অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
বোনাস_পার্ট
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিচের দিকে চোখ যায় তার।সোফায় বসে আছে কেউ একজন। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অনি পেছন দিক থেকে বুঝতে পারছে না কে। জাহানারা বেগম সহ বাড়ির সবাই সেখানে উপস্থিত। কৌতূহল নিয়ে নিচে নামে।
শেষ সিঁড়িটা পার করতেই অনির কানে ভেসে আসে সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বর। যার মাধ্যমে সে নিশ্চিত হয়ে যায় সে রিশাদ ছাড়া আর কেউই না। কয়েক সেকেন্ড থেমে সে পুনরায় এগিয়ে যায়।
একপাশে বসে আছে অনামিকা আরেকপাশে বসেছে আশরাফ শেখ আর জাহানারা বেগম পাশাপাশি। শুধু ফাঁকা আছে অনামিকা আর রিশাদের পাশের জায়গা। অনি একবার অনামিকার দিকে তাকায়। অনামিকার নজর তখন তার দিকে ছিল না। এতে যেন অনি বেশ স্বস্তি পায়।
অনি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রিশাদের পাশে বসে পড়ে। তার মনে প্রশ্ন জাগে রিশাদ কেন এখানে। সে মূলত রিশাদের সামনা সামনি পড়তে চায়না বলেই এবাড়িতে এসেছিল। তার মনের কথা তো কেউ জানে না।
উপস্থিত সবার কথাবার্তার মাধ্যমে অনির কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় রিশাদকে জাহানারা বেগমই এবাড়িতে আসতে বলেছেন। মূলত সে এসেছিল অনিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অনি?অনি তো এসেছিল ক’টা দিন এখানে থাক্র উদ্দেশ্যে। আর এখানে কেন থাকতে চায় তা তো একেবারে স্পষ্ট। রিশাদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চায় সে।
রিশাদ বেশ চুপ চাপ আছে। এবাড়িতে আসার পর থেকে তার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। পুরনো কিছু কথা বার বার মস্তিষ্কে উঁকি দিচ্ছিল। এবাড়িতে অনেক বার এসেছে। তখন কতটা সহজ ভাবে মিশে গিয়েছিল সবার মাঝে। সম্পর্ক গুলোও ছিল সাবলীল। অদৃশ্য আড়ষ্টতা সবাইকে যেন ঘিরে ধরেছে। সরল সমীকরণ যেন সেই এক রাতেই জটিল হয়ে গেছে।
রিশাদ সংকোচ কাটিয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে সবার সাথে সহজ ব্যবহার করতে। অনি মাঝে মাঝে রিশাদের দিকে তাকাচ্ছে। রিশাদের হাবভাব দেখে তার বোঝার চেষ্টা করছে তার মধ্যে কি চলছে। তবে সে বিশেষ কিছু বুঝতে পারেনা।
রিশাদের অস্বস্তির অবসান ঘটে যখন জাহানারা বেগম অনিকে বলেন রিশাদকে উপরে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ হতে। অনিও কোন বাক্যব্যয় না করে জাহানারা বেগমের কথামতো উপরে চলে যায়। রিশাদও অনির সাথে উপরে চলে যায়।
রিশাদকে নিয়ে অনি তার নিজের রুমে যায়। কেউ কারো সাথে কোন কথা বলে না। রিশাদ অনির মনোভাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন একটা যেন তাকে এড়িয়ে চলছে সেটা সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছে না।
রুমে গিয়ে অনি রিশাদের হাতে একটা টাওয়েল ধরিয়ে দেয়। রিশাদ ফ্রেশ হতে যায়। অনি রিশাদের জন্য খাবার আনার বাহানা দিয়ে নিচে নামে।
অনামিকা আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অনি নিচে নামতেই অনামিকা শেখ বলেনঃ
–“তুমি আবার নিচে আসলে কেন?আমি তো এক্ষুণি রিশাদের জন্য খাবার উপরেই পাঠাচ্ছিলাম।”(অনামিকা)
