অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১২

0
334

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১২)

#আরশিয়া_জান্নাত

ডিবি অফিসার মিজান আর পারভেজ একটু আগে ওমরদের বাসায় এসেছেন। ওমর আর অনীল ড্রইং রুমে তার সামনে বসা। মিজান কতগুলি ফটো দেখিয়ে বলল,সেদিন সন্ধ্যার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে এই ছেলেটার ছবি পেয়েছি। ভিডিও ক্লিপ দেখে মনে হলো ছেলেটা কিছু একটা বলতেই মিস অন্তরা স্বেচ্ছায় সিএনজিতে উঠেছেন। এখানে জোরজবরদস্তির আলামত নেই। এখন আপনারা দেখে বলুন তাকে চিনেন বা পূর্বে দেখেছেন কি না।

অনীল ভালোমতো দেখে বলল,না অফিসার একে আমি আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। কে এই ছেলে কোনো তথ্য পেয়েছেন?

দেখুন এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা খুব স্মার্ট। এদের কাদের সঙ্গে কি চলছে তা বাড়ির লোক খবরও পায় না।

আপনি কি বলতে চাইছেন?

আপনাদের তথ্যমতে যেদিন সে মিসিং হয়েছে তার একদিন পর তার বিয়ে। এখন এখানে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক কথাই আসছে। যেমন ধরুন এখন মেহেদী দিতে পার্লারে যেতে হয় না। বাসায় এসে ডিসকাউন্টে দেওয়ার মতো অনেক ফেমাস আর্টিস্ট আছে। তা সত্বেও মিস অন্তরা অনেকটা জোর করে আপনাকে না জানিয়ে তার ভাইকে নিয়ে গেছে। আবার তার ভাই মানে ওমর জানতো সেখানে তার বান্ধবীরা আসবে। কিন্তু সে তাদের দেখবার আগেই হলুদের গয়নার অর্ডার দেওয়ার তাড়া দিতেই সে চলে যায়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো ওমর যাওয়ার পর ঐ ছেলে আসা অবধি মিস অন্তরা ভেতরে যাননি ওখানে দাঁড়িয়েই কারো অপেক্ষা করছিলেন তখনই ঐ ছেলে আসে তাদের মধ্যে কিছু একটা কথা হয় আর অন্তরা চটজলদি সিএনজিতে ওঠে। আপনারাই বলুন এখানে ঘটনাটা কেমন সিনেম্যাটিক হলো না? লাইক বিয়ের আগে প্রি প্ল্যান করে পালানো,,,,

ওমর এইবার রেগে বলল, আপনি আমার বোনের বয়ান না শুনে এভাবে মনগড়া গল্প বানাতে পারেন না। ও কেন পালাতে চাইবে? এই বিয়ে ওর মতের বিরুদ্ধে হচ্ছেনা। তাছাড়া আপনি ওর ফোনের লাস্ট কললিস্ট তো দেখেছেন সেখানে ওর দুই ফ্রেন্ডের নাম্বার ছিল।
আপনি রীতিমতো আমার বোনকে অপবাদ দিচ্ছেন! ওর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা না করে এমন কিছু বলা কতখানি যৌক্তিক?

কুল ডাউন মিস্টার ওমর। আমরা প্রমাণের সাপেক্ষে প্রাথমিক একটা অনুমান বলছি এতো হাইপার হবেন না প্লিজ কো-অপারেট করুন।

স্ট্রেইঞ্জ আমার বোনের এমন অবস্থা ওর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ওকে কিছু জানোয়ার মিলে রেইপ করেছে। আমার মা হসপিটালাইজড। আমাদের মেন্টাল কন্ডিশন আপনি বুঝতে পারছেন? তার উপর এমন কথাবার্তা শুনলে কার মাথা ঠিক থাকবে? এখানে কো-অপারেট করার পথ রাখছেন? ইনফ্যাক্ট আপনার এসব শুনে আমাদের সবার মনে সন্দেহের দানা সৃষ্টি হবে যা আমার বোনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আমি চাই না আমার বোনকে কেউ এমন দৃষ্টিতে দেখুক।

পারভেজ অবস্থা স্বাভাবিক করতে বললেন,দেখো বাবা বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে এমন বলা। আমরা আইনের মানুষ আমাদের সন্দেহের তালিকায় কেউই বাদ যায় না। তুমি আবেগ দিয়ে না ভেবে লজিক্যালি ভাবো মিজানের কথা ফেলনা মনে হবে না। যাই হোক আপনারা যেহেতু ছেলেটিকে চেনেন না আমরা অন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর আশা করি মিস অন্তরা শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুক।

তারা চলে যাবার পর অনীল বলল, পুলিশ তাদের ডিউটি পালন করছে এখানে রাগারাগী করার কী আছে? মেয়েরা বাইরে এমন করছে না তা তো না? এমন বহু ঘটনা অহরহ ঘটছে এতো রিয়্যাক্ট করছো কেন?

