#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২১[#পরবর্তী_অংশ]
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য ভয়ে চোখমুখ কুঁচকে আছে এখনো ৷ মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে আবেশের শার্ট ৷ আবেশ ক্রমেই ঝুঁকে যাচ্ছে মাধুর্যের মুখের উপর৷ আবেশ ধমক দিয়ে বলল,
‘ কে নিয়ে যাচ্ছে তোমায়! আমি ছাড়া কে আছে এখানে৷’
‘ আমি গাড়িতে ছিলাম হাওয়ায় ভাসছি কী করে! আবেশ..শ কোথায় আপনি৷’ মাধুর্য ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল ৷ রাগে আবেশের চোখেমুখ শক্ত হয়ে উঠেছে ৷ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার কাছেই আছো৷ চোখ খুলে দেখো৷’
মাধুর্য আবেশের কথা শুনলো না ৷ চোখেমুখে তার উৎকন্ঠা৷ আবেশের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ছোট ছোট চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো৷ আবেশ থমকে দাঁড়িয়ে আছে ৷ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা সূর্যের দিকে ৷ সেইসাথে তাকাচ্ছে মাধুর্যের রক্তিম আলোয় লালাভ হয়ে উঠা মুখশ্রীর দিকে ৷ মাধুর্য দেখলো,আবেশের বিমুগ্ধ চোখ যা তাতে আর সামনে নিবদ্ধ ৷ আবেশ মাধুর্যকে নামিয়ে দিলো কোলে থেকে ৷ নিজেই মাধুর্যের কোমড়ে হাত রেখে সামনে মুখ ফিরিয়ে দিয়ে মাধুর্যের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলল,
‘ একটি সুন্দর সকালের সূর্য তোমার নামের খাতায় তুলে দিলাম,আমার মাধবীলতা৷’
আবেশের এমন ফিসফিস আওয়াজে ঝিমিয়ে থাকা মনের কোঠা প্রজাপতি ডানা মেলে গেলো মাধুর্যের ৷ সে বিভোর চোখে সামনে তাকালো৷ আবেশের হাতজোড়া ধরে রেখেছে তার কোমড় ৷ সেইদিকে মাধুর্যের হুঁশ নেই এখন ৷ সে ব্যস্ত আকাশ জুড়ে বিস্তার করা সুন্দর ভোর দেখতে ৷ নদীর শীতল বাতাসে নিজেকে মেলতে ৷ দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে সূর্যকে কাছে টানতে ৷ একঝাঁক উড়ো পাখি সূর্যের ঠিক নীচ দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে ৷ মাধুর্য দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ কতো সুন্দর!’
‘ এখন ঘুমাও৷ তোমার দেখতে হবে না৷’ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল ৷ মাধুর্য বুকভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ সূর্যের কিরণ স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে,আবেশ৷ দেখুন অনেক সুন্দর ৷ স্রোতশূন্য নদীতে আচ্ছাদিত হচ্ছে৷’
‘ চলো আবার ঘুমাবে৷’
‘ কেন!’ মাধুর্য বিস্ময় নিয়ে বলল৷ আবেশ হেয়ালি করে বলল,
‘ এতো ঘুম কোথা থেকে পাও তুমি৷’
মাধুর্য আধখোলা চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলল,
‘ মোটেও আমি এতো ঘুমোই না৷ চোখ লেগে গিয়েছিলো একটু৷’
‘ কীহ..ওহ মাই গড ৷ ওইটাকে চোখ লেগে যাওয়া বললে ঘুম কাকে বলে!’
আবেশ খানিকটা জোরে চিৎকার করে বলল৷ মাধুর্য কানে হাত দিয়ে বলল,
‘ এতো জোরে কেউ চিৎকার করে!’
‘ তোমায় যদি আমি নদীতে ছুড়ে মারতাম তবুও তোমার ঘুম ছুটতো না৷’ আবেশ মৃদু হেসে বলল৷ মাধুর্য ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
‘ তারমানে আপনি আমাকে ছুড়ে দিতে নিয়ে এসেছেন!’
মাধুর্যের কথা শোনে আবেশ বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ এতো সুন্দর একটা ভোর উপভোগ করানোর জন্য কষ্ট করে লাভ কী হলো! তার বোকা বউ তো উল্টো তাকে ভুল বুঝে যাচ্ছে৷
মাধুর্যের কোমড়ে হাত রেখেই তাকে সামনে ঘুরালো আবেশ ৷ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ আমাকে নিয়ে তোমার এইসব লেইম চিন্তাধারা হয়!’
