#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ০৬
দরজা বন্ধ করতেই শুভ্রা হাপাতে থাকে। নিশ্বাস যেন ভারি হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একি হতে যাচ্ছিলো আজ তার সাথে। আজ যদি কোনো অঘটন হয়ে যেতো তাহলে বাইরের মানুষগুলো কে সে কি করে মুখ দেখাতে পারতো। এসব ভেবে হাউমাউ করে কাদতে থাকে। চিতকার দিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে হাটুতে মুখ গুযে কাদতে থাকে।সে জানে চিৎকার দিলেও তার চিৎকার শুনার মতো পাশে কেউই নেই। কিন্তু এদিকে যে এক শীতল চোখজোড়া তার দিকে চেয়ে আছে তার কাছে যে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে চাচ্ছে এতে তার কোনো ধারণাই নেই।
৯ টার দিকে বাবা মাকে নিয়ে বাড়িতে এসে সাদাফ আর নাদিম। অফিসের ৫ তলাতেই তারা আজ শিফট করেছে যেহেতো মা বাবা ও অনেক দিন থাকবে। খাওয়া দাওয়া এবং জরুরি কথাবার্তা শেষে প্রায় ১২ টার দিকে সাদাফ নিজের রুমে আসে। ফ্রেস হয়ে এসেও মাথাটা কেমন তার ঝিমঝিম করছে। তাই এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ৫ তলা থেকে শুভ্রাদের ৪ তলার জানালা ভালো করেই দেখা যায়। আরো উচু হওয়াতে শুভ্রা যে নিচে বসে কাদছিল তা ভালো করেই এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। তবে এতক্ষন অন্ধকার থাকাতে আগে যা হয়েছিল তা কিছুই দেখেনি। শুভ্রা যখন দরজা বন্ধ করেছিল তখনই সাদাফ বারান্দায় এসেছিল। শুভ্রা কে এভাবে হাউমাউ করে কেদতে দেখে বুকের ভিতর আবার ছ্যাত করে উঠলো।
আচ্ছাহ এই মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দেখলে আমার ভেতরে এতো অস্বস্তি কেন হয়? যখন ই তাকে দেখি আমার মন টা এতো ফুরফুরে কেন হয়ে যায়। আজ বিকেলে তার সাথে কথা বলাতে মনে হয়েছিল যেন এভাবেই কথা বলতে থাকি আজীবন। এভাবেই তাকিয়ে থাকি আমি। কে তুমি মায়াপরী। কেন হুট করে এসেই আমার জীবনের সংগে ধাক্কা খেলে? চেনা নেই জানা নেই হুট করে দেখা হওয়ার পর ই বা কেন আমি তোমায় বার বার চুখে হারাচ্ছি? কেন এই #অচেনা_তুমি আমার হ্রদয় মন সব কিছু তোমাতে টেনে নিয়ে গেলে। এখন যখন আমার সুখ শান্তি মন সব তুমিই কেড়ে নিয়েছ ধরা তো তুমায় আমাকেই দিতে হবে। সে তুমি চাইলেও আর না চাইলেও। কারণ আমি যেটা চাই সেটা আমি যেভাবেই হোক আদায় করে নিবোই। জোর করে হোক আর ভালোবেসে হোক। তোমার এই ব্যাথা, কান্না আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না মায়াপরী।
কাদতে কাদতে শুভ্রা ওভাবেই বসে কবে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তার শুভ্রার নিজের ও হুস নেই। আর সাদাফ তো শুভ্রাকে দেখে দেখেই সারারাত বারান্দার ওই স্টেয়ারিং চেয়ারে বসেই কাটিয়েছি।
সকাল ১০ টা পেরিয়ে গেলো। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে সারাঘর আলোকিত হয়ে রয়েছে। সারারার কান্না করাই ঘুম না হওয়াতে আজ ফজরের নামাজ টাও ছূটে গেলো। আর মাথা টাও কেমন ঝিম ঝিম করছে। দরজা খুলে রুমের বাইরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সে। কারণ আজ শুক্রবার। আফিস ও ছূটি। বাইর থেকে কোনো আওয়াজ না আসায় বুঝতে পারলো মিসেস লুতফা রা এখনো আসে নি।
প্রায় বেলা ১২ বাজে। কলিং বেল বাজতেই শুভ্রা মনে এক আশার আলো ফুটে উঠে । দৌড়ে গিয়ে দরজার সামনে মি. রহমান কে দেখে শুভ্রা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে থাকে।
মি.রহমানঃ আস্তে মা!! কি হয়েছে? কাদছিস কেন? কেউ কিছু করেছে? নিশ্চয় সোহেল বকেছে তোকে না?
