অনন্যময়ী পর্ব_৫৬
#সানজিতা_তুল_জান্নাত
রিশার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনি। কিছুটা দ্বিধায় আছে সে। এই মূহুর্তে রিশার সাথে রাফির ব্যাপারে কথা বলবে কিনা সেটা নিয়েই সে ভাবছে। সকল সংশয় উপেক্ষা করে অনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এখনই রিশার সাথে কথা বলে নেয়া উচিত।
দরজায় যথাসম্ভব আস্তে করে টোকা দেয় অনি যাতে বেশি জোরে আওয়াজ অন্যকেউ না শুনতে পায়। কোন রেসপন্স পায়না রিশার। আলতো করে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়। অনি রুমের মধ্যে প্রবেশ করে।
রুমের এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে রিশাকে কোথাও দেখতে পায়না। অনির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। ওয়াশরুমেও নেই রিশা। বেলকনির দিকে চোখ পরতেই দেখতে পায় দরজাটা আধখোলা অবস্থায় আছে। অনি সময় ব্যয় না করেই বেলকনির দিকে যায়।
বেলকনিতে রাখা দোলনায় দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুজে বসে আছে রিশা। চুলগুলো এলোমেলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পাচ্ছে। রিশাকে এই অবস্থায় দেখে অনির বুকটা ধ্বক করে ওঠে। রিশাকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
অনির উপস্থিতি রিশা এখনো টের পায়নি।হয়তো সে নিজের কল্পনার রাজ্যে মত্ত হয়ে আছে। অনি রিশার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখতেই রিশা ধড়ফড় করে ওঠে। হঠাৎ এভাবে কারো স্পর্শ পেয়ে রিশা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।
রিশা অনিকে দেখে বুঝতে পারছে না কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে। অনিকে এই সময় এখানে সে প্রত্যাশা করেনি। অনির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
–ভাবী তুমি এখানে? কি হয়েছে?(রিশা)
রিশার দিকে ভালোভাবে চোখ বুলায় অনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে গেছে। ঠিকমতো কথাও বের হচ্ছে না।
–প্রশ্নটা তো আমারও রিশা কি হয়েছে তোমার? (অনি)
–কই কিছুনা তো।তুমি এত রাতে এখানে কি করছো?(রিশা) বলেই নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে রিশা। অনি শুধুই রিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশার অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে হয়তো সে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে আর রিশা বার বার অনির নজর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
রিশাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে মানসিক ভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েছে।চোখেমুখে বিষাদ যেন ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। অশ্রুগুলো সেই বিষাদেরই এক বহিঃপ্রকাশ। রিশার মধ্যে কি চলছে তা সহজেই বোঝার উপায় নেই। তবে অনি যেহেতু আজ রাফি আর রিশাকে একসাথে দেখেছে তাই কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে।
অনি রিশার পাশে বসে পড়ে। রিশা যেন কিছুটা নীরব হয়ে গেছে। অনি রিশার গাল দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। রিশা শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অনিকে দেখে যেন তার আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণাগুলো সব আজ তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে।বার বার যেন আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে রিশার হৃদয়টা।
