অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_২৫
প্রায় ন’টা বাজতে চলেছে। রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে নি রিশাদ। ভোর বেলার দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জাগা পেয়ে পাশে তাকিয়ে অনিকে দেখতে পায় না রিশাদ।এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও খুঁজে পায়না রিশাদকে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনিকেই সে সবার আগে দেখে। রিশাদ বুঝতে পারছে অনি ধীরে ধীরে তার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে যা তার জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। রিশাদ উঠে বসে। কিছুক্ষণ অলসভাবে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকে রিশাদ। হয়ত মনে মনে সে অনির জন্য অপেক্ষা করছে।
চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ বসে থাকে রিশাদ। হতাশ হয়ে সে বেড থেকে নেমে একা একা ওয়াশরুমে যায়।
অনি হাতে এক কাপ কফি নিয়ে একটু পর উপরে উঠে আসে। রুমে এসে রিশাদকে কোথাও দেখতে পায়না সে। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে আসে অনির কানে। কফির মগটা বেড সাইড টেবিলে রেখে দেয় অনি। রিশাদ তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
অনিকে দেখে রিশাদ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না এমন ভাব দেখায় যেন এই রুমে সে ব্যতীত আর কেউই নেই। অনি কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রিশাদ হাতমুখ মুছে নিয়ে অনিকে অতিক্রম করে বিছানায় বসে পড়ে।অনি কিছুক্ষণ রিশাদকে পর্যবেক্ষণ করে রিশাদের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দেয়। রিশাদ অনির দিকে চোখ কুঞ্চিত করে তাকায়। অনি ইশারায় বলে কি হয়েছে??
রিশাদ ছোট্ট করে জবাব দেয়; কিছুনা। আমি কফি খাবো না আপনি নিজের কাজে যান।
বলেই রিশাফ ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনি কিছুটা অবাক হয়। রিশাদ তাকে ইগনোর করছে সেটা সে অনি ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পারছে। সে পুনরায় রিশাদের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দেয়। রিশাদ অনির দিকে একবার তাকিয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে পুনরায় অনির দিকে তাকায়। অনি তখনও রিশাদের দিকে তাকিয়ে ছিল্ম রিশাদের এভাবে তাকানোয় অনি তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাইরে যায়। রুম থেকে বেরিয়ে কিছু একটা ভেবে আবার রুমের ভেতরে আসে। রিশাদ তখন কফির মগের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল।
অনি কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ;কি হলী ব্যাপারটা!আমাকে দেখলে তো এমন ভাব করে যেন কেউ নিমপাতার রস খাইয়ে দিয়েছে আর এখন দেখো একা একা হাসছে। পাগল নাকি লোকটা। অদ্রি আপু যে কিভাবে এই লোকটা কে এতদিন সহ্য করেছে আল্লাহ ভালো জানে।
রিশাদের কানে স্পষ্ট ভাবে অনির কথাগুলো পৌঁছায় না। সে ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অনির দিকে তাকায়। অনি সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বলে; মামনি বলেছে আজকে কিন্তু আপনাকে হসপিটালে যেতে হবে একবার। আজকে আপনাত প্লাস্টার খুলে দেওয়া হবে। মামনি আপনাকে একবারে রেডি হয়ে নিচে নামতে বলেছে।
অনি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলায় রিশাদ তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। অনি রিশাদকে উপেক্ষা করে আলমারি থেকে রিশাদের জন্য একটা শার্ট আর প্যান্ট বের করে রিশাদের সামনে ধরে। রিশাদকে কাপড় গুলো দিয়ে অনি রিশাদকে বলে; আপনি তাড়াতাড়ি প্লিজ চেঞ্জ করে নিন। দেরি হলে আপনার জন্য আমি বকুনি খেতে পারবো না কিন্তু।
