অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৬০

0
6052

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৬০

চৌধুরী বাড়ির একমাত্র মেয়ে অনন্যময়ী। এত ঐশ্বর্য বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সে দূর অজানায় অনাথের মতো বড় হয়েছে। এতে যদিও তার কোন আফসোস নেই। তবে তার বাবা মা থেকেও যেন ছিল না। বাবার হয়তো খোঁজ ছিল না তবে মা নামক সত্ত্বার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সে বঞ্চিত ছিল মায়ের শীতল ছায়া থেকে। রাহাতের কোন খবর পাওয়া যায়নি বলে সবাই হয়তো ধরেই নিয়েছিল যে সে মারা গেছে। এই ধারণাটাই যে তারা একসময় সত্যি হিসেবে অনির সামনে তুলে ধরে। অনির কাছের তাদের বিশ্বাস করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। অনির ছন্নছাড়া জীবনে বোধ হয় সীমিত সময়ের জন্য হলেও পিতৃসুখ লেখা ছিল না। জীবনের এই চরম নিষ্ঠুরতা আজ মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।

রেহানা বেগম ক্রমাগত বিলাপ করতে করতে অনিকে জানান দিচ্ছেন রাহাত সাহেব জীবনের শেষ দিনগুলোতে সে কিভাবে তার স্ত্রী সন্তানের সান্নিধ্য পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছেন। তাদের হাতেও কিছু করার ছিল না। কেননা তারা কেউই জানতো না রাহাতের স্ত্রী অনামিকা বা তার সন্তান অনন্যময়ী খবর।এমনকি তারা চিনতোও না তাদের। তারাও অসহায় ছিলেন। রাহাতের অবস্থাও এতটা খারাপ ছিল যে কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। বিধায় সবাই শুধু নীরব দর্শক হয়ে রাহাতের আর্তনাদ গুলো অনুভব করেছে। মানুষটা তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। বাঁচতে চেয়েছিল সে,একটা সুখী পরিবার গড়তে চেয়েছিল ভাগ্য তার ইচ্ছায় সায় দেয়নি। তাই বোধ হয় সে সময় অনামিকার হৃদয়টা বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। রাহাতের ভালোবাসা রাহাতের প্রতি তার ঘৃণাকে ছাপিয়ে অনামিকার হৃদয় অবধি পৌঁছাতে পারেনি।কতটা অসহায় ছিল রাহাত ভাবতেই অনন্যময়ী ডুকরে কেঁদে ওঠে।

আজ তার ইচ্ছে করছে অনামিকার মুখোমুখি হতে।কেন সে পারেনি রাহাতকে ক্ষমা করতে?তাহলে আজ তার জীবনটা সবার মতো স্বাভাবিক হতো।বাবা মা থাকা সত্ত্বেও এতিমের মতো বড় হতে হতো না। যেখানে আজ তাকে বাবার কবর দেখতে হচ্ছে সেখানে হয়তো আজ দেখতে পেত তার বাবার হাসিমুখটা,চাইলে একটু ছুঁয়ে দিতে পারতো তার বাবার মুখটা।বুক ফেটে কান্না আসছে অনির। ফ্রেমে বন্দি তার বাবার অবয়বটা বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। অশ্রুগুলো পড়ছে রাহাতের ছবির উপর। জীবনে প্রথমবার সে এভাবে কাঁদছে শুধু তার বাবার জন্য। বাবা নামক অদৃশ্য সত্ত্বা অনেক আগেই তার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিল। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে বাবা মেয়ের মিলন হয়তো ঘটেনি। তবে আজ রাহাত যদি বেঁচে থাকতো তবে দেখতে পারতো তার সন্তান তাকে কতটা ভালোবাসে। তাহলে রাহাত হয়তো শান্তিতে মরতে পারত।

অনন্যময়ীর আর্তনাদ আজ সবাইকে কাঁদাচ্ছে। তার জীবনের ইতিহাসগুলো জেনে চৌধুরী পরিবারের সবাই যেন থমকে যায়। যার সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর কথা,সকল আভিজাত্য বিলাসিতার মাঝে বেড়ে ওঠার কথা সে বড় হয়েছে মায়ের অবহেলায় ভিনদেশে কিছু অজানা অচেনা মানুষের মাঝে। অশ্রুসিক্ত অনি আজ তার মায়ের মুখোমুখি হবে ঠিক করে নিয়েছে। রেহানা বেগমের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলোমেলো পায়ে জাহানারা বেগমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনি।

