অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৪৭

0
5932

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৪৭

অনি রিশাদের সম্পর্কটা যত গভীরতা লাভ করছে অনির ইংল্যান্ডে ফেরার দিনও ততই যেন এগিয়ে আসছে।ফিরে যাবার চিন্তায় আনন্দগুলোকেও যেন ঠিকমতো উপভোগ পারছে না সে। শুধু যে সে উপভোগ করতে পারছে না তা নয়। পরিবারের সবাই যেন অনির চলে যাবার কথা ভাবলেই কেমন মুছড়ে যায়। শায়লা বেগম এবিষয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। এবাড়িতে আসার পর শায়লা বেগম তাকে নিজের সন্তানের মতো আদরস্নেহ দিয়েছেন। তারা যে শ্বাশুড়ি বউমা তা বাইরের মানুষের কাছে মনেই হয়না। অচেনা অজানা কোন ব্যক্তি আকস্মিকভাবে তাদের মধ্যে শ্বাশুড়ি বউমা সম্পর্ক ঠাওর করতে না পারলে তার অবচেতন মস্তিষ্ক ঠিকি ধারণা করবে যে তারা নিশ্চিত মা মেয়ে। তাই তার মনখারাপটাও যেন আরো বেশি।

জাহানারা বেগম অনিত ফিরে যাবার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। শায়লা বেগম ও জাহানারা বেগম দুজনেরই ইচ্ছে ছিল রিশাদ যেন অনিকে ইংল্যান্ডে রেখে আসে। সবেমাত্র রিশাদ নতুন একটা প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছে। বিয়ে,অসুস্থতা,মিথিলার অসুস্থতাই ইতিমধ্যে অনেক বেশি সময় সে তার কাজ থেকে দূরে সরে ছিল। বিধায় তার পক্ষে এই মূহুর্তে অনির সাথে যাওয়া সম্ভব নয়। এবিষয়টা নিয়ে রিশাদেরও বেশ মন খারাপ। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় মন খারাপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অনি পরিস্থিতির গুরুত্বটা বুঝলেও তারও কিঞ্চিত মন খারাপ। কত দিন পর সে ফিরে আসতে পারবে তা তার জানা নেই। নিজের কাছের মানুষদের থেকে দূরে থাকার কষ্টটা সে আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পারে তবে এবারের ক্ষেত্রে আরো নতুন সম্পর্ক সংযোজন ঘটেছে বিধায় কষ্টের মাঝেও কিছু নতুনত্ব রয়েছে। তবে এই নতুন কষ্টগুলো তাকে একটু বেশিই বিচলিত করে তুলছে।

আজ শুক্রবার। মিথিলা আর রিশার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আজ তারা তাদের স্বপ্ন পূরণের খুব নিকটে এসে পৌঁছে গেছে। এসে গেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যার জন্য এতদিন ধরে দিন রাত পরিশ্রম করে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা।

ভোরবেলা উঠে নামাজ ফজরের নামাজ পড়ে নেয় মিথিলা। রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিল।আজ রাতে একটু ভালো ঘুম হওয়ার দরকার ছিল যাতে মাথাটা ফ্রেশ থাকে। মিথিলা নামাজ পড়া শেষ করে রিশার রুমের দিকে যায়। মিথিলা খুব ভালো করেই জানে রিশা আগের রাতে পুরো সিলেবসাটায় একটু চোখ না বুলালে হয় না। তাই সে নিশ্চিত আজ রাতেও রাত জেগে পড়াশোনা করে ভোরবেলার আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটাক্ব নিয়ে আর পারা যায়না। পরীক্ষার আগের রাতে এসে এমন তাড়াহুড়ো করে। মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে রিশার রুমে চলে যায়।

রিশা এখনো কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। বিছানায় বইখাতা গুলো এখনো ছড়ানো ছিটানো আছে। এক রাতেই মনে হচ্ছে সব উদ্ধার করে দিয়েছে। মিথিলা রিশাকে দেখে হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করে কপালে হাত দেয়।