নিজেকে সামলাতে না পেরে রিশা অনিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এতক্ষণ যাবত হৃদয়ে চেপে রাখা আর্তনাদ গুলো কান্না রূপে বেরিয়ে আসে। অনির আর কোন সন্দেহ নেই যে রিশা সত্যিই রাফিকে ভালোবাসে। রিশার কান্নার বেগ বেড়েই যায়। অনি তাকে থামানোর চেষ্টা করেনা। রিশাও যেন আজ থামার নামই নিচ্ছে না।
রিশার কান্নায় অনির মনটাও ডুকরে ওঠে। চোখের কোণায় অশ্রুগুলো এসে জমা হয়। রিশার কষ্টগুলো তার বুকেও যেন আঘাত হানে। যদি একে অপরের প্রতি ভালোবাসায় থাকে তবে কিসের এত বিষাদ কিসের এত কষ্ট তা অনির কাছে এখনো স্পষ্ট হয়নি।
রিশা কান্না করতে করতে একসময় তার কান্নার বেগ কিছুটা কমে যায়। অনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সময় নেয় রিশা নিজেকে স্বাভাবিক করতে। চোখ দুটো মুছে সে কিছুটা ধাতস্থ হয়।
দুজনেই নীরব আছে। কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। নীরবতা ভেদ করে অনি বলে ওঠে;
–রাফি ভাইয়াকে ভালোবাসো রিশা?(অনি)
অনির কথা শুনে রিশা যেন বেশ ভালোভাবে অবাক হয়।রাফির ব্যাপারটা তো সে কাউকেই জানায়নি। তবে অনি কিভাবে জানলো!রিশা কিছু বুঝতে পারছে না।
–রাফি!ভাবী এসব তোমাকে কে বললো?আমি তো…(রিশা)
–তুমি তো কাউকেই জানাও নি এটাই বলতে চাইছো তো তাইনা?(অনি)
রিশা কোন কথা বলে না। শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনির দিকে। অনির নজরও রিশার উপর স্থির।
–একটু আগে যে তুমি রাফির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে আমি নিচে নেমে দেখলাম দরজা খোলা। বাইরে গিয়ে তোমাকে দেখতে পাই। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম এত রাতে রাফিকে আর তোমাকে দেখে। কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। তাই এসেছিলাম তোমাকে দেখতে। কি হয়েছে রিশা?কি সমস্যা?তুমি এভাবে কান্না করছো রাফিকেও দেখলাম।কি হয়েছে তোমাদের মাঝে।সত্যিই যদি ভালোবেসে থাকো তবে কোন ঝামেলা হয়েছে কি তোমাদের মাঝে?(অনি)
অনির কথাগুলো শুনে রিশা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সে বলতে শুরু করে;
–রাফির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু অতীতের কিছু তিক্ত স্মৃতি রয়েছে যা বার বার আমার বর্তমানে এসে অপ্রত্যাশিতভাবে অনধিকার চর্চা করছে। তুমি হয়তো আমাকে খারাপ ভাবছো এত রাতে আমি একটা ছেলের সাথে এভাবে দেখা করছি। বিশ্বাস করো আমি সেরকম না।আসলে ভাবি তোমাদের বাসায় রাফির সাথে প্রায় এক বছর পর আমার দেখা হয়। তারপর থেকেই প্রায়ই সে আমাকে ফলো করতো। আবার অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেও দেখা হতো। সেদিন রেস্টুরেন্টেও আমার ওর সাথে এক দফা কথা হয়। কদিন ধরেই রাফি খুব পেইন দিচ্ছিল আমাকে। আজ ও আমার বাড়ি অবধি চলে এসেছেম বাধ্য ওর সাথে দেখা করতে হয়েছে।” (রিশা)
–তোমাকে আমি বিশ্বাস করি রিশা। তোমাকে খারাপ ভাবার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি বিশ্বাস করি তুমি ভুল কিছু করবে না। তবে তোমাকে এভাবে দেখাতেও আমার মোটেও ভালো লাগছে না।(অনি)