অনি মূলত খাবার নেয়ার জন্য নিচে আসলেও তার এখন রুমে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। এদিকে অনামিকা শেখও তাকে ছাড়ার পাত্রী নন। অনামিকাকে কিছু বলতে না পেরে অনি রিশাদের জন্য খাবার নিয়ে উপরের চলে যায়।
রিশাদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। অনিকে আসতে দেখে সে হেয়ার ব্রাশটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে অনির দিকে ফেরে।
–“খেয়ে নিন।দুপুরেও কিছু খাননি।”(অনি)
–“এই অবেলায় আমার কিচ্ছু খেতে মন চাচ্ছে না। আপনি জাস্ট আমাকে এক কাপ কফি দিন তাহলেই হবে। আমি পরে বাসায় যেয়ে খেয়ে নেব।”(রিশাদ)
অনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো কুঞ্চিত হয়ে গেছে। রিশাদ অনির এমন চাহনির মানে বোঝে। তাই কিছুটা অসহায় মুখ করে থাকে।
–“আপনি তো দুপুরেও খান নি তাহলে এখন খাবেন না কেন?খেতে কি সমস্যা।না খেয়ে থেকে শরীর খারাপ হলে বলবেন শ্বশুড় বাড়ির লোকজন আপনার ঠিকমতো যত্ন নেয়নি। চুপ চাপ খেয়ে নিন।”(অনি)
রিশাদ অনির কথায় বাধ্য হয়ে খেতে খেতে শুরু করে দেয়। ক্ষুধা বসে যাওয়ায় তার খেতে মন চাচ্ছিল না। তবুও অনির জোরাজুরিতে সে অল্প করে খেয়ে নেয়।
সন্ধ্যায় অনি নামাজ পড়ে উঠে রিশাদের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যায়। রিশাদ রুমে বসে অলস ভাবে ফোন টিপছিল। রিশাদ অনিকে রুমে আসতে দেখে নড়েচড়ে ওঠে।
অনি রিশাদের হাতে কফির মগ দিলে রিশাদ মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নেয়। রিশাদ যে কফিটা পেয়ে খুশি হয়ে গেছে তা তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তার উপর অনির হাতের কফি।
রিশাদ তৃপ্তি নিয়ে কফির মগে চুমুক দেয়। অনি রিশাদের বিপরীতে সোফায় বসে কফির মগটা হাতে নিয়ে রিশাদের দিকে আড়চোখে তাকায়।
কফি খাওয়া শেষ করে রিশাদ তাকে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া দিতে থাকে। কিন্তু অনি তো ভেবে এসেছিল সে কিছুদিন থাকবে এখানে। শায়লা বেগমও দুবার ফোন দিয়েছিল। তবে যাওয়ার জন্য তাকে বিশেষ জোরাজুরি করেনি। কিন্তু অনির মনে হয়েছে শায়লা বেগম তাকে খুব মিস করছেন।
অনির খুব থাকতে মন চাইলেও তার আর থাকা হয়না। রিশাদের কাল অফিসে খুব জরুরী মিটিং আছে আর তার সব ফাইল ওবাড়িতে আছে। তাই আর থাকা হলো না। অনি রিশাদের এভাবে চলে যাওয়ায় বাড়িতে সবারই মন খারাপ হয়ে যায়। তবে ওদের যাওয়া টাও জরুরি তাই আর কেউ আটকায়নি। তবে রিশাদ অনিকে রেখে যেতে চায়। অনি কিছু একটা ভেবে আর থাকেনা। এতে যেন রিশাদ মনে মনে বেশ খুশিই হয়।
গাড়িতে মন খারাপ করে বসে আছে অনি। রিশাদ ড্রাইভিং সিটে গাড়ি চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে অনির দিকে তাকাচ্ছে। অনির মনটা একটু বেশিই খারাপ। এখন মনে হচ্ছে তাকে রেখে আসলেই ভালো হতো। অনির মন খারাপ রিশাদের মাঝেও অস্থিরতার সৃষ্টি করে।
অনি খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনিতে এক রাশ উদাসীনতা আর কিছু নিরেট অনুভূতি। অনি আনমনেই কিছু একটা ভাবছে। রিশাদ আচমকাই গাড়ি থামানোতে তার ঘোর কাটে। অবাক চাহনিতে অনি রিশাদের দিকে তাকায়।
