অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_২৭
ব্যক্তিগত ব্যস্ততা ও পড়াশোনার চাপে অদ্রি রিশাদের খুব বেশি দেখা সাক্ষাত না হলেও ফোনালাপ ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চেনা পরিচিতিটা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বন্ধুত্ব বজায় রাখতেই কদাচিৎ কফিশপে কফির আড্ডা নয়তো ব্যস্ত শহর থেকে দূরে ফুটপাতের ধারে বা নদীকূলের ধারে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি হাঁটা। সময়ের সাথে সাথে দূরত্বটা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। নামমাত্র পরিচিতি একটা দৃঢ় সম্পর্কে রূপ নেয়। সম্পর্কে শেষ পরিণতিতে নিয়ে যেতেই দুই পরিবারের সবার সম্মতি নিয়ে এলাহিকাণ্ড করে মহা সমারোহে বিয়ের আয়োজন করা হয়।
চারিদিকে উৎসব লেগে যাওয়ার মতো পরিবেশ;সবার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ সাথে হৈ হুল্লোড় তো আছেই। অদ্রির বিয়ে উপলক্ষেই দেশে ফিরেছিল অনি। এদিকে যাকে ঘিরে আয়োজন তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। দুদিন যাবত সে কিছুটা মানসিক চাপে আছে, এই মূহুর্তে প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে অদ্রি। কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না সে এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত। বার বার ফোনের দিকে তাকিয়ে ইমেইলটা দেখছে সে।
মাসখানেক আগে নিউইয়র্ক এর একটা মেডিকেল কলেজে হায়ার স্টাডিসের জন্য এপ্লাই করে অদ্রি। অনলাইন এক্সামের রেজাল্টের ভিত্তিতে শর্টলিস্টে জায়গা পায় অদ্রি। ঢাকা মেডিকেলে পড়াকালীন সময় থেকেই সে বার বার এই সুযোগটার জন্য চেষ্টা করেছে। অনেক বছরের চেষ্টার পর এই সুযোগটা সে হাতে পেয়েছে। এতো কাছে এসেও সে এই সুযোগটা হারাতে চায় না সে। যদি এই সুযোগটা সে হারাতে না চায় তবে তাকে আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে নিউইয়র্ক এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। এদিকে বিয়ের তোড়জোড়ও সব শুরু হয়ে গেছে। অদ্রি প্রতিটা পদে পদে রিশাদ তার সাথে থেকেছে। তবে এই ব্যাপারে সে কিছুটা দ্বিধায় আছে অদ্রি। তার মন তাকে সায় দিচ্ছে না রিশাদকে জানাতে। সে তার ভবিষ্যত নিয়ে কখনোই কোন সমঝোতা করতে রাজি নয়। ছোটবেলা থেকেই সে তার পড়ালেখা নিয়ে একটু বেশিই পজেসিভ ছিল যা ধীরে ধীরে তার ইনসিকিউরিটিতে পরিণত হয়ে যায়। ছোটবেলায় স্কুলে কেউ তার চেয়ে বেশি নাম্বার পেলেই কেঁদে ভেসে দিতো।
টেনশন,ইনসিকিউরিটিতে বার বার হাত কচলাচ্ছে অদ্রি। এরই মধ্যে পার্লারের লোকজনও চলে এসেছে। অদ্রিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনি তাকে জোর করে পার্লার থেকে আসা মেয়েদের সামনে বসিয়ে দেয়। অদ্রি জোর করে একটা হাসি দেয়।
পার্লারের মেয়েরা অদ্রিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। অদ্রির বিচলত অবস্থা অনির চোখে ধরা পড়ে। সে এই বিষয়ে দিদা জাহানারা বেগমের সাথে আলোচনা করলে জানতে পারে বিয়েতে কিছুটা বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। তাই অনিও বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।
বিকেলবেলা বর যাত্রীর আগমনে বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে যায়। সবাইকে বরযাত্রী কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পারে। হাজার রকম জল্পনাকল্পনা শেষে অদ্রি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তার স্বপ্ন পূরণের। তাই সবার চোখের অগোচরে বিয়ের সাজপোশাক খুলে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র একটা হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে সে বাগানের দিকে চলে যায়। গাছের আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে অদ্রি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বরযাত্রী দের ভিড়ে রিশাদকে দেখে দু ফোটা জল পেলে। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সে মেইনরোডে এসে এয়ারপোর্ট এর দিকে যায়।
