অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১০

0
341

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১০)

#আরশিয়া_জান্নাত

শহর থেকে খানিকটা দূরে পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়িটাতে অ*র্ধ*ন*গ্ন অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে অন্তরা। এদিকটা জঙ্গলের মতোই ঝোপঝাড়ে ঘেরা,মানুষের আনাগোনাও নেই তেমন একটা। তাই কখন বা কারা ওর এই অবস্থা করেছে জানা যাচ্ছেনা আপাতত। লেডি কনস্টেবল সাহেরা অন্তরাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে গিয়ে টের পায় জা*নো*য়ারগুলো কেমন খুবলে খেয়েছে ফুটফুটে মেয়েটাকে! বাঁচবে কি না কে জানে?
চারপাশে খোঁজ করতেই অন্তরার ব্যাগ পাওয়া যায়। সেখান থেকে তার পরিবারের সঙ্গে কনট্যাক্ট করে এসপি সুমন। ততক্ষণে অন্তরাকে হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অনীল পুলিশের কল পেয়েই দৌড়ে হাসপাতালে এসেছে। তার সঙ্গে ওমর আর শামীমাও এসেছে। প্রথমে সে ভেবেছে অন্তরা এক্সিডেন্ট করেছে। কিন্তু ডক্টররা যখন বললো ভিক্টিমকে গ্যা*ঙ*রে*ই*প করা হয়েছে অনীলের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। শামীমা চিৎকার করে বিলাপ করে বললো, ডাক্তার সাহেব আমার মেয়েটার কালকে বিয়ে। একটু পর ওর হলুদ হবার কথা। এখন আমার মেয়েটার কি হবে! আমার মেয়েটার এতো বড় সর্বনাশ কে করলো।
শামীমার আত্মবিদারক কান্নায় যেন চারপাশ ভারী হয়ে গেল। অন্যান্য পেশেন্ট, নার্স করুণভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো এক ধর্ষিতা মেয়ের মায়ের দিকে।

অনীল বেঞ্চিতে বসে পড়লো। তার শরীর যেন অবস হয়ে গেছে। সে বারবার মন কে বলছে এ আমার ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন খুব শীঘ্রই আমার ঘুম ভেঙে যাবে। আমি দেখবো আমার মা অন্তরা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এইসব কিছু সত্যি না।

ওমর শামীমাকে ধরতেই শামীমা অজ্ঞান হয়ে তার বুকেই লুটিয়ে পড়ে। ওমর দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে বুঝে পায় না তার কি করা উচিত। ওর একমাত্র আদরের বোনটা যে আইসিউতে ভর্তি তার কি অবস্থা? সে কি বেঁচে আছে? সে চাইছে জিজ্ঞাসা করতে সবকিছু রাখো আগে বলো আমার বোন বেঁচে আছে তো? ওর দম আছে তো?
কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হয় না,,,

ফ্ল্যাশব্যাক,,,

অন্তরা বসে বসে তেঁতুলের আচার খাচ্ছে এমন সময় নাহিদের কল আসে।

আস্সালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। তা মহারাণী কি করছিল?

আচার খাচ্ছিলাম খাবেন?

বাহ বেশ তো।

হঠাৎ কল?

কেন কথা বলতে ইচ্ছে করতে পারে না?

নাহ সেটা না। তবে আপনিতো বেশি একটা কল করেন না। তাই আর কি!

আসলে বিয়ের আগের এই সময়টা মেয়েদের জন্য খুব মর্মস্পর্শী হয়। পরিবারের সাথে অবিবাহিত জীবনের অন্তিমক্ষণে আমি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছিনা। আপনি আবার ভেবে বসবেন না আমি খুব আনরোমান্টিক! কথা বলার জন্য তো পুরো জীবন পড়ে আছে।

আপনি খুব অন্যরকম জানেন? আমি সবসময় দেখেছি আমার কাজিনদের বিয়ের একমাস আগে থেকেই সারাক্ষণ কানে ফোন নিয়ে বসে থাকতে। একটু পরপর দুলাভাইদের ফোন। এমন হয়েছে বোনের সাথে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারতাম না সেই ফোনকলের চক্করে। কি যে বিরক্ত লাগতো! কিন্তু আপনি সেটা করেন নি।

হাহা, এখন আমি কল না করায় বিরক্ত লাগছে নিশ্চয়ই!

অন্তরা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।আসলেই সে ভেবেছিল তার বরও বুঝি রোজ ফোন দিবে। কিন্তু নাহিদ দেয়নি বলে ভীষণ বিরক্ত লাগছিল।
নাহিদ ধীর কন্ঠে বললো, অন্তরা! আপনি কি জানেন লজ্জা পেলে আপনাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়? যদিও চোখে দেখছি না তবে মন দিয়ে অনুভব করতে পারছি আপনার রক্তিম মুখখানা।

অন্তরার ফুফু তাহেরা অনেকটা ভেংচি কেটেই বললো, বুঝি না বাপু কি যামানা এলো। হলুদের আগেরদিন বলে পার্লারে যেতে হয় মেহেদী পড়তে। বিয়েতো আমরা করি নাই। এখনকার বিয়েশাদী কেমন জানি।

অন্তরা তার ফুফুর গলা জড়িয়ে বললো, তোমার বিয়েতো হয়েছে সেই ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে। তখনের সাথে মিলাইলে হবে? তুমি জানো এখন সপ্তাহ জুড়ে অনুষ্ঠান হয়। মেহেন্দী, সংগীত, ব্রাইডাল শাওয়ারসহ কত অনুষ্ঠান। তুমি বললে ফুপাজানকে বলি আবার বিয়েটা করুক??