রিশাদ জবাবে কিছু না বলে কফির মগে চুমুক দেহ। রিশাদের এধরনের গা ছাড়া ভাবে অনির মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। সে যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। রিশাদ অনির মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে অনিকে আর খ্যাপানোর রিস্ক নেয় না। কফির মগটা সরিয়ে রেখে সে একা একা টি শার্ট খোলার চেষ্টা করে। কোনমতেই সে খুলতে পারে না। অনি সবটাই লক্ষ্য করে।
রিশাদ চোখ মুখ খিচিয় বসে থাকে। একটু পরেই সে বিরক্তির সুরে বলে; আম্মুকে ডাকুন।
–মামনিকে ডাকা যাবে না।মামনি এখন ব্যস্ত আছে। (অনি)
–তাহলে রিশাকে ডাকুন।(রিশাদ)
–রিশা বাসায় নেই। কোচিং ক্লাসে গেছে। (অনি) বলেই অনু মুখ চেপে মিটি মিটি হাসছে। রিশাদের কর্মকাণ্ডে অনির বিরক্তি লাগলেও এখন তার প্রচুর হাসি পাচ্ছে।
রিশাদ হাসির শব্দ পেয়ে অনির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে সবগুলো দাঁত বের করে একটা লম্বা হাসি দেয়। রিশাদের প্রচণ্ডভাবে মেজাজ খারাপ হয় অনির এভাবে মজা নেয়ার জন্য। সাথে কিছুটা অসহায়বোধ ও হয়। রিশাদ মনে মনে অদ্রিকে হাজারখানেক গালি দেয়। অদ্রির জন্য আজ এই মেয়েটা তার গলায় ঝুলে পড়েছে। তার সাথে এভাবে মজা নিতে পারছে। রিশাদ চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।
অনি হাসি থামিয়ে রিশাদের দিকে এগিয়ে যায়। অনি রিশাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের মাঝে কয়েক ইঞ্চির তফাত। খুব সাবধানে সে রিশাদের টি শার্ট খুলে দিয়ে শার্ট পরিয়ে দিয়ে। রিশাদকে দাঁড়ায় করিয়ে তার শার্ট এর বোতামগুলো লাগিয়ে দেয়। রিশাদের খুব অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি হচ্ছে অনি এতো কাছাকাছি আসায়। রিশাদ মনে মনে ভাবতে থাকে আচ্ছা অনিরও কি এমনই অনুভূতি হচ্ছে?
রিশাদের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে অনি বলে; আমি শার্টটা পরিয়ে দিয়েছি আপনি এখন নিজ দায়িত্বে প্যান্টটা পরে ফেলুন। বলেই শব্দ করে হাসতে হাসতে অনি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রিশাদ বোকার মতো অনির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ যাবত যুদ্ধ করার পর রিশাদ প্যান্ট পরতে সফল হয়। একটা প্যান্ট পরতে যেন তার ঘাম ছুটে গেছে। বিছানায় বসে হাফ ছাড়ে রিশাদ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করে নেয় রিশাদ। অনেকদিন হলো শেভ না করায় তার দাঁড়ি গুলো একটু বড় হয়ে গেছে। তবে রিশাদ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হাসে রিশাদ।
একটু পর অনি নাস্তার ট্রে নিয়ে রিশাদের রুমে আসে। রিশাদ কে সোফায় বসিয়ে দেয় অনি। খাবারগুলো টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রিশাদের মুখোমুখি বসতে বসতে বলে; মামনি খুব ব্যস্ত তাই আমি নিজেই আপনার খাবারটা নিয়ে আসলাম। রিশাদকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে অনি। রিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে খাবার মুখে নেয়। চিবুতে চিবুতে রিশাদ ভাবতে থাকে এই মেয়েটা আসলেই অনেক বেশি অদ্ভুত। আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও কয়েকগুন বেশি অদ্ভুত।
খাওয়ার মাঝামাঝি রিশাদ কিছু একটা ভেবে বলে; অনন্যময়ী আপনি খাবেন না??
–আপনি আগে খেয়ে নিন। তারপর আমি খাবো।(অনি)
–আমি তো এতো খাবার খেতে পারবো না আপনি আমার সাথেই খেয়ে নিন।(রিশাদ)
অনি রিশাদের কথায় কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাসে। রিশাদকে খাবার খাইয়ে দিতে দিতে সে নিজেও খেয়ে নেয়। খাবার শেষ করে অনি প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিলেন শায়লা বেগম। অনিকে দেখে বলেন; কিরে তুই ব্রেকফাস্ট করবি না??
–মামনি আমি খেয়েছি। তুমি জলদি ব্রেকফাস্ট করে নিও।আর পাপা কোথায়??
