অচেনা তুমি পর্বঃ৩৪

0
670

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৩৪

আজ বৃহস্পতিবার। সকাল সকাল শুভ্রা আর কুবরা নাস্তা করে রেডি হয়ে নেয় সাদাফের সাথে কলেজে এডমিশন নেওয়ার জন্য।

রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় সাদাফের মা পেছন দিয়ে ডেকে বলছে “নাদিম তো বাড়িতে আছে। তোরা সবাই চলে গেলে বেচারা কি করবে? এর বদল কলেজ থেকে কোথাও বেড়িয়ে ও আসিস। ভালো লাগবে সবার। ”

সাদাফের মায়ের বলতে দেরী কিন্তু তার রেডি হয়ে চলে আসতে এক মূহুর্ত লেইট না।

নাদিমঃ চল রেডি আমি।

সাদাফঃ এই না মাত্র আম্মু বললো! তবে তুই আগে থেকে জানতি?

নাদিমঃ না তবে মাইন্ড রিড করার ক্ষমতা আমার যে বরাবরই বেশি তা অবশ্য তোর থেকে ভালো কেউ জানে না। ( ভাব নিয়ে)

নাদিমের আসার আর বেড়ানোর কথা শুনে তো কুবরার মনে খুশির তর সইছে না। নাদিমের সাথে সময় কাটানোর কথা শুনলে আনমনে হেসে উঠে সে।

কুবরার মুখে হাসির ঝলক দেখতেই সাদাফ নাদিমের কানে ফিসফিসিয়ে বলে “” খুউব তো মনে লাড্ডু ফুটেছে,,, দুজনের মনে, এখন আবার চোখাচোখি হাসাহাসি ও?? ওয়েল ডান চালিয়ে যা। তুই যে কতো ছটফট করছিলি আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য তা তোর এই ১০ সেকেন্ডে রেডি হওয়াতে বুঝে গিয়েছি। ( চোখ টিপ দিয়ে)

নাদিম কিচ্ছু না বলে এক পলক কুবরার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে চুলকে গাড়ির দিকে রওনা দেয়।

নাদিম ড্রাইভিং সিটে বসে আর কুবরা তার পেছনে। শুভ্রা আর সাদাফ পেছনে পাশাপাশি বসে। নাদিমের পাশের সিটে কুবরা বসা মাত্র সামনের লুকিং গ্লাস নাড়িয়ে কুবরার চোখ বরাবর করে দেয়।

মানে গ্লাসটা এমন ভাবে সেট করে যেন নাদিম নিজের সিটে বসে কুবরাকে দেখতে পায়।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। সাথে রেডিও তে পুরোনো দিনের কিছু বাংলা ভালোবাসার গান। সাদাফ চোখ বন্ধ করে গান অনুভব করছে আর পাশে বসা শুভ্রার হাত নিজের হাতবদ্ধ করে রেখেছে। শুভ্রা ও মনে মনে সে গান গাইছে আর জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।

কুবরা পাশের জানালার গ্লাস নামিয়ে সেখানে হাত দিয়ে তার উপর মুখ রেখে ব্যস্ত ঢাকা নগরী দেখতে ব্যস্ত। বাইরের বয়ে বেড়ানো বাতাসে কুবরার খোলা সিল্কি চুল উড়ে এসে বার বার আলতো ভাবে নাদিমের মুখে বারি খায়। আর নাদিম ও কুবরার চুলের সেই মন মাতানো ঘ্রান উপভোগ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে।

থেকে থেকে নাদিম সামনের লুকিং গ্লাস দিয়ে বার বার কুবরার দিকে তাকাচ্ছিলো। হঠাত কুবরা গ্লাসের দিকে তাকাতেই দেখে নাদিম তার দিকে তাকিয়ে আছে । মুচকি একটা হেসে কুবরা আবার ও বাইরের পরিবেশ দেখাতে মন দেয়।

প্রায় মিনিট ১৫ পর গাড়িটা একটা গেইট দিয়ে ঢুকে বিশাল এক মাঠে প্রবেশ করে। গাড়ি থেকে নেমে দেখে সামনে তিনটি পর পর ৪ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং। এগুলো সম্ভবত কলেজের ক্লাসরুম।

হেটে হেটে কিছু দূর গিয়ে দেখে একতলা বিশিষ্ট একটা ক্যান্টিন। আরেকপাশে খেলাধুলা করার মাঠ। কলেজের ছেলেমেয়েরা কিছু গল্প গোজব করছে, কেউ বা খেলছে, কেউবা ক্লাসের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, কেউবা ক্যান্টিনে টিফিন খাচ্ছে।

