অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৪৮

0
6308

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৪৮

রিশাদ একরাশ বিরক্তি নিয়ে উপরে যায়। রুমের দরজা লক করা দেখে তার মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়।

দরজা নক করতেই রিশা কোনরকমে মাথাটা বের করে রিশাদের দিকে একটা শপিং ব্যাগ ছুড়ে দেয়। রিশাদ শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখতে পায় তার ভেতরে একটা নীল পঞ্জাবি। এই পাঞ্জাবিটা সে কিছুদিন আগেই কিনেছিল এখনো পড়া হয়নি।

–“ভাইয়া তুমি এই পাঞ্জাবিটা পড়ে নাও আমার রুমে গিয়ে। তারপর নিচে গিয়ে আমাদের জন্য ওয়েট করো আমরা আসছি। ”

বলেই রিশা রিশাদকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। রিশাদ মিথিলার উপর রেগে গেলেও নিজেকে সংযত রাখে। সে খুব ভালো করেই জানে এখন রিশা কথা না শুনলে রিশা খুব ঝামেলা পাকাবে পরে অনির সাথে ঘুরতে যাওয়াই মাটি হয়ে যাবে। এই পাগলিকে এখন ক্ষ্যাপানো মানে বিপদ ডেকে আনা।

চোখ মুখ কুঁচকে সে রিশার রুমে গিয়ে পাঞ্জাবিটা পরে রেডি হয়ে নেয়। পাঞ্জাবিটা পড়তে তার মম চাইছিল না। সে চেয়েছিল অনির সাথে পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরতে বেরোবে। বাট কপাল খারাপ। তার বিদেশিনী বউ শাড়িই সামলাতে পারে না।যাই হোক সে পাঞ্জাবিটা পড়ে বেরিয়ে আসে।

রুমের সামনে গিয়ে নক করতেই ভেতর থেকে ভেসে আসে রিশার গলার আওয়াজ।

–“ভাইয়া তোমাকে এখানে আসতে বলিনি। তুমি নিচে গিয়ে গাড়ির কাছে ওয়েট করো আমরা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আসছি।”

রিশার কথায় রিশাদের রাগ হলেও সে মিথিলাকে কিছু না বলে বিড় বিড় করে নিচে চলে যায়।

রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এখন তার মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছেম গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভিতরের দিকে দুপা এগোতেই দেখতে পায় মিথিলা আর রিশা এগিয়ে আসছে।

মিথিলা আর রিশার আড়ালেও আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে। রিশাদ চোখ কুঁচকে তাকায়। সে বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা।

রিশাদের সামনে এসে দুজনে সরে দাঁড়াতেই রিশাদের প্রিয় মানুষটা বেরিয়ে আসে। পরনে তার নীল শাড়ি।শাড়িতে প্রেয়সীর সৌন্দর্য যেন হাজার গুণ বেড়ে গেছে। যদি কোন পরীর সাথে সাক্ষাত হতো তবে সে অবশ্যই তুলনা করে দেখতো কে বেশি মোহনীয়। রিশাদের দৃষ্টিতে তো তার অপরূপা ভালোবাসার মানুষটার যেন সকল সৌন্দর্যের অধিকারিণী। বাকি সব তুচ্ছ,নগণ্য। একবার নয় দুবার নয় বার বার সে তার অপরূপার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। প্রতিটা মূহুর্তে তার প্রেয়সীকে নিত্যনতুন রূপে আবিষ্কার করছে।

অনন্যময়ীর বাহ্যিক সৌন্দর্যে যেন আজ তার নামটাই সার্থকতা ফুটে উঠেছে। সকলের মাঝে সে এক আনকোরা অনন্যময়ী।

–“ওরে ভাইয়া রে!তুই যেভাবে তাকিয়ে আছিস নিজেই নিজের বউয়ের উপর নজর লাগিয়ে দিবি?”(রিশা)