রিশার মাথার কাছে গিয়ে কয়েকবার ডাক দেয়।কিন্তু তার কোন সাড়াশব্দ পায়না। মিথিলা এবার কাথা ধরে টান দিয়ে রিশা ঘুমের ঘোরেই শক্ত করে কাথা চেপে ধরে। মিথিলা কিছুটা রাগত স্বরে ধমক দিয়ে রিশাকে উঠায়। রিশা চোখমুখ কুঁচকে মিথিলার দিকে তাকায়। তার মন চাচ্ছে মিথিলা কে একেবারে খেয়ে ফেলতে।

–আর পাঁচটা মিনিগ ঘুমোতে দিলে কি হতো? এখনো তো অনেক সময় আছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে কথা গুলো বলে রিশা।

–আর এক মিনিটও না।এক্ষুণি যা ফ্রেশ হয়ে অযু করে আয়। নামাজ পড়তে হবে সকাল হয়ে গেল বলে। দুহাত ভাজ করে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বলে মিথিলা।

রিশা আর কোন কথা না বাড়িয়ে হতাশ হয়ে ঢুলতে ঢুলতে ওয়াশরুমে চলে যায়। মনে মনে মিথিলার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিচ্ছে। মিথিলা জানে রিশা এখন তাকে মনে মনে ঝেরে দিচ্ছে। রিশার উদ্ভট কথাগুলো ভাবতেই তার খুব হাসি পায়।

রিশা ফ্রেশ হয়ে অযু করে ফজরের সালাত আদায় করে নেয়। বেশিরভাগ দিনই মিথিলায় তাকে এসে ডেকে দেয়। কখনো কখনো শায়লা বেগম বা রায়হান সাহেব এসে তাকে ডেকে দেয়।

নামাজ শেষ করে রিশা বই খুলে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়। পুরো সিলেবাসে সে চোখ বুলাতে পারেনা। শুধু আগের রাতে পুরো সিলেবাসটা কভার করা সম্ভবও নয়। রিশার কেমন কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব গুলিয়ে যাচ্ছে কিচ্ছু মনে পড়ছে না। অসহায় মুখ করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে থাকে।

–আরে ধুর বোকা এত টেনশন করছিস কেন?দেখবি সব পারবি। এখন এত প্যানিক করিস না এক্সামটা কিন্তু খারাপ হবে।আরো নানান কথা বলে রিশাকে আত্মবিশ্বাস জোগায় মিথিলা। মিথিলার তবুও কেমন ভয় ভয় লাগছে।

মিথিলা রিশাকে এতো ভালোভাবে বোঝালেও তার নিজের মধ্য্র যে কিরকম টেনশন হচ্ছে তা শুধু সে নিজেই বুঝতে পারছে। মনে মনে শুধু সে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে যেন আজকের দিনটা তার আর রিশার ভালোভাবে পার হয়ে যায়।

সকাল বেলা শায়লা বেগম রিশা আর মিথিলাকে পাশে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেন। টেনশনে তাদের কারোরই খেতে মন চাইছিল না তবুও শায়লা বেগম তাদের জোর করে খাইয়ে দেন।

১০টা থেকে এক্সাম শুরু হবে। সাড়ে ন’টার মধ্যে এক্সাম ভেন্যুতে পৌঁছাতে হবে।এক্সাম ভেন্যু একট্য দূরে হওয়ায় সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। শায়লা বেগম,সাবরিনা আর রায়হান সাহেবকে সালাম করে তার থেকে আশীর্বাদ নিয়ে নেয় দুজনেই। অনি দুজনকেই পরীক্ষার জন্য শুভ কামনা জানায়। রিশাদ মিথিলা আর রিশাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

মিথিলা এক্সাম হলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই দূরে কাউকে দেখে তার ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিত হাসি ফুটে ওঠে। তার আত্মবিশ্বাস যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। চশমা পড়ে ফর্মাল ড্রেস আপে একজন সুদর্শন যুবক তাদের দিকে এগিয়ে আসে।

রিশাফ গাড়ি থেকে নেমেই সামনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। নামটা প্রথমে তার মনে হচ্ছিল না। ব্রেইনে একটু চাপ দিতে তার মনে পড়ে যায় “ইভান”।

–হেই!ডক্টর ইভান,রাইট?”(রিশাদ)

–ইয়েস।তুমি রিশাদ তাইনা?”(ইভান)