–দিদা! অনির এই ডাকে জাহানারার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই অনিকে যেন বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে তার।

–আমাকে তোমার মেয়ের কাছে নিয়ে চলো দিদা। আজ অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমার মেয়েকে।কেন আমার জীবনটা এভাবে শেষ করে দিল তোমার মেয়ে?কেন দিদা?(অনি)

–অনি শান্ত হ মা তুই।এভাবে পাগলামি করে না সোনা। একটু শান্ত হ।শরীর খারাপ করবে মা তোর।(জাহানারা)

–না দিদা আমি একদম ঠিক আছি। আজ শান্ত হওয়ার সময় নয়। শান্ত থেকেই আমি জীবনের প্রতিটা সুখ হারিয়েছি আমার কোন অভিযোগ ছিল না। তুমি শুধু আমাকে একবার নিয়ে চলো। আমি মরে যাব দিদা প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো। আমার এই কথাটা রাখো। (অনি)বলেই অনি পড়ে যেতে নেয়।

জাহানারা বেগম আর রিশাদ এসে অনিকে ধরে ফেলে। রিশাদ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে অনির গালদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে; অনন্যময়ী এমন পাগলামি করে না সোনা।প্লিজ শান্ত হও।তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে বলো।আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো?

অনি রিশাদের হাতে হাত রেখে বলে;ও রিশাদ!প্লিজ আমাকে একবার নিয়ে চলো।প্লিজ আমাকে।একবার নিয়ে চলো।তাহলে আমি ঠিক হয়ে যাব।বিশ্বাস করো আর কখনো যেতে চাইবো না। শুধু একবার রিশাদ। আমি জানতে চাই আমার বাবার অপরাধ কি কখনো ক্ষমা করা যেতো না?কেন আমার বাবাকে এতোটা শাস্তি দিলো? সে তো আমাকে কখনো ভালোবাসেনি বাবা তো আমায় কত ভালোবাসতো দেখো আমি না হয় শুধু আমার বাবাকে নিয়েই ভালো থাকতাম। আমার তো কোনদিনও আমার মা ছিল না তার জন্য তো আমি আমার বাবাকেও পেলাম না। কেন এত নিষ্ঠুর হলেন উনি। কাঁদতে কাঁদতে বলে অনি।

অনির কথাগুলো রিশাদের বুকে গিয়ে আঘাত করছে। অনির এমন শোচনীয় অবস্থা সে কল্পনাও করতে পারেনি। অনির প্রতিটি অশ্রু রিশাদকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। অনির আর্তনাদ গুলো যেন রিশাদের হৃদয়ে হাতুড়ি পেটা করছে। অনির সাথে না পেরে রিশাদ আর জাহানারা বেগম অনিকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

সারাটা রাস্তা অনি তার বাবার ছবিটা বুকে আগলে রেখে অশ্রুপাত করছে। আজকের সত্যিটা সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বাবা নামক মানুষটা যে জীবনে নেই তা সে জানতো না এমন নয়। সে জানতো বাবা নেই। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো যে তার বাবা মা পরিস্থিতির শিকার। সে জানে তার বাবা একটা ভুল করেছে তবে তার মায়ের সাথে খারাপ কিছু করেনি।কেননা শরীয়ত মোতাবেক অনামিকা রাহাতের স্ত্রী ছিল।হয়তো সে জোরপূর্বক তাকে বিয়ে করেছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এর পেছনে যে কিছু বাইরের মানুষেরও প্ররোচনা ছিল তা তো তারা জানত না। রাহাত যে মূহুর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তখন থেকেই সে অনামিকাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। রাহাত চাইলে আরো খারাপ কিছু করতে পারত। হয়তো সে চাইলেই পারতো অনামিকাকে ধর্ষণ করে নিউজপেপারের হেডলাইন বানিয়ে তার মান সম্মান শেষ করে দিতে। অনামিকার মনে রাহাতের জন্য এতটাই ঘৃণা ছিল যে রাহাতের অনুশোচনা বোধ,ভালোবাসা কিছুই চোখে পড়েনি। রাহাতের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিজের পেটের সন্তানকেও দূরে ঠেলে দিয়েছেন।

অনামিকা বাড়িতে টুকটাক কাজ করছিল। জাহানারা বেগম বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে তাকে কিছু না জানিয়েই বেরিয়েছেন। দুবার কল করেছিলেন জাহানারা কে তবে রিসিভ করেন নি। বেল বাজার শব্দ শুনে তিনি ভাবেন তার মা ফিরেছে। হাতের কাজটা রেখেই তিনি দরজা খুলতে চলে যান।

