তারকারাজি- (১৭)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
ক্রুদ্ধ নীলাশা যখন ছুরি নিতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল তখনও তার খেয়াল ছিল না যে, বসার ঘরে অতিথির উপস্থিতি রয়েছে। ওদিকে অতিথিদের-ও বোধহয় খেয়াল ছিল না কোনো রমণীর সিঁড়ি ভাঙার ব্যস্ততাতে। নীলাশা খুব কৌশলে ছুরিসহ নিজের দু’হাত পিছনে লুকিয়ে, এগিয়ে গেল বসার ঘরের দিকে। বসার ঘরে তখন রমরমা পরিবেশ। নীলাশা যখন ত্রস্তব্যস্ত পায়ে মুক্তির দাবী নিয়ে বসার ঘরে পৌঁছাল, তখন তার শীর্ণ পল্লবে ঢাকা চোখ দুটো যেন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল! এই বিমূঢ়তা কাটাতে নীলাশার মাত্র কয়েক মুহূর্তই সময় লাগল। সামনে আরাভ, আরাভের বাবা আহসান চৌধুরী ও আরেকজন যুবকের উপস্থিতি যেন নীলাশাকে বিব্রত বোধ করতে বাধ্য করল। ইয়াসিন চৌধুরী তার হারিয়ে যাওয়া অতি প্রিয়তম বন্ধুকে পরিবারসহ দাওয়াত করেছিলেন। নীলাশা শুনেছে, নীলাশাকে প্রথম দিন ভার্সিটিতে ছাড়তে গিয়েই বহু বছর পর দেখা হয়েছিল দুই বন্ধুর। দুই জনের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যস্ততার কারণে পরিকল্পিত ও একান্তভাবে দেখা করা সম্ভব হয়নি এতদিন। তবে আজ যখন দু’জনার সময় মিললো তখন আর দেরি করলেন না ইয়াসিন চৌধুরী। পরিবারসহ দাওয়াত করলেন বন্ধুকে। তবে কি আহসান চৌধুরীই তার বাবার বন্ধু? প্রশ্নটা মনে আসতেই এক লহমায় বুঝে নিল উত্তরটা। নীলাশা মাথা নত করে দাঁড়ালো। তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটা একদমই ভালো না। দুর্দমনীয় ক্রোধটাকে বুকে আগলে রাখার ভীষণ চেষ্টায় কাতর হয়ে পড়ল মেয়েটি। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা বরাবরই অসাধ্য সাধনের রূপ ধারণ করে নীলাশার কাছে৷ নিজের এই চেষ্টা করার মাঝেই ইয়াসিন চৌধুরীকে তার বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গেল,
“ আহসান, মেয়েকে তো চিনিস-ই। আর নীলাশা, ও আমার বন্ধু আহসান, তোমাদের ভার্সিটির প্রফেসর। ওর বড় ছেলে অভ্র আর ছোট ছেলে আরাভ। আরাভ আর তুমি কিন্তু একই ভার্সিটিতে পড়ো। ”
নীলাশা মাথা নিচু করেই সালাম দিল। সম্বোধনে ডাকল ‘স্যার’। তার উত্তরে আহসান চৌধুরী হেসে বললেন,
“ আরে মামণি, আমি ভার্সিটিতেই তোমাদের স্যার। এখানে বাবার বন্ধু হিসেবে আঙ্কেল-ই ডাকবে তুমি, বুঝলে? ”
নীলাশা অল্প করে ওনার দিকে তাকিয়েই মাথা দোলায়। মেয়েটির চোখে ঢের পানি জমে থাকতে দেখে আহসান চৌধুরীর হাসিটা মলিন হয়ে যায়। এদিকে আরাভও প্রথম ধাপে অবাক হয়েছিল খুব। অতঃপর নীলাশার মতোই দুইয়ে-দুইয়ে চার করে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। তবে নীলাশার এহেন অবস্থা চোখ এড়ায়নি আরাভের। সেই ক্রন্দনরত লালাভ চোখ, জাজ্বল্যমান মুখশ্রী এমনকি তার ঠোঁট চেপে কান্না নিবারনের চেষ্টাটাও চোখে পড়েছে আরাভের। বাবার থেকেও বেশি বিচলিত দেখায় তাকে। তবে দু’জন গুরুজনের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সে আর তখনই যেন ইচ্ছাপূরণের উছিলার মতো আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,