–ওই তুই চুপ থাক।সব সময় একটু বেশি বক বক করিস। যা নিজের কাজে যা।

–হ্যা এখন তো তাই ই বলবি। ছোট বোনদের সামনে এভাবে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছিস ড্যাব ড্যাব করে একটু তো লজ্জা শরম কর।

রিশাদ রিশার দিকে তেড়ে যেতে নিলে রিশা দৌঁড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। মিথিলাও হাসতে হাসতে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

অনি শাড়ির কুচিটা ধরে রিশাদের দিকে এগিয়ে যায়। রিশাদ হাত তার প্রেয়সীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে অনি মুচকি হেসে রিশাদের হাতে হাত রাখে।

অনিকে গাড়িতে বসিয়ে ভালোভাবে শাড়িটা ঠিক করে দরজা লাগিয়ে নিজেও বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। অনি গাড়িতে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের পরিবেশটা উপভোগ করে অন্যদিকে রিশাদ গাড়ি চালানোর ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে তার প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত।

ছুটির দিন হওয়ায় শহরে খুব বেশি ব্যস্ততা নেই তবুও যেটুকু আছে তা চোখে পড়ার মতো। অনি বেশ উৎসাহ নিয়ে সবকিছু উপভোগ করছে। প্রথমবারের মতো সে তার জন্মভূমিকে ঘুরে দেখছে। তবে দিনটা আরো বেশি বিশেষত্ব লাভ করেছে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্য থাকায়।

এক অবিস্মরণীয় বিকেলের সাক্ষী হয় এই নবদম্পতি। রিশাদের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তই বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করেছে।শহর থেকে কিছুটা দূরে চলে আসে তারা। সারা বিকেল একসাথে ঢাকা শহরে চষে বেড়ায় অনি। তাদের এই সুখকর মূহুর্তের সাক্ষী হয় আশে পাশের মানুষজনও।

শহরের কিছু কিছু ঘটনায় অনি মন্ত্রমুগ্ধ হয় তো কিছু কিছু ঘটনায় তার হৃদয়ে ঘন আষাঢ় নামে। রাস্তার মোড়ে বছর ছয়েকের ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে যখন অনির দিকে একগুচ্ছ ফুল এগিয়ে দেয় অনির খুব ভালো লাগে। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয় তার কাছে। তবে যখন সে উপলব্ধি করতে পারে মেয়েটা এই অল্প বয়সে জীবীকা নির্বাহের জন্য ফুল বিক্রেতা হয়ে গেছে ভেবেই অনির মনটা খারাপ হয়ে যায়।

সারা বিকেল ঘোরাঘুরি শেষে একটা রিসোর্ট এর সামনে এসে থামে। অনি ভেবেছিল তারা হয়তো বাসার দিকে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে সে আশেপাশে সব কিছুই অচেনা। সামনেই একটা লেক, লেকের ধারে একটা মাঝারি আকারের তিনটে কুঠুরি। রঙ বেরঙ এর লাইট জ্বলছে। মানুষ জনের আনাগোনাও বেশ কম।

রিশাদ অনিকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। অনি চোখ বুলিয়ে আশে পাশে দেখছে। ভেতরে ঢুকতেই ফর্মাল ড্রসআপের একজন ব্যক্তি তাদের ওয়েল কাম জানায়।

রিশাদের সাথে টুক টাক কথা বলে জানায় তাদের জন্য সবকিছুর এরেঞ্জমেন্ট করা আছে। অনি কিছুই বুঝতে পারছেনা। সবটা যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

রিশাদের হাতে একটা কালো কাপড় চওড়া ফিতে দিয়ে লোকটা মুচকি হেসে চলে যায়। রিশাদ অনির পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ বেঁধে দেয়। অনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলেই রিশাদ তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে;

–“একটু অপেক্ষা করুন ম্যাম।আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”(রিশাদ)