দরজা খুলতেই তিনি অনন্যময়ী কে দেখতে পান। অনন্যময়ীকে দেখে তিনি অবাক হননি অবাক হয়েছেন তার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে।ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। রিশাদ আর জাহানারা বেগম দুদিক থেকে ধরে রেখেছেন। বাবার একটি ছবি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে তার মায়ের সামনে।

অনামিকা হয়ে হন্তদন্ত হয়ে অনির কাছে যান। চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে? অনির চোখের জল মুছতে গেলে অনি তার হাত সরিয়ে দেয়।

–আজ আপনি আমার অশ্রু মুছতে এসেছেন।এই অশ্রুগুলোর কারণ তো আপনিই মিসেস.অনামিকা শেখ।কেন আমার জীবনটা আপনি এভাবে শেষ করে দিয়েছেন?কি অপরাধ ছিল আমার?আমার অপরাধ কি এটাই যে আল্লাহ আমাকে আপনার গর্ভে পাঠিয়েছিল?নাকি আমার বাবা রাহাত চৌধুরী বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আপনি তো কখনো আমাকে ভালোবাসেননি।আমাকে অন্তত আমার বাবার ভালোবাসাটা পেতে দিতেন। জন্মের পর আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আপনি নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করতেন তার সন্তানকে আপন করব নিতেন। আপনি তা করেননি। কোনদিন ফিরেও তাকাননি আমার দিকে।আর আমার বাবাকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিতেন। কাঁদতে কাঁদতে উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে অনি।

অনামিকা আজ এত বছর পর রাহাতের নাম শুনে বড়সড় ধাক্কা খান। অনন্যময়ীর কাছে এই কথাগুলো শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। অনির প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তার কাছে। সত্যিই তো সে অন্যায় করেছে। রাহাতের ভালোবাসাকে অদেখা করে সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সংসার করেছে। নিজের সন্তানকে দূরে ঠেলে সে অন্যের সন্তানকে আপন করে নিয়েছে। কত নিষ্ঠুর একজন মা সে। অনুতাপের অনলে সে আগে থেকেই পুড়ছিল তবে অনির প্রতিটি কথা যেন আজ তার অন্তরে বুলেটের মতো গেঁথে গিয়ে ভেতরটাকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল। সে সময় যদি তিনি রাহাতকে ক্ষমা করে দিতেন বা তার সাথে ঠান্ডা মস্তিষ্কে বসে এই বিষয়ের কোন সুরাহা করতেন তবে হয়তো তার ভাই আর রাহাত উভয়েই বাঁচতো। সে তো রাহাতের সন্তান বলে অনিকেও ভালোবাসতো না।তবে যদি রাহাতকে বলে দিত যে জন্মের পরেই যেন সে অনিকে নিয়ে অনামিকার জীবন থেকে দূরে চলে যায় তাহলেও এর একটা বিহিত হতো। রাহাত শুধু হয়তো তার মেয়েকে নিয়েই ভালো থাকতো।

নিয়তি জটিল খেলায় রাহাত আদনানের জীবনাবসান লেখা ছিল আর অনির কপালে অবহেলা।তাই অনামিকা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল সেদিন।অনামিকার নিয়ন্ত্রাণহীন হয়ে অশ্রুরা সব গাল বেয়ে পড়ছে।

–এই আপনি কাঁদছেন কেন বলুন তো?কার জন্য কাঁদছেন? আমার জন্য?আমাকে তো কোনদিন মেয়ে বলে মেনেই নেননি। নাকি আমার বাবার জন্য?আমার বাবাকেও তো কোনদিন মেনে নেননি।আপনাকে ছাড়াই আমি আমার বাবার সাথে সুখে থাকতাম।আমার বাবার ভুলের শাস্তি শুধু তাকে দিয়ে শান্তি পাননি আপনি তাইনা তাই আমাকেও দিয়েছেন শাস্তি। আপনার শাস্তি তো মাথা পেতে নিয়েছি। আগে ভাবতাম বোধ হয় আমি আপনার মেয়ে হওয়ার যোগ্য নই। তবে আজ আমি বলছি আপনি আমার মা হওয়ার যোগ্য নন। আপনি আমার বাবার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য নন। আমার হতভাগ্য যে আমার জন্ম আপনার গর্ভে হয়েছে। পারতেন তো আমাকে গর্ভেই মেরে ফেলতে। শুধু কষ্ট দেয়ার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এতটা নিষ্ঠুর মা কি করে হতে পারলেন আপনি?আমার বাবা তো মারা গেছেনই আজ থেকে আমার মাও হয়তো মৃত বলে বিবেচিত হবে আমার কাছে। অবশ্য আপনার কাছে তো আমার কোন মূল্যই নেই। (অনি)