মিসেস লুতফা শুনা মাত্রই আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন ঃ অমনি না? আসতে না আসতেই ন্যাকামি শুরু হয়ে গেলো। আর যাই হোক সব দোষ আমার ছেলের হবে না? আমার ছেলে মোটেও কিছু করে নি।
বাইরের এতো চেচামেচির আওয়াজ শুনে সোহেল রুম থেকে বেরে এসে দেখে শুভ্রা মি.রহমান কে জড়িয়ে ধরে কাদছে। বুকের ভেতর এক অজানা ভয় কাজ করছে তার। তবে কি কাল রাতের কথা সে বলে দিবে!
শুভ্রা কাদতে কাদতে দেখে সোহেল তার দিকে রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রা আগে থেকেই ভরকে ছিলো। তার উপর সোহেল কে দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলো।
শুভ্রাঃ কেউ কিচ্ছু করে নি আংকেল। আমার না বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিলো। কাল আম্মুর সাথে ও কথা হয় নি। আমাকে কি কয়েকটাদিন ছুটি দিবে?
শুভ্রার কথা শুনে সোহেল এবার হাফ ছেড়ে বাচলো।
মিসেস লুতফাঃ ওমনি না?? কাজ করতে এসেছিস ই বা কদিন হলো। এসেই ছিটি নিয়ে ফাকি দেওয়াএ ধান্দা। বলি ডেইলি যে ৫০০ টাকা দিই তা তো টাইম টু টাইম নিতে পারস।
মি. রহমানঃ আহ থাক না লতু। সত্যিই তো মেয়েটা আসার পর থেকে একবারও মায়ের কাছে যাই নি। কয়েকটি দিন ছুটি দিলে কি হয়?
মিসেস লুতফাঃ একদম না। আর তিনি যখন কাজ করতে আসছিলেন তখন তো তিনি একবার ও বলেন নি যে এরকম কান্নাকাটি করে বাপের বাড়ি যেতে চাইবেন। আর কাল সাদিয়া কে দেখতে আসবে। বাড়িতে এতো কাজ আমি করবো কি করে শুনি? কোথথাও যাওয়া চলবে না।
মি. রহমান স্ত্রীর মুখের ওপর আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না। অগত্যা শুভ্রাকে কথা শুনতে হলো। তারপর তিনি শুভ্রাকে শান্তনা দিয়ে বুঝাতে শুরু করলে। তারপর শুভ্রাকে টাকাটা দিয়ে বললেন তার মাকে দিয়ে আসতে।
শুভ্রা কাজ কাম সেরে রেডি হয়ে নিচে দোকানে গেলো। আজ দোকানে কেউ নেই। শুভ্রা টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বলে মাকে ফোন দিল। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে অজস্রনয়ন জলে কাদতে লাগলো সে। শুভ্রার কান্নার গলা শুনতেই শুভ্রার মায়ের বুকটা আতকে উঠে। কোনো অঘটন হয় নি তো তার কলিজার টুকরো মেয়েটার সাথে!!
মাঃ সভ্রা,, ক কি হয়েছে তো কাদছিস কেন?
শুভ্রাঃ মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর থাকতে পারছি না। আমার আর ভালো লাগছে না।
মাঃ মা আমার কি হয়েছে বল।কেউ কিছু বলেছে??