রিশাদ কিছু দূর পর্যন্ত অনিকে নির্দেশনা দিয়ে হেঁটে নিয়ে যায়। আচমকা কোলে তুলে নেয়। অনি যেম আজ একের পর একেক অবাক হচ্ছে।রিশাদের মাথায় যে কি চলছে সে বুঝতেই পারছেনা।

অনি চুপচাপ রিশাদের বুকে মাথা দিয়ে রিশাদকে অনুভব করার চেষ্টা করছে। অনি কেমন যেন মনে হচ্ছে সবটা নড়ছে। রিশাদের কোলেও যেন সে কিছুটা দোল খাচ্ছে। একটু পরেই অনিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় রিশাদ।

অনিকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আস্তে করে ফিতাটা খুলে দেয়। চোখ খুলতে যেয়ে হঠাৎ বেশি আলো চোখে পড়ায় চোখ দুটো কুঞ্চিত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সে পুনরায় চোখ খোলে।প্রথমে কিছুটা ঝাপসা মনে হলেও ধীরে ধীরে সবটা স্পষ্ট হয়ে যায়।

অনি সবটা দেখে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এত সুন্দর ডেকোরেশন। লেকের মাঝ বরাবর একটা প্ল্যাটফর্ম এর উপর অনি রিশাদ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে ফুল দিয়ে সাজানো একটা নৌকা। অনু বুঝতে পারে এই নৌকাতে করেই রিশাদ তাকে কোলে করে এখানে এনেছে।

হোয়াইট লাইটিং আর অর্কিড দিয়ে সাজানো পুরী প্ল্যাটফর্ম। সাদার মাঝে নীল এক জোড়া দম্পতী। রিশাদ একগুচ্ছ সাদা গোলাপ নিয়ে অনির সামনে হাঁটুর উপর দিয়ে ভর দিয়ে বসে তার ভালোবাসার প্রকাশ করে। অনি তার ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফুলগুলো গ্রহণ করে।

রিশাদ তার প্রেয়সীর হাত ধরে পকেট থেকে একটা রিং বের করে পরিয়ে দেয়। অতঃপর সে ভালোবাসার পরশ দেয় তার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করিয়ে। অনি যেন লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে।আজকের সন্ধ্যাটা রিশাদ এত বেশি স্মরণীয় করে রাখবে তা অনির কল্পনাতীত ছিল।

তবে অনির মনে প্রশ্ন জাগছে রিশাদ এত সব কিছু কখন করলো। তাহলে এই কাজের জন্যই সে বেরিয়েছিল অনিকে মিয়ে বেরোনোর আগে। অনি যেন রিশাদের পাগলামি গুলোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।হৃদয় ও মস্তিষ্কে ভালোবাসার আলোড়ন জাগিয়ে দিচ্ছে। যদি সময়টা এখানে থেমে যেত তাহলে মন্দ হতোনা।

রাতে সেখানেই একসাথে ডিনার করে রিশাদ। রিশাদ নিজ হাতে অনিকে খাইয়ে দেয়। তার একটাই উদ্দেশ্য তা হলো অনির সাথে এই ক’টা দিনকে সে বিশেষভাবে কাটাতে চায়।

ডিনার শেষ করে রিশাদ অনিকে নিয়ে বাসায় ফেরে।বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। শায়লা বেগম কিছুটা রেগে যান।তবে মিথিলা আর রিশাদ যখন অসহায় চাহনি করে সরি বলে সাথে সাথে তার রাগ উধাও হয়ে যায়।

অনি রুমে গিয়ে শাড়িটা খুলে ফেলে। একরকম যুদ্ধ করেই সে শাড়ি খোলে। মিথিলা এত বেশি সেফটি পিন লাগিয়ে দিয়েছিল যে অনি খুঁজেই পাচ্ছিল না। রিশাদের সহায়তায় সে শাড়িটা খুলতে সক্ষম হয়।শাড়ি খোলার পর তার জন্যে মনে হচ্ছে বিশাল এক বোঝা নেমে গেছে।