অনির কথা শুনে রিশা কিছুটা আস্বস্ত হয়। রিশা কিছুটা সময় নিয়ে অনিকে শুরু থেকে সবটা জানিয়ে দেয়। রাফির সাথে সম্পর্কের শুরু থেকে শুরু করে তার সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে সম্পর্কের ইতি টানা কিছুই সে গোপন রাখে না। সবটা শুনে অনি কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
রিশা এতদিন ধরে একা কষ্টগুলো সহ্য করছে। কারো সাথে কখনো শেয়ার করেনি। রিশার চাঞ্চলতার পেছনে চাপা কষ্টগুলো অনুধাবন করারও কোন উপায় ছিল না। কি অদ্ভুত!সে বা পরিবারের অন্য কেউ কখনো টেরই পায়নি ছোট্ট চঞ্চল রিশা কতটা কষ্ট একা সহ্য করে গেছে।
অনি রিশাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। রিশার কিছুটা হালকা লাগছে অনির সাথে সবটা শেয়ার করায়। কিছুক্ষণ পর রিশাকে অনি ছেড়ে দেয়।
রিশার হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে;
–তুমি একা এতটা কষ্ট সহ্য করে গেছো।আমরা কখনো কেউ টেরই পায়নি তোমার কষ্টগুলো।হয়তো নির্ঘুম অশ্রুসিক্ত রাত্রি গুলো তোমার কষ্টের সাক্ষী হয়েছে। তোমাকে খুব ইচ্ছে করছে কিছু কথা বলতে।”(অনি)
–হ্যা বলো না ভাবী কি বলবে?(রিশা)
–তুমি তো জানো তোমার ভাইয়া আর আমার বিয়েটা কতটা অপ্রত্যাশিত ভাবে হয়েছিল। বিয়ের পর পরই রিশাদ আমাকে বলেছিল অদ্রিপুর জায়গাটা সে কোন দিনও আমাকে দিতে পারবে না। আমি নিজেই চাইতাম না কখনো এই সম্পর্কটা বোঝা হিসেবে রিশাদের উপর চাপিয়ে দিতে। তার উপর কিছুটা অপরাধবোধ ও ছিল অদ্রিপুর জায়গাটা নিয়েছি ভেবে। সব সময় এটাই ভাবতাম পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠলে আমি আবার চলে যাব। রিশাদও এটাই চাইত।সময়ের ব্যবধানে রিশাদ আর আমার মাঝে অদৃশ্য ভালোবাসার অনুভূতি গুলো আদান প্রদান হতে থাকে নিজেদের অজান্তেই।রিশাদের জীবনে আমি কখনোই চাইনি অদ্রিপুর জায়গা টা নিতে। আজ অদ্রিপু আবার ফিরে এসেছে। তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে।অদ্রিপুর খুশির জন্য আমি স্বার্থপরের মতো রিশাদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে রিশাদকে ছাড়তে পারবো না। রিশাদকে পেয়ে সত্যিই আমি সৌভাগ্যবান। তার জন্যেও আমার জীবনে স্বাভাবিকতা এসেছে। আমি এত সুন্দর এক পরিবার পেয়েছি। পারিনি শুধু মাত্র অদ্রিপুর কথা ভেবে রিশাদকে ছাড়তে। সবাইকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই বলছি সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাবার আগে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। অদ্রিপুর মতো যেন তোমাকেও পস্তাতে না হয়। নিজের ভালোবাসাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো। হয়তো সে সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।সম্পর্ক শেষ করে দেয়া কোন সমাধান নয়। রাফিকে ছাড়া যে তুমি ভালো নেই সেটা তো বুঝতে পারছো। আর রাফিও যে ভালো নেই তা আমি নিজে উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন তুমি ভেবো দেখো কি করবে। তুমি যে সিদ্ধান্তই নেবে না কেন আমি তোমার পাশে আছি। সবকিছুর উর্ধ্বে তোমার ভালো থাকাটা জরুরি। রাফিকে আমি চিনি না, রাফির ভালো থাকা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।আমার সব চিন্তা তোমাকে ঘিরে।তুমি ভালো থাকলেই কিন্তু আমরা ভালো থাকবো।”(অনি)
