অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_১৪
দুপুরের খাবার খেয়ে রিশার সাথে বাড়ির সামনের বাগানে হাঁটতে বের হয় অনি। তার ঘাড়ের ব্যথাটা কমেছে কিন্তু এখনও সরাসরি ঘাড় ঘুরাতে পারছে না। রোদের তীব্রতা কমে এসেছে। রোদের তাপে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ফুলগুলো রোদের তীব্রতা কমার সাথে সাথে সতেজ হয়ে উঠছে। ফুলের পাপড়িগুলোর মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই পানি দেয়া হয়েছে। নেতিয়ে যাওয়া তৃষ্ণার্ত ফুলগুলো পানি পেয়ে যেন মাথা সোজা করে দাঁড়াচ্ছে। মৃদু সূর্যের আলোয় হালকা বাতাসে হেলে দুলে যেন তাদের আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করছে। অনির মনটা এক মূহুর্তেই ভালো হয়ে যায়। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে অনির ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মেলে।
ফুলগুলোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। ঘাড়ের ব্যথাটা পুরোপুরিভাবে ভালো না হওয়ায় নিচু হতে পারে না অনি। হাটুর উপর ভর দিয়ে ঘাসের উপর বসে ফুলগুলোর সুবাস নেয় অনি। বাতাসে মাথার কাপড়টা পড়ে গিয়ে চুলগুলো উড়তে থাকে। মুখের উপর এসে ভিড় জমায় চুলগুলো। অনির সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে থাকা রিশা অনির এই রূপ দেখে যেন মুগ্ধ হচ্ছে।রিশা ফোন বের করে মূহুর্তগুলোকে ক্যামেরায় বন্দি করে নেয় অনির অজান্তেই।
রিশাদ বেলকনিতে বসে কফির মগে চুমুক দিতেই বাগানের দিকে চোখ যায়। এলোকেশে ফুলগুলোর সুবাস শুষে নিতে ব্যস্ত এক মায়া কন্যা ফুলের বাগানের একমাত্র রাজকন্যা। ফুলের মাতাল করা উপচে পড়া সুবাস যেন শুধু তার জন্যই।দূর থেকে রিশাদ মুখটা স্পষ্ট বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে অনির মুখটা স্পষ্ট হয়ে যায়।এক ধ্যানে রিশাদ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে অনিকে।
অনির কপালের সামনে আসা চুলগুলোকে হাত দিয়ে বারবার সরিয়ে দিচ্ছে। রিশাদের সেটাও খুব ভালো লাগছে। তার মনে হচ্ছে সে নিজ হাতে কপালের সামনে আসা চুলগুলোকে সরিয়ে আলতো করে কানের পিঠে গুঁজে দেবে আর মায়াকন্যা ফুলের সুবাস নেয়ায় ব্যস্ত থাকবে। রিশাদের মাথায় অহেতুক কল্পনারা এসে ভিড় জমায়।
বাগানের একপাশে সাদা গোলাপের গাছ দেখে অনির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। পছন্দের ফুলগুলোর নামের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে সাদা গোলাপ। অনি সাদা গোলাপ গুলোকে ছুঁয়ে দেখে। দেশে আসার পর সে এই প্রথম সাদা গোলাপ দেখছে। বিদেশে তার বারান্দা বাগানের এক বিশেষ অংশ জুড়ে সাদা গোলাপ।
ফুল অনির অতিব প্রিয় বস্তু সাদা ফুলগুলো একটু বেশিই প্রিয়। যার মধ্যে অন্যতম হলো সাদা গোলাপ। সাদা হলো শুভ্রতার প্রতীক। সাদা যেকোন কিছুর প্রতিই অনির দুর্বলতা কাজ করে।
অনির তার বাগানের কথা খুব মনে পড়ছে। ঠিকমতো যত্ন নিচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর একবারও নেয়া হয়নি। দেশে আসার পর এত ঘটনার মধ্যে সে একদম ভুলেই গিয়েছিল। আজ হটাৎ মনে হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আবার তার বাগানটাকে দেখার সু্যোগ হবে কিনা তা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছে না। তার নিয়তি এবার তাকে অন্যরকম পরীক্ষায় ফেলেছে।
রিশার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে পুরো বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছে অনি। হটাৎ ই তার চোখ বেলকনির দিকে পড়ে। রিশাদ তখনও ঘোর লাগানো দৃষ্টি ফেলছে অনির দিকে। অনি অস্বস্তি বোধ করে তাতেও যেন রিশাদের কোন হেলদোল নেই। সে একইভাবে অনির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টির উপর মস্তিষ্ক কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না। অনি শাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে চুলগুলো ভালোভাবে ঢেকে নেয়। অনিকে এভাবে ইতস্তত হতে দেখে রিশাদ তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জার চরম সীমায় পৌঁছে যায় সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আছরের আযানের ধ্বনিতে চারপাশটা মুখরিত হয়ে যায়। অনি রিশাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে অফিসের কাজ করছিলেন রায়হান সাহেব। তার পাশেই বসে শায়লা বেগম ও সাবিনা বেগমের টুকটাক গল্প করছিলেন।