ওয়াশরুম থেক্ব ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে অনি। হাতের কনুই বেয়ে পানির ফোটা টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে। একগুচ্ছ ভেজা চুল অনির মুখ,গলায় লেপ্টে আছে। রিশাদের নজর অনির উপর স্থির।

অনি তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। রিশাদ গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। স্নায়ুগুলো আজ কিছু অচেনা উদ্দীপনার সৃষ্টি করছে রিশাদের মাঝে।অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় কেমন অদ্ভুত ভাবে রিশাদ তাকে দেখছে।রিশাদের এরূপ চাহনির সাথে সে মোটেও পরিচিত নয়।

রিশাদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অনি লাইট অফ করে দেয়। ডিম লাইট টা জ্বালিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই রিশাদের সাথে চোখাচোখি হয়। অনি রিশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করে। প্রেমময় সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে সে আজ রিশাদের চাহনি।

রিশাদ বিছানা থেকে নেমে অনির দিকে এগিয়ে যায়। অনি দু কদম পিছিয়ে আলমারির সাথে পিঠ ঠেকে যায়। রিশাদ দুহাতের মাঝে অনির গালটা ধরে তার প্রিয়তমার কপালে গভীরভাবে ঠোঁটে পরশ বুলিয়ে দেয়। এর আগেও বহুবার অনি রিশাদের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে। তবে আজকের অনুভূতি যেন একেবারেই আনকোরা। অনি দুচোখ বুজে গভীর ভাবে অনুভূতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে যেন। রিশাদ অনির পাপড়ি যুগলে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা অনির ওষ্ঠদ্বয় আঁকড়ে ধরে।

অনির হৃদপিন্ডের গতি যেন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। নীরবতা এতটাই বেশি যে নিজেই মনে হচ্ছে নিজের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছে। ঘটনাগুলো এত দ্রততার সাথে ঘটছে যে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা গুলিয়ে ফেলছে।তার অবচেতন মন বোধ হয় চাইছে হোক না যা হচ্ছে হোক।

রিশাদ কিছুক্ষণ পর অনিকে ছেড়ে দিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে;

–“তোমাকে একটু ভালোবাসার অধিকার দেবে কি আমায় অনন্যময়ী?”

এই প্রশ্নের জবাবে অনি কি উত্তর দেবে তা তার জানা নেই। এই সময় মস্তিষ্ক তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেনা। শুধু ইচ্ছে হচ্ছে রিশাদের ভালোবাসায় নতুন করে সিক্ত হতে। রিশাদের এমন ভালোবাসার আহ্বান ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য তার নেই। খুব বাজে রকমের শব্দহীনতায় ভুগছে অনি। নীরবে সে রিশাদের ডাকে সাড়া দেয়।

অনি রিশাদ পাড়ি জমায় এক নতুন ভালোবাসার জগতে। দুজনেই কিছু আনকোরা অনুভূতি অনুভব করে। মনের আদান প্রদান অনেক আগেই হয়ে গেছে আজ অস্তিত্বেরও আদান প্রদান হয়ে গেল। অনি রিশাদের সম্পর্ক যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে আজ।

স্বামী স্ত্রীর মাঝে পবিত্র হালাল সম্পর্ক স্থাপনের আত্মতৃপ্তি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি গুলোর মধ্যে অন্যতম। যা হালাল উপায়ে লাভ করার মাঝেই সার্থকতা।সম্পর্কের দৃঢ়তা বাড়াতে এর জুড়ি মেলা ভার।

সুখকর মূহুর্তগুলো অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হলেও এর রেশটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী মানুষকে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগা পেয়ে নিজেকে রিশাদের বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করে অনি। বিশেষ লজ্জা কাজ করছে আজ তার মধ্যে। আজকের প্রভাত টা কেমন অন্যরকম লাগছে। আসলে প্রভাতের মাঝে কোন পরিবর্তন আসেনি এসেছে তাদের সম্পর্কের মাঝে। তাই বোধ হয় আজ সব কিছুই অন্যরকম লাগছে তার কাছে।