“ কী ব্যাপার, নীলাশা মামণি অসুস্থ না-কি? চোখ-মুখের অবস্থা এইরকম কেন? ”
নীলাশা তার দুই পাশে মাথা নাড়ায়। বলে, সে ঠিক আছে। আহসান চৌধুরী এই নিয়ে আর প্রশ্ন করে না। তবে নীলাশাকে বসতে বলার পরও বসতে না দেখে একটু খটকা-ই লাগে সবার। বন্ধুর সাথে আলাপ-আলোচনা করার সময় ব্যয় হয় মাত্র দুই মিনিট। ইতোমধ্যেই কথার রেশ ধরে আহসান চৌধুরীকে বলতে শোনা যায় যে, আরাভ ও তার বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আগামী মাসের এক তারিখে ঢাকা ত্যাগ করবে। এই কথা শুনে নীলাশা সেই-যে ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়েছে…! সেই দৃষ্টি আর সরায়নি মেয়েটা। ইয়াসিন চৌধুরীও মেয়ের কান্না দেখে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন। তার পরের দিনই-যে মেয়েটা তার বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে যাওয়ার বায়না ধরেছে! তিনি বন্ধুর সাথে কথা বলতে বিব্রতবোধ করছেন। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে সামাল দেওয়া উচিত! আর সেই সময় নিশ্চুপ নীলাশার কান্না দেখে আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,
“ নীলাশা, অ্যানি প্রবলেম? তুমি… ”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নৌশিন আহমেদের উপস্থিতি ঘটল বসার ঘরে। হন্তদন্ত নৌশিন আহমেদ ছুটে এলেন একদম স্বামীর নিকটে। বোঝা যাচ্ছে, জরুরি কিছু একান্তভাবে বলতেই এসেছেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড চিন্তিত মাতৃবৎ মনের নৌশিন আহমেদ চাওয়ার পরও নিচু গলায় কথা বলতে পারলেন না। ওনার কথা নীরব ঘরটিতে স্পষ্ট শোনা গেল,
“ তোমার মেয়ে হাতে ছুরি ধরে রেখেছে, ইয়াসিন। মেয়েটা সুইসাইড করুক সেইটা দেখার জন্যই বসে আছো তুমি? ”
ইয়াসিন চৌধুরী হঠাৎই কেঁপে উঠলেন। সেই সাথে ধকধক করে উঠল উপস্থিত তিনজনের মন। তারা কিছু ভুল শুনেনি তো? উত্তেজনা আঁকড়ে রাখতে না পেরে আরাভ দাঁড়িয়েই পড়ল। নিশ্চিত হতেই নীলাশার লুকিয়ে রাখা হাত দুটো দেখে নেয় সে। নৌশিন আহমেদ সত্যি বলেছেন। কতটা চিন্তিত হলে একজন মা এভাবে ছুটে আসেন? মেয়েটি যে নিজেকে শেষ করতে একবারও ভাববে না তা আক্রোশে রিরি করে কাঁপতে থাকা নীলাশাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইয়াসিন চৌধুরীকে দেখা যায় উঠে দাঁড়াতে। তিনি চিন্তিত ও অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্রথমে স্ত্রীকে ও পরে মেয়েকে প্রশ্ন করেন তিনি,
“ তুমি কোথায় ছিলে যে ও ছুরি নিতে পারল? আর নীলাশা, দিন-দিন এতো ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছ কেন তুমি? কোনো সেন্স আছে যে, ঠিক কী কারণে তুমি সুইসাইড করতে চাচ্ছো? ”
নীলাশা উত্তর দেয় না। মায়ের কাজে সে বেশ অসন্তুষ্ট। সে তো চায়নি সবাই সবটা বুঝে যাক। কিন্তু মা তো… যাইহোক, বাবার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না নীলাশা। বরং পাশের সোফায় ছুরিটা রেখে নত মুখেই বলল,
