অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫৪
জীবনের চূড়ান্ত তিক্ত সত্যগুলো জানা সত্ত্বেও কেউ যখন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তখনকার অনুভূতি গুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে যন্ত্রণার শিহরণ জাগায়। উড়তে থাকা পাখি হঠাৎ যেমন গতি হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে অনিরও আজ তেমনি বোধ হচ্ছে। হঠাৎ যেন সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।নীরবতার মাঝেও তার কানে বার বার অবৈধ শব্দটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিজের অতীতটা বেশ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তার সামনে এসেছিল।
নামমাত্র পরিবার আর এই দেশ ছেড়ে যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিল নেহাতই অবুঝ এক শিশু ছিল অনি। জাহানারা বেগমকে বেশ কষ্ট করেই মানুষ করতে হয়েছিল অনিকে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে শুরু করে। শৈশব পেরিয়ে সে কৈশোরকালের দিকে পা বাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই সে বুঝে গিয়েছিল তার বিশেষ কোন পরিবার নেই। বাবা বলতে আশরাফ শেখকেই চিনেছিল। দূরে থাকা সত্ত্বেও আশরাফ শেখ বরাবরই অনির খবর নিয়ে এসেছেন। ছোট্ট অনির মনে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগতো কেন তার বাবা মা তার সাথে থাকতো না। কোন উত্তর কখনো সে পায়নি। আস্তে আস্তে প্রশ্নটা তার মনের মধ্যেই চেপে গেছে।
ভিনদেশে থাকায় অনি জীবনে একটা বিশেষ সুবিধা লাভ করেছে। সেখানে কেউ কারো ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না। কার বাবামা আছে কার বাবামা নেই সে ব্যাপারে কেউ কখনো কারো জীবনে অনধিকার চর্চা করেনা।যে যার মতো আপন গতিতে চলছে। প্রয়োজন ব্যতীত সখ্যতা গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত একে বারেই বিরল। তাই সে তথাকথিত সমাজের মানুষদের কোন কথা কখনো তাকে শুনতে হয়নি। একাকীত্বের মাঝেই সে যেন আপন এক দুনিয়ে গড়ে তুলেছিল।
সমস্যা তখন হয় যখন তার পিতার পরিচয়ের জায়গায় আশরাফ শেখের জায়গায় জাহানারা বেগম রাহাত চৌধুরীর নামটা লিখে দেন।হাজার হোক জন্মদাতা পিতার পরিচয়ের জায়গায় তো আর অন্যকোন নাম বসানো জায়েজ না। যে পিতা মৃত্যুর আগ অবধি নিজের সন্তানের জন্য বিচলিত ছিল তার অধিকারটা হনন করতে চাননি অনামিকা। নিজের স্ত্রী সন্তানকে কাছে পাবার জন্য রাহাতের আহাজারি গুলো জাহানারা বেগমের কানে যেন আজো বাজতে থাকে। একেকটা ভুল একেক জনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
জাহানারা বেগম কোন কিছুই অনির কাছে গোপন রাখেন নি। তার বাবা মায়ের সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ অবধি অনিকে জানিয়েছেন তিনি। সন্তান হিসেবে অনির জানা জরুরি। সবটা শোনার পর অনি তার বাবা মা কাউকেই কোন দোষ দেয়নি। এসব কিছুই তার ভাগ্যে নির্ধারিত ছিল। বিধায় আজ সে পরিবার হীন জীবনযাপন করছে।তবে দেরিতে হলেও তার পরিবার পাওয়ার স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে রিশাদের আগমনের মধ্যে দিয়ে।