–“হুম।তো কি খবর? কেমন আছো?”(রিশাদ)

–“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”(ইভান)

–“তো এদিকে হঠাৎ কি মনে করে?তোমার কেউ এক্সাম দিচ্ছে নাকি?”(রিশাদ)

–“না সেরকম কেউ নেই। এমনিই আরকি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।কিছুটা আমতা আমতা করে কথাগুলো বলে ইভান।আড়চোখে সে বারবার মিথিলার দিকে তাকাচ্ছিল। মিথিলা ইভানের সাথে চোখাচোখি হতেই তার চোখ সরিয়ে নেয়। এসব কিছুই রিশাদের চোখ এড়ায় না। সে ভ্রু বাঁকিয়ে একবার ইভান আর মিথিলার দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। রিশাদের কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে। তবে এখন সে বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায় না। রিশা আর মিথিলাকে অল দ্যা বেস্ট বলে হলে ঢুকিয়ে দেয়।

ভালোভাবে পরীক্ষা শেষ করে রিশাদ মিথিলা আর রিশাকে বাড়ি নিয়ে যায়। যতক্ষণ পরীক্ষা চলছিল রিশাদের যেন টেনশনে মাথা ঘুরছিল।রিশাদের চেয়েও ইভানের অবস্থাটা আরো বেশি শোচনীয় ছিল। টেনশনে সে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছিল না। রিশাদের কিছুটা খটকা লাগে। তবে সে এখন এ বিষয়ে ভাবতে চায়না। আগে এক্সামটা ভালোই ভালোই শেষ হোক তারপর এ বিষয়ে দেখা যাবে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে যোহরের নামাজের আযান দিয়ে দেয়। রিশাদ গোসল সেরে নেয়। অনি রিশাদের কাপড় সব আগেই গুছিয়ে রেখেছিল। রিশাদ গোসল সেরে পাঞ্জাবি পড়ে বেরিয়ে যায় মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। নিচে নেমে রায়হান সাহেব আর রিশাদ একসাথে বেরিয়ে যায়।

রিশাদ বেরিয়ে যাবার পর অনি ঘরটা গুছিয়ে বিছানা ঝেড়ে রুমটা একটু ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়ে একবারে গোসল করে নেয়। গোসল শেষ করে সে যোহরের সালাত আদায় করে নেয়।

রুমে বসে বোর হচ্ছে অনি।মিথিলা আর রিশাও বেশ ক্লান্ত নিজেদের রুমে রেস্ট নিচ্ছে। শায়লা বেগম ও রান্না শেষ করে সবেমাত্র গোসলে গেছেন। অনি বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চোখ বুলায়।

দুপুরের খা খা রোদ্দুরে। দু একজন মানুষকে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় ব্যস্ততা থাকলেও অন্যান্য দিনগুলোর চেয়ে কম। দূর থেকে কিছু কিশোরের চিল্লানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। খেলার মাঠটায় তারা ফুটবল খেলছে।খোলা আকাশটা আজ স্বচ্ছ নীল,উন্মুক্ত। কয়েকটা অচেনা পাখি গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। এক ধ্যানে সেদিকে চেয়ে রয়।

একজোড়া হাত এসে অনির দুচোখ ঢেকে দেয়। অনির চোখের সামনে যেন সবটা অন্ধকার হয়ে আসে। কিছুটা অবাক হয়ে সে হাতজোড়া নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে। দুকদম পিছিয়ে এসে সে রিশাদের বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে দিয়ে শরীরের ভার রিশাদের উপর ছেড়ে দেয়। তার ঠোঁটজুড়ে আত্মতৃপ্তির অম্লান হাসি।

রিশাদ অনির দুচোখ ছেড়ে দিয়ে তার প্রিয়তমাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে। অনি তার বিশ্বস্ত হাতদুটোর উপর নিজের হাত রাখতেই রিশাদ অনিকে শক্ত করে ধরে হাওয়া ভাসিয়ে ঘোরায়। অনি আবেশে দুচোখ বুঝিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকে। প্রিয়তমার প্রশান্তিময় হাসিতে রিশাদের সারা শরীর জুড়ে শিহরণ জাগে। নতুন করে বার বার সে যেন তার অনন্যময়ীর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। অনন্যময়ীর সাথা কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত তার মাঝে নতুন নতুন অনুভূতির উদ্ভব ঘটাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর রিশাদ অনিকে নামিয়ে দেয়। অনি রিশাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দেয়। রিশাদ বুকে হাত দিয়ে দুচোখ বুজে বলে;