–তোর পাপা রেডি হচ্ছে।তুইও গিয়ে রেডি হয়ে নে।কিন্তু তুই ব্রেকফাস্ট করলি কখন??(শায়লা বেগম)
–এইতো মামনি এক্ষুণি করেছি তুমি চিন্তা করো না আমি আসছি। বলেই অনি রুমের দিকে চলে যায়।শায়লা বেগম কিছু বুঝতে পারেন না। তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন।
কিছুক্ষণ পর অনি রিশাদকে নিয়ে রেডি হয়ে নিচে
নেমে আসে। রায়হান সাহেব আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। এরপর তারা শায়লা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেন। গাড়িতে সামনে বসেন রায়হান সাহেব। অনি রিশাদ পিছনের সিটে পাশাপাশি বসলেও তাদের মাঝে হাতখানেকের দূরত্ব। রিশাদ অনি কেউই কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।
সারা রাস্তা জুড়ে রায়হান সাহেব গল্প করে অনির সাথে। তাদের গল্পের মূল বিষয় ছিল ঢাকা শহর।অনি খুব আগ্রহ নিয়ে রায়হান সাহেবের গল্প গুলো শোনে। বেশ ভালোই লাগছিল তার কাছে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল অনি। খুব কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। সকল শ্রেণির মানুষরা তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।
অনির কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লেগেছে যে বিষয়টা তা হলো ঢাকা শহরের জ্যাম।দীর্ঘ বিশ মিনিট যাবত জ্যামে আটকে থাকার পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে যায় অনি রিশাদ। হাসপাতালেত ভেতরে ঢুকে সোজা ডাক্তার আংকেলের কেবিনের দিকে যায়।
কেবিনে প্রবেশ করে একজন নার্স তাদের বসতে বলে। ডাক্তার আংকেল কেবিনে ছিলেন না। মিনিট পাঁচেক পর হন্তদন্ত করে কেবিনে প্রবেশ করেন ডাক্তার আংকেল। রায়হান সাহেব ডাক্তার আংকেলের সাথে কুশল বিনিময় করেন।
অনি উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে তাকে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়ে ডাক্তার আংকেল অনিকে বসতে বলেন।
–কেমন আছো অনি মাই ডিয়ার?? এন্ড রিশাদ তোমার কি খব্র বলো??(ডাক্তার আংকেল)
অনি রিশাদ একসাথে জবাব দেয়; জি আলহামদুলিল্লাহ আংকেল আপনি কেমন আছেন?? অনি রিশাদ দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। সামনেই ডাক্তার আংকেল ও রায়হান সাহেবও একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। লজ্জায় অনি রিশাদ দুজনেই মাথা নিচু করে ফেলে।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য অনি বলে; আপনি কেমন আছেন আংকেল? আপনাকে অনেক টায়ার্ড লাগছে?
–এইতো ডিয়ার আছি।আসলে কি বলো তো আজ সারারাত হসপিটালেই ছিলাম তো বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই একটু টায়ার্ড আর কি। দেখো তোমার আন্টি বার বার কল দিচ্ছে আমি রিসিভই করতে পারছি না। কাল রাতে একটা ইমারজেন্সি অপারেশন ছিল। একটা বাচ্চা মেয়ে গুনগুন খেলতে খেলতে ফ্লোরে পরে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত লাগে। খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ছিল। আল্লাহর রহমতে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। একটু আগেই বাচ্চাটার সেন্স ফিরেছে। চেকাপ করেই আসছিলাম আমি। শি ইজ সাচ অ্যা কিউটি পাই।
ডাক্তার আংকেলের কথা শুনে অনির কিছুটা কৌতূহল জাগে তবে সে তা প্রকাশ করে না। বাচ্চাটা ভালো আছে শুনে তার খুব ভালো লাগে। ডাক্তার আংকেল সবার সাথে আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে। রিশাদকে চেকাপ করেন।