অদ্রির মা ও দিদা জাহানারা বেগম হাসিমুখে রিশাদকে বরণ করে নেয়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে অনি সবটাই দেখে। বেবি পিংক কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে সে। সাথে ম্যাচিং করা হিজাব হাতে ছোট্ট একটা ডায়মন্ড রিং র ব্রেসলেট লেহেঙ্গার স্টোন গুলার সাথে চকচক করছে। অনিকে বেশ হাসিখুশি লাগছে। এই প্রথম সে বাংলাদেশে এসে কোন বিয়েতে অংশগ্রহণ করেছে। অনুভূতি গুলো নতুন তবে বেশ রোমাঞ্চকর।
অদ্রি রুমে একা আছে ভেবে অনি কিছুটা চিন্তিত হয়। বরণ শেষ হতেই সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে অদ্রির রুমে যায়। সেখানে বিছানার উপর অদ্রির বিয়ের শাড়ি গহনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।অনি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অদ্রি যে পালিয়ে গেছে তা অনির মাথায় আসে না। সে ওয়াশরুমে গিয়েও অদ্রিকে পায়না। রুম থেকে বাইরে এসে এদিক ওদিক সবগুলো রুমে খুঁজে দেখে কোথাও অদ্রিকে দেখত পায় না। বাড়ির আরো কয়েকজন সদস্য এসে অদ্রির খোঁজ করে। কিন্তু কেউই অদ্রিকে কোথাও খুঁজে পায়না। খবর পেয়ে অনামিকা শেখ উপরে আসেন। অনিকে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করব বলেন;অদ্রি কোথায়??
অনি কিছুটা অপরাধবোধ নিয়ে বলে;অদ্রিপুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা।
–খুঁজে পাচ্ছিনা মানে? রুমেই তো ছিল অদ্রি। বলেই অনামিকা শেখ হন্তদন্ত হয়ে অদ্রিকে খুঁজতে শুরু করে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়েন। দূর থেকে অনি অনামিকা শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনামিকা শেখকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনি এক গ্লাস জুস এনে অনামিকা শেখের সামনে ধরে।
–আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জুসটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে। (অনি)
অনামিকা শেখ বেদনাহত নয়নে অনির দিকে তাকায়। তার চোখ জলে টইটুম্বুর হয়ে আছে। অনামিকা শেখকে দেখে অনি কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব করে। অনামিকা শেখের সাথে অনির দূরত্ব টা যেমন সীমাহীন ভালোবাসাও ঠিক তেমনি যা অপ্রকাশিত।
অনামিকা শেখ অনির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দেন। শান্ত কণ্ঠে অনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন; অদ্রিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেলে অদ্রি। তূমি কিছু জানো??
অনি ধীর গলায় বলে; না।আমি তো নিচে ছিলাম। উপরে এসে অদ্রিপুকে কোথাও খুঁজে পাইনি।
অনামিকা শেখ কিছু না বলে উঠে নিচের দিকে যান। এতক্ষণে সবটা জানাজানি হয়ে গেছে। রিশাদ নির্বাক হয়ে বসে আছে। সে কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছে না। অদ্রির বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়ার পিছনে কোন কারণ সে ঠাওর করতে পারছে না। নানান জনের নানান কথায় রিশাদ প্রচণ্ড ভাবে বিরক্ত হচ্ছে। তবে কাউকে কিছু বলার আগ্রহ সে খুঁজে পাচ্ছে না। অদ্রির এধরনের কাজে রিশাদ মারাত্মকভাবে আঘাত পেয়েছে। অদ্রির পূর্ণ সম্মতি নিয়েই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। অদ্রির কোন খবর কেউ বলতে পারেনা। অদ্রির বেস্ট ফ্রেন্ড রাইসাও এই বিষয়ে কিছু বলতে পারছে না। অদ্রির এই কাজে সে নিজেও যেন শকের মধ্যে আছে। অদ্রি রিশাদের সম্পর্ক টা রাইসা অনেক কাছ থেকে দেখছে।
রিশাদের ফোনের নোটিফিকেশন টোনটা বেজে ওঠে। তবে এই মূহুর্তে সে তা চেক করার প্রয়োজন মনে করছে না। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। অদ্রির পালিয়ে গেছে সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ পর রিশাদ অন্যমনস্কভাবে ফোন অন করে। হোমস্ক্রিনে অদ্রির নামের মেসেজ দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দেরি না করে সে অদ্রির মেসেজটা ওপেন করে। ৩০ সেকেন্ডের কম সময়ের ব্যবধানে রিশাদ অদ্রির মেসেজটা পড়ে ফেলে। সে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝে উঠতে পারছে না। রিশাদের কাছে সবটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। অদ্রির ক্যারিয়ারের কাছে রিশাদ তার কাছে একেবারেই তুচ্ছ। রিশাদের শুধু একটাই আফসোস অদ্রি তাকে ভরসা করে কথাগুলো বলতে পারলো না। তার ভালোবাসা কি এতটাই ঠুনকো ছিল??
