অনন্যময়ী পর্ব_৪৬
#সানজিতা_তুল_জান্নাত
কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটা রেখে অনির নিকটে চলে আসে রিশাদ। অনি তো আগের মতোই থম কেরে বসে আছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে এখন। রিশাদ অনির নাম ধরে ডাকে তবে কোন সাড়া পায়না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ বুলাতেই রিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
রিশাদ দেখতে পায় অনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে আছে। বেশ ভালো ভাবেই অবাক হয় অনির এমন কান্ডে। পরক্ষণেই তার মনে হয় যে হয়তো ফোনের স্ক্রিন লাইট অফ হয়ে গেছে। কিন্তু রিশাদের কৌতূহলী মন কিছুতেই বুঝতে পারছে অনি কিসের চিন্তায় মগ্ন।
রিশাদ অনির কাঁধ স্পর্শ করে তাকে ডাক দেয়। অনির এবার ধ্যান ভাঙে। রিশাদের তাকিয়ে তাকিয়ে সে কিছুটা থতমত খায়। রিশাদকে আমতা আমতা করে বলে;
–“কিছু বলছিলেন রিশাদ?”(অনি)
–“সেরকম কিছু না। আপনাকে ডাকছিলাম সাড়া দিচ্ছিলেন না। ফোনের দিকে এক ধ্যানে তাকয়ে ছিলেন। কোন সমস্যা অনন্যময়ী? “(রিশাদ)
অনি এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। রিশাদ দেখে ফেলেছে কিনা। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছে না। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকয়ে দেখে স্ক্রিন অফ হয়ে গেছে। তাই কিছুটা স্বস্তি পায়। রিশাদ পুনরায় অনিকে প্রশ্ন করে কি হয়েছে?অনি কিছুটা আমতা আমতা করতে বলে;
–“না কিছু হয়নি তো। ওই একটা পোস্ট পড়ছিলাম আর কি। তেমন কিছু না।”(অনি)
অনির কথা রিশাদের বিশ্বাস হয়েছে কিনা তা অনি রিশাদের মুখভঙ্গি দেখে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবে রিশাদের মন থেকেও পুরোপুরি কৌতূহল দূর হয়নি। রিশাদ এবিষয়ে অনির সাথে আর কোন কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেসে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনির চিন্তা কিছুটা দূর হয়। তবে অদ্রির বিষয়টা নিয়েই তার এখন বেশি চিন্তা। পুনরায় সে ফোন অন করে মেসেজ চেক করে। অনির মনটা এবারে খারাপ হয়ে যায়। অদ্রি পুনরায় আইডি ডিএক্টিভ করে ফেলেছে। অনির মেসেজের উত্তর দেয়া তো দূরের কথা এখনো সে মেসেজটা সিনও করে নি।হতাশ হয়ে অনি ফোনটা পাশে রেখে দেয়। একটু পরেই উঠে গিয়ে অযু করে এশার সালাত আদায় করে নেয়।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার মতো ঘুমোতে যায়। অনি রিশাদও ডিনার শেষ করে সবেমাত্র উপরে এসেছে। অনি অলসভাবে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে রিশাদ সোফায় বসে কাগজ পত্র সব এলোমেলো করে কিসব ডিজাইন বানাচ্ছে। অনি দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কদিন যাবত সে লক্ষ্য করছে রিশাদ তার নতুন প্রোজেক্টটা নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত সময় পার করছে। বেশির ভাগ সময়েই সে কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। মাঝে রিশাদের এত ব্যস্ততায় অনি কিছুটা একা ফিল করে। তবে রিশাদের সাথে যে অল্প সময়টুকু পায় তাতেই সে খুশি।কোন অভিযোগ নেই তার।
রিশাদ বুঝতে পারে অনি কতটা মিস করে। তাই সে একটু কষ্ট করে হলেও রুমেই বেশি কাজ করে।আগে তো সে এসকল কাজ স্টাডি রুমে বসেই করতো বেশির ভাগ সময়।
প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে।চারপাশে সব কিছু নীরব,স্তব্ধ হয়ে গেছে। অনির এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রিশাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। অনি রিশাদের বাহুর মাঝে আবদ্ধ হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। রিশাদের নিঃশ্বাসের শব্দ তার কানে এসে বারি খাচ্ছে। রুমের ডিম লাইটের আলোয় রিশাদকের মুখটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। সোনালি আলোয় রিশাদ্র মুখটাও সোনালি দেখাচ্ছে। অনির নজর রিশাদের উপর স্থির। আর ভাবনায় জুড়ে বিচরণ করছে অদ্রি।