–“হ্যায় ম্যা তো মার যা ভা!!”(রিশাদ)

রিশাদের কথায় অনি আলতো করে রিশাদের বুকে ধাক্কা দেয়। রিশাদ খপ করে অনির হাতটা চেপে ধরে। আরেক হাত পকেটে ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করে অনির হাতের মুঠোয় ভরে দেয় রিশাদ।

অনি কৌতূহল নিয়ে হাতে থাকা জিনিসটার দিকে তাকায়।এই জিনিসটা সে অনেকবার দেখেছে তবে নামটা ঠিক মনে করতে পারছে না। সম্ভবত কোন খাবার জিনিস হবে। লালচে রং এর দেখতে গোল গোল প্যাচানো। রিশাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রিশাদ অনির এই চাহনির মাঝে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়।

–“এটা জিলাপি। আপনি আগে কখনো খেয়েছেন?”(রিশাদ)

অনির মনে পড়ে যায় এটা সে অনেকবার দেখেছে ছবিতে তবে কখনো খাওয়া হয়নি অনির। নামটাও সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।

–“না আগে কখনো খাইনি বাট দেখেছি। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।”(অনি)

–“হুম বুঝতে পেরেছি। খেয়ে দেখুন খুব ভালো লাগবে খেতে।”(রিশাদ)

অনি রিশাদের কথা শুনে কামড় দিয়ে মুখে নেয়। বেশ মিষ্টি আর খুব রসালো। বেশ ভালোই লাগে অনির খেতে। খেতে খেতে অনি বলে;

–“আপনি কোথায় পেলেন এটা?”(অনি)

–“মসজিদে দিয়েছিল। আমি ভাবলাম আপনার জন্য নিয়ে আসি।আমাদের মসজিদে প্রায় দিনই কেউ না কেউ দেয়।”(রিশাদ)

–“ওহ আচ্ছা।কিন্তু কেম দেয়?”(অনি)

–“কেউ মিলাদ পড়ালে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য দিতে হয়। কেউ জিলাপি দেয়,কেউ বাতাসা আরো অনেক কিছু।”(রিশাদ)

–“ওহ আচ্ছা।”(অনি) ব্যাপারটা অনির কাছে বেশ ভালো লাগে। রিশাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে অনি জিলাপি শেষ করে।

শায়লা বেগমের ডাক শুনে অনি রিশাদ নিচে নামে। পুরো পরিবার একসাথে লাঞ্চ করতে বসে। মিথিলা আর রিশাকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। পরিবেশ হালকা করতে রিশাদ অযথা রিশার মাথায় আস্তে করে থাপ্পড় মারে। মিথিলা তিড়িং বিড়িং করে রেগে যায়। রিশাদ আর রিশার চিরায়ত ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। শায়লা বেগম আর সাবরিনা সবাইকে খাবার পরিবেশন করে নিজেরাও বসে পড়েন। হাসি মজায় একসাথে সবাই খাবার খায়।

লাঞ্চ শেষ করে যে যাফ রুমে যায় একটু জিরিয়ে নিতে। রিশাদ রুমে গিয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। ম্যাগাজিনের একটা পাতায় রিশাদের চোখ আটকে যায়। একজোড়া হাস্যজ্জ্বল দম্পতির ছবি দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির পরনে শাড়ি আর ছেলেটির পরনে পাঞ্জাবি। তাদের ভালোবাসার এক অনন্য মূহুর্ত ক্যামেরায় বন্দী করে ছাপানো হয়েছে।

অনি রিশাদের পাশে এসে বসে। রিশাদ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। সে ভাবছে অনি তো আর ক’টা দিন তার সাথে আছে। এই ক’টা দিনের প্রতিটি মূহুর্তকে সে স্মরণীয় করে রাখতে চায়।

–“আচ্ছা অনন্যময়ী, আপনার ফ্লাইট কবে?”(রিশাদ)