সবটা জানাজানি হওয়ার পর সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। শহরের স্বনামধন্য ব্যক্তি হওয়ায় সেখানে প্রেসের লোকজনও হাজির ছিল। তারাও এসে দুই পরিবারের লোকজনদের ঘিরে ধরে। সম্মান বাঁচাতে অনির সাথে রিশাদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়।আশরাফ সাহেব সে বিষয়ে কোন মতামত দেন না। কেননা ছোটবেলা থেকেই জাহানারা বেগমই অনির লিগ্যাল গার্ডিয়ান। তাই এ বিষয়ে তিনিই যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নেবেন।
রায়হান সাহেব জাহানারা বেগমের কাছে বিনীত অনুরোধ করেন এ বিষয়ে ভেবে দেখার জন্য। জাহানারা বেগম দ্বিধায় পড়ে যান। অদ্রিকেও তিনু কম ভালোবাসেন না। আর অনিই বা কেন এই বিয়েতে রাজি হবে।
দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সবটাই দেখছে অনি। প্রেসের লোকজনরাও এই বিষয়টাকে টেনে হেচড়ে বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যা অনির মোটেও ভালো লাগছে না। অনামিকা শেখকে দেখতে পায় অনি। কোণার সোফাটায় বসে ক্রমাগত অশ্রুপাত করছে অনামিকা শেখ। অনির বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তাই সে পিছনে ফিরে রুমের দিকে হাঁটা দেয়।
জাহানারা বেগম অনির পথ আটকে দাঁড়ান। অনি ভ্রু কুঁচকিয়ে সেদিকে তাকায়। জাহানারা বেগম অনির হাত ধরে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেন। অনির সামনাসামনি বসেন জাহানারা বেগম।
–দেখো দিদিভাই আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। অদ্রি দিদিভাইয়ের পালিয়ে যাওয়ায় দুই পরিবারেরই অনেক সম্মানহানি হয়েছে। বাইরে সবাই যে যার মতো মনগড়া কথা বলে চলেছে। সাংবাদিকরাও নানান ধরনের মন্তব্য করে চলেছে। এতে এ বাড়ির সবার মান হানি হচ্ছে। সাথে রিশাদের পরিবারেরও সম্মানহানি হচ্ছে।
কথার মাঝে বিরতি দিয়ে জাহানারা বেগম। অনির গালে হাত দিয়ে তিনি পুনরায় বলতে শুরু করেন;
–তুমি ছোটবেলা থেকেই বিদেশে একা মানুষ হয়েছে। এ পরিবারের কারো সাথেই সেভাবে যোগাযোগ ছিল না ঠিকি। কিন্তু দিনশেষে এটাই কিন্তু তোমার পরিবার এরাই তোমার আপনজন। তুমি কি পারবে এদের সম্মান বাঁচানোর জন্য রিশাদকে বিয়ে করতে। বুকে পাথরচাপা দিয়ে কথাগুলো বলছেন জাহানারা বেগম। চেপে রাখা কান্নায় তার গলা ধরে আসছে।
অনি ফ্যালফ্যাল করে তার দিদার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
অনি উঠে দাঁড়িয়ে জাহানারা বেগমকে বলে;
–কি বলছো এসব তুমি দিদা। আমি রিশাদ ভাইয়াকে কিভাবে বিয়ে করবো! উনি তো অদ্রিপুকে ভালোবাসে আমি কিভাবে ওনাকে বিয়ে করবো?আর আমাকে তো আবার ফিরে যেতে হবে। তুমি তো জানো সবকিছু। তাহলে এভাবে কেন বলছো দিদা। প্লিজ চলো না আমরা আজই ফিরে যাই। অদ্রিপুর বিয়েটা তো আর হবে না। এখানে থেকে আমরা কি করবো?? প্লিজ দিদা চলো না আমরা ফিরে যাই। (অনি)
–স্বার্থপরের মতো কথা বলো না অনি। এরা তোমার পরিবার তোমার আপনজন। তাদের এভাবে বিপদে ফেলে দিয়ে অসম্মানের মুখে রেখে কিভাবে যাবে তুমি বলো!! আমি জানি তুমি তোমার পরিবারের সবাইকে কতটা ভালোবাসো। এভাবে বলে না সোনা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি রিশাদের সাথে তুমি মানিয়ে নিতে না পারলে এক মূহুর্তও তোমাকে আমি এখানে থাকতে পারবো না। তবে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও আমি তোমাকে কিছু করতে বলবো না। তোমার যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে। আশা