‘ আপনি নিজেই তো বললেন,তোমাকে ছুড়ে ফেললে৷ এই কথার মানে কী দাঁড়ায়! আপনি আমাকে ছুড়ে ফেলতে নিয়ে এসেছিলেন৷’
মাধুর্য অভিমান করে বলল ৷ আবেশের মনের কোণে সুপ্ত ইচ্ছা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আর সেটা হলো,’আবেশ তুই নিজেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়৷’
‘ এ..ই..এই আপনি ভুলেও আমায় ছুড়ে মারার চেষ্টা করবেন না৷ যদি করে থাকেন তাহলে আমি…’
‘ তাহলে কী তুমি!’ আবেশ কঁপাল কুঞ্চন করে বলল৷ মাধুর্য কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
‘ তাহলে আমি নিজেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বো৷’
মাধুর্যের মুখ দেখে আবেশ ভাষা শূন্য হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো৷ তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে গম্ভীর স্বরেই বলল,
‘ রিডিউকুলাস৷ আমি তোমার যুক্তি দেখে জাস্ট স্পিচলেস৷’
‘ কে জানে হয়তো আমাকে আপনার ও বোঝা মনে হয়৷’
‘ মাধুর্য স্টপ!আর একটা ফালতু কথা বললে সত্যি সত্যি ফেলে দিবো৷’
আবেশ হুমকির স্বরে বলল ৷ মাধুর্য মুখ কাচুমাচু করে চুপ হয়ে রইলো ৷ আবেশ মাধুর্যকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ চলো,দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’
বলেই আবেশ নদীর পাড় বেয়ে উপরে উঠে দাঁড়ায় গাড়ির সামনে ৷ নদীর বাতাস আলগা হয়ে ছুঁয়ে দিলো মাধুর্যকে ৷ সুর তুলে বলল,
‘ মাধুর্য কাজটা ঠিক করিস নি৷ এইবার রাগ সামলা৷’
___________
মাইলের পর মাইল রাস্তার ধারে সুউচ্চ গাছের সারি৷ তার পাশের বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত ৷ সূর্যের চিকন আলোক রশ্মি স্নেহের পরশে সিক্ত করছে তাদের ৷ কাঁচা মাটির রাস্তার ফলে গাড়ির ঝাঁকি তে বেহাল অবস্থা ৷ মাধুর্য চুপ করে বসে আছে৷ সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য আবার রুপগঞ্জে কাটানো বিষাক্ত অতীতের কথা মনে হতে৷
আবেশ রোদচশমা খুলে দিলো৷ জানালার পুরো কাচ নামিয়ে দিলো ৷ রাশিরাশি ভালোলাগা জড়িয়ে নিলো তাকে ৷ রুপগঞ্জ! তার ভালোবাসার নাম৷ যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো একটা গল্প৷ অজানা অনুভূতির গল্প ৷ যার নাম ছিলো মাধবীলতা৷ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো তার মন ৷ সামনেই পুরোনো বাড়ি যেখানে তারা ঘুরতে আসতো ৷ সব ভেসে উঠছে চোখে ৷ ওইতো ফয়েজ আর মাধুর্য আবেশকে রেখেই দৌড়ে যাচ্ছে৷ মাধুর্যের দুই বেণি হাওয়ায় দোল খাচ্ছে বাতাসে ৷
তখনো তার মনে কোনো অনুভূতির সঞ্চার হয় নি৷ তবে আজ অনুভূতি সাজিয়ে সেই ছোট মাধুর্য তার পাশেই বসে আছে ৷ এইকথা ভেবে সে আড়চোখে তাকালো মাধুর্যের দিকে ৷ মাধুর্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে মুখে কাঠিন্য ভাব আনার চেষ্টা চালালো৷
মাধুর্য ভয়ে ভয়ে ডাক দিলো,
‘ শুনছেন!’
‘ আমার কান খোলাই আছে৷’ আবেশ কাট কাট গলায় জবাব দিলো৷ মাধুর্য শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ আপনি আমার সাথে রাগ করে আছেন?’
‘ রাগ করার মতো কিছু করেছো তুমি?’
‘ অবশ্যই! তখন..’