রিশা খুব মনোযোগ দিয়ে অনির কথাগুলো শোনে। অনির প্রতিটি কথা তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। তবে প্রচণ্ড রকমের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে রিশা। রাফির তিক্ত কথাগুলো আজও সে ভুলতে পারেনা। মাঝে মাঝেই যেন তার অবচেতন মনে কথাগুলো কানে বাজতা থাকে। ডুকরে কান্না আসে তার। ভালোবাসার মানুষের কাছে থেকে পাওয়া অপমান,অবিশ্বাস সে মেনে নিতে পারেনি। তাই অভিমান করে দূরে চলে এসেছে। রাফিও কোন চেষ্টা করেনি তার মনের রানীর অভিমান ভাঙানোর বিধায় অভিমানটা বেড়ে আজ পাহাড় সমান হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও সে তার অভিমানিনীর মান ভাঙাতে পারছে না। তবে রাফি হতাশ হয়ে চেষ্টা করা থামায় নি। তা দেখেই রিশা আজ যেন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। রাফিকে মুখের উপর কিছু খারাপ কথা শোনালেও ভেতর থেকে যে কীভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তা কেউই টের পায়নি। তার ভেতরে বহমান ঝড়ে যে সব কিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার আভাস কেউই পাচ্ছে না।
নিকষ কালো আঁধার রাতে অনি আরো কিছুক্ষণ সময় কাটায় রিশার সাথে। কথায় কথায় কখন যে রাতটা কেটে গেছে কেউই বুঝতে পারেন। দূর থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
রিশাকে নিয়ে অনি রুমে আসে। রিশাকে একেবারে ফজরের নামায পড়ে একটু ঘুমিয়ে নেবে ভেবে ওয়াশরুমে যায় অযু করতে।অন্যদিকে অনিও তার নিজের রুমে চলে যায়।
রুমে যেতেই সে রিশাদের মুখোমুখি হয়।রিশাদ সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে অনিকে পাশে না দেখে ভেবেছিল অনি হয়তো অযু করতে গেছে।কিন্তু অনিকে না পেয়ে সে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অনি রুমে চলে আসে।
–এত ভোরবেলা কোথায় গিয়েছিলে তুমি?(রিশাদ)
–আসলে একটু রিশার রুমে গিয়েছিলাম।(অনি)
–কেন? রিশার কি কিছু হয়েছে নাকি?(রিশাদ)
–না না কিচ্ছু হয়নি। ঘুম থেকে উঠেছে কিনা দেখতে গিয়েছিলাম। নামাজ পরবে তো তাই। (অনি)
অনি রিশাদের কাছ থেকে এই মূহুর্তে রিশার ব্যাপারে এড়িয়ে যায়। সে চাইছিল রিশা আর রাফির মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেলে জানাবে। রিশার কাছ থেকে সবটা জানার পর অনির এটা দৃঢ় বিশ্বাস যে রিশা আর রাফির মধ্যে খুব শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিভাবে যেন সে তাদের ভালোবাসার গভীরতা টা আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে।
অনির কথায় রিশাদের কোন খটকা লাগে না। কেননা সে জানে রিশা ঘুম থেকে উঠতে পারেনা প্রতিদিন কারো না কারোর তাকে ডেকে দিতে হয়।
রিশাদ আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়তে যায়। অন্যদিকে অনিও ফ্রেশ হয়ে অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে। কিছুটা সময় নিয়ে সে মোনাজাত করে।
নামাজ শেষ করে সে পুনরায় একবার রিশার রুমে যায় আস্বস্ত হওয়ার জন্য রিশা ঘুমিয়েছে কিনা। দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখতে পায় রিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনি কিছুটা স্বস্তি পায়।
একটু পরেই রিশাদ মসজিদ থেকে বাসায় ফেরে। টুপিটা খুলতে খুলতে অনিকে উদ্দেশ্য করে বলে;
— অনন্যময়ী রিশার কি কিছু হয়েছে?(রিশাদ)
অনি বিছানা গোছাচ্ছিল। রিশাদের কথা শুনে সে কিছুটা অবাক হয়। রিশাদ কেন আবার এই কথাটা বলছে?
