শ্রাবণ সন্ধ্যা পর্ব:-০৫

0
3557

শ্রাবণ সন্ধ্যা পর্ব:-০৫

#আমিনা আফরোজ

শেষ বিকেলের গোধূলি লগ্নের রুক্তিম সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তাই এখন দিনের আলোকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু ডোবা থেকে ব্যঙদের অবিশ্রান্ত ডাকাডাকি শোনা যাচ্ছে। টানা ঘন্টা দুয়েক বৃষ্টির পর এখন অবশ্য বৃষ্টি কিছুটা কমেছে তবে শীতল বাতাস এখনো বইছে।এই শীতল বাতাস আর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে চেয়ারম্যানে সামাদ মিয়া সন্ধ্যাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ছেলের জেদের কাছে আবারো হার মানলেন তিনি।

এদিকে চেয়ারম্যান সাহেব কে বাড়িতে দেখে বিরক্তি ফুটে উঠল আশরাফ সাহেবের মুখে।তবে সেই বিরক্তি চেয়ারম্যান সাহেবকে বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–“কি ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব আপনি হঠাৎ আইজ আমার বাড়ি আইলেন যে?

–“আইবার পারি না নাকি মাস্টার মশাই?”

–“একশবার আইবার পারেন। তয় কারণডা কি চেয়ারম্যান সাহেব?”

চেয়ারম্যান সাহেব ঘরের মধ্যে চেয়ারে আরাম করে বসলেন। তারপর পকেট থেকে পানের কৌটা বের করে সেখান থেকে একটা বানানো পান মুখে পুরে দিলেন তিনি। অতঃপর পান চিবোতে চিবোতে বললেন,

–“আত্মীয়তা করবার আইলাম আপনার লগে?”

–“কি কইতাছেন বুঝবার পারলাম না আপনার কথা?”

–“না বুঝনের মত তো কিছু কই নাই মাস্টারমশাই। আমরা আগামীকাল সন্ধ্যারে দেখবার আসতে চাইতাছি। এইডাই কওনের লাইগ্যা আইলাম।”

চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে আশরাফ সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মেয়েকে যে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য দূরে পাঠানোর চিন্তা করছেন সে বিপদ কিনা নিজেই তার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। তিনি বেশ জোরালো স্বরে বললেন,

–“এইডা আপনি কি কইতাছেন চেয়ারম্যান সাহেব? এইডা সম্ভব না।”

চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

–“সম্ভব হইবো কি হইবো না হেইডা মুই শুনবার চাই নাই। কাল আমরা সন্ধারে দেখবার আইমু এডাই শেষ কথা। আর দিন চারেক এর মধ্যে একটা ভালো দিন দেইখা বিয়েডাও ঠিক কইরা যামু।”

–“কিন্তু…….

আশরাফ সাহেব কে থামিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব আবারো বলতে শুরু করলেন,

–“দেখেন মাস্টারমশাই আপনি তো জানেন আমি মানুষডা বেশি ভালা না। আমি এক কথা দুই বার কইতে পছন্দ করিনা। আমারে খারাপ হইতে বাধ্য কইরেন না। তাই যেইডা হইতাসে হইতে দেন। আপনার মাইয়া সারাজীবন সুখেই থাকবো।”

এই কথাগুলো বলে চেয়ারম্যান সামাদ মিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর থেকে বের হয়ে বাহিরের অবস্থা দেখলেন। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভাল না। যখন তখন হয়ত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। তাই তড়িঘড়ি করে আশরাফ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিকেল থেকে বৃষ্টি হওয়ার ফলে রাস্তায় বেশ কাদা জমে গেছে। টর্চ লাইটের আলোতে বেশ সাবধানতার সাথে পা ফেলে ছেলেকে মনে মনে গালি দিতে দিতে এগিয়ে চললেন বাড়ির পথে।

এদিকে সন্ধ্যায় বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আশরাফ সাহেব গম্ভীর মুখে বিছানায় বসে আছেন। উনার পাশে ওনার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম কোথায় আছেন তবে দৃষ্টি তার স্বামীর মুখপানে। পুরোপুরি ঘটনাটা না জানলেও কিছুটা অনুমান করতে পারছেন তিনি। একসময় নীরবতার বেশ কাটিয়ে আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,

–“কি হইছে হেইডা না কইলে কেমনে বুঝমু আমি? আর ওই বজ্জাদ চেয়ারম্যান আমাগোর বাড়িত আইছিল কিল্লাই?”