–অনন্যময়ী!কি বলছো তুমি এটা?এভাবে বলো না মা।আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি আমি ভুল করেছি। আমি তার জন্য অনুতপ্ত।আমাকে ক্ষমা করে দাও মা।অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন অনামিকা।

–আমার বাবাও তো অনুতপ্ত ছিল।তাকে তো ক্ষমা করেননি আপনি। না পেরেছেন তাকে ক্ষমা করতে না পেরেছেন আমাকে আপন করে নিতে। একজন মৃত মানুষের উপর ঘৃণা থেকে আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। মরার পরেও আপনি আমার বাবাকে ক্ষমা করেননি। কেন এত নিষ্ঠুর হলেন আপনি। আপনি তো কখনো ভালোবাসেননি বাবার ভালোবাসাও পেতে দিলেন না আমায়। (অনি)

অনামিকা আজ নীরবে অনির কথাগুলো শুনছে। কষ্টে তার বুকের মাঝের বহমান ঝড় গুলো আজ দেখবার মতো কেউ নেই। অনিকেও আজ থামাবার কেউ নেই। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে মনের ভেতর জমে থাকা কষ্টগুলো আজ যেন সে বের করে দিচ্ছে। অনামিকার নীরবতা অনিকে আরো বেশি উগ্র করে দিচ্ছে।

অনামিকার হাজার ডাককে উপেক্ষা করে দিয়ে অনি চিরদিনের মতো এবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। অনামিকা দরজায় বসে বার বার তার মেয়েকে ডাকে। অনি একবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকায় না। মাটিতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনামিকা। অদ্রি আর জাহানারা বেগম এসে তাকে ধরে ফেলে।

অনি আর অনামিকার কথাগুলো সেখানে দাঁড়িয়েই নীরব দর্শক হয়ে শুনছিল সে। সেও যেন আজ অনির কষ্টটা অনুভব করতে পারছিল। অনামিকা তার মাকে জড়িয়্ব হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। এই দিনটা যে একদিন আসবে তা তিনি জানতেন আর অনামিকা এর সম্পর্কে অনেক আগেই সাবধান করেন তিনি। তবে বিগত দিনে অনামিকা আর অনির সম্পর্কের উন্নতি দেখে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলেন। আজকের ঘটনায় তার সকল আশার আলো নিভে যায়।

অনির সাথে সাথে পুরো পরিবারে যেন বিষাদ নেমে আসে। আনন্দের আলোকবাতিগুলো সব নিভে যায়। এই অবস্থায় রিশা মিথিলারও মনের অবস্থা ভালো নেই। রাফি ইভানও বেশ বিব্রত হয়ে আছে।

বিকেলবেলার দিকে অনিকে নিয়ে বাসায় ফেরে রিশাদ। জাহানারা বেগম ওবাড়িতে থেকে অনামিকাকে সামলাচ্ছেন। অনামিকার যে বড্ড দরকার তাকে। তাকে কিভাবে ফেলে যেতেন তিনি। তিনি জানেন অনিকে সামলানোর জন্য অনেকেই আছে।রিশাদই যথেষ্ট তাকে সামলানোর জন্য।

রেহানা ও নিহাল চৌধুরী অনিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ জোরাজুরি করে।তবে রিশাদ অনির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে অনিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়।

বাসায় ফিরে রিশাদ অনির চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে অনি আজ বড্ড ক্লান্ত তাই রিশাদকে আর বেশি কষ্ট করতে হয়নি অনিকে ঘুম পারাতে। অনির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রিশাদ। অনির অসহায় চাহনির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনা রিশাদ। উঠে গিয়ে সে নিজেও ফ্রেশ হয়। আছরের আযান দিলে সে ঘরে বসেই নামাজ পড়ে নেয়। অনিকে রেখে আর মসজিদে যেতে চায়নি।

