ভেতরে বাহিরে পর্ব-২১

0
1417

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২১
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
নিশীথের অন্ধকারে ডুবে আছে চারিধার৷ নিস্তব্ধ চারিদিক৷ খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া তীব্রবেগে ঢুকে ছুঁয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীর৷ আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ সৃষ্টিতে আড়ষ্টভাব এনে দিচ্ছে মাধুর্যকে ৷ সে বরাবর বজ্রপাতে আওয়াজে শিউরে উঠে ৷ আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না ৷ আবেশ ড্রাইভ করছে দক্ষতার সাথে৷ পাহাড়ি রাস্তা নামতে বৃষ্টির সময় বেগ পেতে হয়৷ সিলেট থেকে রূপগঞ্জ যেতে অনেক বেশিই সময় লাগবে ৷ তার এখন আফসোস হচ্ছে! রাতে না বের হওয়াটাই উচিৎ ছিলো মাধুর্যকে নিয়ে ৷ ভোররাত পার হয়ে যাবে পৌছাতে৷ আকাশ জুড়ে বৃষ্টির আসর বসবে কে জানতো এইসময়ে।
মাধুর্য ভয়ে বিমূর্ত হয়ে বসে আছে৷ চোখেমুখে ফুঁটে উঠেছে ভয়৷ থেকে থেকেই আকাশ জুড়ে আলোকপাত হয়ে তীব্র শব্দ আচ্ছাদিত হচ্ছে পরিবেশ ৷ প্রত্যেকটা শব্দ ভয়ে জমিয়ে দিচ্ছে তাকে৷ তীব্র শব্দে আবারো বাজ পড়তেই আবেশের হাত শক্ত করে ধরলো সে ।ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। মাধুর্যের আচমকা ধরাতে আবেশ ভড়কে যায়। মাধুর্যের চোখেমুখে ভয় দেখে শীতল হেসে বলল,

‘ ভয় পাচ্ছো? আমি আছি তো। ভয় পেও না।’

আবেশের এমন ভরসার কথা শুনে এমনি এক বজ্রপাতের রাতের কথা মনে পড়লো তার ৷ তার মা হারিয়ে যাওয়ার পর উন্মাদ হয়ে খোজ করছিলেন শাহেদ ৷ হুট করে সেও উধাও হয়ে যায় একদিন। একা রেখে গেলো মাধুর্যকে ৷ ছোট মাধুর্য সেদিন বাড়ির উঠানে বসে ছিলো রাস্তার দিকে তাকিয়ে ৷ আষাঢ় মাস! হঠাৎ করেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি সেই সাথে বজ্রপাত ৷ থেকে থেকে গর্জে উঠে মেঘ৷ সেদিন মাধুর্য সারা ঘরে লুকানোর আশ্রয় খুজেছিলো৷ আশেপাশের মানুষ নিজেদের ঘরে ৷ সে একা ভয়ে শিউরে উঠছিলো সারারাত ভর৷ শাহেদ ফেরে নি সে রাতে ৷ অতিরিক্ত ভয়ে মাধুর্যের ধুম জ্বর এলো ৷ এরপরের দিন শাহেদ ফিরলেন লতা বেগম আর রাব্বীকে নিয়ে ৷ সেইদিন আসার পরেই ইচ্ছামতো মারলেন শাহেদ ৷ মোটা একটা লাঠি দিয়ে ৷ সেই রাতের পর থেকেই তার জীবন পাল্টে যায় ৷ রাব্বী যখন তাদের কাছে আসে তখুনি সে আট নয় বছরের বড় ছিলো। শাহেদ তাকে মেরে যাবার পর ব্যথাতুর শরীরে লাথি দিয়ে একটা কথা বলেছিলো,

‘ তোর মা যেমন আমার মায়ের জীবন বিষাক্ত বানিয়ে ছিলো আমি তোর জীবন বানাবো৷ তোকে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দিবো না ৷ আমার মায়ের প্রতিটি চোখের পানির মূল্য তুই দিবি৷ তোর মা তো পালিয়েছে ৷ ওই হারামজা*র জীবন ও শেষ করে দিয়েছি ৷ এখন তুই আছিস ৷ তোকে তিলে তিলে মারবো ঠিক আমার মা যেমন তিলে তিলে কষ্ট পেয়েছিলো৷’