গুনগুনের জ্ঞান ফিরে আসায় চৌধুরী পরিবারের সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। গুনগুন সবার সাথে আধো আধো বুলিতে কথা বলে। হিমাদ্রী গুনগুনের কপালে চুমু খেলে গুনগুন মলিন চেহারায় এক নৈসর্গিক হাসি দেয়। তার হাসিতে সবার চোখেমুখেও যেন খুশুর ঝলকানি দেখা দেয়। ভোর হতে না হতেই হাসপাতালে হাজির হয়েছিলেন নিধি আর আয়েশা বেগম। গুনগুনের অসুস্থতার খবর পেয়ে আয়েশা বেগম কান্নায় ভেঙে পরলে নিধি তাকে কোন রকম সামলে নেয়। সে নিজেও গুনগুনের জন্য বেশ চিন্তুত হয়। আয়েশা বেগম বার বার গুনগুনের কাছে যেতে চাইলে নিধি তাকে খুব কষ্ট করে সামাল দেয়। ওতো রাতে গাড়ি পাওয়াও মুশকিল ছিল।তার উপর তারা দুজনেই একা মহিলা হয়ে কিভাবে আসবে। তাই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নিধি আয়েশা বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যায়।
নিরা গুনগুনকে একটু একটু করে স্যুপ খাইয়ে দেয় রেহানা বেগমকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয় নিরা হিমাদ্রী। অফিসে ইমারজেন্সি থাকায় নিহাল চৌধুরী একটু আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। আর রাফি রেহানা বেগমকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেছে।
খাওয়া শেষ হলে হিমাদ্রী গুনগুনকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ গুলো খাইয়ে দেয়। গুনগুন ওষুধ গুলো খেতে না চাইলে হিমাদ্রী তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। হিমাদ্রী অদ্ভুত কান্ড কারখানাগুলো দেখে গুনগুন হালকা শব্দ করে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হিমাদ্রী সেই সুযোগে গুনগুনকে ওষুধ গুলো খাইয়ে দেয়। হিমাদ্রী ও গুনগুনের এতো সুন্দর ভালোবাসার মূহুর্তে গুলো দেখে বরাবরই তার দুচোখ ভরে আসে। এবারেই তাই হয়েছে। প্রতিবারই তার কাব্যর কথা মনে পড়ে।এই সুন্দর মূহুর্ত গুলো গুনগুনের তার বাবার সাথে কাটানোর কথা ছিল। কেন প্রকৃতি এতো নির্দয় হলো তার সাথে। বাবাকে হারানোর কষ্টটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় নিরা। গুনগুনের আগমন বার্তায় নিজেকে সামলে নেয় নিরা। তবুও তার জীবনের সীমাহীন শূন্যতা গুলো অপূরণীয়।
আয়েশা বেগম নিরার কাঁধে হাত রাখলে নিরা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে ম্লান হাসি দেয়। আয়েশা বেগম তার মেয়ের কষ্টগুলো খুব গভীর ভাবে অনুভব করতে পারেন তবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ব্যতীত তার হাতে আর কিছুই নেই। ব্যথাতুর দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন আয়েশা বেগম।
নিরা নিজেকে গুনগুন সামলে নিয়ে গুনগুনের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। গুনগুন তার মাকে দেখে ভুবন ভোলানো হাসি দেয়। জবাবে নিরা মুচকি হেসে গুনগুনের কপালে চুমু দেয়। নিরা গুনগুনের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নানান কথা বলে গুনগুনের মন ভালো করার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে জোরে শব্দ করে হাসতে গেলে কিছুটা মাথায় ব্যথা পায় গুনগুন তাই নিরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে গুনগুনের দিক সবরকম ভাবে খেয়াল রাখার।
হিমাদ্রী কেবিনের ভেতরে সোফায় বসে গুনগুনের প্রেসক্রিপশন টা ভালো করে দেখছিল। একটা ওষুধ কিভাবে খাওয়াতে হবে তা সে ঠিক মতো বুঝতে পারছে না। দায়িত্বরত। নার্সকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও কিছু ভালোভাবে বলতে পারেন না। তাই হিমাদ্রী নিরাকে বলে;ভাবী তুমি তুমি থাকো আমি একটু আসছি ডাক্তারের সাথে কথা বলে।
–জি ভাইয়া ঠিক আছে। (নিরা)
হিমাদ্রী প্রেসক্রিপশনের ফাইলটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ডাক্তারের কেবিনের সামনে এসে নক করে দরজা খুলে বলে; এক্সকিউজ মি আংকেল!! মে আই কাম ইন প্লিজ?
