অন্তঃপুরে দহন পর্ব ৯

0
359

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-9)

#আরশিয়া_জান্নাত

মা তুমি কি জানো নানু বেঁচে আছে?

ওমরের কথায় শামীমা স্তব্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞাসুচোখে তাকিয়ে রইলো ওমরের দিকে।

ওমর তার কাঁধে হাত রেখে পাশ ঘোরালো। দেখলো জীর্ণশীর্ণ দেহের এক বৃদ্ধা হুইলচেয়ারে বসে আছেন। শামীমা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা সত্যিই তার মা? যাকে সেই ছোটবেলায় দেখেছিল সে! চামড়া কুঁচকে বুড়িয়ে যাওয়া শরীরটা দেখেও চিনতে অসুবিধা হলো না তার। তবে তাকে কেন মিথ্যা বলা হয়েছিল তার মা মরে গেছে? এতোগুলি বছর সে মায়ের অভাবে ভুগেছে, সৎমায়ের অত্যাচারে জর্জরিত হয়েছে। অথচ তার জন্মধাত্রী মা জীবিত ছিল!
শামীমা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠে। চারপাশের হাওয়া যেন ভারী হয়ে উঠে বহুবছর পর মা মেয়ের মিলনের অশ্রুবর্ষণে।
ওমরেরো চোখ ভিজে আসে এমন দৃশ্য দেখে।
ওমরের নানা মারা যাওয়ার পূর্বে ওমরকে বলে গিয়েছিল তার আপন নানী বেঁচে আছেন। তাঁদের বিচ্ছেদের গল্পটাও অসহায়ের মতো স্বীকার করেছিলেন। ওমরকে শামীমার মামার এড্রেস দিয়েই বৃদ্ধ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর অনেকদিন ধরেই ওমর আসল নানুর খবর বের করে। আর শামীমাকে নিয়ে আসে চাঁদপুরে।
শামীমার মা ওমরকে জড়িয়ে বলে, নানুভাই তুই আজকে আমারে এমন এক উপহার দিছোস যেইডা আমি স্বপ্নেও পূরণ করতে পারিনাই। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি তুই অনেক সুখী হ। আমার কলিজার টুকরাডারে আমি এই জীবনে আবার বুকে নিতে পারছি এহন মরলেও আমার কষ্ট নাই। মারে আল্লাহ তোরে সাতরাজার ধন দিছে তুই বড় ভাগ্যবতী রে মা।
শামীমা ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, আমি আসলেই ভাগ্যবতী এমন ছেলের মা হয়ে।


অনীল ব্যাংক থেকে বিশ হাজার টাকা বের করে কফিশপে ঢুকলো। ঐখানেই সেই ছেলেটা বসে বসে পিজ্জা খাচ্ছে। এমন আয়েশ দেখে অনীলের মেজাজটা চরম খারাপ হলেও কিছু করার নেই। অনীল তার সামনের কোচটায় বসে বললো, এই নাও টাকা। আর যেন তোমায় না দেখি। টাকা টাকা করে মাথা না খেয়ে উপার্জন করলেই পারো। এই বয়সী ছেলে আরেকজনের টাকায় উলাল করে!

লিসেন মিস্টার অনীল আপনার লেকচার কেউ শুনতে আসে নি। আর কে বলেছে আমি উপার্জন করিনা। এই যে আপনার পকেট থেকে বিশ হাজার বের করে আনলাম এটা কি চাট্টিখানি কথা? কেউ কি এমনি এমনি নিজের টাকা দেয়? আপনার জন্য একটা কফি অর্ডার করেছি খেয়ে যান। আমি আবার আপনার মতো না। এটার বিল আমিই দিবো। আমার মন আবার অনেক বড় বুঝেন নাই ব্যাপারটা। বাই দ্য ওয়ে শুনলাম আপনার মেয়ের বিয়ে। দাওয়াত তো দিবেন না। তবে আমার মর্জির কথা জানিনা ইচ্ছা হইলে দোআ করতে চলে আসবো। আফটার অল দুলাভাইয়ের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সম্পর্কে তো ভাগনী হয় তাই না?