তাহেরা খানিকটা লাজুক হেসে বললো, মেয়ের কথা শোনো কি সব বলে। এই বয়সে আবার বিয়ে। লোক হাসানো কারবার। শোন মা বিয়ের সপ্তাহ আসরের পর বের হতে নাই। নাইওরির রূপ বাড়ে তাই আলগা হাওয়ার বদনজর থাকে। তোরা শহরের মানুষেরা এসব মানতে চাস না। এই সন্ধ্যায় যাবি মেহেদী পড়তে। কেন রে আমার ভাই ভাবী কি কাউরে আনতে পারেনাই যে ঘরে এসে পড়াই দিবো?

অন্তরা খানিকটা মিইয়ে বললো, ঐ পার্লারের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া খুব টাফ গো ফুফু। অনেক কষ্টে পেয়েছি। এখন বাবাকে বলে ভেস্তে যেতে দিও না।আর ঢাকা শহরে দিন রাত সব সমান। আমার বেশিক্ষণ লাগবেনা।

তোর সাথে কে যাবে?

কেন ভাইয়া আছে না?

ও তাহলে ঠিক আছে। সাবধানে যা তাড়াতাড়ি ফিরে আয়।

অন্তরা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে ফুফুর গালে চুমু খেল। তাহেরা তার আদরের ভাইঝির কান্ড দেখে হাসতে লাগলো। মেয়েটাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসেন তিনি।

ওমর অন্তরাকে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে বলে, বের হবার আগে কল দিস আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো। আর পাখিরা কোথায় এখনো আসে নি যে?

ওরা রাস্তায় আছে চলে আসবে টেনশন নিও না তো তুমি যাও। আমি কল করবো। আর শুনো কাঁচা ফুলের অর্ডার দিয়েছো তো? আমি যে ছবিটা দিয়েছি সেইম টু সেইম হয় যেন। হলুদ ফুল যেন ভুলেও না দেয় আর মাঝখানের কলিটা যেন গোলাপি হয়|

আর কয়বার বলবি এটা? আমি ঐখানেই যাচ্ছি। এতো অস্থির করতে পারিস না তুই!

কি করবো আমার তো আর ভাবী বা বড়বোন নেই যে সবকিছু বলে দিবে। নিজেকেই তো সব বলতে হচ্ছে। তুমি ছেলেমানুষ বুঝো কিছু?

কোথায় বিয়ের কথা ভেবে একটু কান্নাকাটি করবি তা না নেচেই তো কূল পাচ্ছিস না।

ভাইয়া এভাবে বলিস কেন। বিদায়ের সময় দেখিস খুব করে কাঁদবো। এখন যা তো।

ওমর বোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বোনের চোখমুখে আনন্দ যেন ঠিকরে পড়ছে। মনমতো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলে বুঝি মেয়েরা এভাবেই ঝলমল করে?

ওখানে দাঁড়িয়ে পাখিদের অপেক্ষা করতে করতে অন্তরা তাদের কল করার জন্য ফোন নিতে যাবে তখনই একটা ছেলে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আপু আপনি অন্তরা?

জ্বি!

আপনার ভাই ওমর একটু আগে যাওয়ার সময় সামনের রোডে এক্সিডেন্ট করেছে, আমাকে বলেছে আপনাকে যেন হসপিটালে নিয়ে যাই।
উনার অবস্থা খুবই খারাপ তাড়াতাড়ি চলেন,,

ছেলেটা এমনভাবে বলেছিল যে অন্তরা কথাটা শুনে আগপিছ না ভেবে কান্না করতে করতে ছেলেটার সঙ্গে সিএনজিতে উঠে বসলো। সে ভাববার ও সুযোগ পেল না কেউ তাকে কল না করে এভাবে সরাসরি চিনে খবর দিবে কিভাবে। আর জানবেই বা কি করে ওটা ওর ভাই ওমর ছিল? অন্তরার যখন বুঝতে পারলো তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। সিএনজি হাই স্পিডে ফেলে এসেছে অনেকখানি পথ,,,,,,
।।
গতকাল রাতে অন্তরা নিখোঁজ হবার পর তাকে পুরো শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ওমর আর তার বন্ধুরা। কোথাও তার হদিস না পেয়ে শেষে থানায় নিখোঁজ ফাইল করে। ওদিকে আত্মীয় স্বজনরা যে যা পেরেছে শামীমাকে শুনিয়ে গেছে, যেন সব দোষ তার। এতোকিছুর মাঝেও শামীমা জায়নামাজ আঁকড়ে পড়েছিল। সিজদায় লুটে ফরিয়াদ করেছিল, আল্লাহ গো আমার মেয়েটাকে সহীহ সালামত ফিরাইয়া দাও। আমার মেয়েটারে ভালো রাখো আল্লাহ!”””

কিন্তু নিয়তি যে বড্ড বেশিই নিষ্ঠুর। কোন পাড়ের পাড়ের গড়ন যে কোন পাড়ে ভাঙে বোঝা বড় দায়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here