অচেনা তুমি পর্বঃ১৬

0
1054

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ১৬
মেয়েটির কন্ঠ শুনে এবার সাদাফের বুঝতে বাকি রইলো না সে কে।
এবার সাদাফ শক্ত গলায় মুখ খুলে বললোঃ ইলিয়ানা আমি এখানে ঘুরতে আসি নি অফিসের ইম্পোরটেন্ট কাজে এসেছি। আর আম্মু আব্বু ডাক্তার দেখাতে এসেছি। আর এভাবে লেপ্টে আছো কেন। দূরে সরে দাড়াও। আমার কাজ আছে অফিসে। যেতে হবে আমায়, সরো।

ইলিয়ানাঃ ওওও স্যাডি এমন করো কেন সবসময়। যখনই তোমার সাথে দেখা হয় এমন পালাই পালাই কেন করো।

সাদাফঃ ছাড়ো আমায়। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

সাদাফের কথায় ইলিয়ানা একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। ইলিয়ানার সরে দাড়াতেই শুভ্রা ইলিয়ানার মুখ দেখে আরেকদফা ধাক্কা খায়। শুভ্রার মনে হচ্ছে যেন অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ও তার আরও অবাক হলে কম হবে না ।

এটা তো সেই মেয়ে যাকে আমি সোহেলের সঙ্গে দেখেছিলাম। এই মেয়েটা এখানে কি করছে। আর মি.চৌধুরীর সাথেও বা উনার কি সম্পর্ক। তবে কি এই মেয়েটা উনার ঘনিষ্ঠ কেউ হয়? আর এই মেয়েটার আচরণে বাবাই, মামনী ও কিছু বলছে না কেন? (শুভ্রা মনে মনে এসব চিন্তা করতে থাকে) ।

সাদাফের বাবাঃ এ কেমন সভ্যতা ইলিয়ানা? আমরা এতো গুলো গুরুজন এখানে আছে। অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলো। আর এসব কি পোশাক পড়ে আছো? এটা কি পার্টি?

ইলিয়ানাঃ ওওও বাবাই তোমি এতো ব্যাকডেটেট কেন? একটু নিজেকে আপডেট করো। এখন তো এগুলোই ফ্যাশন।

সাদাফের বাবাঃ ফ্যাশন হলে কি বড়দের সামনে ও এসব পড়ে আসা যাবে নাকি। দেখ শুভ্রাকে দেখ। সে ও তো তোমার বয়সী। অথচ সে কি এসব ফ্যাশন করেছে?

ইলিয়ানা মাথা ঘুরিয়ে দেখে সুন্দর করে এক মেয়ে সেলওয়ার কামিজ পড়ে আর মাথায় হাত পর্যন্ত হিজাব পড়ে হাতে একটা প্লেট নিয়ে টেবিলের সামনে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার কেম জানি মেয়েটির মুখ খুন চেনা চেনা লাগছে। হয়তো এর আগেও কোথাও দেখা হয়েছিল তাদের।

শুভ্রাকে দেখে ইলিয়ানা মুখ ভেংচি দিয়ে বলেঃ কাম অন বাবাই। শেষে কিনা কাজের লোকের সাথে আমার তুলনা করছো?
সাদাফের বাবাঃ ইলিয়ানা সে কোন কাজের লোক নয় আমার বোনের মেয়ে শুভ্রা। (দাত কটমট করে)
ইলিয়ানাঃ ও তাই। তা এমন খ্যাত এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাবাই এর ভাগ্নি মানে নিশ্চয় তুমি অনেক বড়লোক এভাবে সং সেজে থাকার মানে কি। যে কেউ ই তো তোমায় কাজের লোক বলবে ( মুখ বাকিয়ে হেসে)
সাদাফের ইচ্ছে করছিলো ইলিয়ানার গায়ে ঠাটিয়ে একটা চড় দিতে। হাটে হাত দাত কটমট করছে সাদাফের। সে একবার নাদিমের দিকে তাকায় তো একবার ইলিয়ানার দিকে তাকায়। নাদিম তো বেচারা মনে মনেই শেষ সেখানে মুখে আর কি বলবে। কারণ নাদিম যদি ইলিয়ানাকে না বলতো তবে ইলিয়ানা এখানে এসে এমন ঝামেলাও করতো না।