“ আই’ম ওয়ার্নিং ইউ, ড্যাড। আই উইল কিল মাইসেল্ফ ইফ ইউ ডোন্ট লেট মি গো উইদ দেম। ”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত বেগে দোতলায় উঠে গেল নীলাশা। সবাই দেখছে সেই মেয়েটিকে যে কি-না রীতিমতো শাসিয়ে গেল তার বাবাকে। ইয়াসিন চৌধুরী চিন্তিত। না পারছেন একা ছাড়ার অনুমতি দিতে আর না পারছেন মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সামলে রাখতে। তিনি হতাশ দৃষ্টিতে নৌশিন আহমেদের দিকে তাকাতেই দেখতে পান স্ত্রীর ক্রন্দনরত মুখটা। অতঃপর তিনি নিজেকে অতিষ্ঠ মনে করে ব্যথিত অনুভূতিটা প্রকাশ-ই করে বসলেন,
“ আমার মেয়েটা যে এমন হবে তা আমি কল্পনাও করি নাই। ফ্যামিলির যত অশান্তি সব ওকে ঘিরে। এই মেয়েকে ঠিক করব কীভাবে বলতে পারিস, আহসান? আমার পুরো জীবন লেগে যাচ্ছে নীলাশাকে স্বাভাবিক করতে। ”
বন্ধুর কথা শুনে আহসান চৌধুরী প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললেন,
“ নীলাশা কোথায় আর কাদের সাথে যাওয়ার কথা বলল? যদি খুব পার্সোনাল কিছু না হয় তো বলতে পারিস। মেয়েটা রাগের মাথায় যদি কিছু করে বসে তখন তো সমাধান খুঁজে লাভ নাই কোনো। ”
ইয়াসিন চৌধুরী মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন। বয়সের সাথে সাথে শারীরিক যন্ত্রণাটাও বেশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নীলাশাদের ভ্রমণে যাওয়ার কথা জানালেন তিনি। এ-ও জানালেন যে, তিনি ভ্রমণে যেতে দিবেন না বলেই নীলাশা রেগে আছে। তাই বলে আত্মহত্যা? নীলাশার এরূপ আচরণ ও তাকে ভ্রমণে যেতে না দেওয়ার কারণের উপর প্রশ্ন উঠতেই ইয়াসিন চৌধুরী নীলাশার অতীতের এক ঘটনা উন্মুক্ত করে বললেন,
“ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ আ ফ্রেন্ড ইনডিড… এই একটা বাক্যের জন্যই আমার চঞ্চল মেয়েটা এমন চুপচাপ, বদমেজাজি, রাগী হয়ে গেছে। বন্ধুই যেন ওর কাছে সব! বন্ধু ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না নীলাশা, কিচ্ছু না। বছর কয়েক আগে লন্ডনের দু’জন মেয়ে এক সাইকো কিলারকে ধরতে পুলিশকে হেল্প করেছিল, নিউজটা পড়ছিলি তুই? ”
আহসান চৌধুরী একটু সময় নিয়েই ভাবতে শুরু করেন। তিনি মনে করতে পারেন না এমন কোনো খবরের কথা। তখনই ওনার বড় ছেলে অভ্রকে বলতে শোনা যায়,
“ বাবা, আঙ্কেল মনে হয় ওই সাইকো কিলারের কথা বলতেছে যে টিনএজ মেয়েদের মাথা কেটে গাছে ঝুলিয়ে রাখতো। কিলারের নামটা মাথায় আসতেছে না! ”
ইয়াসিন চৌধুরী সম্মতি জানিয়ে বলতে শুরু করলেন,
“ হ্যাঁ, তার কথা-ই বলছি আমি। ওকে যখন লন্ডনের পুলিশরা হাতেনাতে ধরেছিল তখনও আমরা বুঝতে পারি নাই যে, যে মেয়েটার মাথা কাটা হয়েছিল সেইটা আমাদের নীলাশাও হতে পারত! সেদিন নীলাশারা স্কুল থেকে আউটিং-এ যায় সবাই। নিজের বেস্টফ্রেন্ড স্টেসির সাথে একা ঘুরতে-ঘুরতেই না-কি সেই কিলারের সামনে পড়ে গিয়েছিল ওরা। কে জানতো সামনের মানুষটা মানুষরূপী জানোয়ার? নীলাশা খুব ফ্রেন্ডলি ছিল। সেই ছেলে যখন নীলাশার সাথে কথা বলতে-বলতে নীলাশাকে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলছিল, তখনই না-কি স্টেসির চোখে পড়ছিল ছেলেটার গায়ের শুকানো রক্ত। ও বুঝতে পেরেছিল যে, কিছু একটা ঝামেলা ছিল ছেলেটার মধ্যে। নীলাশাকে ফাঁদে ফেলা হচ্ছিল। ঠিক কীসের কথা বলছিল মনে নাই কিন্তু স্টেসি