মাধুর্যের অসুস্থ শরীরের বেধড়ক ভাবে মার পড়ার জন্য বিছানায় পড়ে গিয়েছিলো সে ৷ এর পর সে যখন ভালো রেজাল্ট করেছিলো সেই বছর রাব্বী মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে তৃতীয় বারের মতো ফেল করে যার জন্য শাহেদ তাকে বকেছিলো ৷ এই কারণেও তাকে মেরেছিলো রাব্বী৷ লতা বেগম কেমন শান্ত প্রকৃতির ৷ মাধুর্য যখন চিৎকার করে কাঁদতো সে তখন দাঁড়িয়ে দেখতো৷ না কাছে আসতো না কখনো তাকে মারতো ৷ ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাধুর্য ৷ রাব্বীর বউ ইকরা মেয়েটাকে জোর করে তুলে এনেছে রাব্বী৷ তাকে যখন রাব্বী মারতো সে ফেরাতে আসলে ইকরাকেও মারতো ৷ ইকরার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো মাঝেমধ্যেই তাদের রুমে থেকে৷ রাব্বীর প্রতি মাধুর্যের ক্ষোভ জন্মেছে প্রচন্ড ৷ এতো নিকৃষ্ট কেন সে! ইকারার কথা মনে হতেই মাধুর্য আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ইকরা ভাবীর জন্য আমার কষ্ট হয় ৷ রাব্বীর জন্য তার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে৷ আমাদের স্কুলের কলেজে পড়তো ইকরা ভাবী৷ তাকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলো রাব্বী ৷ ইকরা ভাবীর বাবা ওর নামে কেস করলে তাকে মানুষ দিয়ে গায়েব করে ফেলেছে৷’

মাধুর্যের হঠাৎ বলা কথায় গাড়ি থামিয়ে দিলো আবেশ৷ চিন্তার ভাজ পড়লো কঁপালে তার ৷ আবেশের হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়াতে ভড়কে গেলো মাধুর্য ৷ অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ আপনি ঠিক আছেন! অসুস্থ লাগছে৷ গাড়ি থামিয়ে দিলেন কেন৷’

‘ তোমার লাস্টের কথা আবার রিপিট করো মাধুর্য ৷ ইকরা ভাবীর বাবাকে গায়েব করার ক্ষমতা রাব্বীর থাকলে মেহরুন আন্টিকেও রাব্বী গায়েব করতে পারে,মাধুর্য৷’

‘ কিন্তু কীভাবে! ও তখন ছোট ছিলো ৷ আপনার থেকে দুই বা তিন বছরের বড় হবে হয়তো৷ বাইশ বা বিশ বছরের ছেলে কীভাবে পারবে!’

মাধুর্য ভেবেচিন্তে উত্তর দিলো৷ আবেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ সে এতোটা খারাপ কী করে হলো! তার পেছনে মাস্টার মাইন্ড আছে ৷ যে সম্পূর্ণ কাজ নিখুঁতভাবে করেছে৷’

মাধুর্য ভাবলো৷ রাব্বী প্রায় বলতো তার মায়ের জীবন তার মা মেহরুন নষ্ট করে দিয়েছে৷ তবে কী? শাহেদ রাব্বী আর লতা বেগমকে আগে থেকেই চিনতো! মাধুর্যের জানামতে,মেহরুন হারিয়ে যাবার পর পরিচয় হয়েছে তার লতা বেগমের সাথে৷ মাথা ব্যথা করে উঠলো মাধুর্যের ৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ঠিক আছো তুমি৷’

‘ হ্যাঁ,গাড়ি থামালেন কেন৷ দ্রুত চলুন৷’

আবেশ চালালো না ৷ গাড়ির হুইলে হাত দিয়ে বসে রইলো৷ ফাঁকা রাস্তা তাই চিন্তা নেই খুব একটা ৷ আর বৃষ্টির বেগ বেড়েছে ৷ ঝমঝম শব্দ তুলে নৃত্য করছে বৃষ্টিকন্যা৷ গাড়ির সাদা আলো বৃষ্টির সাথে খেলা করছে ৷ সাদা ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে বৃত্ত আঁকছে তারা ৷ আবেশ সিটবেল্ট খুলে ফেললো ৷ কঁপালে হাত ঠেকিয়ে বসে বলল,