শুভ্রাঃ আসলে আমার বাবা মায়ের অঢেল টাকা পয়সা থাকলেও আর না থাকলেও আমি এসবের ভালোই ব্যবহার করতে জানি। এই নয় যে আমার কিপটে স্বভাবের জন্য নই বরং আমি আমার দ্বীন এবং চলতি জিবনের কথা ভেবেই আমি এভবে চলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর আপনি কোন দুনিয়ায় আছেন? হয়তো সবকিছু এখনো ভালোভাবে জানেন না তাই এভাবে চলেন। সময় থাকতে আল্লাহর পথে ফিরে আসুন। (ইলিয়ানার চোখে চোখ রেখে)

শুভ্রার কথায় ইলিয়ানার গা জ্বলে খা খা করছে। এইটুকুনি একটা মেয়ে কিনা তাকে এডভাইস দিচ্ছে।

ইলিয়ানাঃ বাই দ্যা ওয়ে। আমার না তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা এর আগেও কি আমাদের দেখা হয়েছে?

শুভ্রাঃ কি জানেন তো আপু। পৃথিবীটা না গোলাকার। ঘুরেফিরে কিন্তু ঠিকি কয়েকবার একই মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। কে বলতে পারে এভাবেই হয়তো কোনো একদিন আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিলো। হতে পারে সেটা খুব একটা ভালো কাজের ক্ষেত্রে নাহয় খুবই জঘন্য কোনো পরিস্থিতিতে ( ইলিয়ানার দিকে ঝুকে)

শুভ্রার কথাগুলো ইলিয়ানার কাছে কেমন ধোয়াশার মতো লাগছে। কি সব বলছে এই মেয়ে আগামাথা তো কিছুই বুঝছি না। শুধু ইলিয়ানা নয় শুভ্রার কথায় বাড়ির বাদবাকি সবাই বেশ অবাক। বিশেষ করে সাদাফ।
শুভ্রার মা আর কুবরা শুভ্রার এহেন কথায় অবাক হয় নি। কারন তারা জানে শুভ্রা খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ তবে সে যদি কোনো কারণে রেগে যায় তারও বহিপ্রকাশ করবে না সে। কিন্তু সে অনুযায়ী যার উপর সে রেগে আছে ঠান্ডা মাথায় তার মাথা পাগল করে তাকে রাগিয়ে দিবে সে। এখন তারা অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে ইলিয়ানার উপর সে কেন রেগে আছে।

এদিকে শুভ্রার আর ইলিয়ানার কথা কাটাকাটির পরিস্থিতি সামলে উঠার জন্য সাদাফের মা এবার নিজেই বলে উঠলোঃ আসলে ইলু আমার বোনের মেয়ে। টাউনে বড় হয়েছে তো তাই এভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করতে। আর শুভ্রা ও তো এতোদিন টাউনে ছিলো, তাই হয়তো কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে গিয়েছে আর কি। এসো এসো সবাই নাস্তা করে নিই।

সাদাফঃ না আমার খিদে নেই আপাতত পরে খেয়ে নিবো।
ইলিয়ানাঃ কেন স্যাডি?? অন্তত আমার জন্যে হলেও আমাদের সাথে খেতে বসো। কতোদিন পর তোমাদের সাথে দেখা হয়েছে । আসো আসো খেয়ে নিই। ( সাদাফের হাত ধরে টানতে টানতে)
সাদাফ আগে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্রা ইলিয়ানার ধরা সাদাফের হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। স্বভাবিক ভাবেও নয় একেবারে শক্ত মুখে শান্ত দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে আছে।

শুভ্রার এমন রুপ সাদাফ আগে কখনোই দেখেনি। হয়তো ছিলো হাসি খুশি নাহলে একটু মন খারাপ। তবে আজকের ওই রুপ তার বড্ড অচেনা লাগছে আজ।