কিছু একটা বলেই নীলাশাকে সড়িয়ে আনছিল ওই কিলারের কাছ থেকে। দুইজনে মিলে স্টেসির ট্যাব থেকেই কোড নাম্বারে কল করে পুলিশকে জানায় ব্যাপারটা। তখনই না-কি… তখনই না-কি নীলাশাকে নিয়ে যেতে ওই ছেলে… ওই ম্যাক্স ছেলেটা আসছিল আয়রন মেটালিক কোনো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে। নীলাশাকে যে কীভাবে মারছিল তা ওইসময় ওর হাত-পায়ের দাগ দেখলে তুই বুঝতে পারতিস, আহসান। ওই সাইকোটা আমার মেয়েকে সেদিন মেরেই ফেলত। কিন্তু না, স্টেসি বাঁচিয়েছিল আমার মেয়েকে। ওর ক্যারাটে ট্রেইনিং নেওয়া ছিল জানতাম। টেকনিক্যালি নীলাশাকে বাঁচিয়ে দিলেও নিজে বাঁচতে পারে নাই মেয়েটা। যখন নীলাশা আমাদের সবটা বলল তখন আমরা কী শুনছিলাম জানিস তুই? ও বলছিল ওর সামনে, তৎক্ষনাৎ-ই না-কি স্টেসির মাথাটা আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। নীলাশার সামনেই টুকরা-টুকরা করে দেয় স্টেসির বডি পার্টস। শুনছিলাম, নীলাশাকে যখন পুলিশের মাধ্যমে রেসকিউ করা হয়েছিল তখন নীলাশার গায়ে স্টেসির রক্ত জবজব করছিল। ভাবতে পারিস স্টেসি মেয়েটাকে কীভাবে মারছিল ওই ম্যাক্স? এমন করে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে খুন হতে দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারে? স্টেসি চালাকচতুর মেয়ে ছিল দেখে কৌশলে আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিছে। নাহলে আজকে স্টেসির সাথে-সাথে আমার মেয়েটাও…! ”
ইয়াসিন চৌধুরী সম্পূর্ণ কথাটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বুকের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ওনার৷ তিনি বললেন তো খুব সহজ করেই কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল তা অনুভব তো কেবল নীলাশাই করতে পারে! সেই ক’বছর সাইকো কিলার ম্যাক্সকে নিয়ে প্রতিবেদনটা কম লেখা হয়নি! সবকিছু জেনে যা বুঝতে পেরেছিলেন তা হলো- স্টেসির করুণ পরিণতি! ইয়াসিন চৌধুরী বিস্তারিত বলতে থাকেন যা তিনি জানেন। সবটা শুনে আহসান চৌধুরীকেও বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে নীলাশার ব্যাপারটা পরীক্ষণ করতে দেখা গেল। তারপর আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,
“ নীলাশা কি সেই ট্রোমার জন্যই এমন বিহেভিয়ার করছে? কিন্তু সেই ট্রোমা তো এতদিন থাকার কথা না! হঠাৎ কী হলো ওর? ”
ইয়াসিন চৌধুরী আরও বিস্তারিত বলতে যান৷ তবে তার আগেই নৌশিন আহমেদ বলতে শুরু করলেন,
“ না, ভাইজান। সব হয়েছে আপনার বন্ধুর জন্যই। সেদিনের পর নীলাশা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রায়-প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে বলতো স্টেসি এসেছে, ওকে ডাকছে, ওর কাটা হাত দুটো না-কি টানছে নীলাশাকে। সারা দিন-রাত এগুলো বলতো যে, স্টেসি তাকে বার-বার বলছে ‘ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ আ ফ্রেন্ড ইনডিড। আই ডাইড ফর ইউ, নাও ইউ হ্যাভ টু ডাই ফর মি।’