আজ অদ্রির কথাগুলো শুনে অনির পুরনো ক্ষতগুলো আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। নিজের বাবা মার উপর কোন অভিযোগ নেই তার। তবে জাহানারা বেগমের বর্ণনায় শোনা তার বাবা জীবনের শেষ দিনগুলোয় অনুশোচনায় কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবেই তার মনটা উদাসীনতায় ভরে যায়। তার মা যদি তার বাবাকে ক্ষমা করে দিত তাহলে বোধ হয় তারও একটা হ্যাপি ফ্যামিলি পাওয়া হতো। মামার আদরটাও তার কপালে জুটতো। বিধাতা হয়তো তা চাননি বিধায় সবার জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। বাবা সান্নিধ্য না পেয়েও সে তার একাকীত্বের পৃথিবীতে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে তার বাবার প্রতি অগাধ ভালোবাসা।জীবনের শেষ মূহুর্ত অবধি চেষ্টা করেছেন নিজের অনাগত সন্তানের সান্নিধ্য পেতে। ভাগ্য তার চাওয়া গুলোই সায় দেয়নি।
সমাজের লোকের কথা যাতে শুনতে না হয় তাই আগেই তাকে এই এই সমাজের থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল। তাই এখানকার তথাকথিত সামাজিক মানুষদের কুৎসিত সে রূপটা দেখার সুযোগ হয়নি। আজ অদ্রির কথাগুলোর মাধ্যমে তাও যেন পূর্ণতা পেল। অদ্রির দেয়া আঘাত গুলো অনির হৃদয়ে যে সিলমোহর দিয়েছে তা মুছে ফেলা নিতান্তই কষ্টসাধ্য এক কাজ। সময়ের ব্যবধানে হয়তো তা ম্লান হয়ে যাবে কিন্তু মুছে যাবে না।
অনির ভাবনার অবসান ঘটিয়ে তার পাশে এসে পড়ে রিশাদ। ওবাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই হাস্যজ্জ্বল অনির চেহারা জুড়ে উপচে পড়া মলিনতায় রিশাদ নিজেও বেশ বিষন্ন হয়ে পড়েছে। আজ যা কিছু হলো তা মোটেও ঠিক হয়নি।অনিকে কিভাবে স্বাভাবিক করবে সেই ভাবনায় অস্থির সে। অনির এই মলিনতা রিশাদ অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছে। অনির নীরবতায় রিশাদের অন্তরে যে তোলপাড় শুরু হয় তা শুধু নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়।
শিকারির নিক্ষেপিত বাণে আহত হরিণীর মতো অনি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। এই যন্ত্রণা গুলো ভোলবার নয়। রাত গভীর হলে অনিকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দেয় রিশাদ। এক মূহুর্তের জন্যও সে রিশাদকে ছাড়ছে না। রিশাদও তার প্রিয়তমার এই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় পরিপূর্ণ ভাবে খেয়াল রাখছে। রিশাদকে হারানোর এক অজানা ভয় অনির অন্তরে গেঁথে গেছে। কোন কিছুর বিনিময়েই সে অবেলায় পাওয়া এই এক চিলতে সুখ হারাতে চায় না। সবার বাবা মা পরিবার পরিজন সবকিছুই আছে। অনির বেলায় ভরসা করার মতো মানুষ কেবলই দুজন। প্রথমত জাহানারা বেগম আর দ্বিতীয়ত রিশাদ।