শায়লা বেগম অনি আর রিশাকে ডেকে বসতে বলেন। রিশা রুমে চলে যায়। অনি শায়লা বেগমের পাশে বসে পরে। সাবিনা বেগম অনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছু একটা ভাবছেন তিনি। সাবিনা বেগমের নজর অনির উপর স্থির হয়ে থাকে। অনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে।
অনির জন্য সাবিনা বেগমের বেশ মায়া হয়। শায়লা বেগমের কাছ থেকে সবটা শোনার পর তার মনেও অনি বিশেষ স্থান পায়। তবে নিজের মেয়ের সামনে কোন কিছুই তার সামনে।প্রাধান্য পায় না। এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। অনিকে দেখলেই সাবিনা বেগমের যেমন মায়া হয় তেমনি নিজের মেয়ের কষ্টের কথা ভেবে তার বুকটা হুহু করে ওঠে। নিজের মেয়ের জন্য কোন কিছুই করতে পারেন নি তিনি।
দীর্ঘ ৫ বছর যাবত সাবিনা বেগম তার মেয়েকে কষ্টের অনলে পুড়তে দেখেছেন মা হিসেবে যা তার জন্য ছিল অসহনীয়। নীরবে আশ্রু ফেলা ছাড়া তার কিছু করার উপায়ও ছিল না। যে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে তাদের সামনে যেয়ে কিভাবে বলতো নিজের মেয়েকে এ বাড়ির বউ করে নিতে। হাজার হোক দিনশেষে তারা এ বাড়ির আশ্রিতা। তবে এ বাড়ির সদস্যরা তাদের কোনদিনও আশ্রিতা ভাবে নি বরং তাদের মাথায় করে রেখেছে। রিশাদ রিশার মত এ বাড়ির আরেক সন্তান মিথিলা। শায়লা বেগম ও রায়হান সাহেব আদর স্নেহ ভরণপোষণ কোন দিক থেকেই কোন কমতি রাখেন নি মিথিলার।
মিথিলার বয়স যখন দেড় বছর বয়স তখন শায়লা বেগম এ বাড়িতে সাবিনা বেগমকে আশ্রয় দেন। সেই মিথিলা আজ ১৮ বছর বয়স। সেই দুর্যোগময় আঁধার রাতের কথা মনে হলে তার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে।
সাবিনা বেগম হলেন শায়লা বেগমের স্কুল লাইফের প্রিয় বান্ধবি সাবরিনার বড় বোন। খুব ভালো সম্পর্ক থাকায় তাদের একে অপরের বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল। কলেজ লাইফেও তারা একসাথেই ছিলেন। তাই তাদের বেশ ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই সাবিনা বেগমের সাথে আলাপ হয় শায়লা বেগমের। শায়লা বেগমকে তিনি ছোট বোনের মতোই স্নেহ করতেন। শায়লা বেগম উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন সাবিনা বেগম।বাবা ছিলেন একজন সৎ পুলিশ আর মা সাদাসিধে গৃহিণী।
সাবিনা বেগমের ভাষ্যমতে ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে একজন প্রতারক সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পড়েছিলেন। যা ছিল তার জীবনের প্রথম ও সর্বশেষ ভুল । যার ফলশ্রুতিতে আজ তার মা বাবা বোন কে হারিয়ে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটায় এমনভাবে হোচট খেয়ে পড়েছেন যেখান থেকে আজও উঠতে পারেন নি। যার জন্য তিনি আজ সব হারিয়েছেন সেই মানুষটাকে আজও হয়ত ভুলে যেতে পারেননি অন্তরের কোথাও না কোথাও তার জন্য সুপ্ত ভালোবাসা রয়ে গেছে বলেই শুধুমাত্র মিথিলাকে ঘিরেই তার জীবন এখন সীমাবদ্ধ। অন্য কেউ তার জীবনে আসে নি। মিথিলাই তার বাঁচার সম্বল। মিথিলাকে ঘিরেই তার জীবন পরিক্রমা।
দেখতে দেখতে এ বাড়িতে প্রায় ১৭ বছর পার করলেন সাবিনা বেগম। এ বাড়ির প্রতিটা সদস্য তার কাছে খুব বেশি প্রিয়। সম্পূর্ণ নিজের বলতে তার কিছুই নেই। তার জীবনে প্রাপ্তির খাতাটা বিশাল শূন্যতায় ভরা। নিজের জীবনে তার চাওয়ার মত কিছুই নেই শুধু চান নিজের মেয়েটার সুখ। তার কপালে সুখ ছিলনা বলে কি তার মেয়েটাও সুখী হবে না? ভাবতেই সাবিনা বেগমের চোখ দুটো ভরে আসে।
শায়লা বেগমের ডাকে সাবিনা বেগম ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসেন।
-আপা মিথিলা কোথায়? মেয়েটার কি হয়েছে বলো তো রুম থেকে বের হয় না কেমন মনমরা হয়ে থাকে। হাসিখুশি মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।(শায়লা বেগম)