করি তুমি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে। আল্লাহ যেন তোমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তৌফিক দান করে যাতে সবার কল্যাণ হয়। এখানে সব কিছু রাখা আছে যদি তোমার মনে হয় বিয়েটা করবে তাহলে রেডি হয়ে এসো যদি না করতে চাও তবে একেবারে সব কিছু গুছিয়ে বেরিয়ে এসো আমরা আজই চলে যাব। তোমাকে জোর করছি না আমি। তোমার যেটা ভালো হয় তুমি সেটাই করবে। আমি কাউকে ডেকে দিচ্ছি সে তোমাকে হেল্প করবে। (জাহানারা বেগম)
জাহানারা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অনির রুমে তার কাজিন শতাব্দীকে পাঠিয়ে দেয় অনিকে হেল্প করার জন্য। অনি ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখমুখ শুষ্ক হয়ে আছে তার। চোখে উদাসীনতা। সে বুঝতে পারছেনা তার কি করা উচিত। চোখ বুজে ভাবতে থাকে অনি।
অনির বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা বেগম,আশরাফ শেখ ও রায়হান খান। জাহানারা বেগম খুবই বিচলিত হয়ে আছেন।অনিকে যতদূর তিনি চেনেন সে কখনোই এই অবস্থায় ইংল্যান্ড এ ফিরে যাবে না। তবে বিয়েতে রাজি হবে কিনা তা নিয়ে তার মনে সংশয় কাজ করছে। আশরাফ শেখ শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান সাহেবের চোখে চোখ মেলাতে পারছেন না তিনি। তিনি আজ যেন পরাজিত এক পিতা অপরাধবোধ তাকে ঘিরে ধরেছে। রায়হান সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করেন যেন নিজেকে অপরাধী না ভাবে। সত্যিই তো এখানে তার কোন দোষ নেই। তবে সন্তানের যেকোন ভালো কাজে পিতামাতা যেমন সবচেয়ে বেশি গৌরবিত হয় তেমনি কোন ভুল কাজে পিতামাতাই সবচেয়ে বেশি লজ্জিত হয়।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ তিন জোড়া চোখ অনির উপর পড়ে। তাদের তিন জনের মুখেই ফুটে ওঠে মলিন হাসি। বধূ বেশে লাল বেনারসি পড়ে বেরিয়ে আসে অনি। মাথায় তার কাজ করা লাল ঘোমটা। চোখে মুখে কোন সাজসজ্জা নেই তবুও যেন তাকে সাক্ষাত অপ্সরী লাগছে । জাহানারা বেগম অনির দিকে এগিয়ে যান। তার কপালে চুমু খেয়ে বলেন;
–আমি জানি তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। আশীর্বাদ করি সব সময় যেন সুখে থাকো। (জাহানারা বেগম)
অনি কোন কথার জবাব দেয় না। জাহানারা বেগম অনির অবস্থাটা টের পেয়ে আর কোন কথা বাড়ান না। বিয়ের আসরে উপস্থিত হন অনিকে নিয়ে। অতিথিরা একেকজন একেক কথা বলতে থাকে। তবে কেউ কোন পরোয়া করে না।
রিশাদ অদ্রির দেয়া আঘাতে পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সব কিছুই তার কাছে বিষাদময় লাগছে। রায়হান সাহেব তার সামনে অনুরোধ করে সে যেন অনিকে বিয়ে করে। বাবার এই কথাটা ফেলতে পারেনি রিশাদ। ক্রমাগত অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছে সে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে বিয়েতে রাজি হয়। অনিকে তার পাশে বসানো হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