–কই না তো।তোমাকে কি কিছু বলেছে?(অনি)
–নাহ।এমনিই মনে হলো আর কি। (রিশাদ)
–ওহ আচ্ছা।(অনি)
অনি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে;
–কফি খাবে তুমি?(অনি)
রিশাদ একটা ফাইল হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলে;
–কফি পেলে মন্দ হয় না। বাট তোমাকে এখন এত সকাল বেলা আর কষ্ট করে বানাতে হবে না। তুমি আমার পাশে বোসো তাহলেই হবে। (রিশাদ)
রিশাদের কথা শুনে অনি মুচকি হাসে। অতঃপর অনি বলে;
–উঁহু নাহ।একদম কষ্ট হবে না আমার। তুমি একটু দাঁড়াও আমি এক্ষুণি আসছি। বলেই অনি হাতের কাজ ফেলে রিশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিচে চলে যায় কফি বানাতে।
রান্নাঘরে আমেনার মা একা একা সকালের নাস্তা বানানোর কাজ করছিলেন। অনিকে দেখে এক গাল হেসে পান চিবুতে চিবুতে বলে;
–আরে বউমা তুমি এত্তো সক্কালে!কি লাগবো আমারে কও আমি দিতাছি। (আমেনার মা)
–না না আমার কিছু লাগবে না।আপনি আপনার কাজ করুন আমি শুধু কফি বানাতে এসেছি রিশাদের জন্য। (অনি)
–তুমি খাড়াও আমি বানায় দিতাছি। তোমারে আর কষ্ট করোন লাগবো না। (আমেনার মা)
–না না খালা আমি বানিয়ে নিচ্ছি। (অনি)
অনির জোরাজুরিতে আমেনার মা আর পারেনা। অনি নিজেই কফি বানাতে শুরু করে। হঠাৎ তার খেয়াল হয় আজ শায়লা বেগম রান্নাঘরে আসেন নি।
–খালা মামনি কোথায়?আজ দেখছি না যে রান্নাঘরে।(অনি)
–বড় ম্যাডামের কি হইছে জানি না। আমার ঘরে ডাইকা কইল সকালে নাস্তা বানানোর জোগাড় করতে। (আমেনার মা)
–মামনির কি হয়েছে?শরীর খারাপ?(অনি)
–কি হইছে তা তো কবার পারিনা। (আমেনার মা)
অনি দ্রুত কফি বানানো শেষ করে। আমেনার মার হাতে কফি পাঠিয়ে দেয় রিশাদের জন্য। তারপর সে রান্নাঘর থেকে সোজা যায় শায়লা বেগমের রুমে। শায়লা বেগমের জন্যে কিছুটা চিন্তা হচ্ছে অনির।
দরজায় নক করতেই শায়লা বেগমের গলা ভেসে আসে। অনিকে তিনি ভেতরে যেতে বলেন।
অনি ভেতরে গিয়ে দেখতে পায় শায়লা বেগম বিছানায় শুয়ে আছেন। তাকে দেখে অনি ঠিক ঠাওর করতে পারছে না যে অসুস্থ। তবে কিছুটা দুর্বল মনে হচ্ছে।
অনি শায়লা বেগমের কাছে গেলে তাকে বসতে বলে।
–মামনি তোমার কি শরীর খারাপ?চিন্তিত কণ্ঠে বলে অনি।
–না শরীর খারাপ না। কোমড়ের ব্যথাটা একটু বেড়েছে। তুই চিন্তা করিস না।(শায়লা বেগম)
–আগে বলোনি কেন?ডাক্তার দেখাতে হবে তো।(অনি)
–ডাক্তার তো দেখিয়েছি। তবুও কমছে না। (শায়লা বেগম)
অনি শায়লা বেগমের সাথে টুক টাক কথা বলে। কিছু একটা ভেবে সে শায়লা বেগমকে বলে;
–মামনি তুমি থাকো আমি এক্ষুণি আসছি। বলেই অনি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রান্নাঘরে গিয়ে হট ব্যাগ গরম পানি ভরে নিয়ে মিনিট বিশেক পর হাজির হয় শায়লা বেগমের রুমে। খুন যত্ন নিয়ে সে শায়লা বেগমের কোমড়ে গরম পানির সেঁক দিয়ে দেয়। এতে শায়লা বেগমের ব্যথা কিছুটা উপশম হয়। তিনি আরাম বোধ করেন। অনির পরম যত্ন পেয়ে শায়লা বেগম আজ বেশ সন্তষ্ট হন অনির উপর। মনে হচ্ছিল অনি নিজের মেয়ে হয়েই যেন আজ তার সেবাযত্ন করছে। শায়লা বেগমের অন্তর জুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়। মন ভরে তিনি প্রার্থনা করেন অনির জন্য।
কিছুক্ষণ সময় কাটায় অনি শায়লা বেগমের সাথে এরপর সে রান্নাঘরে যায় সবার জন্য নাস্তা বানাতে। আমেনার মা আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সাবরিনা আর অনি মিলে সবটা সামলে নেয়।
অনি রান্না শেষ করে উপরে নিজের রুমে যায়। রিশাদ এতক্ষণে রেডি হয়ে গেছে অফিসে যাওয়ার জন্য।