অনি নড়েচড়ে ওঠায় রিশাদেরও ঘুমটা ভেঙে যায়। ভোরবেলায় সে তার ঘুম ঘুম চোখে প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে থাকে।
নীরবতায় কিছু সময় কাটানোর পর অনি বলে ওঠে;

–“রিশাদ ছাড়ুন এখন উঠতে হবে। ভোর হয়ে আসছে গোসল দিয়ে নামাজ পড়তে হবে। এখন না উঠলে কিন্তু নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে যাবে।”

–“প্লিজ অনন্যময়ী আর কিছুক্ষণ থাকো। এরপর উঠো।”

–উঁহু একদম না। আপনি থাকুন আমি গোসল করে আসছি।

রিশাদ অনিকে যেতে দেয়না।অনি উঠতে নিলেই রিশাদ আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অনিও হার মেনে ওভাবেই শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর রিশাদের হাতের বাঁধনে একটু আলগা হতেই অনি ফট করে বিছানা থেকে নেমে যায়। রিশাদ ধরার আগেই সে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

গোসল করে অযু করে বেরিয়ে আসে অনি। রিশাদ এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। অনি জোর করে রিশাদকে গোসল করতে পাঠায়। রিশাদ নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনির ধমক খেয়ে গোসল করে আসে।

রিশাদ আর মসজিদে যায়না। অনি রিশাদ একসাথেই ফজরের সালাত আদায় করে নেয়। ভোরের আলো ফূটে গেছে। চারদিকে পাখিরাও তাদের নিত্যদিনের কাজ হিসেবে কিচির মিচির করতে শুরু করে দিয়েছে।

অনি নামাজ শেষ করে একটা চিরুনি নিয়ে বিছানায় বসে। চুলগুলো খুলে দিতেই ফ্লোরে পড়ে যায়। অনির চুল রিশাদের আকর্ষণের একটার অন্যতম বস্তু। তাই সে এক ধ্যানে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।

অনির ভেজা চুল গুলো দিয়ে পানি পড়ছে টপ টপ করে। তোয়ালে দিয়ে একটু একটু করে চুল মুছতে শুরু করে।এটা যেন রীতিমতো তার কাছে এক বিশাল যুদ্ধ। এবাড়িতে এসে প্রায় প্রতিদিনই তাকে এই যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়।

অনির চুল মুছতে মুছতে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। রিশাদ অনির পাশে গিয়ে বসে। অনির হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে সে খুব সুন্দর করে চুল মুছতে শুরু করে দেয়। অনি তা দেখে মুচকি হাসে।

খুব যত্ন নিয়ে চুল মুছে দেয় অনি। চিরুনি টা নিয়ে রিশাদ অনির চুলগুলো চিরুনি করে দেয়।অনি ব্যথা পাবে ভেবে সে খুব সাবধানে চুলের জট খুলে দেয়। খুব আগ্রহ নিয়ে সে অনির চুল আচড়ে দেয়। আর অনি মুগ্ধ হয়ে রিশাদকে দেখছে। অনির ছোটখাটো বিষয়গুলো নিয়েও কতটা যত্নশীল সে। অনির সাথে টুক টাক গল্প করে রিশাদ।

প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। রিশাদ আজ একটু সময় নিয়েই রেডি হয়। অফিসে যাওয়ার আজ তার বিশেষ কোন তাড়া নেই। অনি রিশাদের জিনিসগুলো সব গুছিয়ে রেখেছিল। রিশাদ রেডি হয়ে নিচে নামে। অনি ঘর গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

রায়হান সাহেব ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলেন পাশাপাশি পেপার পড়ছিলেন। রিশাদ একটা চেয়ার টেনে পাশে বসে।

–“গুড মর্নিং বাবা।”

–“গুড মর্নিং ডিয়ার সান।”

