অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৩২
ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় অনি। রিশাদ মসজিদে গেছে নামাজ পড়তে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রাভাব চলে আসে অনির।
প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। ফোনের মেসেজ টোনের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় অনি। মিনিট পাঁচেক পর বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয় অনি। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রিশাদের খোঁজ করে। পুরো রুমে কোথাও রিশাদকে খুঁজে পায় না।
অনি মনে মনে ভাব;”রিশাদ কি এখনো আসে নি নাকি?” হয়তো সে হাঁটতে বেরিয়েছে।
চুলগুলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক করে নেয়। ওড়নাটা মাথায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
শায়লা বেগম রান্নাঘরে সবে মাত্র চা বসিয়েছিলেন। একজন কাজের লোক ফ্লোরে বসে তরকারি কাটছিলেন শায়লা বেগমের নির্দেশনা অনুযায়ী।
ডোরবেলের শব্দ পেয়ে কিছুটা অবাক হন অনামিকা শেখ। এতো সকালবেলা কে এলো তাদের বাসায়। রায়হান সাহেব তো এই সবেমাত্র মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। তার তো এতো তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। এসব কিছু জল্পনা কল্পনা করতে করতে এসেই দরজা খুলে দেন অনামিকা শেখ।
দরজা খুলে সামনেই রিশাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরেক দফা অবাক হন তিনি। সাথে কিছুটা অপরাধবোধ ও কোথা থেকে এসে যেন ভিড় জমে তার মাথায়। সন্তানের ভালো কাজে যেমন পিতামাতার মাথা উঁচু হয় তেমনি কিছু কিছু ভুল সিদ্ধান্তেও আবার তাদের সেই উঁচু মাথা নিচু হয়ে যায়। এমনটাই অনুভব করছেন অনামিকা শেখ।
–আসসালামু আলাইকুম আন্টি।(রিশাদ)
–ওয়ালাইকুমুস সালাম।কেমন আছো বাবা?(অনামিকা শেখ)
–আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।আপনি কেমন আছেন?(রিশাদ)
অনামিকা শেখকে দেখে খুব একটা ভালো লাগে না রিশাদের। তার চোখ মুখের বেহাল অবস্থা। মনে হচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে তিনি খুব বাজেভাবে চিন্তিত। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কত রাত যেন তার নির্ঘুম কেটে গেছে। রিশাদের ধারনা অনুযায়ী অনামিকা শেখ হয়ত অদ্রির ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। চিন্তিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। রিশাদ এ বিষয়ে এই মূহুর্তে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না।
–এইতো ভালো আছি বাবা। এতো সকাল সকাল তুমি?তোমার শরীর ঠিক আছে?(অনামিকা শেখ)
–জি আন্টি। একচুয়ালি দিদার সাথে একটু দরকার ছিল। উনি তো বাসায়ই আছেন তাইনা। (রিশাদ)
–হ্যা ভেতরে এসো না প্লিজ। (অনামিকা শেখ)
রিশাদ ভেতরে প্রবেশ করে। অনামিকা শেখ রিশাদকে নিয়ে জাহানারা বেগমের রুমে যায়। জাহানারা বেগম সবে মাত্র কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে উঠছিলেন।
অনামিকা শেখ দরজার কাছে এসে বলেন;
–“মা আসবো? রিশাদ এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।”
–“হ্যা এসো।”(জাহানারা বেগম)
অনামিকা শেখের সাথে সাথে রিশাদও ভেতরে প্রবেশ করে। রিশাদকে দেখে বেশ অবাক হন জাহানারা বেগম।
রিশাদ রুমে প্রবেশ করে কুশল বিনিময় করে জাহানারা বেগমের সাথে। অনামিকা শেখ এর মাঝেই বলেন;”তোমরা কথা বলো আমি আসছি”
বলেই অনামিকা শেখ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
–“এখন কেমন আছো তুমি? বাসার সবাই কেমন আছে?”(জাহানারা বেগম)
–“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।”(রিশাদ)
জাহানারা বেগম গভীর ভাবে রিশাদকে পর্যবেক্ষণ করেন। তার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। রিশাদকে কিছুটা অন্যরকম লাগছে তার।