নিজেকে সবার কাছ থেকে এক রকম আড়ালেই রেখেই পার করে দুদিন। এই দুদিন কথা বলার মাঝে শুধু রিশাদের সাথেই টুক টাক কথা হয়েছে অনির। মাঝ খানে একদিন জাহানারা বেগম আর আশরাফ এসে অনিকে দেখে গেছেন। অদ্রির এমন কাজে আশরাফ নিজেও বেশ লজ্জিত। হাজার হোক অদ্রির ভালো মন্দ যেকোন কাজেরই দায়ভার বাবা হিসেবে তার উপর পরে। অনি কারো সাথে কোন কথা বলেনি। ভদ্রতার খাতিরে শুধু কুশল বিনিময় করে।
আশরাফ শেখকে সে ছোটবেলা থেকে বাবা বলে চিনে এসেছে। তার কাগজগুলোও একজন বাবার মতোই ছিল। তাই তো অনির তালিকায় প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে আশরাফ শেখ একজন। যদিও আজ সে এই মানুষটাকে বাবা বলে ডাকতে এক অদ্ভুত জড়তা কাজ করছে। এই বোধ হয় অদ্রি এসে বলবে আমার বাবাকে বাবা বলে ডাকবি না।
অদ্রির প্রতিটা কথা অনির অন্তরে গেঁথে গেছে। অদ্রির কাছ থেকে এত বড় আঘাত দুঃস্বপ্নেও কল্পনায় ছিল না অনির। এক ঝড়ো হাওয়া এসে যেন অনির সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। অদ্রিকে মানসিকভাবে গুড়িয়ে দিল। ছোটবেলা থেকে সকল প্রতিকূলতার দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে আজ প্রিয় মানুষটার কথার আঘাতে যেন অনি একেবারেই ভেঙে পরেছে।
রিশাদের সাপোর্ট পেয়ে অনি নিজের জীবনে কিছুটা ধাতস্থ হয়। এইদুদিন যে রিশাদ তার জন্য কষ্ট পেয়েছে ভাবতেই তার মনটা ডুকরে ওঠে। নিজের জীবনের সাথে যে রিশাদের জীবনটাও জড়িত তা হয়তো অনি এই কয়দিনে ভুলেই গিয়েছিল। দুদিন সময় নেয় নিজেকে সামলে নিতে। সে মনস্থির করে আবার আগের মতো হয়ে যাওয়ার জন্য।
জীবনে সবাইকে একসাথে খুশি করা সম্ভব নয়। আর অনি ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছুই করেনি। অদ্রির এভাবে রিয়্যাক্ট করাটাও হয়তো জায়েজ ছিল। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজেরই বোনের সাথে দেখা কতটা কষ্টকর তা হয়তো অদ্রির মতো কেউই উপলব্ধি করতে পারছে না। নিজের বোন কথাটা বলেই বিদ্রুপের হাসি দেয় অনি। নিজের বোন না আসলে সৎ বোন। কথাটা ভাবতেই অনির সারা শরীরের লোম শিউরে ওঠে। আজ প্রথম সে নিজেকে অদ্রির সৎ বোন বলে কল্পনা করছে। অনুভূতিটা কষ্ট দায়ক কিনা তা অনি বুঝতে পারছে না।
বিকেলবেলার দিকে অনি আসরের নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হয়। রিশাদ এইদুদিন অফিস ছুটি নিয়েছিল। আজ অনিকে একটু স্বাভাবিক দেখে রিশাদ অফিসে যায়। অনি সারাদিন রুমেই ছিল। শায়লা বেগম তিনবেলা এসে অনিকে খাইয়ে দিয়ে গেছেন। রায়হান সাহেব সকালে আর রাতে দুবার করে অনির সাথে দেখা করে যান। আর রিশা মিথিলারও বেশ মন খারাপ অনিকে এ অবস্থায় দেখে। তারাও নানা ভাবে চেষ্টা করে অনির মন ভালো করার। সব মিলিয়ে এত সুন্দর একটা পরিবার আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছে অনি। নিজেকে তার সৌভাগ্যবান মনে হয়।