–মহারানীর এতক্ষণে আসার সময় হলো। একটু আসছি বলে চলে গেলে আর কফি অন্যের হাতে পাঠিয়ে দিলে। কি করছিলে এতক্ষণ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধতে বাঁধতে কথাগুলো বলে রিশাদ।
অনি বিছানায় বসে দম নিতে নিতে বলতে থাকে; –মামনির একটু শরীর খারাপ।তাই আসতে দেরি হচ্ছিল। রান্না করছিলাম। (অনি)
রিশাদ অনির দিকে ফিরে বলে;
–মামনির কি হয়েছে?(রিশাদ)
–ব্যাক পেইন।চিন্তা করো না আমি গরম পানির সেঁক দিয়ে দিয়েছি এখন ভালো আছে। তুমি তো ব্রেকফাস্ট করবে। নিচে চলো। (অনি)
বলেই অনি বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলে রিশাদ তার হাতটা ধরে বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়।
–রিশাদ এটা কি হলো?চলো তো তাড়াতাড়ি নিচে চলো আমার অনেক কাজ আছে। (অনি)
রিশাদ অনির হাত দুটোতে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে ওড়নাটা দিয়ে তার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম খুব যত্ন করে মুছে দেয়।
–যাবো তো নিচে বাবা। কাজ করে অনেক টায়ার্ড হয়ে গেছো। (রিশাদ)
রিশাদের কথায় অনি মুচকি হেসে রিশাদের বুকে মাথা রাখে। রিশাদ তার প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরে। দিনের শুরুতে ভালোবাসার এই মূহুর্তগুলো অনি রিশাদের সম্পর্কে আরো বেশি দৃঢ় করে তুলছে।
কিছুক্ষণ পর অনি রিশাকে ছেড়ে দিলে রিশাদ তার প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। অনির মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়।
অতঃপর রিশাদ রুম থেকে বেরিয়ে শায়লা বেগমের সাথে দেখা করে। শায়লা বেগমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা শেষে রায়হান সাহেব আর রিশাদ একসাথে নাস্তা করে বেরিয়ে যায়।
অনিও হাতের কাজগুলো শেষ করে শায়লা বেগমকে সকালের খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয়। এরপর শায়লা বেগম নিজের রুমে শুয়ে রেস্ট করেন।
রিশার রুমে গিয়ে অনি দেখতে পায় রিশা এখনো ঘুমিয়ে আছে। মিথিলা তাকে ডাকছে কিন্তু এখনো ওঠার নামই নেই। অনি মিথিলা মিলে রিশাকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করে নেয়।
দুপুরবেলা গোসল শেষ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিচ্ছিল। দুপুরের রান্নাটা শেষ করে অনি একেবারে গোসল শেষ করে নেয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে রিশার কথাটা ভাবছিল। জানিনা রিশা কি সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন রিশা যেন ভালো থাকে। এটাই তার কামনা। শুয়ে থাকতে থাকতে কিছুটা তন্দ্রাভাব চলে আসে অনির।
বিকেলের দিকে ঘুম থেকে জাগা পায় অনি। সাবরিনা বেগম মিথিলা তাকে খাবার জন্য ডেকেছিল। তবে খাবারের চেয়ে ঘুমের আগ্রহটাই বেশি ছিল তার। তাই আর খাওয়া হয়নি।
ঘুম থেকে জাগা পেয়ে ফ্রেশ হয়ে কয়েক অল্প একটু ভাত খায় অনি।
রুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়েই দেখতে পায় রিশার ম্যাসেজ। “ভাবী আমি একটু বাইরে এসেছি। তুমি চিন্তা করো না আমি সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় চলে আসবো। ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি।”
ম্যাসেজটা পড়ে কপাল কুঁচকায় অনি। তবে সে নিশ্চিত নয় রিশা রাফির সাথেই দেখা করতে গেছে কিনা। অনি ফোনটা রেখে আছরের নামাজ পড়তে যায়।
চলবে…..
আসসালামু আলাইকুম?