সাদাফঃ ইলিয়ানা ছাড়ো আমাকে। আর এভাবে গা ঘেঁষে ঘেঁষে কেন থাকো। দূরে সরো। (বিরক্তিতে)
ইলিয়ানাঃ ওমা। দুদিন বাদে তো আমার সাথেই থাকতে হবে। এতো লজ্জা কিসের। (কিঞ্চিৎ হেসে)
সাদাফঃ লজ্জা মাই ফুট। আর তোমায় আমি আগেও বলেছি আমি তোমায় স্রেফ এন্ড স্রেফ বোনের চোখেই দেখি। নাথিং এলস। গট ইট? নাও খেলে খাও আদার ওয়াইস ইউ ক্যান গো নাও।

ইলিয়ানাঃতুমি আমায় চলে যেতে বলছো স্যাডি। এতো বড় অপমান করতে পারলে। তুমি জানো আমার পেছনে কতো ছেলে লাইন দিয়ে বসে থাকে আর আমি তো তাদের পাত্তা না দিয়ে শুধু তুমাকেই ভালোবাসি। আর তুমি কিনা আমাকে পাত্তাই দাও না।

সাদাফ আর ডান বা না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে গেলো। ইলিয়ানা গিয়ে সাদাফের মাকে গিয়ে বিচার দিতে যায়।
ইলিয়ানাঃ দেখেছো হাম্মি তোমার ছেলের কতো এটিটিউড। কেন বলো না আমাকে এতো পাত্তা দেয় না ও। ( মুখ ন্যাকা করে)
সাদাফের মাঃ সাদাফ যখন চায় না তখন যেচে বার বার কথা শুনত্র যাস কেন। আর কতো কথা শুনবি। ও তো বলেছে ও তার ডিসিশন থেকে নড়বে না। তাহলে কেন শুধু শুধু জোর করছিস মা?

ইলিয়ানাঃ তুমিও আর তোমার ছেলের সাফাই গাইও না তো। বিয়ে তো আমি তোমার ছেলেকেই করবো। বাই হুক অর বাই ক্রুক। ( এই বলে সে ও গটগট করে চলে গেলো)

সাদাফের মাঃ আরে খেয়ে তো যা।
সাদাফের বাবাঃ মেয়েটা আর মানুষ হলো না। ( একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে)

সাদাফের মাঃ আসলে কি বল তো নাজু। ওই যে আমার বোন ছিল ওরই মেয়ে। মেয়েকে শহরে বড় করে শহরেরই কালচারে বড় করেছে। কিন্তু বড় হওয়ার পরেও সে এখনো ছোটদের মতো চলতে চায়। মাঝে মাঝে তো ওর এমন কাজে আমার নিজেরও লজ্জা করে। নিজের বোনের মেয়ে বলে কিছু বলতেও পারি না। তার উপর বড় হওয়ার পর থেকে সাদাফের ও পিছু ধরেছে। সাদাফ এসব মেয়েলি ব্যাপার স্যপার একদম সহ্য করতে পারে না। তবুও এই মেয়ে নাছুরবান্দা।

শুভ্রাঃ বয়সের সাথে মামনি সবার ই মন এবং মানসিকতার পরিবর্তন হয় । কেউই ছোট থেকে যায় না। যদি সেটা হয় তাহলে সেটা হতে পারে তার মানসিক সমস্যা আর না হয় ইচ্ছাকৃতভাবে সেই হিসেবে চলা।

এদিকে নাদিম তো রীতিমতো কাপাকাপি করছে। সাদাফকে বন্ধু হিসেবে ভয় পায় না তবে কোনো কারনে রেগে গেলে সে মা বাবা আর পরানের বন্ধু কিছুই মানে না।

কুবরাঃ কি গো বাদাম ভাইয়া। ওই ইলিয়ানা না শিয়ানাকে দেখে এখনো শক্ত হয়ে আছেন নাকি? অবশ্য হওয়ারই কথা। আপনার তো এমন মেয়ে ই পছন্দ।
নাদিমঃ হুম অবশ্যই পছন্দ। আসলে লো ক্লাস মেয়েদের না আমার একদম ই পছন্দ না। বরাবরই আমি যেমন হ্যান্ডসাম তেমন স্টাইলিশ মেয়েই পছন্দ।