অনি নিচে নামে। ড্রইংরুমে বসে শায়লা বেগম আর সাবরিনা টুক টাক কথা বলছিলেন। মনে হচ্ছিল কোন জরুরী কথা বলছেন। তাদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে তাই মনে হচ্ছে। দুমিনিট দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে অনি। শায়লা বেগমের নজর অনির উপর পড়তেই অনি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। শায়লা বেগম কি ভাববে?অনি বোধ হয় দূরে থেকে তাদের কথা শুনছিল।
–অনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?এখানে আয় বোস আমাদের সাথে।(শায়লা বেগম)
শায়লা বেগমের কথায় অনি স্বস্তি পায়। তেমন কিছু ভাবেনি বলেই মনে হয় তার কাছে।
অনি আস্তে করে শায়লা বেগমের পাশে বসে পড়ে। তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ যাবত গল্প করে সময় কাটায়। শায়লা বেগম অনিকে এভাবে দেখে যে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন তা তার কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। রিশা মিথিলাও এসে সবার সাথে যোগ দেয়। শায়লা বেগম সবার জন্য বিকেলের নাস্তা বানান। রিশা মিথিলা আর অনি তিনজনে আজ বেশ ভালো সময় কাটায়। আজকে তাদের মনে হচ্ছিল আগের অনিকে ফিরে পেয়েছে তারা। অনি সকল কষ্টের উপর পর্দা টেনে হাসিমুখে সবার সাথে মিশে যায়।
সন্ধ্যার একটু পর পর রিশাদ আর রায়হান সাহেব একসাথে বাসায় আসে। ড্রইংরুমে সবার মাঝে অনিকে দেখে যে রিশাদ কতটা স্বস্তি পায় সেই অনুভূতিটা বোঝানো মুশকিল। আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে ফুটে ওঠে।
রিশাদ দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সাথে যোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর রায়হান সাহেব এসেও শামিল হন সবার সাথে। পুরো বাড়িটা আজ চঞ্চলতায় মুখরিত। শায়লা বেগম সবাফ জন্য স্ন্যাকস বানিয়ে আনেন সাথে গরম গরম চা। চমৎকার এক সন্ধ্যের সাক্ষী হয় সবাই।
রাতে একসাথে ডিনার করার পর পারিবারিক এই আসর ভেঙে যায়।সবাই যে যার মতো নিজেদের রুমে যায় ঘুমাতে। পরিবারের কেউ একজন ভালো না থাকলে যে তা সবাইকে প্রভাবিত করে তারই প্রমাণ পেয়েছে আজ অনি। পরিবারের সবাই তাকে কতটা আপন করে নিয়েছে। এত সুন্দর এক পরিবার পাওয়া অনির জীবনে আশীর্বাদ এর চেয়ে কম নয়। কোন কিছুর বিনিময়েই সে হারাতে চায়না অবেলায় পাওয়া এই সুখানুভূতি গুলো।
ঘড়ির ঘন্টার কাটাটা দুইয়ের ঘরের কাছাকাছি চলে এসেছে। রিশাদের চোখে ঘুম নেই।রিশাদের বাহুডোরে আবদ্ধ ঘুমন্ত অনির দিকে তাকিয়ে রিশাদ কিছুটা স্বস্তি পায়। দুদিন পর আজ একটু সে ভালোভাবে ঘুমোচ্ছে। অনির জন্য বেশ চিন্তিত রিশাদ। সারাজীবন তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়ে আর তার অতীত ফিরে এসেই অনিকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা দিয়েছে। রিশাদের কিছুটা খারাপ লাগে। অদ্রির সাথে কোন অন্যায় করেছ্ব বলে মনে হয় না। সে তো শুধুই তার কর্মফল ভোগ করছে। সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তার জন্য ভালো কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন তাই রিশাদ আর অদ্রির পথ আলাদা করে দিয়েছেন। নানান কল্পনা জল্পনা করতে করতে রিশাদের তন্দ্রাভাব চলে আসে।
ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে আবছা আবছা অনির কানে ভেসে আসছে। অলসতা কাটিয়ে অনি রিশাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে ওজু করে বেরিয়ে আসে। রিশাদ এখনো ঘুমোচ্ছে। অনি কয়েক বার ডাক দিতেই রিশাদের ঘুম ভেঙে যায়। রিশাদ নিজেও ফ্রেশ হয়ে মসজিদে যায় নামাজ পড়তে। নামাজে যাওয়ার আগে প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে ভুলে যায় না। লজ্জাবতী অনি লজ্জায় লাল হয়ে যায়।রিশাদ মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে তার বাবার সাথে মসজিদে যায়।
অনি একটু সময় নিয়ে নামাজ শেষ করে বেলকনিতে যায়। পুরোপুরিভাবে ভোরের আলো ফোটেনি। ধূসর আকাশ,কুয়াশাছন্ন পরিবেশ। পাখিদেরও নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে।ল্যাম্পপোস্ট গুলো এখনো জ্বলছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দৃশ্যমান। কুকুর গুলো অলস ভঙ্গিতে ফুটপাতে বা রাস্তার পাশে শুয়ে আছে। সারারাত জেগে পাহারা দেয়ার ডিউটি শেষ করে তারা যেন বড্ড ক্লান্ত।রাস্তায় কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছে না।
অনি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে রেলিং আলতো করে রেলিং ধরে চোখ বুজে দীর্ঘ এক দম নেয়। অনির শ্বাসরন্ধ্র থেকে শুরু করে হৃদপিণ্ড পর্যন্ত যেন শীতল হয়ে যায়।ভোরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া চোখেমুখে বারি খায়। অগোছালো চুলগুলো হালকা ঢেউ খেলে যায়।নীরব প্রকৃতির সাথে একা কিছুক্ষণ সময় কাটায় অনি। ভোরের আলো পুরোপুরিভাবে ফুটতে ফুটতে যেন নীরব প্রকৃতিটাও চঞ্চলতায় মুখরিত হয় পাখিদের আনাগোনা আর সীমিত সংখ্যক মানুষের বিচরণে।
একজোড়া হাত এসে রেলিং এ রাখা অনির হাতের উপর ভর করে। হাত দুটোর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে অনি মুচকি হাসে। রিশাদ অনির কাঁধে থুতনি রেখে কিছুটা আহ্লাদী কণ্ঠে বলে;
–“প্রকৃতিবিলাস শেষ হয়েছে আপনার ম্যাম?”(রিশাদ)
-“উঁহু না তো।”(অনি)
রিশাদ অনিকে সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু একটা বের করে অনির হাতে ধরিয়ে দেয়।
অনি দেখতে দশ বারোটা সাদা সাদা কি যেন ফুল। সাদা পাপড়ির সাথে কমলা রঙের বৃন্ত। ফুলগুলো নাকের কাছে ধরে বেশ সুন্দর এক সুবাস পায় অনি। ফুলগুলোয় বিন্দু বিন্দু কুয়াশা লেগে আছে। এই ফুলের সাথে সে পরিচিত নয়। তবে প্রথম দেখায় ফুলগুলো তার বেশ মনে ধরেছে।
অনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে;”কি ফুল এটা?”
–শিউলি ফুল।
–এত সকাল সকাল ফুল কোথায় পেলে তুমি?
–মসজিদে অনেকগুলো শিউলি ফুলের গাছ আছে। সকালবেলা মসজিদ প্রাঙ্গন শিউলি ফুল দিয়ে ভরে যায়। সেখান থেকেই কয়েকটা এনেছি তোমার জন্য। ভালো লাগে নি??