ফ্লাইটের কথা শুনে অনির চোখ দুটো রিশাদের উপর স্থির হয়ে যায়। খুব অস্বাভাবিক অনুভূতি হচ্ছে তার। রিশাদের কাছ থেকে এত দূরে থাকতে হবে ভাবলেই কেমন ছন্নছাড়া মনে হতে নিজেকে।রিশাদ তার অস্তিত্বে মিশে গেছে,তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রিশাদের বিচরণ।

অনি রিশাদের গা ঘেঁষে বসে তার বাহু চেপে ধরে কাঁধে মাথা রেখে ম্লান গলায় বলে;

–“আর পাঁচ দিন।”(অনি)

অনির মলিন কণ্ঠস্বর শুনেই রিশাদ উপলব্ধি করতে পারে অনির মনটা খারাপ হয়ে গেছে। রিশাদ অনির মন খারাপের কারণ উপলব্ধি করত্ব যেয়ে বুঝতে পারে এটা তারও মন খারাপের একটা বড় কারণ। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রিশাদ বলে;

–“অনন্যময়ী!আজকে আমার সাথে ঘুরতে যাবেন?আপনার তো ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখা হয়নি এখনো। চলুন আজ আপনাকে আমার শহর ঘুরে দেখাবো।”(রিশাদ)

–“এখন যাবেন?”(অনি)

–“হ্যা এখনই।মানুষ তো বিকেলবেলাই ঘুরতে যায় অনন্যময়ী। দেখবের বিকেলের ঢাকা শহরের প্রেমে পড়ে যাবেন। আর যেতে মম চাইবে না এখান থেকে।”(রিশাদ)

–“আপনার প্রেমে তো অনেক আগেই পড়েছি। আজ তাহলে নতুন করে আপনার শহরের প্রেমে পড়ে যাই।”(অনি)

রিশাদ অনির কথা মুচকি হাসে।

–“জি মহারানী। তবে আপনি যদি শাড়ি পরে আপনার এই প্রেমিকের ইচ্ছাটা পূরণ করতেন তাহলে জীবন ধন্য হয়ে যেত।”(রিশাদ)

শাড়ির কথা শুনে অনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কি যুদ্ধ করে সে শাড়ি পড়ে এবাড়িতে ক’টা দিন কাটিয়েছে তা ভাবলেই অনির কেমন অসহায় বোধ হয়। আবার সেই শাড়ি পড়তে হবে!কি বিপদ রে বাবা!মনে মনে বিড় বিড় করতে থাকে অনি।

রিশাদ অনির দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। রিশাদ খুব ভালো করেই জানে অনি একেবারেই শাড়ি পড়তে পারেনা। প্রথম দিকে যখন অনি শাড়ি পড়তো তাকে দেখতে একদম নতুন বউয়ের মতো মনে হতো। রিশাদের মনে পড়ে যায় সেই দিন গুলোর কথা।

অনি যখন শাড়ির আচল কোমড়ে গুঁজে ঘরের টুক টাক কাজ করতো তাকে দেখে যেন মনে হতো একেবারে পাক্কা গৃহিণী। রিশাদ অনির নজর লুকিয়ে অনির দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। সামনে আসা চুলগুলো কাজে ফাঁকেফাঁকে কানের পিঠে গুঁজে দিলে বার বার তা বেরিয়ে যেত। একসময় ব্যর্থ হয়ে সে আর গুঁজতো না। একগুচ্ছ চুল তার চোখে মুখে ঢেউ খেলে বেড়াতো। অনির এই মারাত্মক চাহনি গুলোই রিশাদের নজর কেড়েছে। হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গেছে। নিজের অজান্তেই সে তার প্রিয়তমার প্রেমে পড়েছে। একবার নয় বার বার।

–“রিশাদ!”(অনি)

অনির কথা ধ্যান ভাঙে রিশাদের। রিশাদ কিছুটা থতমত খেয়ে বলেঃ

–হ্যা বলুন।

–“কোথায় হারিয়ে গেছেন আপনি?আমি কিছু বলছি শুনুন।(অনি)

–কই না তো।আপনি কি যেন বলছিলেন বলুন।(রিশাদ)

অনি কিছুটা অসহায় মুখ করে বলে;