খবরদার! ঐদিকে ভুলেও নজর দিও না। তোমাকে যদি আমি দেখি আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

হাহাহা আপনার চেয়ে নিকৃষ্ট আসলেই কেউ হতে পারবে না। আপনাকে দেখলেই না আমার মুখ দিয়ে দলা পাকিয়ে থুতু আসে। আপনার গায়েই যে তা ফেলি না এই আপনার সৌভাগ্য।

মুখ সামলে কথা বল রাফি! এতো স্পর্ধা তোর আমার টাকায় খেয়েপড়ে বড় হয়ে আমার গলায় কাঁটার মতো বিধছিস। আরে তোর চেয়ে কুত্তা পাললে আরো ভালো হতো অন্তত লেজ নাড়িয়ে ভক্তি করতো।

ইশ রে! বড্ড আফসোস আপনার তাই না? তো পালতেন একটা কুত্তা! আমারে পালতে গেলেন কেন?

সেটা তোর বোনরেই জিজ্ঞাসা করিস। তোর বোনেই তো তোর খরচের বদলে শুইতে আসছিল। এখন তোরা সিদ্ধি পুরুষ তাই না? আর আমি নিকৃষ্ট। নিজেদের দিকে তাকা আগে তারপর অন্যকে বলতে আসিস।

আমার বোন এমনি এমনি যায় নাই আপনি তাকে বাধ্য করেছেন। আমার সদ্য ডিভোর্সী বোনটারে আপনি,,,,,, আমার বোনের অসহায়ত্বের সুযোগ নিছেন আপনি।

অনীল সিগারেট এ আগুন দিয়ে ধোঁয়া তুলতে তুলতে বললো, তুমিতাগড়া জোয়ান ছেলে, ভালোমন্দ বুঝিস না। এই পৃথিবীতে কেউই সহায় না। সবাই অসহায়। টিকে থাকার যুদ্ধে সবাইকেই সক্রিয় হতে হয়। মাথার উপর ছাল লাগে। আমি তোমাদের ছাল ছিলাম। তোমাকে আমি বড় স্নেহ করি। তাই বলছি আমার ভালো রূপ দেখেছ খারাপটা দেখতে চেও না। চোখ ঝলসে যাবে।

অনীল সেখান থেকে চলে গেল। রাফির চোখ পানিতে রক্তিম হয়ে গেল দাঁত কিড়মিড় করে বললো, চোখ তো সেদিনই ঝলসে গেছে যেদিন আমার বোনকে তোর সাথে দেখেছিলাম। এই ঝলসানো চোখকে কিসের হুমকি দিচ্ছিস শু*য়ো*র? আমার বোনকে রক্ষিতার মতো ভোগ করেছিস। একঘরে করে রেখেছিস, আবার মহৎ সাজার শখ! তোর এইসব কর্মের ফল তুই পাবি। অবশ্যই পাবি। পেতে তোকে হবেই। আমিও দেখবো তোর ছাল হবার কত ক্ষমতা। হাহাহা
হাসতে হাসতে কফিতে মেশানো আফিমের নেশায় ডুবে গেল মুহূর্তে।
___________________

ঢাকা শহর একটা জাদুর শহর। এই শহরে যেমন আয়েশী জীবনের হাতছানি আছে, ধনীদের বিরাট অট্টালিকা আছে তেমনি আঁধার কালো বাস্তবতা আছে। কমলাপুরের কংক্রিটের উপর ঘুমিয়ে পড়া শতশত লোক আছে। টাকায় টাকায় ছড়াছড়ি সেই শহরটাতেও বেকারত্ব আছে। যানজটের মতো মনে অরাজকতার বিশৃঙ্খলা আছে। তবুও মায়ার শহর জাদুর শহর ঢাকা। একই শহরের কত রুপ তাই না? ঠিক যেন মানুষের মতো। হ্যাঁ মানুষের মতোই বহুরূপী। তার একেক চরিত্রে একেক রূপ। বাবারূপে সে যতোটা ভরসার নাম,পৃথিবীর সবাই খারাপ হলেও বাবা খারাপ হয় না। অথচ সেই একই মানুষ ভালো স্বামী কিংবা ভালো বস নাও হতে পারে। মেজাজ দেখানো মানুষটাই অন্যদের কাছে শান্ত স্বভাবের অমায়িক মানুষ! হিংস্র মানুষটাও কারো কারো সামনে ছোট্ট বাচ্চার মতো আদুরে। কারো জন্য বিশালতার উপমা তো কারো কাছে নর্দমার জঘন্য কীট। মানুষ আসলেই বহুরূপী। এদের চেনা সহজ না।