বাড়িতে এখনো আত্মীয় স্বজনরা আছেন। বিয়ের ডেটটা পেছানো হবে কিনা সে ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। রাফি ও ইভানের পরিবারের কোন আপত্তি নেউ বিয়ের ডেট পেছালে। রাফির সাথে কথা বলে রিশাদ ফোনটা রেখে দেয়। শায়লা বেগম রুমে আসেন। অনি ঘুমোচ্ছে। অনির পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকেন তিনি। রিশাদের এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। সকাল থেকে গায়ে হলুদের কাজে ব্যস্ত ছিল। রাফিদের বাড়ি গিয়ে সেখানেও খাওয়া ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছিল।

শায়লা বেগম রিশাদের জন্য এক প্লেট ভাত নিয়ে আসেন। রিশাদের একদম খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও জোর করে কয়েক লোকমা ভাই খাইয়ে দেন।

সন্ধ্যার পর পর অনির ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে অস্পষ্টভাবে সে দেখতে পায় রিশাদকে।রিশাদ কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। অনির জাগা পাওয়া সে এখনো টের পায়নি।

কাকে যেন ফোনে বলছিল রিশাদ বিয়ের ডেটটা পেছানোর কথা।অনির কানে স্পষ্টভাবেই তা পৌঁছায়। অনির এখন কিছুটা হালকা লাগছে তবে তার কষ্টগুলো ঠিক আগের অবস্থানেই আছে।

শরীর কিছুটা দুর্বল লাগছে হয়তো বেশি স্ট্রেসের জন্য। নিজের চেষ্টায় সে বিছানায় বসে।

–রিশাদ!(অনি)

অনির কণ্ঠ পেয়ে রিশাদ পেছনে ফিরে তাকায়।অনিকে জাগা পেতে দেখে ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে পরব ফোন করবে বলে কল কেটে দেয়।

অনির কাছ গিয়্ব রিশাদ বলে; উঠে পরেছো তুমি? এখন ভালো লাগছে?

–হুম!আমার একটা কথা শোনো প্লিজ।(অনি)

–বিয়েটা পেছানোর কি দরকার বলো।আমার জন্য যদি বিয়েটা পেছানো হয় তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে।প্লিজ সবকিছু আগের মতোই থাক না।(অনি)

–সেটা কিভাবে সম্ভব অনি?তুমি তো জানো বাড়ির সবাই তোমাকে কতটা স্নেহ করেন তোমার মন খারাপ থাকলে কি কেউ বিয়েটা ভালোমতো উপভোগ করতে পারবে?আর এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়। যাদের বিয়ে তারাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (রিশাদ)

–প্লিজ বিয়ের ডেট ক্যান্সেল করো না। আমি এখন ভালো আছি। দেখো। আমি চাইনা আমার জক্নহ বিয়ে পেছাক।ওরা কত আশা নিয়ে আছে। আমার জন্য অড়া বলছে ঠিকি তবে ওদেরও মন খারাপ হবে। প্লিজ তুমি দেখো।এখনো তো অনেক সময় আছে গায়ে হলুদের সব প্রিপারেশনও নেয়া আছে। রিশাদের বুকে মাথা দিয়ে শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে অনি।

রিশাদ বুঝতে পারছে। অনির কথাও ফেলে দেয়ার নয়। সবার আনন্দটা নষ্ট হয়ে গেছে। মুখে কিছু না বললেও যে সবার মন খারাপ তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।

–আচ্ছা ঠিক আছে।বিয়ের ডেট পেছাবো না।তবে তোমাকেও আমার কথা মানতে হবে।প্রমিস করো মানবে?(রিশাদ)

–আচ্ছা ঠিক আছে প্রমিস। কি কথা সেটাও তো বলো।(রিশাদ)

–আজকে যা হলো সব ভুলে যাও।খারাপ স্মৃতিগুলো মনে রাখতে নেই। তোমার মন খারাপ থাকলে আমি কি করে ভালো থাকতে পারি বলো।আর মরার কথা একদম মুখে আনবে না। তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? একদম মন খারাপ করবে না। তোমার যেভাবে থাকতে মন চায় সেভাবেই থাকো কোন কিছুতে বাঁধা দেব না। সব সময় তোমার পাশে আছি আমি।(রিশাদ)