–শাড়ি পরতেই হবে?অন্যকিছু পরলে হবে না? আসলে শাড়ির কথা ভাবলেই আমার কেমন কেমন লাগে?মনে হয় এই বুঝি খুলে গেলো?”(অনি)

অনির কথায় রিশাদের কিছুটা হাসি পেলেও সে হাসি চেপে রেখে বলে;

–আচ্ছা ঠিক আছে আপনার যেটা ভালো লাগে আপনি সেটাই পরুন। (রিশাদ)

রিশাদের কথায় অনির মনটা খুশি হয়ে যায়। সে ভেবেছিল রিশাদ হয়তো তাকে জোর করবে।কিন্তু না রিশাদ অনির ইচ্ছের গুরুত্বটা দিয়েছে। রিশাদের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।

রিশাদের একটা ফোন আসায় অনি আর রিশাদের কথোপকথনের বিরতি ঘটে। রিশাদ কল রিসিভ করে কথা বলে।

–“অনি আমার একটু একটা কাজ আছে। বেশি না তিরিশ মিনিটের মতো লাগবে।আমি এক্ষুণি রেডি হয়ে বেরোচ্ছি।আপনি রেডি হয়ে থাকবেন।আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো। প্লিজ খুব ইম্পরট্যান্ট কাজ। তিরিশ মিনিটের বেশি এক সেকেন্ডও লাগবে না।”(রিশাদ)

–আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।আপনি যান।কিন্তু লেট করবেন না।”(অনি)

–ওকে মহারানী।(রিশাদ)

রিশাদকে অনি ওয়ারড্রব শার্ট বের করে দেয়। রিশাদ একটু ফ্রেশ হয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়।

বেরিয়ে যাওয়ার দুমিনিট পরেই সে আবার রুমে ঢোকে। অনি ড্রেসিং টেবিলের জিনিসগুলো ঠিক করে রাখছিল। রিশাদ পেছন থেকে এসে হঠাৎ করে এসে অনির কোমড় চেপে ধরে।

রিশাদের এই কাজগুলোতে অনি এখন আর আতকে ওঠে না। কেননা এগুলো এখন তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আয়নার ভেতর থেকে অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। রিশাদ অনির কানে কানে ফিস ফিস করে বলে;

–আমি আম্মুকে বলে যাচ্ছি আমরা একসাথে বেরোবো।আমার লজ্জাবতী মহারানী তো লজ্জায় কিছু বলতেই পারবে না। আর কোন হেল্প লাগলে রিশা বা মিথিলাকে ডেকে নেবেন। আমি আসছি।” বলেই রিশাদ অনির গালে ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করিয়ে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

অনিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিশাদ রুম থেকে বেরিয়ে শায়লা বেগমের রুমের দিকে যায়। শায়লা বেগমকে তাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে বেশ খুশিই হন। অনি রিশাদের সম্পর্কের উন্নতি দেখে শায়লা বেগম খুবই খুশি হন। তার ছেলেমেয়েরা সুখে আছে ভাবলেই কেমন প্রশান্তি অনুভব হয় তার। শায়লা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিশাদ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়। একটুও দেরি করা যাবে না। কাজটা ইম্পরট্যান্ট না হলে সে যেতই না। কি আর করার তাকে যেতেই হবে।

অনি টুকটাক কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়ারড্রব খুলে জামাগুলো একটা একটা করে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। বুঝে উঠতে পারছে না কোন ড্রেসটা পড়বে। জামাগুলো উলটে পালটে দেখতে দেখতে ওয়ারড্রবের কর্নারের দিকে নীল রং এর একটা শাড়ির উপর চোখ আটকে যায় অনির। শাড়িটা বের করে গায়ের উপর মেলে ধরে আয়নায় দেখে। বেশ ভালোই মানিয়েছে। কিন্তু এই শাড়ি সে পড়বে কিভাবে।ভাবতেই হতাশ হয়ে পড়ে।

রিশাদ কত শখ করে বলেছিল তাকে শাড়ি পরতে কিন্তু সে তো শাড়ি পড়তেই পারে না শাড়ি সামলাতেও পারেনা। বাসায় সে কোনরকমভাবে পড়তো বাইরে গিয়ে যদি কোনভাবে শাড়ি খুলে যায় তাহলে কি হবে?