-কি যে হলো মেয়েটার পড়াশোনার চাপ একটু বেশি মনে হয়। সামনেই তো ভর্তি পরীক্ষা। তাই একটু এখন জোর দিয়ে পড়ছে।(নিজেকে সামলে নিয়ে সাবিনা বেগম জবাব দেন)
-তা তুম ঠিকি বলেছে। তুমিও তো কম ভালো ছাত্রী ছিলে না। তোমার মেয়েটাও হয়েছে ঠিক তোমার মতোই মেধাবী। দেখলে না এইচএসসি তে কি ভালো রেজাল্ট টাই না করলো। বলেই শায়লা বেগম এক গাল হেসে দেন।
সাবিনা বেগম কোন প্রতি উত্তর না দিয়ে ম্লান হাসি হাসেন।
কিছুক্ষণ পর অনি উঠে রুমে যায়। রিশাদ তখনও বেলকনিতে বসে ছিল। একা একা তো আর সে রুমে হেটে আসতে পারে না। অনি রিশাদকে বেলকনিতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। এই ব্যক্তির চাহনিতে অনির বেশ অস্বস্তি হয়। ঝটপট অযু করে এসে অনি আসরের নামাজ আদায় করে নেয়।
ঘরময় পাইচারি করছে অনি। রিশাদ এখনও বেলকনিতে বসে। তার কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না। পা টিপে টিপে বেলকনিতে যায় অনি। রিশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনি। রিশাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। এক চিলতে সূর্যের সোনালি রেখা রিশাদের মুখ বরাবর বরেছে। সিল্কি চুলগুলো কপালে ভিড় জমিয়েছে। আলোয় ঝলমল পড়ছে।গাল বেয়ে অশ্রু গড়ানোর ছাপ। হাতের বইটা খোলা অবস্থায় বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে পাশেই আধ খাওয়া কফির মগ।
রিশাদের শান্ত মলিন চেহারার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে অনি। রিশাদের এই মলিন চেহারায় অনি মুগ্ধ হচ্ছে। এই প্রথম সে কোন পুরুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে ভাবতেই সে লজ্জায় লাল নীল হলুদ হয়ে যায়।
ধীর গলায় অনি রিশাদকে ডাকতে থাকে। রিশাদ কে কোন কিছু সম্বোধন না করে সে ডাকে। কোন সাড়া শব্দ পায় না।
হালকা ধাক্কা দিয়ে রিশাদকে ডাকতে থাকে।
রিশাদ ঘুম ঘুম চোখে অনির দিকে তাকায়। তার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না বিধায় সে অনির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অনি রিশাদের কোন উত্তর না পেয়ে বলে;
আপনি এখানে ঘুমাচ্ছিলেন কেন?
রিশাদ সব কিছু বুঝতে পারার পর জবাব দেয়; আসলে আমি এখানে বসে বই পড়ছিলাম। রুমে বসে খুব বোর হচ্ছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে।চলুন রুমে যেয়ে ঘুমাবেন। (অনি)
রিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়; না রুমে যাব না আমাকে একটু ছাদে নিয়ে যাবেন? রুমে একদম ভালো লাগছে না। অনেক দিন হলো ছাদে যাই না।
অনি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আপনি তো হুইল চেয়ার ছাড়া যেতে পারবেন না। আমি কিভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে ভাব আপনাকে?(অনি)
রিশাদ কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দেয়; আচ্ছা হুইল চেয়ারে যাব না। আমার পায়ের ব্যথাটা তো অনেকটাই কমে গেছে। আপনি যদি একটু কষ্ট করে আপনার কাধে ভর দিয়ে নিয়ে যেতেন। অথবা রিশা বা আম্মুকে ডেকে দেন তাহলেও হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে আম্মুকে ডাকতে হবে না। আম্মু হয়ত ব্যস্ত আছে। রিশাও একটু আগেই রুমে গেছে। আপনি আমার সাথে চলুন। (অনি)
অনি রিশাদের দুহাত ধরে দাড় করিয়ে বাম হাতটা তার কাধের উপর দিয়ে নেয়। আক হাত দিয়ে বাম হাতটা ধরে আরেক হাত দিয়ে কোমড় চেপে ধরে। বিগত দিন গুলোতে অনি বহুবার রিশাদকে এভাবে ধরেছে বিধায় তার অস্বস্তি বোধটা কমে কমে গেছে।
আস্তে আস্তে রিশাদ পা ফেলে সামনের দিকে পা বাড়ায়। রিশাদ কে খুব সাবধানে ছাদে নিয়ে আসে অনি। ছাদের উপর দোলনায় বসিয়ে দেয় রিশাদকে। একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে থাকে অনি।
রিশাদ অনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিছু সময় পর রিশাদ নিজেই অনিকে তার পাশে বসতে বলে। অনি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রিশাদের পাশে বসে পরে।
দুজন কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তারা যেন নীরবতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
চলবে…….