অদ্রির কথা ভাবতেই অনির মনটা অজানা শশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ছে বার বার। নিজের অজান্তেই বোধ হয় সে অদ্রির জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। অদ্রির মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস তার নেই। যদিও সে কোন অন্যায় করে নি তবুও বার বার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অপরাধবোধ জাগ্রত হচ্ছে। সে কি অদ্রির সাথে কোন অন্যায় করে ফেলেছে?না তো। এসব কিছুই তো তার ইচ্ছাকৃত ভাবে হয়নি।সেদিন অদ্রি যদি বিয়ের আসর থেকে এভাবে কাউকে না জানিয়ে চলে না যেত তবে হয়ত কাহিনীটা অন্যরকম হতো। অনি তার আগের অবস্থানে ফিরে যেত আর তার জায়গায় আজ হয়তো অদ্রি থাকত। সে তো এসবের কিছুই চায়নি শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।
অনির নিয়ন্ত্রণে কিছুই ছিল না। তার জন্মের পর থেকে কোন কিছুই তার মন মতো বা স্বাভাবিকভাবে হয়নি। রিশাদের সাথে বিয়েটা তো তার ভাগ্যে আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। তাই তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা অনিবার্য ছিল। হাজার রকমের কল্পনা জল্পনার মধ্যে দিয়ে অনির তন্দ্রাভাব চলে আসে। দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। চোখ খুলে থাকা দায় হয়ে যায়। রিশাদের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ অদ্রির চিন্তায় বেশ বিচলিত সে। কিভাবে অদ্রির মুখোমুখি হবে আর অদ্রিই বা কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে??
_________________
ফোনের স্ক্রিনের ভেতর রিশাদের হাস্যজ্জ্বল মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে আছে একজোড়া অশ্রুসিক্ত নয়ন।গাল বেয়ে ফোনের স্ক্রিনের উপর পড়ে কয়েক ফোঁটা বেদনার কণা। অশ্রুগুলো ক্রমাগত গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছে। বাঁধা দেয়ার কোন প্রচেষ্টা দেখাচ্ছে না। এক নাগাড়ে চেয়ে আছে। একসাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্ত গুলো আজ নিছকই স্মৃতি যা প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়ায়। নীরব কান্না শব্দে পরিণত হয়।এতদিন ধরে ভালোবাসার মানুষের কাছে থেকে দূরে থাকার আর্তনাদগুলো আজ যেন বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
অদ্রি যেন প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আজ বড্ড ক্লান্ত। আজকের এই দিনটার জন্য একমাত্র সে নিজেই দায়ী। ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ের আসরে প্রত্যাখ্যান করে পালিয়ে এসেছিল সে। ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিয়ে নিজের স্বপ্নকে নিজের ক্যারিয়ারকে বেছে নিয়েছিল। সেদিন সে ঝোঁকের মাথায় কত যন্ত্রণাময় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা প্রতিটি মূহুর্ত এখন তাকে বুঝিয়ে দেয়। সে একবারও রিশাদের মতামত নেয়ার চেষ্টা না করে নিজেই সব সিদ্ধান্ত নেয়। ভাবার চেষ্টা করেনি রিশাদ তাকে সব সময়ই সাপোর্ট করেছে এবারেও হয়তো তাকেই সাপোর্ট করে যেত। স্বপ্ন পূরণের মোহে অন্ধ হয়ে সে নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে আজ যন্ত্রণাময় এক জীবনযাপন করছে। সুখবিহীন এক সাফল্যময় জীবনযাপনে সে ব্যস্ত ঠিকি।দিনশেষে ঠিকি সে তার সিদ্ধান্তের জন্য অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছে।