স্ত্রীর কথা শুনে উনার মুখের দিকে তাকালেন আশরাফ সাহেব। ভাবতে লাগলেন তার ভাবনা চিন্তা গুলো কি করে যে বুঝতে পেরে যায় আনোয়ারা বেগম। হয়তো অর্ধাঙ্গিনী বলেই এতটা বুঝে তাকে। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,

–“আগামীকাল চেয়ারম্যান সাহেব আমাগোর সন্ধ্যারে দেখবার আইবো হেইডা কইবারই আইছিল।”

স্বামীর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন আনোয়ারা বেগম। তারপর রেগে বললেন,

–“মগের মুল্লুক নাকি। তুমি কিছু কইতে পারলা না?”

–“কইছিলাম কিন্তু ওনি আমার কথা হুইনা আমারে হুমকি দিয়ে গেছে। জানোই তো লোকডা কেমন সাংঘাতিক।”

–“তাইলে এখন কী করবা?”

–“হেইডাই ভাবতাছি সন্ধ্যার মা।”

–“ভাইবা দেখো কি করন যায় ‌। তয় আমি একখান কথা কইয়া দেই আমি কিন্তু আমার মাইয়ারে অমন পোলার লগে বিয়া দিমু না।”

–“এইটা তো আমি ও দিমু না। সেইজন্যই ভাবতাছি কি করন যায়। এমন কিছু করন লাগবো যেন আমাগোর সন্ধ্যার কোনো ক্ষতি না হয়।”

–“হয় এইডা ঠিক কইছো তুমি।”

–“আমি আবার কোন দিন ভুল কইলাম শুনি।”

–“থাক থাক নিজের এত প্রশংসা করন লাগবো না।”

এ কথা বলে তিনি সন্ধ্যাদের ডাকতে গেলেন। আশরাফ সাহেব ও স্ত্রীর পেছনে পেছনে মেয়েদের ঘরে প্রবেশ করলেন।

রাত তখন মধ্যরাত। বিছানায় শুয়ে নানান ভাবনায় মত্ত সন্ধ্যা। কিছুক্ষণ আগে বাবার বলে যাওয়া কথাগুলো এখনো ওর মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেইসাথে প্রচন্ড রাগ লাগছে নেহালের প্রতি। ছেলেটার জন্য যত অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে তাকে। একেতো বাবা তাকে দূরে পাঠানোর চিন্তা করছেন অন্যদিকে আগামীকাল তিনি সন্ধ্যাকে কলেজ যেতেও বারণ করে দিয়েছেন। আপাতত যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে দিতে চান তিনি তারপর সময় সুযোগ বুঝে সন্ধ্যাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিবেন। সন্ধ্যা মনে মনে ভেবে রেখে দিয়েছে আগামীকাল বেশ কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেবে নেহালকে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো তা নিজেও বুঝতে পারল না।

সকালে সোনালী রোদের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল জারা অনেকক্ষণ আগেই উঠে গেছে। সন তড়িঘড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। সন্ধ্যা ঘর থেকে বের হতেই আনোয়ারা বেগম বলে ওঠলেন,

–“কিরে মা মন খারাপ নাকি তোর?”

–” না মা। মন খারাপ কেন হইব?”