শুভ্রার এখন মনে পড়লো সে কি করতে যাচ্ছিল। এখন যদি সে তার মাকে বলে দেয় নিশ্চয় তিনি শুভ্রাকে চলে যেতে বলবেন। আর সে যদি কাজ ছেড়ে চলে যায় তাহলে সংসার চালাবে কে? বোনের পড়াশোনার খরচ চালাবেই বা কি করে। কোনো মতে প্রসঙ্গ কাটিয়ে
বললোঃ না আম্মু তোমাদের খুব মনে পড়ছিলো। কতোদিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আন্টি বলছে কোথাও যাওয়া হবে নাহ।তাই মন খারাপ হয়েছে।
মাঃ পাগলি মেয়ে একটা। মন খারাপ করলে এভাবে কাদতে হয়? আমি তো আরো কি না কি ভেবেছিলাম।
শুভ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলল এই ভেবে যে তার মা কথাটা বিশ্বাস করলো। তারপর আরো টুকিটাকি কিছু কথা বলার পর শুভ্রা ফোন রেখে দিয়ে চলে আসতে গেলেই সাদাফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ব্ল্যাক ট্রাউজার সাথে ব্ল্যাক গ্যাঞ্জি আর জগিং শু পড়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কপালের উপরের সিল্কি চুলগুলো ও ঘামের সঙ্গে লেপ্টে আছে। জগিং করায়
সাদাফঃ কেমন আছেন।
শুভ্রাঃ ভালো।
সাদাফঃসত্যিই??
শুভ্রাঃ হুম সত্যি।
এতক্ষন বাড়ির কেও শুভ্রার দিকে খেয়াল না করলে সাদাফ কিন্তু ঠিকই খেয়াল করেছে যে শুভ্রার দুই গালে আবারও চড়ের দাগ। হাত যতোটুকু দেখা যাচ্ছে তারে নখের আচড়ের দাগ বসে রক্ত জমাট বেধে আছে। এসব দেখে কষ্টে তার বুক ফেটে আসছে। ঠিক কোন কারণে তার এই তীব্র কষ্ট সে তো নিজেও জানে না ভালো করে। নিজেকে শক্ত করে বললোঃ তা মিস শুভ্রা কিছু ভেবেছেন?
শুভ্রা না শুনার ভান করে চলে যাওয়ার মতো করে বলল ঃ আচ্ছা আপনার দেরি হচ্ছে বোধহয়। আমার কাজ আছে আমি যাই।
সাদাফঃ আমার কোনো দেরি হচ্ছে না মিস শুভ্রা। আপনাকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি আপনায়। কালকের বলা কথাটা ভেবে দেখেছেন? ( খানিকটা জোর দিয়ে বলে) ।
শুভ্রাঃ দেখুন মি. আমি বর্তমানে যে কাজটা করছি সেটাতে আমি যথেষ্ট ভালো বেতন পাই। এমন ভালো সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না।
সাদাফঃ আপনি কি বলতে চাইছেন রোজ রোজ এভাবে পরের মাইর খেয়ে থাকাটাকে আপনি ভালো সুযোগ বোঝাতে চাচ্ছেন?
শুভ্রা সত্যিই বেশ লজ্জা পাচ্ছে সাদাফের কথা শুনে।
সাদাফ এবার নরম স্বরে বলল
ঃ দেখুন মিস শুভ্রা। আপনাকে আমিই প্রথম দিনই খেয়াল করেছি যেদিন আপনার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিল। সেদিনও আপনার গালে চড়ের দাগ। পরর দিন বিকাশের দোকানে ও সেইম। আর কাল তো রীতিমতো সাগরের বুকে কাদতে কাদতে আরেকটা সাগর বানিয়ে দিচ্ছিলেন। আর আজও যে আপনি সারারাত কেদেছেন তা আপনার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নিজের দিকে একবার ও তাকিয়ে দেখেছেন?? নিজের হাতের দিকে একবারব লক্ষ্য করেছেন আপনি??