–হ্যা খুব ভালো লেগেছে। বলেই অনি মুচকি হাসে।রিশাদ হাস্যজ্জ্বল অনির নাকের ডগায় আলতো করে টিপে দিয়ে নিজেও অনির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে দেয়। প্রতিটি সকাল যেন এমনই সুখকর হয় তাদের জন্য।
রিশাদ সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। অনি ঘরটা একটু গুছিয়ে নিচে নেমে সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করে নেয়। আজ মিথিলা আর রিশা অনিকে জোর করছে শপিং করার জন্য। মূলত অনির অগোচরে রিশাদই রিশাকে এই আইডিয়াটা দিয়েছিল। এতে করে অনির মনটাও একটু ভালো হয়ে যাবে আর বাসায় বসে বসে বোর হতে হবে না।
রিশা অনি আর মিথিলা তিনজনে একসাথে বেরোয় শপিং করার জন্য। এই নিয়ে তৃতীয় বার অনি ঢাকা শহরে বেরিয়েছে। এখানকার সবকিছু ইংল্যান্ডের মতো উন্নত মানের না হলেও অনির কাছে বেশ ভালো লাগে। অচেনা মানুষগুলোকেও খুব কাছের মনে হয় স্বজাতি হওয়ায়। অনির জীবনযাপন ইংরেজদের সাথে হলেও তার মধ্যে বাঙালিয়ানা একেবারে ভরপুর।
অনি ধীরে ধীরে আরও বেশি আসক্ত হচ্ছে এদেশের প্রতি। তাইতো সে ঠিক করেছে এখানকার ভার্সিটিতে ট্রান্সফার নিয়ে পড়াশোনা কন্টিনিউ করবে। যদিও সে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে রিশাদের খুশির জন্যই মূলত সে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এদেশের ভালো কোন ইউনিভার্সিটিতে ট্রান্সফার নিতে তাকে কোন বেগ পেতে হবে না।
সারাদিন ঘুরে ফিরে তারা তিনজন শপিং করে। শপিং করার চেয়ে তারা ঘুরেছেই বেশি। মূলত অনিকে ঢাকা শহরটা দেখানোর জন্যই এত ঘুরেছে তার। অনির বেশ ভালোই লাগে মিথিলা আর রিশার সাথে সময় কাটাতে।তবে রিশাদের অনুপস্থিতি টাও সে অনুভব করতে পেরেছে।
প্রায় তিনটের দিকে অনিরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করার জন্য। রিশাই সবার হয়ে খাবার অর্ডার দেয়। যতক্ষণ না খাবার সার্ভ করছিল তারা তিনজনে টুকটাক গল্প করছিল। সবার মাঝে যেন রিশার আগ্রহটাই বেশি। মেয়েটা বরাবরই এমন। যেখানেই যায় সবাইকে মাতিয়ে রাখে।
পাশের টেবিল থেকে একজোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশার দিকে তাকিয়ে আছে। রিশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত। চোখজোড়ার মালিক চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। রাগ তার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তবে এই রাগের কারণ অজানা।
মিনিট দশেক পর একজন ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে। মিথিলার হাত লেগে পানির গ্লাসটা উল্টে পরে যায়। রিশা লাফ দিয়ে ওঠে। উঠতে উঠতেই তার জামার সামনের অংশে কিছুটা পানি পরে যায়। রিশা হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ায়।
কয়েকটা টিস্যু বের করে নিয়ে সে ওয়াশরুমের দিকে যায়। জামাটা একটু মুছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে ঠিক করে নিচ্ছিল। ওয়াশরুম থেকে বেরোবে এমন সময়ে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে রিশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে।
রিশা কিছু বুজে ওঠার আগেই রিশার মুখ চেপে ধরে। সামনে থাকা ব্যক্তির চোখের দিকে তাকিয়ে রিশার আত্মা কেঁপে ওঠে। অগ্নিচক্ষু করে তাকিয়ে আছে রাফি। এখনই সে যেন রিশাকে ভষ্ম করে দেবে। রিফা অসহায় মুখ করে তাকায়।
–“আমার সাথে আসতে তো ভালো লাগে না তাইনা। আমি বললেই যত্তসব বাহানা দিস। আর এখন ঠিকি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বাইরে ঘুরছিস। কি মজ পাস আমাকে এভাবে ঘুরিয়ে?আন্সার মি ইডিয়ট। “(রাফি)
রিশা কাচুমাচু হয়ে যায়। রাফিকে সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই গাম্বাটটা সব সময় এমন করে। মনে মনে বলে রিশা।
রিশার কোন উত্তর না পেয়ে রাফি আরও রেগে যায়। রিশা ইশারা করে বুঝায় মুখ থেকে হাত সরাতে না হলে কথা বলবে কিভাবে।
রাফি হাত সরিয়ে নিতেই রিশা বড় করে দম ফেলে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে;
–আল্লাহ গো!এত জোরে চেপে ধরে আর একটু হলেই তো মনে হচ্ছিল আমি মরেই যেতাম।আল্লাহ বাঁচাইছে?