এখন সম্ভবত ক্লাস শুরু হবে। ১১ টা বাজে মাত্র।

সাদাফ সকলকে নিয়ে অফিস রুমে যায়। তারপর শুভ্রা আর কুবরাকে এডমিশন করিয়ে দেয়। হ্যাড স্যার শুভ্রা আর কুবরাকে কলেজের সকল নিয়ম কানুন এবং ফ্যাসিলিটিস বুঝায়। সব মিলিয়ে দুজনের ভালোই লাগে। তিনি জানান শনিবার থেকেই তারা কলেজে জয়েন কর‍তে পারবে।

শুভ্রা তো খুব খুশি নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশ, নতুন ভাবে পড়াশোনা শুরু করতে পারবে বলে।
তবে পড়াশোনার বিষয়টা কুবরার খুব বিরক্ত ই লাগছে। তবু নতুন কলেজের ব্যাপারটা তার কাছেও খুব এক্সাইটেড।

কলেজ থেকে বেরিয়ে সকলে সবার আগে লাইব্রেরিতে যায় স্যার এর লিখে দেওয়া অনুসারে বই কিনতে। তারপর দুই জনের জন্য দুই সেট দুই সেট বই খাতা যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস সব কিনে গাড়ির ডিকিতে রাখে।

পড়াশোনা বিষয়ক সব ব্যাপার স্যাপার শেষ হলে নাদিম গাড়ি স্টার্ট দেয় এখন ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। গন্তব্য এখন লেকের ধারে পার্কে।

সকালে এখান কার পরিবেশ টা শান্ত থাকে। একদম জন মানবহীন। এই সময় ব্যস্ত নগরীর মানুষ নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই একান্তে সময় কাটানোর জন্য নাদিম সবাইকে এখানে নিয়ে আসে।

?️?️?️?️?️

লেকের সামনে এক বেঞ্চিতে বসে আছে শুভ্রা। সামনের ওই লেকের মাছ গুলোকে একটা একটা করে খাওয়ার দানা ছুড়ছে আর তৃপ্তি সহকারে চেয়ে আছে। একটু পর সাদাফ এসে পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে চোখ দুটি আবদ্ধ করে নেয়। শুভ্রা মুচকি হেসে বলে “” মিস্টার চৌধুরী কি লুকোচুরি খেলছে? তবে তো তিনি প্রথম বারে হেরে গেলেন আমি যে ধরে ফেলেছি। “””

সাদাফঃ শুভি তুমিও না। কোথায় ভেবেছি তোমায় ভয় দেখাবো। ( ঠোঁট উলটে)

শুভ্রাঃ উমাগো….. আমার কি ভয় লাগছে!!! বাচাও…. এই তো আমার ভয় লেগেছে ( ফিক কিরে হেসে)

সাদাফঃ শুভি তুমিও না খুব দুষ্টু। এমনিতে সবার সামনে হলে কতো ম্যাচিউর আর আমার সামনে সব শয়তানী।

শুভ্রাঃ কারন আপনি তো আপনিই। আপনাকে আমার আসল রুপ না দেখিয়ে কাকে দেখাবো বলুন তো (?)

সাদাফঃ হুমম তাই তো আমি আমার এই শুভিকে এত্তো ভালোবাসি। ( শুভ্রার হাতে কতোগুলো বেলুন ধরিয়ে দিয়ে)

শুভ্রাঃ আয়ায়া এত্তোগুলো সুন্দর সুন্দর বেলুন!!

সাদাফঃ তোমার পছন্দ হয়েছে?

শুভ্রাঃ হ্যা খুউউব!!! ( সাদাফকে জড়িয়ে ধরে )

সাদাফ ও শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে। মাঝে মাঝে শুভ্রার এমন বাচ্চাময় আচরণে সাদাফ নিজেও তাকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসে। সারাদিনের গম্ভীর্যতা কাটিয়ে যখন একান্তে মন প্রফুল্ল থাকে তখন এমন আচরণ করে সে। আর সাদাফ ও সেটা উপভোগ করে।

মাথার উপর ইট,পাথরে তৈরি বিশাল এক ছাতার ছায়া। তারই নিচে দাঁড়িয়ে কবুতরকে গমের দানা ছিটাচ্ছে কুবরা। ক্ষুদার তরে কবুতরগুলো কুবরার গায়ের উপর উপছে পড়ছে। হামলে পড়ছে তার হাতে থাকা ওই শস্যদানার উপর। তবে কুবরা এই পরিবেশটা খুব উপভোগ করছে।

কক্সবাজারে থাকতেও সারাদিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে কবুতর, হাস, মুরগী নিয়ে পড়ে থাকতো সে। আজ এখানে এসে সেই স্মৃতিগুলো যেন চাঙ্গা হয়ে উঠে। কুত কুত কুত বলে বলে কবুতরকে পরম যত্নে খাবার খাওয়ায় সে।