বিয়ে শেষ হতে না হতেই রিশাদ মাথার পাগড়ি খুলে বেরিয়ে যায়। তাতে অনির কোন ভাবান্তর হয় না। যে পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছে এরকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। রিশাদ সবার ডাক উপেক্ষা করে বেরিয়ে চলে যায়। রিশাদ চলে গেলে অনিও ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে যায়। রিশাদ ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে শাই করে বেরিয়ে যায়। খুব জোরে জোরে গাড়ি চালাতে থাকে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। অদ্রি কেন তার সাথে এমনটা করলো। সে তো অদ্রিকে আটকাতে যেতো না। হাসিমুখে তাকে বিদায় জানিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতো। ক্রমাগত স্পীড বাড়াতেই থাকে রিশাদ। স্বাভাবিকভাবে তার মাথা কাজ করছে না। হাইওয়ে তে উঠতেই বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের আলো চোখে মুখে পড়ে রিশাদের। চোখ বুজে ফেলে আচমকা গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। রিশাদ জোরে ব্রেক কষে রাস্তা থেকে নিচের দিকে গাড়ি নামিয়ে দিতেই গাছের সাথে লেগে যায়। এরপর আর কিছু মনে নেই তার।
রিশাদের এমন কাজে বিয়ে বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত হয়ে যায়। রায়হান সাহেব ক্রমাগত রিশাদকে ফোন করে যাচ্ছেন। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। অনেকক্ষণ যাবত ট্রাই করার পর ফোনের ওপাশ থেকে অচেনা মানুষের গলা ভেসে আসে। রিশাদের এক্সিডেন্টের কথা শুনে রায়হান সাহেব দুপা পিছিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরে। নিজেকে সামলে নিয়ে সবাইকে সবটা জানিয়ে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
নোটিফিকেশনের সাউন্ডে ধ্যান ভাঙে রিশাদের। চোখ ভিজে গেছে তার। নিজের উপর বিদ্রূপের হাসি দেয় রিশাদ। পাশেই রাখা টিস্যু বক্স থেকে টান দিয়ে টিস্যু বের করে চোখ মোছে রিশাদ। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে রিশাদ তার কাজে মন দেয়।
একটু পরেই দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে রিশাদ মাথা তুলে দরজার দিকে তাকায়। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে অনি। অনিকে দেখে রিশাদ বলে;একি আপনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? প্লিজ ভেতরে আসুন!
অনি ভেতরে এসে কফির মগটা রিশাদের হাতে তুলে দেয়। রিশাদ মুচকি হাসে। এই মূহুর্তে তার কফিরই কমতি মনে হচ্ছিল। অনি খুব অল্প সময়েই তার প্রয়োজনীয়তা গুলো না বলতেই বুঝতে শুরু করে। রিশাদ বেশ আয়েশ নিয়ে কফির মগে চুমুক দেয়।
অনি রিশাদের পাশে দাঁড়িয়ে বাম পাশের ভ্রু বাঁকিয়ে রিশাদের দিকে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। রিশাদ অনিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাজ বন্ধ করে অনির দিকে তাকায়।
— আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কোন সমস্যা??( রিশাদ)
অনি গম্ভীর গলায় বলে; না আমার কোন সমস্যা নেই। তবে মনে হচ্ছে আপনার সমস্যা হবে।
–কেন বলুন তো? অবাক হয়ে বলে রিশাদ।
–আজ সবেমাত্র আপনার প্লাস্টার খুলে দেয়া হয়েছে আর আপনাকে তো দেখছি আসার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন সমস্যা না থাকলেও একটু পর সমস্যা হবে। (অনি)
–না সেরকম কিছুনা। লাস্ট কয়েকদিনে অনেক কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে। তাই একটু টুকটাক কাজ গুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। বসুন না আপনি প্লিজ। (রিশাদ)
–হ্যা বসবো তবে এখানে না।(অনি)
–কোথায় বসবেন তাহলে??(রিশাদ)
অনি হাত দিয়ে ইশারা করে পর্দা দিয়ে ঢাকা কাচের ওপারে খোলা বেলকনির দিকে ইশারা করে।