সপ্তাহখানেক আগে তিনি যে রিশাদকে দেখেছেন আর আজ যাকে দেখছেন তাদের মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে যা জাহানারা বেগমের নজর এড়ায়নি। বাকি দিনগুলোর তুলনায় আজ তাকে একটু বেশিই ফুরফুরে মনে হচ্ছে।
–একচুয়ালি দিদা আমি আপনার সাথে অনন্যময়ীর ব্যাপারে কথা বলতে চাই।(রিশাদ)
–হ্যা বলো।(জাহানারা বেগম)
–আপনি হয়তো জানেন ব্যাপারটা। বাংলাদেশে আসার কিছুদিন পূর্বে অনন্যময়ী তার ভার্সিটির ফেস্টে পারটিসিপেট করেছিল তার ফাইনাল সিলেকশনের জন্য কল করা হয় তাকে। অনন্যময়ী তা রিজেক্ট করে দেয়। আমি যতদূর বুঝেছি এটা অনন্যময়ীর জন্য অনেক বড় একটা অর্জন ছিল। যা সে অতি সহজেই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। হয়তো পরোক্ষভাবে আমিই এটার জন্য দায়ী।তাই আমিই সব কিছু ঠিক করে দিতে চাই। আমি চাইনা আমার জন্য অনি এই সুযোগটা হারাক। (রিশাদ)
–তুমি নিজেকে দায়ী ভেবো না।পরিস্থিতিটাই তখন এমন ছিল। সেখানে আমাদের কারোরই কোন হাত ছিল না। এই সুযোগটা হয়তো অনির হাত ছাড়া হয়ে গেছে তবে আমি নিশ্চিত সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।কিন্তু তুমি কি করতে পারবে এ ব্যাপারে। অনি তো বেশ কয়েকদিন আগেই ইমেইল করে দিয়েছে সে এটেন্ড করবে না ভাইভা। (জাহানারা বেগম)
–হ্যা দিদা। আমি দুদিন আগেই এ বিষয়ে জানতে পেরেছি। অনি আমাকে কিছু জানায়নি এ বিষয়ে। আমি আমার রিসোর্স গুলো কাজে লাগিয়ে জানতে পেরেছি কোন ইমারজেন্সির জন্য যদি কেউ স্ব শরীরে উপস্থিত থাকতে না পারে তাহলে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে এ এটেন্ড করতে পারবে। তবে এজন্য অনন্যময়ীর লিগ্যাল গার্ডিয়ান কে এপ্লিকেশন দিতে হবে। অনির লিগ্যাল গার্ডিয়ান মেবি আপনি দিদা।(জাহানার বেগম)
জাহানারা বেগম এক ধ্যানে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনির জন্য কতটা ভাবছে রিশাদ। কেউ হয়তো কখনো তার জন্য এতো ভাবেনি। জাহানারা বেগমের পর হয়ত রিশাদই এতটা ভাবছে অনির জন্য। খুশিতে তার চোখমুখ জ্বল জল্ব করে ওঠে। রিশাদ জাহানারা বেগমকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধের উদয় হয়।
–হ্যা তা ঠিক আছে। কিন্তু অনিকে তো জানাতে হবে। (জাহানারা বেগম)
–না না দিদা অনিকে এখন নয় আগে সবকিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাক তারপর জানাবো।(রিশাদ)
–আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে কি কি করতে হবে বলো।(জাহানারা বেগম)
রিশাদ জাহানারা বেগমের সাথে প্রয়োজনীয় সকল কথা বার্তা শেষ করে সাথে সকল ফর্মালিটিস ও পূরণ করে নেয়।
কাজ শেষ করে রিশাদ জাহানারা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে নেয়। কিন্তু জাহানারা বেগম তাকে না খেয়ে কোথাও যেতে দেয় না। বাধ্য হয়েই রিশাদ সকালের নাস্তাটা অনিদের বাসাতেই করে। অনামিকা শেখ রিশাদকে দেখেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ শায়লা বেগমের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে অনি। সেখানে অনির হাতে বিশেষ কোন কাজ ছিল না আর শায়লা বেগমও তাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছিলেন না। বিধায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোর হচ্ছিল অনি। তাই সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পুনরায় রুমের দিকে যায়। মাঝপথে কিছু একটা ভেবে থেমে যায় অনি। পিছনে ফিরে রিশার রুমের দিকে যায়। রিশা এখনো ঘুমাচ্ছে না জেগে আছে তা নিশ্চিত নয় সে। তবে বেশ কয়েকদিন সে রিশাকে ভোরবেলা উঠতে দেখেছে।
রিশার রুমের সামনে গিয়ে নক করে অনি। প্রথমবার নক করায় ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পায়না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় নক করতেই দরজা খুলে হাসি মুখে বেরিয়ে আসে রিশা।