অনির এই চাহনিতে রিশাদ মারাত্মক ভাবে আকৃষ্ট হয়। শুষ্ক মলিন চোখে এ যেন এক নিরন্তর বেদনা গাঁথা,অন্তহীন গভীরতা। রিশাদের হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত ছাপ ফেলে। রিশাদ যেন অনির চোখের গভীরতায় হারিয়ে যায় এর প্রান্তবিন্দু খুঁজতে গিয়ে। ক্রমশ যেন তার ঘোর বেড়েই চলে। রিশাদের ঘোর কেটে যায় গাড়ির সাইড দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া মালবাহী ট্রাকের কর্কশ হর্ণের শব্দ শুনে।
রিশাদের যেন মনে হচ্ছিল সে এই ব্যক্তিকে পেলে হয়তো প্রচলিত আইনের ধারা অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দিয়ে দিত। অপরাধ তার অনন্যময়ীকে দেখার সময় বিঘ্ন সৃষ্টি ঘটিয়েছে।
রিশাদ নিজের এমন আকাশ কুসুম কল্পনায় বেশ।অবাক হয়ে যায়। সাথে কিছুতা লজ্জাও পায়।
অনি কেমন কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশাদের হুট করেজ কখন যে কি হয়ে যায় কিছুই বুঝতে পারে না।
অনি এবার বেশ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা বিরক্তির সুরে বলেঃ
–“কি হয়েছে?হঠাৎ করে গাড়ি থামালেন কেন?”(অনি)
–“কিছু হয়নি।আপনার মন খারাপ কেন?আপনাকে তো আমি বললাম থাকতে। কাল যাওয়ার সময় নিয়ে যেতাম। আর আপনি চাইলে আরো বেশিও থাকতে পারতেন।চাইলে তো আপনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগ পর্যন্তও ওবাড়িতেই থাকতে পারেন।”(রিশাদ)
–“কেন আমি আসাতে কি আপনার ভালো লাগে নি নাকি?”(অনি)রিশাদের কথায় অনির কিছুটা অভিমান হয়। বোধ হয় রিশাদ চায় না অনি ওইবাড়িতে তার সাথে থাকুক।
–“সেটা কখন বললাম?আপনার মন খারাপ তাই আমি বললাম। ভালো কথা বললেও দোষ।”(রিশাদ)
রিশাদের কথায় অনির রাগ হচ্ছে খুব। রাগের কারণটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার খুব রাগ হচ্ছে। তাই সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।
অনির এমন কাজে রিশাদ হতবাক হয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনিকে দেখতে পায় সে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
রিশাদ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে দেয়। এখান থেকে তাদের বাসা খুব বেশি দূরে নেয়। অনি হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। অনেক দূর অবধি এগিয়ে গেছে। রিশাদ বড় বড় করে পা ফেলেও অনিকে ধরতে পারেনা। বিধায় সে একরকম দৌঁড়ে অনির পাশে হাঁটতে থাকে।
রিশাদের কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না অনি। রিশাদ বার বার তাকে থামতে বলা সত্ত্বেও অনির যেন সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রিশাদকে এভাবে বার বার ইগনোর করায় কিছুটা রেগে যায় সে।
রাগের বশে জোর করে অনির বাহু চেপে ধরে তাকে সামনাসামনি দাঁড় করায়। রিশাদের জোর করে চেপে ধরায় অনি কিছুটা ব্যথা পায়। তবে কোন শব্দ করে না।
অনির চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। তার নাকের ডগা কাঁপছে। রিশাদ অনিকে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করায়।তাদের মধ্যে চুল পরিমাণ ফাঁক নেই। রিশাদও অনির ব্যবহারে বেশ রেগে আছে। শুধু এখন নয় এর আগেও সে অনেকবার অনুভব করেছে অনি তাকে ইগনোর করছে।