রিশাদ মুচকি হেসে ল্যাপটপটা বন্ধ করে। অনিকে কফির মগ দুটো নিতে বলে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। অনি বেশ উৎফুল্ল হয়ে রিশাদের পিছু পিছু যায়। রিশাদ পর্দা সরাতেই একদল আলো এসে অনির চোখে পড়ে। চোখ ছোট করে ফেলে অনি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় অনি। রিশাদ তার দিকে হাত বাড়িয়ে অনির হাত থেকে একটা কফির মগ নিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে আসে।
অনি ফ্লোরে পা দিয়ে অনুভব করতে পারে পুরো ফ্লোর টাই আর্টিফিশিয়াল ঘাস দিয়ে কভার করা। বিষয়টা অনির কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় অনি হাতে তার ধোঁয়া ওঠানো কফির মগ। রিশাদ অনির পাশে এসে দাঁড়ায়। অনিকে বেশ প্রাণবন্ত লাগছে। চোখে মুখে উপচে পড়া খুশির ঝলকানি।
আলগা ভাবে বেঁধে রাখা চুলগুলো হাওয়ায় ঢেউ খাচ্ছে। রিশাদ খুব মনোযোগ দিয়ে অনিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আলতো করে কফির মগে চুমুক দেয়া থেকে শুরু করে অবাধ্য চুলগুলোকে বাধ্য করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাগুলোও রিশাদের নজরে পড়া থেকে বাদ যায় নি। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো গভীর ভাবে দেখছে রিশাদ। রিশাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। রিশাদ তা বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে নেয়।
–এভাবে কি দেখছেন? আপনার কফিতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। (অনি)
–হ্যা খাচ্ছি তো। বলেই রিশাদ কফির মগে চুমুক দেয়। কফিটা পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে গেছে। মুখে দিতেই বিষাদ লাগছে। মুখ কুঁচকে গেছে তার। তবুও অনির সামনে জোর করে হাসির রেখা ফুটে তোলে রিশাদ।
অনি রিশাদের অবস্থা দেখে মুখ চেপে হাসছে। রিশাদ এই ঠান্ডা কফিটা ঢক ঢক করে গিলছে। দেখেই অনির খুব হাসি পাচ্ছে। কোন মতে কফিটা শেষ করে রিশাদ। অনি শব্দ করে হেসে দেয়। রিশাদ অনির এভাবে হাসায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও মুখে প্রকাশ করে না। অনির সাথে টুকটাক গল্প করে রিশাদ। রিশাদের কলেজের কাহিনী গুলো শুনে অনি বেশ মজা পায়। হাসতে হাসতে গড়াগড়া খাওয়ার উপক্রম। রিশাদও অনিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তার গল্পগুলো শোনাচ্ছে। বেশ হাসিখুশি মনে হচ্ছে তাদের।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছে মিথিলা। সে রিশাদের কাছে এসেছিল একটা ইম্পরট্যান্ট বই নেয়ার জন্য। রুমে এসে কাউকে না পেয়ে মিথিলা ফিরে যেতে নেয়। হাসির শব্দ শুনে পিছনে ফেরে।বেলকনির দিকে এগিয়ে গিয়ে রিশাদ আর অনিকে একসাথে এতো হাসিখুশি থাকতে দেখে মিথিলার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অনির জায়গায় যদি আজ সে থাকতো খুব কি খারাপ হতো?? অবাধ্য নোনাজল গুলো এসে ভিড় জমায়। মিথিলা চোখ বুজে জলগুলো ছেড়ে দেয়। দুহাতে মুছে নিয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মিথিলা।
সৃষ্টিকর্তা তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য শ্রেষ্ঠ জিনিস গুলাই নির্ধারণ রেখেছেন। যা তার জন্য চির কল্যাণকর হবে। হয়তো মিথিলার জন্যও কোথাও কেউ অপেক্ষার প্রহর গুনছে যার কাছে রিশাদের প্রতি মিথিলার ভালোবাসা অনেক তুচ্ছ। মিথিলার হয়তো মনে হয় রিশাদকে পাওয়ার জন্য হাজার প্রার্থনা বিফলে গেছে। সত্যিই কি তাই???
চলবে………
আসসালামু আলাইকুম
???