–ওহ ইয়াহ হিমাদ্রী প্লিজ কাম ইন মাই ডিয়ার। হাউ ইজ আওয়ার লিটল বেবি?? এনিথিং রং??(ডাক্তার আংকেল
–নো নো আংকেল শি ইজ ফাইন নাও। একচুয়ালি আংকেল প্রেসক্রিপশনে একটা মেডিসিন কিভাবে খাওয়াতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। আই ওয়াজ অ্যা লিটল বিট কনফিউজড। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কথা গুলো বলে হিমাদ্রী। সে সময় ডাক্তার আংকেল সবেমাত্র রিশাদের চেকাপ শেষ করে তার প্লাস্টার গুলো খুলে দিয়ে এসে নিজেরবচেয়ারে বসেন। রিশাদও তার বিপরীতমুখী করে রাখা একটা চেয়ারে এসে বসে। চেকাপের সময় অনি ও রায়হান সাহেব ওয়েটিংরুমে ওয়েট করছিলেন। হিমাদ্রী পাশেই অন্য আরেকটি চেয়ারে বসতে বলেন ডাক্তার আংকেল।
চেয়ারে বসে হিমাদ্রী পাশেই বসে থাকা ব্যক্তির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে হিমাদ্রীর তবে সে ঠিকমতো ঠাওর করতে পারছে না। আড়চোখে পুনরায় তাকায় হিমাদ্রী। তবে সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না রিশাদকে সে কোথায় দেখেছে। রিশাদ হিমাদ্রির এভাবে তাকানোই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে নড়েচড়ে বসে। হিমাদ্রী তা বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে নিয়ে ডক্টর আংকেলের সাথে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ডিসকাস করে।
ওয়েটিং রুমে বসে বসে বোর হচ্ছিল গুনগুন। তাই সে করিডোর দিয়ে হাঁটতে থাকে। পাশের একটা কেবিনের দিকে তাকাতেই দরজার উপর লাগানো কাঁচ ভেদ করে তার নজর বেডে শুইয়ে থাকা বাচ্চাটার উপর পরে। হুট করে তার মনে পড়ে যায় ডাক্টার আংকেলের কথা গুলো। মেয়েটার প্রতি তখন থেকেই মনে মনে বেশ কৌতূহল জমে আছে অনির। সে মনে মনে ভাবতে থাকে আচ্ছা এই বাচ্চাটাই কি গুনগুন??নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে অনির। হসপিটালে তো অনেক বাচ্চাই থাকে। কোনটা গুনগুন কিভাবে বুঝবে সে??
কেবিনের ভেতর থেকে নিরা বাইরে একজন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। বেড থেকে নেমে সে দরজা খুলে অনির সামনে দাঁড়ায়। অনি কিছুটা হকচকিয়ে যায়। নিরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে; কে আপনি??কাউকে কি খুঁজছেন??
অনি আমতা আমতা করে বলে; না না আপু কাউকে খুঁজছি না।
–ওহ আচ্ছা। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো ভাবছিলাম হয়তো কাউকে খুঁজছেন। আপনার কোন রিলেটিভ কি এখানে এডমিট আছে? (নিরা)
— না কেউ এডমিট নেই তবে কিছু দিন আগে ছিল। আজকে তার চেকাপের জন্যই এসেছি। আপনার কে এডমিট আছে??(অনি)
–আমার মেয়ে গুনগুন। গত রাতেই ওর একটা অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার অবজারভেশনে রেখেছেন। (নিরা)
–ওহ গুনগুন আপনার মেয়ে। কেমন আছে এখন গুনগুন??(অনি)
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে? আপনি কি গুনগুনকে চেনেন??(নিরা)
–একচুয়ালি নো। আমি গুনগুনকে চিনি না। একটু আগেই ডক্টর আংকেল গুনগুনের কথা বলছিলেন। (অনি)
–ওহ আচ্ছা। আসুন না ভেতরে আসুন। ও জেগে আছে। ওর সাথে দেখা করে যেতে পারেন। গুনগুনেরও খুব ভালো লাগবে। (নিরা)
অনি কিছুটা সংকোচবোধ নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। নিরা গুনগুনের কাছে গিয়ে বলে; দেখো গুনগুন সোনা তোমার সাথে একটা নতুন আন্টি দেখা করতে এসেছে।
গুনগুনকে অনিকে একবার পুরোটা দেখে নিয়ে বলে; এই সুন্দর আন্টিটা কে মাম্মাম?? আন্টিটা দেখতে একদম প্রিন্সেস এর মতো।
গুনগুনের কথা শুনে অনি হেসে দেয়। সে গুনগুনের কথা শুনে বলে; আমি তো জানতাম প্রিন্সেস হলো গুনগুন। গুনগুন থাকতে কি অন্য কেউ প্রিন্সেস হতে পারে বলো।
গুনগুন এক গাল হেসে দিয়ে বলে; এই তুমি কি করে জানলে গুনগুন চাচ্চুর প্রিন্সেস? আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাহলে তোমাকে পরী আন্টি বলে ডাকব।
–গুনগুন কি শুধু চাচ্চুর প্রিন্সেস?? উমম না তো গুনগুন তো সবার প্রিন্সেস। তাই তো সবাই গুনগুনকে এত্তো এত্তো আদর করে।
–তুমি তাহলে আমাকে আদর করে দাও!