রিশা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দরজায় নক করার শব্দ শোনে।
–“আরে ভাবী এসো না। দরজা তো খোলাই ছিল। নক করার কি দরকার ছিল? “(রিশা)
অনি মুচকি হাসি দেয়। রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে;
–“না আসলে তুমি ঘুম থেকে উঠেছো কি না বুঝতে পারছিলাম না।”(অনি)
–“একটু আগেই উঠেছি। এই মাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলাম। তো হঠাৎ এতো সকালবেলা তুমি আমার রুমে? কোন দরকার ছিল কি? (রিশা)
–“না তেমন কিছু না। তোমার সাথে তো ঠিকমতো কথাই হয় না। তাই তোমাকে দেখতে আসলাম।আজকাল তো পড়াশোনা নিয়ে অনেক বেশি বিজি থাকো মনে হয়। “(অনি)
–“হ্যা তা আর বলতে। কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা। ভাবলেই বুকটা ধুকপুক করে। “(রিশা)
–“এতো টেনশন করো না। যা হবে ভালোই হবে। তুমি পরিশ্রম করে থাকলে আজ হোক কাল হোক অবশ্যই তার ফল পাবে।(অনি)
রিশার সাথে গল্প করে কিছুটা ভালো সময় কাটায় অনি। রিশাকে বরাবরই বেশ ভালো লাগে অনির। খুব প্রাণবন্ত উৎফুল্ল স্বভাবের মেয়েটা। যেখানে থাকে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। রিশার সাথে আড্ডা দিয়ে অনির বোরিংনেস টাও কমে গেছে। ননদ ভাবীর এই গল্প আড্ডা বেশ কিছুক্ষণ চলে।
একটু পরে রিশা পড়তে বসলে নিজের রুমে আসে অনি। সে ভেবেছে রিশাদ হয়ত এতক্ষণে চলে এসেছে। কিন্তু রুমে গিয়ে কোথাও রিশাদকে দেখতে পায় না। অনি বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নেয়। কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করে সে। তার মনে পড়ে যায় কালকের পর থেকে গুনগুনের কোন খবর নেয়া হয়নি। গুনগুন কেমন আছে তা জানা হয়নি।
অনি কললিস্ট থেকে সেদিনের নাম্বারটা বের করে কল দেয়। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউই কল রিসিভ করছে না। এক সময় কলটা কেটে যায়। অনি ফোন টা কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভেবে সে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। টেবিলের উপর রাখতেই ফোনটা বেজে ওঠে।
অনি কোনরূপ বিলম্ব না করে কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে।
–“আসসালামু আলাইকুম।”(অনি)
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম।” ঘুম ঘুম কণ্ঠে কথাগুলো বলে হিমাদ্রী। সারা রাত গুনগুনের সাথেই ছিল সে। ভোর রাতের দিকে এসে চোখ লেগে যায় তার। অনির ফোন পেয়েও ঘুম ভাঙে তার। ধরতে ধরতেই কলটা কেটে যায়। বিধায়
সে সাথে সাথেই কল ব্যাক করে।
–“ওয়ালাকুমুস সালাম।”(হিমাদ্রী)
–গুনগুন কেমন আছে?(অনি)
–এখন একটু ভালো আছে। রাতে জ্ঞান ফিরেছে এখন ঘুমাচ্ছে।(হিমাদ্রী)
অনি হিমাদ্রী দুজনেই চুপ হয়ে যায়। কেউ কোন কথা বলছে না। একটু পর অনি নিজেই বলে;
–গুনগুনের পাপা আই মিন এরিক যাকে কাব্য চৌধুরীর মতোই দেখতে যিনি ওনার ব্যাপারটা কি সব ঠিক ঠাক হয়ে গেছে?(অনি)
–আসলে কিছুই ঠিক হয়নি।আমরা সবাই খুব কনফিউজড এই বিষয়টা নিয়ে তার উপর গুনগুনের এই অবস্থা। আপাতত এরিক আর এনি আমাদের বাড়িতেই আছে। গুনগুন যতদিন সুস্থ হচ্ছে এরিককে আমরা এ বাড়িতেই থাকার অনুরোধ করেছি। দেখা যাক গুনগুন আগে সুস্থ হোক তারপর অন্য কিছু।(হিমাদ্রী)
হিমাদ্রীর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় অনি। ফোনের ওপাশে হিমাদ্রী হয়ত চাইছিল আরো কিছুক্ষণ অনির সাথে কথা বলতে কিন্তু অনি একরকম ভদ্রতার খাতিরেই কথা বলছিল বলা চলে। তবে অনির কলে বেশ ভালো লাগে হিমাদ্রীর।
কথা বলা শেষ করে অনি ফোনটা রেখে দেয়। রিশাদ এখনো বাসায় ফেরেনি। অনি ভাবতে থাকে মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরতে এতো সময় লাগে?