নিজের স্বপ্নটাকে বেছে নিয়ে বোধ হয় সে ভুল করেনি। রিশাদের কাছ থেকে সবটা গোপন করে পালিয়ে আসাটাই তার বোধ হয় সবচেয়ে বড় ভুল। প্রায় পাঁচ বছর চেষ্টা করার পর সে সুযোগ পেয়েছিল তাই সে তার দীর্ঘ সময়ের ভালোবাসার মানুষের হাত না ধরে স্বপ্ন পূরণ করতে দূর দেশে পাড়ি জমায়।
কথাগুলো মনে করেই অদ্রি ডুকরে কেঁদে ওঠে। আজ তাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতোও কোন মানুষ নেই। আগে তো সামান্য মন খারাপ হলেই তার মা বাবা তাকে কতটা আদর স্নেহে ভরিয়ে দিত। আজ তার ভুল সিদ্ধান্তে তার পাশে কেউ নেই। সে রিশাদের সাথে সাথে তার পরিবারের থেকেও দূরে চলে এসেছে। সবার ভালোবাসাকে তুচ্ছ প্রমাণ করে সে সাফল্যের তারকাযুক্ত ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে চলেছে। সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করেতে পেরেছে সে শুধুই মরীচিকার পেছনে ছুটে চলেছে। সকলের মতামত নিয়ে যদি সে কোন সিদ্ধান্ত নিত তাহলে হয়তো এই মরীচিকাই তার জীবনে স্থায়ী সুখে পরিণত হয়ে বয়ে আনতো অঢেল আনন্দের বন্যা।
–“আমি ভুল করেছি রিশাদ তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে। আমি মস্ত অন্যায় করে ফেলেছি। সকলের সাথে আমি অন্যায় করেছি। এই ভুলটা আমার সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না?তোমাকে ছাড়া থাকা টা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আমি অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি জানি আমার উপর তুমি অনেক রেগে আছো অনেক অভিমান জমে আছে।আমাকে তুমি যা শাস্তি দেবে আমি সবটা মাথা পেতে নেব। তোমার সকল রাগ, অভিমান দূর করে দেব। বিশ্বাস করো তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই।আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো। আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেবে?”রিশাদের ছবিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে অনি।
কান্নারা যেন আজ বাঁধ মানছে না। কষ্টগুলো আজ আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে। অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে অদ্রি। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা কান্নার ফলে যেন আরো বেশি নেতিয়ে পড়েছে। তার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। ওই অবস্থাতেই ঘুমে তলিয়ে যায়।
_________________
ভোরের আযানের শব্দ আবছা আবছা রিশাদের কানে ভেসে আসে। রিশাদের অবচেতন মন পুরোপুরিভাবে এখনো জাগ্রত হয়নি। ধীরে ধীরে তার ঘুমের ঘোর কাটছে। আবছা আযানের ধ্বনি তার মস্তিষ্কে জানান দিচ্ছে ফজরের নামাজের কথা।ঘুমের ঘোর কিছুটা কেটে গেলে রিশাদ চোখ মেলে তাকায়। চোখ দুটো কেমন ভারী ভারী লাগছে। তবুও ঘুমকে কাটিয়ে উঠে চোখ মেলে তাকায়।
তার বাহুডোরে আবদ্ধ অনি গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘুম থেকে জাগা পেয়ে প্রিয় মানুষটার মায়াভরা মুখটা দেখার মতো সুখকর অনুভূতি বোধ আর অন্যকিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। এ যেন পরম সুখকর এক বিরল অনুভূতি যা বলে বোঝানো সম্ভব নয় শুধু উপলব্ধি করা যায়। অনির দিকে তাকিয়ে রিশাদ মুচকি হাসে। আজও সবকিছু যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।এই সেই মেয়ে যাকে এক সময় তার জীবনের সবচেয়ে বড় বোঝা ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করতো। আর আজ সময়ের ব্যবধানে এই মানুষটাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটাই যেন তার কাছে দায় হয়ে গেছে। প্রয়োজন থেকে কখন যে মেয়েটা প্রিয়জনে পরিণত হয়ে গেছে তা বুঝতেই পারলো না। দেরিতে হলেও সে তার জীবনে সঠিক মানুষটাকে পেয়েছে।