তাইয়্যেবা কয়েক টুকরো বনরুটি হাতে নিয়ে রাস্তার ধারে বসে আছে। একটু পরপর পাশের কয়েকটা কুকুরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে কুকুরগুলোও লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে সেই টুকরোগুলো খেয়ে নিচ্ছে। যেন এক অজানা প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে। তাইয়্যেবা বহুক্ষণ পর্যবক্ষেণ করে বুঝলো একটা কুকুর সেই কখন থেকেই ছুটছে কিন্তু কোনোবারই এক টুকরোও খেতে পারেনি। তাইয়্যেবা উঠে গিয়ে সেটার সামনে বসে বড় টুকরা দিলো। অন্যরা ছুটে আসতে চাইলে তাইয়্যেবা তাদের সরিয়ে দিলো। আপনমনেই বললো, অনেক তো খেলি এবার ওকেও একটু খেতে দে। তোদেরই তো সঙ্গী নাকি? এমন স্বার্থপরের মতো নিজে খেলেই হবে?
কুকুরগুলো যেন বুঝলো তার বকা। কান নামিয়ে পা গুটিয়ে বসে রইলো তার সামনে।
তাইয়্যেবা ফিক করে হেসে ফেলল, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তোরা বকাও বুঝিস তাই না রে? তোরা আমাদের বকা আদর সব বুঝিস; ভালোবাসা বুঝিস ঘৃণা বুঝিস। অথচ আমরা মানুষেরা মানুষদের মন বুঝিনা। বুঝিনা কোনটা আদর কোনটা বকা। আমরা বুঝিনা কোনটা সত্যি কোনটা অভিনয়। তারপর হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাইরে, কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান হই যেন ভাই মৌন- মহান
খোলা-মাঠের উপদেশে দিল খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয় আপন তেজে চলতে
চাঁদ শেখালো হাসতে মোরে মধুর কথা বলতে।”

বাহ বেশ ভালোই মনে রেখেছ দেখছি কবিতাটা!

ওমরের কথায় পিছু ফিরে তাকালো তাইয়্যেবা। ওমর! সে শিশির পড়া সদ্য ফোঁটা স্নিগ্ধ শিউলির মতো। যাকে দেখলেই পরম যত্নে কুড়িয়ে নিতে মন চায়। চুপচাপ লাজুক স্বভাবের দারুণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ ছেলে। ওর বাহ্যিক রূপ যতোটা না আকর্ষণীয় তারচেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হলো ওর ব্যক্তিত্ব। তাইয়্যেবা তাকে বহুবার ঝাঁকিয়ে দেখেছে। প্রতিবারই মুগ্ধ হয়েছে ওর ভেতরকার স্বচ্ছতা দেখে। ওমরকে দেখার আগ অবধি তাইয়্যেবা ভাবতো সুন্দর মানুষের মন সুন্দর হয় না। ওরা ওপর দিয়ে যতোটা চকচকে হয় ভেতরটা ঠিক ততোটাই কালসিটে। কিন্তু ওমর তার এই ধারণা বদলে দিয়েছে। আসলে কিছু মানুষের জন্য গোটা জাতটাকে অপবাদ দেওয়া ঠিক না। এখানে সবাই বৈচিত্র। সবাই ভিন্ন আঙ্গিকে গড়া। একজন দুজনকে দিয়ে সেটা বিচার করা ভুল তা সে ওমরকে দিয়েই জেনেছে। তাইতো দূরে থেকেও সবসময় ওমরের খোঁজখবর রেখেছে। কি করছে কোথায় আছে সবই তার নখদর্পণে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে আসা হয়নি তার ধারে। সেদিন মুখোমুখি সংঘর্ষ না হলে কেউই হয়তো কারো সম্মুখে আসতো না। ওমরের লাজুকতা যতোটা প্রখর তারচেয়ে অধিক প্রখর তাইয়্যেবার মনের তীব্র অনুভূতি। গায়ের রঙের যে বিভেদ তা কি হেয় করা যায়? ওমন সুদর্শন ছেলেই বা কেন আসবে তার উঠোনে আলো ছড়াতে? তাই মনের কথা বাক্সবন্দিই রেখেছে এতোটা বছর। কিন্তু বিধাতার বুঝি অন্য কিছুই ইচ্ছে! নয়তো বারবার কেন হচ্ছে এই অনাকাঙিক্ষত সাক্ষাত?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here