নিচে থেকে শায়লা বেগমের ডাক শুনে অনি নিচে নেমে আসে। ব্রেকফাস্ট করার জন্য অনিকে ডাকছিলেন শায়লা বেগম। রিশাদ ব্যতীত সেখানে সবাই উপস্থিত ছিল। অনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রিশার পাশে বসে পড়ে।
অনি বসে বসে ভাবতে থাকে রিশাদ কোথায় গেল? মামনিও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না রিশাদের ব্যাপারে।তাহলে মামনি কি জানে রিশাদ কোথায় গেছে? কিছুটা চিন্তিত হয় সে।
অনির ভাবনার অবসান ঘটিয়ে রায়হান সাহেব বলে ওঠেন; ” অনি মা, রিশাদ কোথায়? রিশাদকে তো দেখছি না।”
অনি চুপ করে থাকে। সে তো নিজেই জানে রিশাদ কোথায়? অনিকে চুপ থাকতে দেখে শায়লা বেগম বলে ওঠেন;”রিশাদ একটু বেরিয়েছে। বলেছিল তো দু তিন ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে। একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে নাকি তার। তুই ঘুমোচ্ছিলি তাই বোধ হয় তোকে আর ডাকেনি।”
শায়লা বেগমের কথা শুনে অনি কিছুটা স্বস্তি পায়। তবে তার কিঞ্চিত রাগও হয়। রিশাদ যাওয়ার আগে রিশাদ তাকে একবার অন্তত বলে যেতে পারতো। সে ঘুমোচ্ছিল তাতে কি হয়েছে বলে তো যেতে পারতো।
অনি মনে মনেই কথাগুলো বলছে আর রিশাদকে হাজার খানেক কথা শোনাচ্ছে। কোনমতে ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে চলে যায় অনি। ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বইটা নাড়াচাড়া করছিল শুধু। তার মাথায় এখন শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে রিশাদ তাকে বলে গেল না কেন? একটু একটু রাগ হচ্ছে তার। তবে রিশাদের বলে না যাওয়ায় তার রাগ হওয়ার বিষয়টা কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে তার। শুধু নামমাত্র সে রিশাদের স্ত্রী। খুব শীঘ্রই হয়তো সে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়েও যাবে। অজানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনি।
অনি বসে বসে খুব বোর হচ্ছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে রিশাদের নাম্বার বের করেও আবার ফোনটা রেখে দেয়। একট পরেই রিশাদ হাতে একটা ফাইল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
অনি রিশাদকে দেখেও না দেখার ভান করে। রুমে যে সে ব্যতীতও অন্য কেউ উপস্থিত আছে তা যেন সে জানেই না। রিশাদ ফাইলটা রেখে অনির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
অনিকে দেখে রিশাদ কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ অনির দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকে রিশাদ। সে বুঝতে পারছে না অনির মাথায় কি চলছে। অনি আড়চোখে রিশাদের দিকে তাকাতেই রিশাদের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। অনি চোখ নামিয়ে নেয়।
রিশাদ অনির কাছে এসে বলে;”কি ব্যাপার কি হয়েছে আপনার?”