ফ্রুট বোল থেকে একটা আপেল খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করে তার বাবার সাথে এরপর তারা একসাথে সকালের নাস্তা করে নেয়। রায়হান সাহেবের তাড়া থাকায় তিনি রিশাদের আগেই বেরিয়ে যান। রিশাদ ব্রেকফাস্ট করে উপরে যায়।

রিশাদ উপরে যাওয়ার সময় শায়লা বেগম তার হাতে অনির জন্য এক কাপ কফি পাঠায়। রিশাদ রুমে গিয়ে দেখতে পায় অনি বিছানার চাদর চেঞ্জ করে বালিশের কভার লাগাচ্ছিল বিছানায় বসে।

–“এই নিন ম্যাম আপনার কফি।”

কফি দেখে অনির মনটা ভালো হয়ে যায়। মনে মনে ভাবতে থাকে শায়লা বেগমের কথা। সবার দিকে নজর আছে তার। মা রা হয়তো এমনই হয়।

অনির হাত বন্ধ থাকায় রিশাদকে কফিটা পাশের টেবিলে রাখতে বলে। রিশাদ টেবিলে রাখতে নিয়ে আবার ফিরে আসে। অনির সামনে বসে অনির সামনে কফির মগ তুলে ধরে। অনি মুচকি হেসে কফির মগে চুমুক দেয়।

অনির সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে রিশাদ অনিকে কফিটা খাইয়ে দেয়। অনিও তার হাতের কাজ শেষ করে নেয়। রিশাদ অনিকে বিদায় জানিয়ে অফিসের জন্য রওনা হয়।

শায়লা বেগমের ডাক শুনে অনি নিচে নামে। পরিবারের বাকি সদস্যরা সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নেয়। রিশা আর মিথিলা ঠিক মতো খেতে পারছেনা পরীক্ষার টেনশনে।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে অনি রুমে যায়। এখন তার প্রথম কাজ হলো জাহানারা বেগমের সাথে কথা বলা।

ফোনটা বের করে জাহানারা বেগমের নম্বরে ডায়াল করে। প্রথমবার রিং হতেই কল রিসিভ করেন জাহানারা বেগম যেন তিনি অনির কলের অপেক্ষাতেই ছিলেন।

অনি তার দিদার সাথে কুশল বিনিময় করে। জাহানারা বেগমের সাথে টুক টাক কথা বলে। তিনি অনিকে জানান আজ একটু বাইরে যাবেন শপিং করতে। বাসায় বসে বসে বোর হবে ভেবে অনিও তার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। জাহানারা বেগম অনির কথায় কোন আপত্তি করেন না।

অনি শায়লা বেগমের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জাহানারা বেগমের সাথে বেরিয়ে যায়।লাক্সারিয়াস একটা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি থামে।বেশ ভালোই মনে হচ্ছে শপিং মলটাকে। অনি এন্ট্রেন্সে দাঁড়িয়ে শপিং মলটায় চোখ বুলিয়ে নেয়। বেশ আভিজাত্যপূর্ণ বলে মনে হয় তার কাছে।

এত বছরের চেনা পরিচিত শহরটা আজ বড্ড অচেনা মনে হয় জাহানারা বেগমের কাছে। এই শহরেই তো জীবনের ভালো মন্দ মেশানো অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে আজ সবটাই বড্ড অচেনা। দীর্ঘ এক হতাশা বেরিয়ে আসে।

অনিকে নিয়ে শপিং মলে ঢোকেন জাহানারা বেগম। ঘুরে ঘুরে তার প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো কিনছিল। কিডস জোনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একজোড়া কোমল হাত এসে অনির হাত আঁকড়ে ধরে। অনি পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় তার চিরচেনা সেই ভুবন ভোলানো হাসি। সেই হাসির অধিকারিণী আর কেউ নয়।

“গুনগুন”বলেই অনি নিচু হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। গুনগুনও আনন্দে তার পরী আন্টির গলা জড়িয়ে ধরে।

গুনগুনকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় অনি। গুনগুন অভিমানী স্বরে বলে; “পরী আন্টি তুমি তো আমায় ভুলেই গেছো?”