হারাম সম্পর্কের পেছনে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছে রিশাদ। পরবর্তীতে হারাম সম্পর্কটাকে হালালে পরিণত করতে যেয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে যার মাধ্যমেই সে আজ এই সুখানুভূতিগুলো অনুভব করার সৌভাগ্য পেয়েছে।
অদ্রির প্রতি অনেক রাগ,ক্ষোভ জমে ছিল রিশাদের।তবে আজ আর তার কোন রাগ নেই। কারো প্রতি তার কোন অভিযোগ নেই। জীবনের খারাপ সময়গুলো পার করেই আজ সে এই ভালো মূহুর্ত গুলো উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তা যা করেন তাতেই কল্যাণ। এক সময় যার থেকে মুক্তি চাইতো আজ প্রতিটি মোনাজাতে সেই মানুষটাকে সারাজীবন পাশে পাওয়ার আকুতি। পবিত্র ও হালাল সম্পর্কগুলো এভাবেই যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে যেন।
কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রিশাদ উঠে পড়ে। অনির মাথাটা বালিশে রেখে ভালো করে শুইয়ে দেয়। অনির ঘুমন্ত মুখটা অনির নজর কাড়ে। রিশাদ নিচু হয়ে অনির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। অনি কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে। রিশাদ মুচকি হেসে ওয়াশরুমে যায়।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে একেবারে অযু করে বেরিয়ে আসে। অনির দিকে নজর পরতেই দেখে সে এখনো ঘুমোচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে পাঁচটা বাজে। রিশাদ পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হয়ে নেয় মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনির পাশে বসে অনিকে ডাকতে থাকে রিশাদ।
–“অনন্যময়ী! উঠুন। আযান দিয়ে দিয়েছে নামাজ পড়বেন তো।”
অনির কোন সাড়া শব্দ পায়না। কয়েকবার ডাকার পর অনি কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে। আবছা চোখ মেলে তাকায় অনি। রিশাদের মুখটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। রিশাদ জোর করে অনিকে উঠে বসায়। অনি রিশাদের গায়েই ঢলে পড়ে।
অনির আজ একটু বেশিই ঘুম পাচ্ছিল। আলসেমিতে তার একদম মন চাচ্ছিল না বিছানা ছাড়তে। রিশাদের ডাকটাও এখন তার বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। রিশাদ অনির এ অবস্থা দেখে হাসতে থাকে। অঞ্জ্র সেদিকেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো রিশাদের বুকে ঢলে পড়েও ঘুমোতে ব্যস্ত।
রিশাদ অনিকে জোর করে বিছানা থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। অনিকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়। অনির ঘুমের ঘোর কেটে যায়। এত ভালোবাসা দিয়ে রিশাদের যত্ন নেয়াটা অনি এখন সজ্ঞানে অনুভব করতে পারছে। কতটা ভাগ্যবতী হলে এমন স্বামী পাওয়া যায়। যে প্রতিটি মূহুর্তে অনিকে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখে।রিশাদকে পেয়ে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
রিশাদ অনির চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়ার পর নিজ হাতে যত্ন নিয়ে তোয়ালে দিয়ে তার মুখটা মুছে দেয়। অনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দুচোখ রিশাদের উপরেই স্থির। রিশাদ অনির দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে একধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রিশাদ অনির নাকটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলে;
–“কি হলো মিস একটু আগে তো ঘুমে চোখটাই টেনে খুলতে পারছিলেন না আর এখন কেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন চোখ সরছেই না। “(রিশাদ)