গুনগুনের কথায় মুচকি হেসে অনি তার কপালে গালে চুমু দিয়ে দেয়। গুনগুন খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। নিরা বলে; এতো কথা হলো কিন্তু আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
–আমার নাম অনন্যময়ী শেখ। আপনার?
–আমি নিরা চৌধুরী। (নিরা)
অনন্যময়ী আরো কিছুক্ষণ সময় কাটায় গুনগুনের সাথে। আয়েশা বেগমের সাথেও পরিচিত হয় সে। গুনগুনকে বেশ মনে ধরেছে তার। বাচ্চাদের সাথে তার খুব বেশি সখ্যতা গড়ে তোলার সুযোগ না হলেও গুনগুনের সাথে সময় কাটাতে বেশ ভালো লেগেছে। নিরা, আয়েশা বেগমের এতো অমায়িক ব্যবহারেও সে মুগ্ধ হয়ে যায়। নিরার সাথে কথোপকথনে তারা একে অপরের নাম্বার নিয়ে নেয়। কথার মাঝেই অনির ফোনটা বেজে ওঠে। রায়হান সাহেব তাকে কল করছে দেখে সে চটপট ফোন রিসিভ করে।
–হ্যালো অনি মা কোথায় তুমি? রিশাদের চেকাপ হয়ে গেছে এখন তো বাড়ি ফিরতে হবে। (রায়হান সাহেব)
–এইতো পাপা আমি এক্ষুণি আসছি। ওয়েটিং রুমের কাছেই আছি আমি।জাস্ট দুমিনিট। (অনি)
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি একেবারে নিচে পার্কিং জোনে চলে এসো। আমি রিশাদকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। (রায়হান সাহেব)
–ওকে পাপা। আমি আসছি।(অনি)
অনি ফোন রেখে নিরা ও আয়েশা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। গুনগুনকেও সে আদর করে দেয় বেরিয়ে আসার পূর্বে। অল্প সময়ে গুনগুন তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। মুচকি হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে অনি পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে যায়।
নিচে নেমে এদিক ওদিক তাকায় অনি। কাউকেই দেখতে পায়না সে। একটু পরেই রায়হান সাহেবের কন্ঠে উচ্চারিত নিজের নামটা অনির কানে ভেসে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে সে রায়হান সাহেবকে দেখতে পেয়ে সেদিকে যায়। গাড়িতে উঠে বসে রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখে তার হাত ও পায়ের প্লাস্টার খুলে দেয়া হয়েছে। মুচকি হেসে রিশাদকে বলে; এখন কেমন আছেন আপনি? ডাক্তার আংকেল কি বললো??
–ব্যথাটা কমে গেছে। পুরোপুরিভাবে সারতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। এখন একা একা একটু হাঁটাচলা করতে পারছি। কিছুদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি কোথায় ছিলেন বলুন তো??
অনি খুব উৎসাহ নিয়ে রিশাদকে গুনগুনের সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে নিয়ে একে একে সবটা জানায়। অনির এই হাশিখুশি ভাবটা রিশাদের খুব ভালো লাগে। সে বরাবরই চায় অনি যেন সব সময় এমন হাসিখুশি থাকে। অনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে রিশাদ। পুরো রাস্তা জুড়ে অনি রিশাদের সাথে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে। তারা হয়ত ভুলেই গেছিল রায়হান সাহেবের উপস্থিতির কথা। লুকিং গ্লাসে অনি রিশাদকে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হন রায়হান সাহেব। তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হতে দেখে স্বস্তি অনুভব করেন তিনি। অনি রিশাদের সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে আশার আলো দেখেছিলেন তা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। মানুষ বরাবরই তার পছন্দমতো স্বপ্নগুলো সাজাতে ভালোবাসে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করে। এর থেকে বেশি তার হাতে কিছুই থাকে না। সবার উর্ধ্বে সৃষ্টিকর্তা যার জন্য যেটুকু নির্ধারণ করে রেখেছেন দিনশেষে তাই তার প্রাপ্য।
চলবে…….
আসসালামু আলাইকুম। আগের পর্বটা আমি ভালো করে লিখতে পারিনা।তার জন্য সরি। ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।??