অনি কান ধরে সরি বলে তার এঞ্জেলের অভিমান ভাঙায়। নিরা, কাব্য,রেহানা এসে উপস্থিত হয়। পরী আন্টিকে দেখে সেই নিরার হাত ছাড়িয়ে দৌঁড়ে চলে আসে।

অনি সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। তবে অবাক হয় সে নিরা আর কাব্যকে দেখে।সে বুঝতে পারছে না এনাকে কাব্য বলবে না এরিক?অনির মনে প্রশ্ন জাগে তবে সে এই মূহুর্তে নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখে।

জাহানারা বেগমের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় অনি। অনির কাছে জাহানারা প্রত্যেকের কথাই শুনেছে। তাদের দেখার কৌতূহলও ছিল মনে মনে আজ সেটাও পূরন হয়ে গেল।

তাদের কথাবার্তা চলছিল।এর মাঝে কয়েকটা ভারী শপিং ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসে হিমাদ্রী।

–তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছো আর আমি খুঁজে খুঁজে মরছি। প্লিজ বাসায় চলো আমি আর পারছিনা।”

–উফফ চাচ্চু তুমি কি অন্ধ হয়ে গেলে?আমরা তো এখানে পরী আন্টির সাথে কথা বলছি।

পরী আন্টি কথাটা হিমাদ্রীর কানে জোরালো ভাবে লাগে। এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি। আজ অনেকদিন পর সে তার প্রিয়মুখটাকে দেখতে পারছে।

বিগত দিনগুলোতে সে কাব্যকে নিয়ে এতটা ব্যস্ত ছিল যে সে তার অপ্রকাশিত ভালোবাসা অনন্যময়ীর খবর নেয়ার সুযোগই পায়নি। এরিক নামক কাব্যর সত্যিটা সবার সামনে আনতে যেয়ে তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তবে দিনশেষে সে তার ভাইকে পেয়েছে এটাই কম কিসে। অনন্যময়ীর থেকে দূরে থাকলেও তার দিনের শেষটাও অনন্যময়ী নামক কল্পনায় আর শুরুটাও।

ভদ্রতার খাতিরে কুশল বিনিময় করে হিমাদ্রীর সাথে। হিমাদ্রীও টুক টাক কথা বলে। অন্যদিকে নিরা আর রেহানা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। জাহানারার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগে বিষয়টা। তবে এবিষয়ে সে বেশি মাথা ঘামায় না।

জাহানারা বেগম চৌধুরী পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ জানায়। রেহানাও বিনা বাক্য ব্যয় করে সাদরে গ্রহণ করেন। বিষয়টা জাহানারা বেগম কিভাবে নেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনিও বেশ খুশি।

চৌধুরী পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দেন। জাহানারা বেগম অনিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ির দিকে যান।

অনি ফ্রেশ হয়ে পরিবারের সবার সাথে লাঞ্চ করে নেয়। রিশাদের সাথে একবার কথা হয়েছিল তার। রিশাদের একটা মিটিং থাকায় সে আর তাকে কল দেয়না। বিছানায় বসে জিরিয়ে নেয়। বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রাভাব চলে আসে। অনি বিছানায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুমন্ত অনির অবচেতন মস্তিষ্কে চেঁচামেচির আওয়াজ পৌঁছেও যেন পৌঁছাচ্ছে না। ঘুম এতটাই কাবু করে ফেলেছে তাকে যে সে উঠতেই পারছে না। আকস্মিক জোরে শব্দ হওয়ায় অনি ধড়ফড় করে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই সে এক দফা অবাক হয়।

চলবে….

আসসালামু আলাইকুম?
আজকের পর্বটা কেমন কেমন মনে হচ্ছে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here