ওমর অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে বলল, অন্তরা আপনাকে ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ভাবে। আপনার সম্মান নষ্ট হবে এমন কিছুই সে করেনি। অথচ আপনি তাকে এইটুকু ভরসা করতে পারেন না? পুলিশের জাস্ট একটা অনুমানকে সত্যি ভাবার লজিক দেখাচ্ছেন? আমার বোনকে আমি চিনি বলেই প্রতিবাদ করেছি।

মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। আমার মেয়ের জন্য আমার চেয়ে বেশি বুঝতে এসো না।

ও আপনার মেয়ে আমার বোন। আপনার চেয়ে কোনো অংশে আমার অধিকার কম না। অবশ্য আপনাকে বলে লাভ নেই, যে চাইলেই মেয়েদের ভোগ করতে পারে তার কাছে নিজের মেয়ে আর পরের মেয়ের মাঝে তফাত কী? সে তো ভাববেই মেয়েরা সহজলভ্য। সে যেমন করে আনতে পারে অন্যরাও তার মেয়েকে নিতে পারবে,,,,

অনীল আক্রোশে ওমরকে সজোরে চড় দিলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এতো বড়সাহস তোর আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমনসব কথা বলছিস। বেয়াদব ছেলে। টাকা পয়সা খরচ করে তোর মতো জানোয়ার পুষেছি আমি? আমার খেয়ে আমার পড়ে আজ আমাকে অপমান করা! এইসব শিখিয়েছে তোর মা? আমি যদি ওরে সামনে পাই,,,,

পারেন আর কি সব রাগ তো অসহায় নারীটার উপরেই ঝাড়তে পারেন। মারতে হলে আমাকে মারেন মাকে টানেন কেন?

তুই কি ভাবোস অনেক বড় হয়ে গেছস তোকে আমি মারতে পারবো না? এই যে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস এটা আমার টাকায় খেয়ে গড়ে উঠেছে,

আমি ফিরাউন দেখিনি কিন্তু আপনাকে দেখেছি। আর বিশ্বাস করুন এটা আপনার বানানো শরীর না, নিজেকে রিযিকদাতা ভাবা বন্ধ করুন। তবে এটা সত্যি এই শরীরে আপনার ডিএনএ বইছে আর এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখের ব্যপার। তাই এইশরীরটাকে আমি তীব্রভাবে ঘৃণা করি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আপনার পাপের শাস্তি আমার বোন পেয়েছে। আর এজন্য স্বয়ং আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করলেও আমি আপনাকে ক্ষমা করবোনা।

অনীল স্তব্ধ হয়ে গেল ওমরের কথায়। বাকরূদ্ধ হয়ে ওমরের বেরিয়ে যাওয়া দেখলো।দেখলো কতোটা জোরে দরজা লক করে গেছে তার শান্তমতোন ছেলেটা। তার একমাত্র ছেলে এতো ঘৃণা পুষে রেখেছে তার মনে এ তো সে আগে বুঝে নি। এতোসব কথা এভাবে মুখের ওপর বলার স্পর্ধা আজ পর্যন্ত কেউ করে নি। সেখানে তারই সন্তান এসব বলল। অনীল বুকের মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব করছে। এই বিশাল ফ্ল্যাটে আজ তার কেউ নেই কেউ না।।


ওমর রাস্তার পাশের ফুটপাতে বসে আছে, বুকের ভেতর চেপে রাখা আক্ষেপ আজ এভাবে নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যাবে ভাবে নি সে। হয়তো পরিস্থিতিটাই দায়ী। চারপাশের তিক্ততা মন বিষিয়ে তুলেছে। বারবার মনে পড়ছে তার ছোটবোনটার ক্ষতবিক্ষত মুখখানা। তার এতো আদরের বোনটার করুণ পরিনীতি মস্তিষ্ক শূন্য করে তুলেছে। সে পারছেনা রাগ কন্ট্রোল করতে। তার উপর বাসায় তার মাও নেই। ওমরের নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করছে। কেন এমন ঘটতে গেল। এতোদিনে তো অন্তরার নিউইয়র্ক চলে যাওয়ার কথা। সে কেন হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে? ওমরের ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে। এই কুৎসিত জঘন্য বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যেতে। পরক্ষণেই মনে হলো না না পালানো যাবে না। মা-বাবার যে মনমানসিকতা এইখানে যে অন্তরাকে একা ফেলে যাওয়া যাবে না।ওমর ভাবতো অনীল অন্তরাকে ভালোবাসে ভরসা করে। কিন্তু আজ মনে হলো সেও সমাজের আর পাঁচটামানুষের মতোই ভাবে। অন্তরাকে এই জাহান্নামে রেখে ওমর কিছুতেই পালাবে না। ওর বোনকে ও সামলাবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে শক্তহাতে সামলাবে। ওর বোনকে ও সামলাবেই।
“তুই শুধু বেঁচে ফির বোন। ভাইয়া তোকে অনেক দূরে নিয়ে যাবো। এই চেনা মানুষগুলোর মাঝে তোকে জর্জরিত হয়ে রোজ মরতে দিবো না। তুই শুধু বেঁচে ফির।”
_________________________
হসপিটাল থেকে কল এসেছে অন্তরার জ্ঞান ফিরেছে।
ক্লান্ত পরিশান্ত অন্তরার মুখটা যেন এইটুকুন হয়ে গেছে। চোখ মেলে সে সবার দিকে চাইলো। কিন্তু অনীলের দিকে তাকাতেই ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে বলল, ভাইয়া উনাকে চলে যেতে বল আমি উনার মুখ দেখতে চাই না।
উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হয়ে গেল অন্তরার কথায়। কী এমন করেছে অনীল যার জন্য অন্তরার মুখে এই কথা??

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here