‘ তোমার কিছু কথা জানা দরকার মাধুর্য৷’

‘ কী কথা?’ মাধুর্য জবাব দিলো৷ আবেশ চোখ বোজে বলল,

‘ শাহেদ আঙ্কেলের নিজের ছেলে রাব্বী৷’

‘ কীভাবে! রাব্বী নিজে বলেছিলো তার বাবা নেই৷’

‘ ভুল বলেছিলো৷ হয়তো রাগ বা ক্ষোভ থেকে ৷ আমি যতোদূর জানি মানে আম্মা বলেছে,শাহেদ আঙ্কেল তোমার নানা ভাইয়ের সম্পত্তির জন্যই রাব্বী আর আর তার মাকে ফেলে পালিয়ে আসে আন্টিকে নিয়ে ৷ তবে তোমার নানাভাই কঠোর মানুষ ছিলেন বলে তার উদ্দেশ্য সফল হয় নি ৷ তাই কোনো সম্পদ ও সে পায় নি। মেহরুন আন্টি তোমার বাবার সাথে পালিয়ে এসেছিলো বলেই হয়তো রাব্বী তোমাকে দেখতে পারতো না৷ আরেকটা কথা তারমানে,তোমার নানাভাইকে শাহেদ আঙ্কেল খুন করেছে পরে যখন আন্টির নামে সম্পত্তি লিখে দেন৷ এতো সহজ হিসেব আগে কেন ধরতে পারি নি,ড্যাম ৷ মাধুর্য শাহেদ আঙ্কেল খুনি ৷ এইজন্য হয়তো আন্টি পালিয়ে গিয়েছেন কোথাও৷’

মাধুর্য অবাক হয়ে আছে ৷ তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না ৷ আবারো ঘুরেফিরে সম্পদের বেড়াজালে আটকে যায় সব৷ সব কিছুর মূলে সম্পত্তি ৷ মাধুর্যের চোখ জ্বলছে ৷ আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি শাস্তি চাই,আবেশ ৷ আমি ভয় পাচ্ছি না আর পাবো না ৷ সব প্রমাণ জোগাড় করে তাকে আর তাদের শাস্তি দিন ৷ আমি নিজে স্টেটমেন্ট দিবো৷’

মাধুর্যের কথা শুনে কিছু বলল না আবেশ৷ সে ভাবছে,শাহেদ কোথায়! চিন্তিত স্বরে বলল,

‘ শাহেদ আঙ্কেল কোথায় তাহলে!’

‘ বাড়িতেই৷ তবে তার দেখা পাওয়া যায় না৷ তবে হ্যাঁ,পাওয়া যেত যখন আমাকে মার‍তে আসতো৷’

বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো মাধুর্য ৷ তার হাসিতে বেদনা লুকায়িত ৷ এক পশলা বৃষ্টির মতো কষ্ট আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের কাছে ৷ তার মা কীভাবে পেরেছিলো অন্য একটা মায়ের সংসার ভেঙ্গে দিতে৷ জঘন্য লাগছে সেই মানুষটাকে ‘মা’ বলতে৷ কেও ‘মা’ হতে না পেরে কাঁদে আবার কেও সন্তানের জীবন হুমকিতে ঠেলে দেয় ৷ দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর ৷ যার আঁচড় পড়েছে মাধুর্যের সুন্দর গোছানো জীবনে ৷

____________
ভোরের আলো ছুঁবে ছুঁবে করছে মাটির কোলে৷ আদুরে পরশে সিক্ততা পাচ্ছে প্রকৃতি ৷ গাছ-গাছালিতে ঘিরে থাকা রূপগঞ্জ ৷ পাখির কলতানে বিভোর পরিবেশ৷ ঘুম থেকে সদ্য উঠা পাখিরা নীড় ছেড়ে ডানা মেলছে উন্মুক্ত আকাশে ৷ মাধুর্য ঘুমিয়ে আছে৷ জানালার ফাঁক গলে শুভ্র আলো আদর মাখছে তার গালে৷ কাল রাতে লং ড্রাইভ করে এসেছে আবেশ ৷ শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করেছে তার ৷ গাড়ি লক করে মাঝে একবার জিরিয়ে নিয়েছিলো তবে এর পরেই হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে এসে পৌছিয়েছে রুপগঞ্জ সদরে ৷ গ্রামের রাস্তাযর মোড়ে থামিয়ে দিলো গাড়ি৷ চারদিকে আবছা হয়ে ফুঁটে উঠেছে সূর্য রশ্মি৷ নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড় করেছে সে ৷ অন্ধকার ছাঁপিয়ে পূর্ব আকাশে যখন গোধূলির মতো আলো ফুঁটে উঠলো তখন আবেশ ঘুরে তাকালো মাধুর্যের দিকে৷ ঘুমে আচ্ছাদিত হয়ে আছে সে ৷ ছোট ছোট চুল গুলো দোল খাচ্ছে হাওয়ার তালে ৷ সূর্য ওঠার সময় ঘনিয়ে এসেছে ৷ আবেশ মাধুর্যকে ডাক দিয়ে বলল,