–“তুই না বললেও বুঝি আমি।চিন্তা করিস না তোর বাপ কোন না কোন কিছু কইরা এই বিয়া বন্ধ করবি।”

–“আমি জানি মা।”

–“এখন আর মন খারাপ করে বইসা না থাইকা যা কিছু খাইয়া ল।”

–“আচ্ছা মা।”

চেয়ারম্যান সাহেবদের সকালে আসার কথা থাকলেও ওনারা এল বিকেলের দিকে। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে উনার স্ত্রী জয়তুন বেগম আর ছেলে নেহাল এল সন্ধ্যাকে দেখতে। যদিও চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামের একজন মুরুব্বী কে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিহালের জেদের কারণে তা আর হয়ে উঠলো না। নেহাল আজ নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে।হাতে কালো রঙের ঘড়ি। এককথায় নেহাল কে আজ অসাধারণ লাগছে।অন্যদিকে সন্ধ্যাকেও লাল রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। সন্ধ্যা তেমন একটা সাজেনে। শুধু চোখে হালকা কাজল দিয়েছে আর লম্বা ঘন চুল গুলোকে খোপা করে রেখেছে। এতেই সন্ধ্যাকে অপরূপ লাগছে।

একসময় পাশের ঘর থেকে সন্ধ্যার ডাক পড়লো। সন্ধ্যা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। সন্ধ্যা ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে সবাইকে সালাম দিল। সন্ধ্যার আওয়াজ শুনে নেহাল মুখ তুলে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সন্ধ্যার কাজল কালো দুটি চোখ দেখে নেহাল মুগ্ধ চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিহালের মা বলল,

–“ওইখানে দাড়াইয়া আছো কিল্লাই?আমাগোর কাছে আইয়া বহো।”

সন্ধ্যা ধীর পায়ে ওনাদের সামনে গিয়ে বসলো। দেখাদেখির পর্ব শেষ হওয়ার পর চেয়ারম্যান সাহেব দিন চারেকের মধ্যে একটি ভালো দিন দেখে ওদের বিয়ে ঠিক করল। নেহাল তখন বলল,

–“বাদবাকি আলোচনা আপনারা শেষ করুন আমি ততক্ষনে সন্ধ্যার সাথে একটু কথা বলে আসি। ওর অনুমতিও তো জানা দরকার তাই না।”

চেয়ারম্যান সাহেব ছেলের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে মনে মনে বললেন,

–“মনে হচ্ছে সন্ধ্যা না করে দেবে আর অমনি ও নাচতে নাচতে বিয়ে ভেঙে দেবে। আমি যতদূর আমার ছেলেকে চিনি ওই মাইয়া রাজি না হইলেও ওকে জোর করে তুলে নিয়ে যাইয় বিয়ে করবো। আর হেই কিনা অনুমতি জানবার যাইতাছে।”

নিহাল সবার অনুমতি নিয়েই সন্ধ্যাকে নিয়ে ওদের পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। আপাতত পুকুর পাড়ে সন্ধ্যা আর নেহাল ব্যতীত আর কেউ নেই। দুজনেরই দৃষ্টি সামনের দিকে। হঠাৎই নেহাল আনমনে বলে উঠলো,

“শোন কাজল চোখের মেয়ে

আমার বিশ্বাস কাটে বিবশ হয়ে

তোমার চোখে চেয়ে।”

-collected

নেহালের কথা শুনে সন্ধ্যা চমকে নেহালের দিকে তাকালো। নেহাল সন্ধ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

–“শ্যামলতা আমার আপনজন হওয়ার জন্য প্রস্তুত তো তুমি?”

সন্ধ্যা কোনো কিছু না বলেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। নিহাল জোরে জোরে বলে উঠলো,

–“আজ না হয় পালালে কিন্তু বিয়ের পর আমার থেকে পালাবে কি করে শ্যামলতা? আমি কিন্তু তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।”

সন্ধ্যা কিছু না বলে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। নেহালের প্রশ্নের উত্তর আপাতত সন্ধ্যার কাছে নেই। আগামীকাল সন্ধ্যার সাথে কি হবে তাও জানা নেই ওর। মনে মনে ভাবছে নিহালকে কি ঢকানো ওর ঠিক হবে?

চলবে

(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর যারা নীরব আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)

Show quoted text

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here