–শাট আপ।যা বলছি তার উত্তর দে।
–কি উত্তর দিব?আমার যেখানে খুশি যার সাথে খুশি যাবো। তাতে আপনার কি?আপনার সাথে যেতে আমার ভাল্লাগেনা আমি যাবো না।হু দ্যা হেল আর ইউ ম্যান। আর এভাবে ওয়াশরুমে একা একটা মেয়েকে হ্যারাস করছেন কেন। কি সমস্যা আপনার?
রাফি জোরে করে রিশার বাহু চেপে ধরে কিছুটা রাগী কণ্ঠে বলে; আমার কি সমস্যা জানো না?আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা তো তুমি?একটা ভুলের জন্য আর কত শাস্তি দেবে আমায়?আর কতদিন এভাবে আমাকে যন্ত্রণার অনলে পুড়িয়ে মারবে বলো তো। একটাবার কি আমায় ক্ষমা করা যায় না?
রিশা হালকা শব্দ করে হেসে নেয়।অতঃপর সে বলে;আর ইউ সিরিয়াস মিঃরাফি। আপনি কি করেছেন বলুন তো। ভুল কিছু তো আর করেননি। তাহলে ক্ষমা চাইছেন কেন?আপনি যা করেছিলেন একদম ঠিক করেছিলেন।আমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ের সাথে আর যাই হোক সম্পর্ক রাখা যায় না।
–রিশা!!কিছুটা উচ্চস্বরেই রাফি রিশার নাম উচ্চারণ করে। অসহায় চাহনি নিয়ে রিশার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে;
–“তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। তবুও প্লিজ আমাকে ক্ষমা করা দাও। আমি আর পারছিনা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে। প্লিজ রিশা একটাবার আমাকে ক্ষমা করো।”
–ক্ষমা করার মতো কিছু করেছেন কি?আমি খুব অবাক হচ্ছি এটা দেখে দ্যা গ্রেট বিজনেসম্যান রাফিয়াত রাফি আমার কাছে ক্ষমা চাইছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা। আসলেও এটা আপনি নাকি অন্য কেউ।হোয়াটএভার আমাকে ছাড়ুন আমার ব্যথা লাগছে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর এসব ড্রামা আমার সামনে প্লিজ করবেন না। যত্তসব আজাইরা। বলেই রিশা নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে অনি মিথিলার কাছে যায়।
রাফি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
–কেন বার বার আমাকে ফিরিয়ে দাও মায়াপরী। করেছি আমি একটা ভুল। আমাকে কি একবার ক্ষমা করে দেয়া যায়না?তুমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছো আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছো। কথাগুলো মনে মনে বলে রাফি।
তার স্মৃতির পাতায় সেই সোনালি দিনগুলো ভেসে ওঠে। এইতো সেদিনের কথা। আজ থেকে দুই বছর আগে। রিশাদের কলেজের একজন বোর্ড মেম্বার রাফি।নতুন ভর্তিকৃত একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নবীণ বরণ ও অন্যান্য কিছু বিষয়ে একটা মিটিং এটেন্ড করতে গিয়েছিল তার বাবার পক্ষ থেকে।এই কলেজের ফাউন্ডার দের মধ্যে তার বাবা একজন। কলেজ গেটে নেমে কোন দিক না তাকিয়ে সোজা ভেতরে প্রবেশ করে রাফি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল।হঠাৎ একটা কল আসায় করিডোরে দাঁড়িয়ে সে কথা বলতে থাকে।