–“কিছু না।আপনি তো নামাজ পড়তে যাবেন। দেরি যাচ্ছে তো আপনার।”(অনি)
–“হ্যা যাবো।আপনিও অযু করে নামাজ পড়ে নিন আমি আসছি।”(রিশাদ)
উত্তরে অনি তার ভুবন ভোলানো হাসি উপহার দেয়। রিশাদের চোখ আটকে যায়। রিশাদ অনির কাছে গিয়ে টুপ করে অনির কানে কানে বলে;
–“সকাল সকাল এভাবে হাসলে যে আপনাকে কি মারাত্মক লাগে। আমাকে মেরে দেবেন তো আপনি।”বলেই রিশাদ অনির গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নামাজ পড়তে যায়।
রিশাদের এমন কান্ডে অনি এক দফা অবাক হয়। কিছুক্ষণ সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উপলব্ধি করে তার সাথে কি ঘটে গেল। লজ্জায় অনির মাথা নিচু করে হাসতে থাকে। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে। আপনা আপনি অনির হাতটা তার গালে চলে যায়। অনির অন্তরে যেন প্রশান্তিতে ভরে যায়।
রিশাদের আগমনের মাধ্যমে অনির জীবনটা ভালোবাসায় ভরে গেছে। তার ফাঁকা ঝুলিটাতেই যেন আজ উপচে পড়া ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো রিশাদ। অতীতের সকল কষ্ট,অপ্রাপ্তি যেন রিশাদের আগমনে আজ একেবারে ঘুচে গেছে।
কিছুক্ষণ পর অনি তার কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে অযু করে বেরিয়ে আসে। একটু বেশি সময় নিয়ে আজ ফজরের সালাত আদায় করে। নামাজ শেষ করে আলমারিতে থাকা ব্যাগটা বের করে একটা সুন্দর বাক্স থেকে ছোট কুরআন শরীফ বের করে। অনেক দিন হলো কুরআন তিলাওয়াত করা হয়নি। দেশে আসার পর থেকে একবারও কুরআন তিলাওয়াত করা হয়নি। আজ তার মনটা বেশ।
অনি পুনরায় জায়নামাজে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করে। যথাসম্ভব নিচু স্বরে ধীরে সুস্থে কুরআন পাঠ করতে থাকে। কি মধুর কণ্ঠস্বর, বুক ভরা প্রশান্তি, ভালোবাসা আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য নিয়ে কুরআন পাঠ করছে।
রিশাদ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে রুমে ঢুকতেই এক মধুর সুর তার কানে ভেসে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় সাদা একটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে কেবলামুখী হয়ে অনি পবিত্র কুরআন পাঠ করছে। কি মনোরম সে দৃশ্য। রিশাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে অনির কুরআন তিলাওয়াত শোনে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়, মুগ্ধ হয়ে রিশাদ কুরআন তিলাওয়াত শুনছে শোনে। সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিশাদ। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক বোঝা মুশকিল।
অনি কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে জায়নাজটা গুছিয়ে রেখে পেছন্ব ফিরে তাকায়। রিশাদকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনি কিছুটা অবাক হয়। রিশাদের ধ্যান ভাঙে।
রিশাদ রুমে প্রবেশ করতেই অনি প্রশ্ন করে;
–“কখন এলেন আপনি?”(অনি)
–“এইতো আপনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন তখনই এসেছি”(রিশাদ)
–“ওহহহ। তো আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? “(অনি)
–“এমনিই আর কি। যাই হোক আপনি কিন্তু মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর কুরআন তিলাওয়াত করেন।”(রিশাদ)
অনি রিশাদের কথায় মুচকি হাসে।
–“হুম। আপনি বসুন আমি আপনার জন্য কফি বানিয়ে আনছি। আপনাকে তো অফিসেও যেতে হবে।”বলেই অনি নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে যায়। রিশাদ অনির চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
চলবে……..
আসসালামু আলাইকুম?