শুভ্রা এবার নিজের হাতের দিয়ে তাকিয়ে দেখে রক্ত জমে নখের খামছি লেফে লাল হয়ে ফুলে আছে ফর্সা ওই হাতটি। দেখা মাত্রই সে হাতদুটো উড়নার ভেতর ঢুকিয়ে নিলো।
সাদাফঃ প্রত্যেকদিন কি এসব সহ্য করে থাকবেন? আমি জানি না কাল রাতে আপনার সাথে কি হয়েছে। তবে এটা বুঝতে পারছি খুব খারাপ হয়েছে। আপনাকে আমি সাহায্য করতে চাইছি মিস. শুভ্রা। আপনাকে যথাযথ বেতন ও দেওয়া হবে তা নিয়ে আপনার কোনো টেনশন নেই।
শুভ্রা এতোক্ষন চুপ করেই ছিল। মনের মধ্যে কেন মনে হচ্ছিলো যে সাদাফ কে বিশ্বাস করলে সে ঠকবে নাহ। তবু সোহেলের করা কৃতকর্মের কথা মনে পড়তেই মন আবার বলে উঠে ( না। কিছুতেই না। সব ছেলেরাই সুযোগ এর সন্ধানি। মেয়েদের সর্বনাশ করাই তাদের উদ্দেশ্য । ) কিন্তু তবু মনের এক কোনায় বলে উঠছে সাদাফ কে একবার হলে বিশ্বাস করা উচিত। কারন তার চোখে সে মমতা দেখেছে, তার জন্য মায়া দেখছে। তার চোখের চাহনিই তাকে সৎ বলে পরিচয় দিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে দেখে সোহেল শুভ্রার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সোহেল অফিসে যাওয়ার জন্যই বের হচ্ছিলো। গেইটে এসে দেখে শুভ্রা কার সাথে কথা বলছিল। একটু এগিয়ে আসতেই দেখে এ তো তার অফিসের বস। কিন্তু সে শুভ্রার সাথেই বা এতো কি কথা বলছে। অনেক্ষন যাবত সাদাফ যখন কথা বলছে সে লক্ষ করলো শুভ্রা তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের বস বলে কথা কি কথা হচ্ছে তা গিয়ে শুনতেও পারছে না জিজ্ঞেস ও করতে পারছে নাহ। শুভ্রা তার দিকে তাকাতেই সোহেল চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
সোহেলকে দেখা মাত্রই শুভ্রা ভয়ে কেপে উঠলো। ভয়ে চোখ বড় করে সোহেলের দিকে তাকিয়ে কাপছে সে। আবার তার কাল রাতের কথা মনে পড়তেই নিজের অজান্তেই সাদাফের এক হাত শক্ত করে ধরে ফেলেছে। কেন জানি শুভ্রা এই লোকটার কাছেই নিজেকে সেইফ ফিল করে সে।
সাদাফ শুভ্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখে সে সোহেল কে দেখেই ভয় পাচ্ছে।
সাদাফ সোহেলের দিকে তাকাতেই গপগপ করে হেটে সে অফিসের দিকে পা বাড়ালো।
সোহেলের এই আকস্মিক চলে যাওয়াতে সাদাফের কিছু খটকা লাগালো। লাগার আরেকটি কারণ হলো সে শুভ্রাদের গেঈটেই দাঁড়িয়েছিল। শুভ্রার ভীত চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে সে সোহেলকেই ভয় পাচ্ছিলো।
শুভ্রার এতোক্ষণে হোশ হলো যে কি করেছে সে। এই প্রথম সে অচেনা অজানা একজন লোককে সে নিজে তগেকে স্পর্শ করলো। সাদাফ শুভ্রতার চোখাচোখি হতেই শুভ্রা দৌড়ে চলে গেল।
শুভ্রা দৌড়ে যেতেই সাদাফ জোরে বলে উঠলোঃ এখনো সময় আছে কিন্তু মিস শুভ্রা, বিষয়টা ভালো করে ভেবে দেখেন।
আর এদিকে শুভ্রা লজ্জায় কুটুকুটি হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভেবে নিলো সে আর কখনোই লোকটার সামনে পড়বে না। ( ছি ছি ছি। এ আমি কি করলাম আজ! ইসসস লোকটা আমাকে নিয়ে কি কিই না ভাবছে কে জানে। নিশ্চিয় আমাকে গায়ে পড়া নির্লজ্জ মেয়ে ভাবছে। আমি আর জীবনেও উনার সামনে পড়বো নাহ) ।
এদিকে যে শুভ্রার অই নরম স্পর্শ পেয়ে সাদাফ নিজেই এক অজানা খুশির দুনিয়ায় হারায়ে গেছে তা তার নিজেরই বলার মতো না। কেমন যেন খুব ভালো লেগেছিলো শুভ্রার সেই উষ্ণ ছোয়ারে। এই স্পর্শ যেন সে আজীবন ই উপভোগ করতে চায় সে।
#চলবে।
(সবাই তাড়াতাড়ি গল্প দিতে বলেন তাই আজ ২৪ ঘন্টার আগেই দিয়েছি। কেমন লেগেছে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন কিন্তু)
???