কিছুক্ষণ ভাবার পর অনি সিদ্ধান্ত নেয় সে শাড়িই পরবে। শাড়ি পড়ে রিশাদকে চমকে দেবে সে। সে সময় রিশাদের হাসি মুখটা দেখার মতো আনন্দের আর কিছু হতে পারে না এই মূহুর্তে। তাই অনি শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট হিজাব বের করে রিশাকে কল দেয়।

দুমিনিটের মধ্যে রিশা রুমে এসে হাজির হয়। রিশা মোটামুটি ভালো শাড়ি পরাতে পারে তবে আজ যেহেতু অনি আর রিশাদ ঘুরতে যাবে তাই একটু বেশিই ভালো করে শাড়ি পড়ানো দরকার। আর এই কাজে রিশার চেয়ে মিথিলা বেশি পারদর্শী। রিশা অনির কথা মা শুনেই এক দৌঁড়ে মিথিলার রুমে গিয়ে মিথিলাকে টেনে নিয়ে আসে। অনি আগের কথাগুলো ভেবে মিথিলার সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে একটু ইতস্ততবোধ করছিল।

আশ্চর্যজনক ভাবে মিথিলা বেশ হাসিখুশি ভাবেই অনিকে শাড়িটা পরিয়ে দেয়। তার চেহারায় কোন কষ্টের ছাপ নেই। মিথিলার মলিন হয়ে আসা চেহারায় আজ অদ্ভুত খুশির বন্যা। অস্বাভাবিক সুন্দর চোখ দুটোও যেন খুশিতে চক চক করছে। মিথিলাকে দেখে বেশ হাসিখুশিই মনে হচ্ছে। অনিও যেন স্বস্তি পায়। তবে মিথিলার এই উজ্জ্বলতার পেছনের রহস্যটা অনি ঠাওর করতে পারেনা আর এই বিষয়ে সে এই মূহুর্তে ভাবছেও না। মিথিলা ভালো আছে সেটাই যথেষ্ট।

রিশা আর মিথিলা মিলে অনিকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। মিথিলা একটু বেশি করে সেফটি পিন লাগিয়ে দেয় যাতে কোনভাবেই শাড়ি খুলে না যায়। অনিরও বেশ আরামদায়কই মনে হচ্ছে।অনি লম্বা চুলগুলো ঘাড়ের উপর খোপা করে বেধে হিজাবটা ভালো করে পরব নেয়। অনি সাজতে না চাইলে রিশা জোর করে অনির লম্বা লম্বা পাপড়িগুলোতে একটু মাসকারা লাগিয়ে দিয়ে নীল কাজল লাগিয়ে দেয়। লিপস্টিক দিয়ে দিতে চাইলে অনি বাঁধা দেয়। লিপস্টিক দেয়াটা সে একদম পছন্দ করে না। এমনিতেও তার ঠোঁটজোড়া হালকা গোলাপি রঙা। অনির ধবধবে ফর্সা মুখটায় মেকাপের প্রয়োজন নেই। বরং মেকাপ ছাড়াই যেন তাকে বেশ সতেজ, স্নিগ্ধ লাগছে।

রিশা আলমারি থেকে রিশাদের জন্য অনির সাথে ম্যাচিং করে একটা পাঞ্জাবি বের করে রাখে।

অনির সাজগোজ শেষ।সে এখন সম্পূর্ণ রেডি। অন্যদিকে রিশাদের আসার কোন খবরই নেই। ভাবতে ভাবতেই অনির ফোনটা বেজে ওঠে। রিশাদ ফোন করে জানায় সে বাসার গেটের সামনেই আছে অনি যেন নিচে নামে। অনি কিছু বলার আগেই রিশা তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রিশাদকে বলে

–“ভাইয়া তুমি উপরে চলে এসো।তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”রিশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিশা খট করে ফোনটা কেটে দেয়। বিধায় রিশাদকে আবার উপরে যেতে হয়।

চলবে….
আসসালামু আলাইকুম। ?গল্পটা শেষের দিকে চলে এসেছে। আর ৭/৮টা পর্বের মধ্যেই শেষ করে দিব ইনশাআল্লাহ। আজকের পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here