অনির অবহেলা, উপেক্ষা মেনে নেয়া রিশাদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য। যদিও সে মুখে বলে অনির উপর তার বিশেষ কোন অধিকার নেই তবে মনেপ্রাণে সে এটাই বিশ্বাস করে অনির উপর এই পৃথিবীতে রিশাদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি। অনির বিন্দুমাত্র অবহেলাও সহ্য করা রিশাদের পক্ষে যেন একেবারেই অসহনীয় পীড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে যাগ। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
রিশাদের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য অনি কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেও রিশাদের শক্তির কাছে পেরে ওঠে না সে। এক পর্যায়ে হার মেনে নেয়। শান্তভাবে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রিশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অনি কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব করে। রিশাদ হাতের বাঁধন আলগা করে দেয়। যেকোন মূহুর্তে যেন তার চোখ ফেটে মানসিক পীড়ার অশ্রুগুলো বেরিয়ে এসে অনিকে জানান দেবে তার প্রতি রিশাদের ভালোবাসার কথা। সে কথা কি অনির মস্তিষ্ক ছাড়িয়ে তার মনে পৌঁছাবে?
রিশাদের এমন করুণ চাহনি অনিকে ভেতর থেকে অস্থির করে দেয়। রিশাদের কষ্টটা যেন সে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। এই কষ্টের কারণটা অনির জানা থাকলেও কোথাও যেন সে মানতে নারাজ। তার মস্তিষ্ক মনের চেয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা বেশি প্রভাবিত তাই সে হয়তো রিশাদের নীরব ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রিশাদ অশ্রুসিক্ত নয়নে অনির দিকে তাকায়। করুণ কণ্ঠে বলে;
–“এত বেশি অবহেলা কি আমার প্রাপ্য অনন্যময়ী? আমার মনের কথা কি আপনার মন অবধি আজও পৌঁছায়নি নাকি আপনি বুঝেও সেটা না বোঝার ভান করেন। বোধ হয় আপনার যোগ্য নই আমি তাইনা অনন্যময়ী? তাই আজও আমার মনের কথাগুলো বুঝতে পারেন নি। সব কথা কি মুখে বলার প্রয়োজন হয় অনন্যময়ী? কেন এত ইগনোর করছেন আমাকে?কি করেছি আমি?কেন এতটা কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে?কয়েক দিন পর তো আপনি চলেই যাবেন এই ক’টা দিন কি আমরা একটু ভালোভাবে থাকতে পারিনা?আমি কি এতটাই অযোগ্য যে আমার ভাগ্যে শুধুই উপেক্ষা আর প্রত্যাখ্যান প্রাপ্য?”
রিশাদের প্রতিটি কথায় অনি মারাত্মক ভাবে আহত হচ্ছে মানসিকভাবে। যার ফল স্বরূপ অশ্রু কণা গাল বেয়ে পড়ছে। কি দারুণ কষ্ট হচ্ছে তার। অথচ রিশাদ ভাবছে অনন্যময়ী বোধ হয় তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছে। সে কি এখনো তার অনন্যময়ী কে ভালো ভাবে চেনেনি?
অনন্যময়ী তো কখনো অবচেতন অবস্থাতেও কাউকে কষ্ট দিতে চাইবে না। কোন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উপেক্ষা করবে না। সেখানে কি করে রিশাদকে উপেক্ষা করবে। রিশাদ তো তার প্রিয় মানুষগুলোর তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। যাকে বিন্দুমাত্র আঘাত দিলে তা কয়েক গুণ বেশি সে অনুভব করবে।
চলবে………
আসসালামু আলাইকুম?