‘ মাধুর্য..এই মাধুর্য উঠো৷’

‘ উঁহু,আমি ঘুমাবো আরেকটু৷’

‘ পরে ঘুমাবা৷ এখন উঠো একটা জিনিস দেখাবো৷’

‘ আপনি দেখুন ৷ আমি পরে আপনার চোখ থেকে দেখে নিবো৷’

মাধুর্য ঘুম কন্ঠেই বলল ৷ আবেশের কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো৷ ওইদিকে সূর্য আকাশের কোল জুড়ে বিচরণ করা শুরু করে দিয়েছে ৷ আবেশ অধৈর্য হয়ে আবারো ডাক দিলো,

‘ মাধু! প্লীজ উঠো৷ একটু উঠো৷’

মাধুর্য বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো আবারো ৷ কাল রাত থেকে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা ৷ এতো ঘুম পায় কোথায় এই মেয়ে? সে নেমে গেলো একাই গাড়ি থেকে ৷
মাধুর্যের দরজার দিকে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই মাধুর্য হেলে পড়ে যাচ্ছিলো সাথে সাথেই ৷ আবশ মুখ কুঁচকে দ্রুত ধরে ফেললো মাধুর্যকে ৷ এতেও ঘুম ছুটলো না মাধুর্যের ৷ আবেশ মাধুর্যকে ধরে একবার পূর্ব দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মাধুর্যের দিকে ৷ বিড়বিড় করে বলল,

‘ সব ঘুম আজ ধরা দিয়েছে ওনার চোখে৷ উফ! কী মেয়েরে বাবা৷ রোম্যান্টিক মুহূর্তেও ঘুমাবে নাকি!’

মাধুর্য আবেশের ছোঁয়া পেয়ে দুইহাতে আঁকড়ে ধরলো আবেশকে ৷ মাধুর্যের হাতের ছোঁয়ায় কম্পন ধরে গেলো আবেশের ৷ ঘাম ছুটে যাচ্ছে ৷ কেমন শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে৷ তবে সব বাদ দিয়ে নীচু হয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে ৷
মাধুর্য ঘুমের তালেই আঁকড়ে ধরলো আবেশের শার্ট৷ আবেশ তাকালো গভীর চোখে৷ মাধুর্য ঠোঁট কামড়ে ঘুমিয়ে আছে বাচ্চাদের মতো ৷

‘ এইভাবে ঠোঁট কামড়ে রেখেছো কেন!’ আবেশ আবারো বিড়বিড় করেই বলল ৷ নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সে৷ সূর্যের কমলা রঙ তখন আকাশ জুড়ে আদর মাখছে ৷
আবেশের হাটার গতির জন্য দুলে উঠছে মাধুর্য ৷ ঘুম ছুটে গেলো অল্প অল্প৷ নিজেকে হাওয়ায় ভাসতে দেখে চিৎকার করে বলল,

‘ আবেশশ..কোথায় আপনি৷ আমি হাওয়ায় ভাসছি৷ এইই আবেশ ৷ আমাকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে৷ আপনি কোথায়৷’

চলবে…

[ পর্বঃ২১ এর পরবর্তী আরেকটা অংশ কাল দেওয়া হবে ৷ ও হ্যাঁ,এশার পরিচয় কাল নিচের প্যারায় দিয়েছি ৷ আর মাধুর্য এহসান নিয়ে অনেকের প্রবলেম ওইটা মিসেস আবেশ এহসান হবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here