কথা বলতে বলতে তার চোখ যায় মাঠের কোণায় বড় আম গাছটার দিকে। সেখানেই কলেজ ড্রেস পরিহিত দুই বেণী করা এক কিশোর খিল খিল করে হাসছিল আর দড়ি খেলছিল। প্রতিবার তার লম্বা চুলের বেণী গুলো উড়ে উঠছিল সাথে সামনে বেরিয়ে আসা চুলগুলো তার চোখে মুখে ঢেউ তুলছিল ছন্দাকারে।
রাফি একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ফোনে কার সাথে কি কথা বলছিল সব ভুলে যায়। একসময় ফোনের ওপাশের ব্যক্তি হতাশ হয়ে ফোন কেটে দেয়। রাফি ফোনটা পকেটে রাখে তবে তার নজর আগের জায়গাতেই স্থির থাকে।
ঘন্টাটা বেজে উঠতেই রাফির ধ্যান ভঙ্গ হয়। সাথে সাথে সে বিরক্তও হয় কিছুটা ঘন্টার শব্দে। ঘন্টা বাজার শব্দ শেষ হওয়ার মূহুর্তেই কেউ একজন বলে ওঠে ;
–রিশা তাড়াতাড়ি রুমে চলে আয় ম্যাম আসবে। সাথে সাথেই রাফির নজরের বাহিরে চলে যায় মেয়েটা।
রাফি বুঝতে পারে মেয়েটার নাম রিশা। মনে কনে কয়েকবার সে রিশার নাম আওড়ায়। অতঃপর সে নিজের কাজে চলে যায়।
মুচকি হেসে রাফি ভাবতে থাকে শেষমেশ এক কিশোরীর মায়ায় জড়িয়ে গেলাম কি অদ্ভুত ব্যাপার।
এরপর থেকেই রাফি নানান বাহানা দিয়ে কলেজে আসতে থাকে। তার একটাই লক্ষ্য শুধুমাত্র রিশাকে একবার দেখা। দু একদিন পরপরই সে কলেজে আসতো। কখনো কখনো রিশাকে দেখতো কলেজ মাঠে সবার সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত তো কখনো দেখতো বাচ্চাদের মতো খেলাধুলা দেখতে ব্যস্ত।
রাফির এত ঘন ঘন আনাগোনায় সবার মাঝে সে বেশ পরিচিত হক্যে গেছে। নিশ্চিত ভাবেই রাফির সুদর্শন চেহারা সবাইকে আকর্ষণ করার মতো। কলেজের অনেক মেয়েই রাফির দিকে আকর্ষিত হয়। তবে কেউই সাহস পায়না কিছু বলার।
একসময় রাফি রিশারও নজরে আসে। তবে সে বিশেষ কোনভাবে আকর্ষিত হয়না। সে স্বীকার করে রাফি নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ। তবে তার সেরকম কোন মন মানসিকাতা ছিল না।
রিশা মাঝে মাঝে আড়চোখে রাফির দিকে তাকাতো। কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতো রিশার দিকে। রিশা সে চাহনির মানে প্রথম প্রথম হয়তো বুঝতো না। তবে যখন সে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করে।
রাফিও হাল ছাড়বার পাত্র নয়। রিশাকে তার ভালোবাসার জানান দেয়। প্রায় একবছর পর রিশা রাফির ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দেয়। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু।
রাফি যেহেতু প্রায়ই তাদের কলেজে আসতো তাই রিশার ফ্রেন্ড সার্কেল সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল। তবে রিশার ছোটবেলার এক বন্ধু যখন ট্রান্সফার নিয়ে আসে তখনই ঝামেলা শুরু হয়। সাদাতের সাথে রিশার মেলামেশা রাফির কোনমতেই পছন্দ নয়। রিশাও সে ব্যাপারটা মাথায় রেখেই চলতো। তবুও অবিশ্বাস নামক এক দমকা ঝড় এসে রাফি আর রিশাকে একে অপরের থেকে ছিটকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
ভুল বোঝাবুঝিতে রাগের মাথায় রাফি কিছু শক্ত কথা বলে ফেলে রিশাকে। অভিমানী রিশা সেই কথাগুলোকে অন্তরে গেঁথে নিয়ে দূরে সরে আসে। দুজনেই আজ বিচ্ছেদের অনলে পুড়ছে।
চলবে………