কুবরার জানি এটা শুনেই মনটা বিষিয়ে গেলো। কথাটা কেমন জানি তার মনে হচ্ছে এটা তাকেই ইনডিরেক্টলি উদ্দ্যেশ্য করে বলা। তবে এতো ফ্লার্ট মার্কা কথা কেন বলে তাকে। কুবরা তো ইলিয়ানার মতো ওতো স্টাইলিশ ও নয়। তবে সেই নাদিম কেন সারাক্ষণ তার পিছনে ঘুর ঘুর করে। অবশ্য বড়লোকদের তো বড়লোকেরই পছন্দ হবে। সেখানে কুবরা তো মিডেলক্লাস ফেমেলির মেয়ে। এসব ভাবতেই কুবরার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠে। মুখ ভেংচি দিয়ে হুহ বলে নাদিমের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

নাদিম ভেবেছিলো এটা বলার পর প্রতিবারের মতোই তাকেও একগাদা ইনসাল্ট করবে। তবে আজ তা না করে চুপচাপ চলে গেলো!! যাওয়ার সময় কিন্তু সে ঠিকই খেয়াল করেছে কুবরার চোখে জল। তবে কি সে তার কথায় কষ্ট পেলো??

অফিসের কাজ শেষে সাদাফ আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। আজ কোনো মতেই কাজে মন বসছিলো না। মাথাটা রাগে ধরে আছে।

সাদাফ ফ্রেস হয়ে বের হয়ে এসে দেখে টেবিলে কফি রাখা আছে তবে কফি আনা ব্যক্তিটি আজ নেই। শুভ্রা যবে থেকে এসেছে তখন একদিন অফিস থেকে এসে শুভ্রা একবার সাদাফ কে কফি দিয়েছিলো। এর পর থেকে সাদাফের রোজ অফিস থেকে এসে শুভ্রাকে আর কফিকে সামনে পাওয়া চাই ই চাই।

দুপুর বেলা খেতে বসলেও আজ দুই বোন চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। আজ দুবোনের এক জনও টু টিও কথা বলে নি। খাওয়া শেষে চুপচাপ খাবার রেখে দিয়ে এসে আবার দুজনেই গুম হয়ে যায়। এদিকে নাদিম আর সাদাফ শুধু দুজন দুজনের মুখ দেখে নিজেরাই মুখকে প্রশ্নবোধক চেহারা করে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

খাওয়াদাওয়া শেষে শুভ্রার মা আর সাদাফের মা বেলকনিতে দোলনায় বসে। আর সাদাফের বাবা খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাতে চলে যায়।

এই সুযোগে সাদাফ শুভ্রার সাথে কথা বলার জন্য রুমে যায়। গিয়ে দেখে শুভ্রা নেই। রুমের বেলকনিতে গিয়ে দেখে সেখানেও নেই। রান্নাঘর কিংবা ওয়াশরুমেও নেই। সাদাফকে এভাবে এদিক ওদিক খুজতে দেখে নাদিম।

নাদিমঃ দোস্ত কি হইছে? কি খুজছ?

সাদাফঃ ভাই শুভ্রা কে দেখেছিস?

নাদিমঃ না দোস্ত দুই বোন কই গেলো বুঝতে পারছি না তো। (ঠোঁট উলটে)

সাদাফঃ দুই বোন মানে?? তুই আবার কুবরার পিছনে লেগেছিস নাকি নাকি। তোর আবার ওকে খুজার কি দরকার? ( চোখ ছোট ছোট করে)

নাদিমঃ আম.. আ.. মানে.. দূর বেডা তুই সবসময় সবকিছু নেগেটিভ ভাবে নিস। আসলে আমি..

সাদাফঃ আসল নকল কিচ্ছু না রে নাদিম। নাদিম দেখ কুবরা কিন্তু খুব ছোট এখনো। মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে। তুই যথেষ্ট ম্যাচিউরড। প্লিস অন্তত ছোট্ট মেয়েটার ইমোশন নিয়েও খেলিস না ভাই।

নাদিমঃ আমারে কোন বাগারে পাইছে ওই পিচ্ছি মেয়েরে লাইন মারবো। খাই দাই আমার কোনো কাজ নাই না? তুই আগে ভাবিরে খুজ। এক কাজ কর আমি ছাদে দেখি তুই না হয় নিচে গিয়ে দেখ বাগানে গেছে নাকি।

সাদাফঃ আচ্ছা চল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here