‘ তখন কী?’ আবেশ না বোঝার মতো বলল ৷ মাধুর্য ওড়নায় আঙুল পেঁচাচ্ছে ৷ বারবার বলতে চেয়েও আটকে যাচ্ছে তার মুখে ৷ অনেকটা সময় বসে থেকে বলল,
‘ তখন আমি কতো সুন্দর একটা মুহূর্ত নষ্ট করে দিলাম৷’
‘ তুমি মুহূর্ত গুলাও বুঝো!’ আবেশ তাচ্ছিল্য করে বলল ৷ মাধুর্য মাথা নীচু করে বলল,
‘ আমি দুঃখিত৷’
‘ গাড়ি থেকে নামো৷’
‘ মানে! গাড়ি থেকে নামবো কেন৷’ মাধুর্য অবাক হয়ে বলল ৷ আবেশ গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ স্কুলে এসে পড়েছি,তাই৷’
আবেশা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল৷ মাধুর্য চারপাশে তাকালো ৷ তার স্কুল! যেখানে সে স্বস্তি পেতো ৷ পুরোনো ভবন গুলো নেই৷ নতুন করে উঠানো হয়েছে সব৷ চাকচিক্যের ভেতর মাধুর্য তবুও শেকড়ের টান অনুভব করলো ৷ তার রেজাল্ট হাতে পেলেও একটা সার্টিফিকেট রয়ে গেছে স্কুলে৷
কলেজের প্রিন্সিপাল কীভাবে ম্যানেজ করেছিলো মাধুর্য জানে না৷ তবে বলেছিলো,কখনো সুযোগ পেলে স্কুল থেকে উঠিয়ে নিতে ৷ এতো বছর পর সেই সুযোগ পাবে ভেবে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আবেশের দিকে তাকিয়ে৷
‘ কোলে করে নামাতে হবে,তোমাকে?’ আবেশে গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে বলল ৷ মাধুর্য ভাবনায় বিভোর ছিলো আবেশের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ ন.ন..না আমি নামছি৷’
বলেই মাধুর্য নেমে দাঁড়ালো ৷ শাঁই করে ভালোলাগা ছুটে এলো মাধুর্যের কাছে৷ উত্তেজনায় চেপে ধরলো আবেশের হাত ৷ আবেশের অন্তর কাঁপিয়ে উঠলো এই ছোঁয়া ৷ চুপিসারে নিজেও আঁকড়ে ধরলো মাধুর্যের হাত৷
মাধুর্যের চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে খুশি৷ স্কুলে মাধুর্যকে নিয়ে আসার পর এতোটা খুশি হবে আবেশ ভাবতে পারে নি৷ আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে৷ সবাই অচেনা৷ তবে এই অচেনা মানুষের ভীড়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে মাধুর্য ৷
___________
রাত আনুমানিক ১০ঃ৩৪৷ নিকষ আলো ছাপিয়ে আকাশের মাঝে চন্দ্র তার হাসি বিলাচ্ছে৷ গোল হয়ে গোলাকার বৃত্ত তৈরি করেছে কালো আঁধারে ডুবে থাকা আকাশে ৷ সারাদিনের জার্নি শেষ করে মাধুর্য ক্লান্ত৷ তবে আবেশ একদম ঠিকঠাক৷ রুপগঞ্জের সব কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এইটাই অনেক৷ তবে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাদের ৷ আবেশ গাড়ি পার্ক করে এসে মাধুর্যের পাশে দাঁড়ালো৷
মাধুর্য তখন নিজের জামা ঠিক করছে ঝুঁকে৷ আবেশ দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ৷ মাধুর্য মাথা তুলতেই তার পিঠ গিয়ে ঠেকলো আবেশের বুকের উপর৷মাধুর্য ভড়কে যায় ৷ আবেশ নিজের পকেটে হাত গুজে বলল,
‘ আমি রেগে আছি৷ আর সেই রাগ কমার নয়৷’
‘ আবারো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন৷’
‘ আমি থাকতে ভয় কীসের তোমার৷’ আবেশ বিড়বিড় করে বলতেই মাধুর্য পেছনে মাথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ কিছু বললেন?’
‘ হ্যাঁ,তোমার সকালে কাজের জন্য আমি প্রচন্ড রেগে আছি৷’
‘ বলে আবার কে রাগ করে?’
‘ এই আবেশ এহসান করে৷’
বলেই শিষ বাজিয়ে এগিয়ে যায় সামনে আবেশ৷ ঠিক ছোট বেলার মতো৷ মাধুর্য বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে নির্বাক চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে৷
চলবে…
[২১ এর সাথে রিলেটেড পর্ব তাই অন্যকিছু টানি নি৷ ব্যথার জন্য জ্বর এসেছে৷ মাথা ব্যথায় চোখ তোলা দায়৷ আশা করি বুঝবেন৷]