অনি গম্ভীর গলায় বলে;”কি আবার হবে কিছু হয়নি তো।কিছু হওয়ার কথা ছিল কি?”(অনি)
–না তা বলিনি। কথা বলছেন না তো তাই বললাম। (রিশাদ)
–কেন আপনি কি আমাকে সব কথা বলেন যে আমি আপনাকে বলবো?(অনি)
–“কেন?আপনাকে আবার কি বললাম না?” (রিশাদ)
–“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?আমাকে বলে গেছিলেন?”(অনি)
রিশাদ এবার সবটা বুঝতে পারে। অনির এমন অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনে রহস্যটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। রিশাদ মুচকি হাসে।
–“আপনি তো ঘুমোচ্ছিলেন তাউ আর বলিনি। সো সরি ফর দ্যাট।”(রিশাদ)
–“আপনাকে আমি বলেছিলাম না আমাকে বলে যাবেন।”(অনি)
রিশাদ মুচকি হেসে বলে; ম্যাম আপনার ফোনটা নিয়ে এক বার ইনবক্স চেক করে দেখুন তো বলে গেছি কিনা?
অনি ফোনটা হাতে নিয়ে ইনবকক্স ওপেন করতেই দেখতে পায় একটা আনরিড মেসেজের উপর রিশাদের নামটা লেখা। রিশাদের মেসেজটা ছিল;
”গুড মর্নিং অনন্যময়ী। আমি একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে বাইরব যাচ্ছি। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই আর ডিস্টার্ব করিনি। আসতে বেশিক্ষণ দেরি হবে না।”
মেসেজটা পড়ে অঞ্জ রিশাদের দিকে তাকায়। রিশাদ মিট মিট করে হাসছে।
–“সরি আসলে আমি মেসেজ চেক করিনি। আমাকে তো আর সচরাচর কেউ মেসেজ দেয় না তাই মেসজ চেক করার কথা আমার খেয়াল ছিল না।”(অনি)
–“ইটস ওকে ম্যাম।”(রিশাদ)
অনি তার নিজের এমন কান্ডে কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। কথা ঘোরানোর জন্য বলে;
–“আপনি তো এখনো মনে হয় ব্রেকফাস্ট করেননি। চলুন ব্রেকফাস্ট করবেন।”
–“না না আমি খেয়ে এসেছি। এত ব্যস্ত হবেন না।” (রিশাদ)
–“ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে।” (অনি)
রিশাদ অনির সাথে কথা বলা শেষ করে টুকটাক অফিসের কাজ করছিল বসে থেকে। অনিও রুমেই বসে একবার বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল তো আরেকবার ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিল। মোট কথা সে খুবই বোরিং টাইম পার করছে।
রিশাদের ফোনটা বেজে ওঠে। হোমস্ক্রিনে জয়ের নামটা দেখে কোনরূপ দেরি না করে কল রিসিভ করে।
–হ্যা জয় কোথায় তুই?(রিশাদ)
———————-
–আচ্ছা ঠিক আছে আমি আমার রুমেই আছি।তুই উপরে চিলে আয়।(রিশাদ)
———————-
রিশাদ ফোনটা রেখে দেয়। অপরপাশের ব্যক্তি কি বলে তা অনি বুঝতে পারে না। বিধায় চোখ দুটো কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থাকে।
একটু পরেই রিশাদের সমবয়সী একজন ব্যক্তি রুমে প্রবেশ করে। অনি এক নজর তার দিকে তাকায়। বেশ চেনাচেনা মনে হচ্ছে অনির। হয়তো বিয়েবাড়িতে দেখেছিল। রিশাদের ফোনালাপ অনুযায়ী হয়তো এই ব্যক্তির নাম হবে জয়।
জয়কে দেখে উঠে দাঁড়ায় রিশাদ।
–আয় ভেতরে আয়। কেমন আছিস?(রিশাদ)
–এইতো ভালো।তোর কি অবস্থা এখন বল।(জয়)
–হ্যা ভালো আছি। (রিশাদ)
জয় অনির দিকে তাকিয়ে অনিকে বলে;
–“আসসালামু আলাইকুম ভাবি।”
–জয়ের মুখে ভাবী ডাক শুনে অনির কিছুটা অস্বস্তি হয়। তবে সে তা অপ্রকাশিত রেখে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে।