নাদিমঃ এই নাও কুবরা আইসক্রিম।

নাদিমের উপস্থিতি টের পেয়ে সকল কবুতর ঝাক বেধে এক সাথে বিরাট পাখার আওয়াজ করে সকলে দূরে সরে যায়। রাগে কুবরার গা জ্বলে শিন শিন করছে।

কুবরাঃ আপনাকে এখানে হুট করে কে আসতে বলেছে?? কবুতরকে খাবার দিচ্ছি দেখছেন না?? দিলেন তো সবগুলোকে দূরে তাড়িয়ে!!! ( কটমট করে)

নাদিমঃ ওরা নাহয় দূরে চলে গিয়েছে। আমি তো কাছে এসেছি। আমায় দেখো না?? ( কোবার চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগানো কন্ঠে)

নাদিমের এমন তাকিয়ে থাকা আর এই স্টাইলে কথা বলায় কুবরার মন কিছুতেই আর স্থির রাখতে পারে না। ক্রমশ আরো আবেগময় নরম হয়ে পড়ে নাদিমের উপর৷ তবু নিজেকে শক্ত করে মুখ খুলে কুবরা।

কুবরাঃ আচ্ছা নিলাম কাছে। তবে আসুন এই নেন এই গমের দানা গুলো খান। ওরা তো চকে গিয়েছে। এখন তো এসব নষ্ট হয়ে যাবেন। আপনার জন্য যখন চলে গিয়েছে আপনি যখন তাদের বদলে এসেছেন তবে এই নিন খান!! , আমি কিন্তু অপচয় একদম পছন্দ করি না। ( গম নিয়ে হাত বাড়িয়ে)

নাদিমঃ নাও আগে তোমি আইসক্রিম টা খাও গলে যাচ্ছে। তারপর দেখা যাবে । ( কুবরার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে)

আইসক্রিমে দুই তিন বাইট দেওয়ার পর কুবরা আবারও সেইম কথা বলে উঠে।

কুবরাঃ এই নিন এগুলো আইসক্রিমের সাথে মিলিয়ে খান। একদম কত্তো ভালো খেতে দেখুন। ( গমের দানা সামনে রেখে)

নাদিম একবার কুবরার বাড়িয়ে রাখার হাতের দিজে তাকায় আরেকবার তার চোখের দিকে। চোখের পলক ফিরতেই নিচু হয়ে নাদিম কুবরার একদম কাছাকাছি চলে আসে।

কুবরার কাছে আসলেই তার নিচু হয়ে যেতে হয় কারণ নাদিম হলো ৬ ফিট আর কুবরা ৫ ফিট ২ ইঞ্চি। যার কারনে তার ঘাড় নামিয়ে নিচু হতে হয়।

কুবরা তার চোখ দুটো কে রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় করে নাদিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদিম আরো কাছে এসে কুবরার ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা আইসক্রিম টা নিজের ঠোঁট আলতো করে লাগিয়ে খেয়ে নেয়।

আকষ্মিক নাদিমের এহেন কাজে হতভম্ব হয়ে এপাশ ওপাশ চারদিকে চোখ বুলাতে থাকে কুবরা। আশে পাশে কাউকে না দেখে স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলে সে। দুপুরের খাওয়ার এই টাইমে কেউই ছিলো না জায়গা টায়। এবারে মতো ইজ্জত বড় মাপের রক্ষা হয়ে গেলো তার। ভেবেই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সে।

নাদিমঃ এভাবে পাগলের মতো করছো কেন?? বার বার খেতে বলছো। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বলে। তুমিই তো বললা অপচয় তোমার পছন্দ নয়। এখন খেয়ে দিলাম বলে চারদিকে এমন উঁকিঝুঁকি করছো কেন?

কুবরাঃ আপনাকে আমি এগুলো খেতে বলেছি। বয়রা নাকি??

নাদিমঃ এগুলো তো পাখিদের খাবার আমি কি করে খাবো? আমার পক্ষে যেটা খাওয়া সম্ভব সেটাই খেয়েছি। বাই দ্যা ওয়ে খুব সুইট ছিলো। ( চোখ টিপ দিয়ে)

লজ্জায় কুবরা কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিলো। সবসময় নিজের জ্বালে নিজেই ফেসে যায় এভাবে। আর সেই সুযোগ ই নাদিম মোক্ষম ভাবে নিয়ে নেয়।

আরো কিছুক্ষণ থাকার পর সকলে মিলে রেস্টুরেন্টে যায় লাঞ্চ করার জন্য। খেয়েদেয়ে বাড়ির সকলের জন্য বিভিন্ন স্ন্যাকস আর ফ্রুটস নিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে তারা।

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here