেজনায় তরতর করে ঘামতে থাকে। সেই লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, কিরে নিবি নাকি এক চান্স?

অনীলকে দেখে মেয়েটা আধমরা কন্ঠে বলে,ভাই আমারে ছেড়ে দেন ওরা একের পর এক আমারে পিষে মারছে আমার আর শক্তি নাই। আমারে ছাইড়া দেন আল্লাহর দোহাই লাগে,,,
কিন্তু জেগে ওঠা শরীরটা সেইসব তোয়াক্কা করেনি। জীবনের প্রথম নারী ভোগের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্রতায়…..

এরপর সে কত নারীকে অনায়াসে বিছানায় এনেছে হিসেব নেই। তবে ঐ মেয়েটার মতো করুণ আর্তনাদ আর কেউ করেনি। আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে সেই মেয়েটার অভিশাপই বুঝি ফলল আজ?
আমার অন্তরা আমার কলিজার টুকরা মেয়েটাকেও বুঝি ওভাবেই খুবলে খেয়েছে নরপিশাচগুলো? না না আর ভাবতে ও পারছেনা সে। হাউমাউ করে কান্নায় ফেঁটে পড়ে অনীল। আমার পাপের শাস্তি আমার নিষ্পাপ মেয়েরে দিলা খোদা! আমি কেমনে সহ্য করমু।
বুকের ভেতর যেন ধারালো চাকু দিয়ে খুঁচাচ্ছে কেউ। অনীলের কান্না দেখে বোধহয় নিয়তি অট্টহাসে!


ওমর চুপচাপ হসপিটালের করিডরে বসে আছে। শামীমা ইমার্জেন্সীতে ভর্তি। অন্তরার অবস্থা শঙ্কাজনক। তাহেরা জায়নামাজে পড়ে আছে। কি সুন্দর হাসিখুশী মেয়েটার কি হয়ে গেল! যতবারি মেয়েটার চেহারাটা মনে আসে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
তাহের আর পাখি হালকা খাবার নিয়ে এসে বলল,ভাইয়া অল্প কিছু হলেও মুখে দিন। আপনিও অসুস্থ হয়ে গেলে অন্তরাকে কে সামলাবে?

তাহের আমার বোন ফিরলে তো সামলাতাম! আমার বোন যে চোখটা মেলেও তাকাচ্ছে না। দেখো আজ ৫দিন ধরে মানিব্যাগটা পড়ে আছে কেউ টাকা নিচ্ছে না। ও যে এতো করে কাঁচা ফুলের গয়না চাইলো দেখো শুকিয়ে গেছে। আমার বোনটা এসব পড়লো না! আমার এইটুকু বোনটাকে ওরা,,,,,,( বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে)
পাখি কাঁদতে কাঁদতে বলল, অন্তরার কিছু হবে না ভাইয়া ও ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।

শামীমার জ্ঞান ফিরতেই সে জিজ্ঞাসা করে, নাহিদরা কেউ এসেছিল?

ওমর মাথা নাড়িয়ে না বললেই সে ঢুকরে উঠে বলে, কেন আসবে বল? আমার অন্তরা যে আর নিষ্পাপ নাই। ওরে যে কলঙ্কিত করে দিছে। আমার মেয়েটার সব শেষ হয়ে গেছে।

মা এসব কেন বল। আল্লাহকে বলো আমার বোনরে যেন সুস্থ করে দেয়। ও বেঁচে থাকলেই হবে। বিয়েশাদীর টপিক বাদ দাওতো।

সমাজরে তুই চিনোস না বাপ। সর্বনাশ হয়ে গেছে,,,

ওমর রেগে বলল, তাহলে ডাক্তারকে বলি চিকিৎসা না করতে? ও মরে যাক বেঁচে থাকার দরকার নাই। তোমাদের কাছে সমাজ জরুরি তো দরকার নাই ওরে। ও কলঙ্কিত তাই ওরে মরবার আগেই মেরে ফেলি!!

শামীমা ওমরের রুদ্রমূর্তি দেখে অভ্যস্ত নয়। সে মুষড়ে পড়ে। সে ঠিক ই জানে এই সমাজ তার মেয়েকে বেঁচে ফিরলেও বাঁচতে দিবে না।
__________________________
ওমর ফের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ক’দিনের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বদন দেখে নিজের জন্য বড্ড মায়া লাগছে তার। পানিতে ভরে ওঠা টলমলে রক্তিম চোখদুটো যেন আর পারছেনা অশ্রু ঝরাতে। হাতের চা*কুটা নিয়ে এলোপাথারি আ*ঘাত করতে থাকে নিজেকে। কেন ভাই হয়ে পারলো না বোনকে রক্ষা করতে? কেন সামলে রাখতে পারে নি সে? ছোটবেলায় যেমন করে রাস্তার বা’পাশে বোনকে রেখে চলতো যেন গাড়ির সাথে ধাক্কা না খায়। কিংবা ভীড়ের মাঝে শক্ত করে ধরে আগপিছ সামলে রাখতো অনাকাঙ্খিত স্পর্শ এড়াতে। এতো যত্নে আগলে রাখা বোনটাকে সেদিন কেন একা ছেড়েছিল? ও যদি একা না ছাড়তো অন্তরা আজ সমাজের চোখে ধ*র্ষি*তা হতো না। ওর বোনকে ঘরের বৌ করতে যারা এতো আগ্রহী ছিল তারা এভাবে এড়িয়ে যেত না। কত খুশিই না ছিল অন্তরা! জ্ঞান ফিরলে কোন মুখে তার সামনে দাঁড়াবে? ওর ভাই ওকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি এই যন্ত্রণা কোথায় মিটাবে? আত্মগ্লানীতে ধুমড়ে মুচড়ে যায়। ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখেও আঘাত করা থামায় না।
ইচ্ছে করছে এখুনী মরে যেতে। এই জীবনটা অসহনীয় লাগছে তার।
“হে আল্লাহ আমি আর পারছি না। আমি তোমার দূর্বল বান্দা আমার পরীক্ষা এতো কঠিন করে নিও না মালিক। আমায় সাহায্য করো”

আরোহী আর পাখি অনেকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে নাহিদের দিকে। নাহিদের উসকোখুশকো চুল, বিবর্ণ চেহারা, কুচকানো শার্ট আর দু পায়ে দুরকম জুতো। তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি নেই গত কয়েকটা দিন নাহিদের কেমন গেছে। নাহিদ ম্লান হেসে বললো,তোমাদের বান্ধবী কি ঠিক করেছে আর চোখ খুলবেনা? এভাবেই ঘুমিয়ে থাকবে? ও যদি ভাবে ও এভাবে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে তবে ভুল ভাবছে। আমাকে ফাঁকি দেওয়া মোটেই সহজ না। ওকে শুধু বেঁচে ফিরতে বলো। আমার আর কিচ্ছু চাই না,,,,

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here