–ওয়ালাইকুমুস সালাম। (অনি)
জয়ের সাথে কুশল বিনিময় করে অনি। এরপর রিশাদ আর জয় তাদের কাজ শুরু করে দেয়।অনি দূরে বসে থেকে কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝাতে পারছে না। তাই রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে যায়।
অনি রুম থেকে বের হওয়ার অপেক্ষাতেই যেন ছিল রিশাদ। রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রিশাদকে তড়িঘড়ি করব বলে; কাজগুলো সব ঠিক ঠাক মতো করেছিস?(রিশাদ)
–হ্যা করেছি এখন শুধু লাস্ট কাজ হলো ইমেইলটা পাঠানো। ইমেইল পাঠানোর ১২ ঘন্টার মধ্যেই ওরা রিপ্লাই দিবে হ্যা বা না।
–আচ্ছা ঠিক আছে ইমেইলটা তাহলে পাঠিয়ে দে এক্ষুণি। যত দ্রুত মেইল করবো তর দ্রুত ওরা জানাবে। বলেই রিশাদ ল্যাপটটা জয়ের দিকে এগিয়ে দেয়।
অনি রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে যান। একজন বয়স্ক মহিলা দুপুরের রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই মহিলাকে আগে এই বাড়িতে দেখেনি অনি। আজই প্রথম দেখছে।
অনিকে দেখে বয়স্ক মহিলাটি বলেন; আপু মনি কিছু লাগবো আপনের?
–না আমার কিছু লাগবে না। আপনাকে তো আগে দেখিনি। (অনি)
–এই বাড়িতে কাম করি। আজই গেরামের বাড়িত থেকে আইছি। বড় বাবার বিয়েতে থাকপার পারিনি। গেরামে গেছিলাম। আমার বড় মাইয়াডার বাচ্চা হইল। আপনে তো বড় বাবার বউ তাইনা। বড় আপা আমারে কইছিল আপনের কথা। আমার নাম আয়মা। সবাই আমারে আমেনার মা কইরাই ডাকে। (আমেনার মা)
–ওহ আচ্ছা। তো মামনি কোথায়?(অনি)
–কে বড় আপা?? বড় আপা তো শরীরডা ভালা না রুমে গেছে বিশ্রাম করতে। আমারে কন কি লাগবো?(আমেনার মা)
–না কিছু লাগবে না। আপনার বড় বাবার একজন বন্ধু এসেছে তার জন্য স্ন্যাকস এর ব্যবস্থা করতে হবে। (অনি)
–আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি যান আমি আইতাছি। (আমেনার মা)
–না সমস্যা নেই। আপনি আপনার কাজ করুন। আমি নিজেই করে নিচ্ছি।(অনি)
আমেনার মা জোর করে অনিকে কোন কাজ করতে দেয় না। বিধায় অনি শুধু কফি বানায় আর বাকি সবটা আমেনার মা সামলে নেয়।
কিছুক্ষণ পর অনি নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। অনির উপস্থিতি টের পেয়ে রিশাদ আর জয় তাদের প্রসঙ্গ পালটে অন্য ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে। রিশাদ আর জয়ের হাবভাব দেখে অনির কিছুটা খটকা লাগে। সে বুঝতে পারে রিশাদ কোন একটা ব্যাপার তার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। অনির এই বিষয়টা খুব একটা ভালো লাগে না। তাই সে স্ন্যাকসের ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রিশাদ আড়চোখে অনির দিকে তাকায়। অনির মলিন চেহারাটা স্পষ্ট তার চোখে পড়ে। অনিকে এভাবে দেখে রিশাদের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তবে রিশাদ মনে মনে ভাবে;
–“এখন একটু মন খারাপ হলেও কিছু সময় পরে আপনাকে যে সারপ্রাইজ টা দেব তা যেন আপনার জীবনে হাজারগুন বেশি খুশি বয়ে আনে। আপনার স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব আপনার অজান্তেই আমি নিয়েছি।” রিশাদ মুচকি হাসে।
চলবে……