অনি রিশাদের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।জোর করে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। রিশাদ এই হাসির মানেটা জানে। সে এটাও জানে যে একদিনে সব ঠিক হবেনা। অনিকে সময় দিতে হবে সবটা মেনে নেয়ার জন্য। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে তো আর কম কষ্ট পায়নি। রিশাদ অনির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে চলে যায়। রিশাদ চলে গেলে অনি বিছানার সাথে হেলান দিয়ে দুচোখ বুজে শুয়ে থাকে। কিছু কথা মনে হওয়াতে চোখের দুপাশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অনির মাঝে যে শান্ত ও ভয়ংকর ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাতে যেন সে বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার নিজের জন্য সে এই পরিবারের মানুষগুলোকে কষ্টে দেখতে পারবে না।মিথিলা রিশার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনকে সে নষ্ট হতে দিতে পারেনা। ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় অনি।

রিশাদ নিচে গিয়ে সবাইকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজন করতে বলে। সবাই খুব অবাক হয়। বিশেষ করে রিশা আর মিথিলা। তারা ধরেই নিয়েছে যে বিয়েটা এখন হচ্ছে না। রিশাদ রাফি আর ইভানের পরিবারকেও জানিয়ে দেয়। তাদের কোন আপত্তি নেই।আগের মতো জাঁকজমক না করে হলেও ঘরোয়া ভাবে তো করাই যায় তাইনা।

গায়ে হলুদের প্রস্তুতি শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। নয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। বাড়ির ছাদে আয়োজন করা হয়েছে। বর পক্ষরাও চলে আসে। রাফি-রিশা, মিথিলা-ইভানের জন্য আলাদা আলাদা স্টেজ বানানো হয়। সেখানে তাদের বসানো হয়। কাজ শেষ করে রিশাদ রুমে যায়।

অনি বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অনি নিজেকে সামলে নেয়। রিশাদকে দেখে অনি একটা শুকনো হাসি দেয়। রিশাদও ম্লান হেসে অনির জন্য ওয়ারড্রব থেকে একটা জামা বের করে। অনিকে ভারী কোন ড্রেস না পরতে দেয় না। অনি ফ্রেশ হয়ে এসে জামাটা পড়ে নেয়। অনির শুকনো মুখটা বেশ লাল হয়ে আছে।মুখে হালকা করে পাউডার দিয়ে ওড়নাটা মাথায় তুলে দেয়। রিশাদও ড্রেস চেঞ্জ করে একটা পাঞ্জাবি পরে নেয়।

রিশাদ অনিকে নিয়ে ছাদে চলে যায়। অনি আসলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনিকে শায়লা বেগমের পাশে বসিয়ে দেন। এরপর কনের বাবা মার হলুদ ছোঁয়ানোর মাধ্যমে গায়ে হলুদ শুরু হয়। রিশাকে হলুদ লাগানোর সময় শায়লা বেগম কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েন। এইতো সেদিন তার কোল আলো করে রিশা এসেছিল। আর আজ মনে হচ্ছে তার ঘর আঁধার করে চলে যাবে।

অনি বসে বসে অনুষ্ঠান দেখছে। রিশাদ একটু পর পর এসে অনিকে দেখে যাচ্ছে। অনির হাতের ফোনটা বেজে ওঠে। জাহানারা বেগমের কল। অনি ফোনটা রিসিভ করে। জাহানারা বেগমের সাথে দু একটা কথা বলে সে ফোনটা রেখে দেয়।

এর মাঝেই রিশাদ এসে অনিকে নিয়ে যায় হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য। অনির যেতে মন চাইছিল না দূরে বসে দেখতেই ভালো লাগছিল।রিশাদের জোরাজুরিতে সে যেতে বাধ্য হয়। পর্যায়ক্রমে সে রিশা আর মিথিলাকে হলুদ মাখায়। তারপর সে আবার নিজের জায়গায় এসে বসে।

হলুদ মাখানো শেষ হলে সবাই রাতের খাবার খেতে চলে যায়। ওয়েটাররা খাবার সার্ভ করে। রিশাদ এক প্লেট খাবার এনে চেয়ার টেনে অনির সামনে বসে পড়ে। জোর করে অনিকে খাইয়ে দেয়। অনিকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেও খেয়ে নেয় রিশাদ। সবাইকে বিদায় জানিয়ে সবকিছু গোছাতে গোছাতে প্রায় দুটো বেজে যায়। অনিকে অনেক আগেই ঘুম পারিয়ে দিয়ে এসেছে রিশাদ। ঘুমের ওষুধের প্রভাব না কাটায় অনি খুব দ্রতই ঘুমিয়ে পড়ে। সব কাজ শেষ করে এসে রিশাদও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অনিকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে…..
আসসালামু আলাইকুম?
রিচেক করা হয়নি?।ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here