এমন সময় আপনার বন্ধু শুরু করল ডক্টর দেখানো। ডক্টর নিজেও বলছিল যে, বন্ধুর মৃত্যুকে এভাবে দেখেছে বলেই নীলাশা এমন করছিল। এইসব-ই ওর কল্পনা। এটা চিন্তার কিছু না। শুধু ওকে চোখে-চোখে রাখলেই হবে। কিন্তু আপনার বন্ধু কি তা শুনেছে? বরং সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে নীলাশাকে জোর-জবরদস্তি স্বাভাবিক করতে গিয়ে এমন চিরতরে অস্বাভাবিক করে ফেলছে। নীলাশা যখন প্রথম বার সুইসাইড অ্যাটেন্ড করেছিল তখনও আমরা সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো ইংল্যান্ড থেকে এখানে চলে আসি। নতুন পরিবেশ দিই আমার সেই পনেরো বছরের নীলাশাকে। স্টেসিকে নিয়ে এইসব কথা তখন বলতো না ঠিকি। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল তখন যখন ওর ফ্রেন্ড, পিহুর সাথে ওর প্রথম আলাপ হয়। আমরা ভাবছিলাম পিহুকে পেয়ে হয়তো স্টেসিকে ভুলে গেছে নীলাশা। কিন্তু না, পিহুকে পেয়ে যেন ও ছোট বাচ্চাদের মতো করতে শুরু করল। নীলাশার জন্য আমরা বিশেষ কিছু করলে পিহুকেও তাতে সামিল করতো ও। এটা বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা বললে ভুল হবে। কারণ ওর সেইসব আবদার মোটেও বন্ধুর প্রতি আরেকজন বন্ধুর ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক ছিল না। পিহু যদি কোনো কারণে স্কুল অ্যাটেন্ড করা বাদ দিত তো নীলাশা বাসায় এসে কান্নাকাটি শুরু করত। তখন ভেবেছিলাম ওর বয়সটাই চলছে আবেগ দিয়ে। সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে যখন ও টিনএজ লাইফের এই ইমোশোন কাটাতে পারবে। কিন্তু সেখানেও আপনার বন্ধু ডক্টর-টক্টর জোগাড় করতে পাগল হয়ে গেল। নীলাশার উপর মেনটাল প্রেসার ক্রিয়েট করল সে। পিহু ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার পর একে-একে নীলাশা যখন একাধিক বন্ধু পেয়ে গেল, ঠিক তখনই আপনার বন্ধুর কেরামতি পুরোপুরি পাল্টে দিল আমার মেয়েটাকে। আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন ভাই, আপনার বন্ধু কি নীলাশা আর তার বন্ধুদের মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব তৈরি করে দেয় নাই? সে প্ল্যান করে বন্ধুদের সাথে নীলাশার এমন আত্মিক বণ্ডিংটা ভাঙতে চেয়েছিল৷ ভাবেন তো, আমার মেয়েটার মানসিক অবস্থাটা তখন কেমন ছিল যখন বুঝতে পেরেছিল তার বাবার চাহিদাটা? আমার সুস্থ মেয়েটাকে ও নিজেই অসুস্থ করে ফেলছে। মানুষ কি তার বন্ধুকে ভালোবাসতে পারে না? ও ভাবে, আমাদের নীলাশা স্টেসির জন্যই সুইসাইড করতে চেয়েছিল। আর তাই নিজের মেয়েটাকে ফোর্স করতে-করতে এখন আমাদের এমন ইমেজ তৈরি হয়েছে যে, আমাদের কথা ওর সহ্যই হচ্ছে না আজকাল! কথায়-কথায় রেগে যাচ্ছে, জেদ করছে আরও কত কী! ও ওর বাবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে বলেই তো এমন সব আচার-আচরণ করছে আর এই কথাটাই আমি ওর বাবাকে বোঝাতে পারি না। নীলাশা তো বলে যে, ও না-কি ওর বন্ধুদের সাথে থেকেই শান্তি খুঁজে পায় আর আমরা না-কি ওর অশান্তির মূল। এখানে আমি তো আমার মেয়েকে দোষারোপ করতে পারব না। ওর কী দোষ? আমাদের দোষেই আমরা আমাদের মেয়েটাকে এমন বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে আমরা নিজেরাই মেরে ফেলেছি! ”
কথাগুলো বলতে বলতেই নৌশিন আহমেদের চোখ ভরে এলো। এই কয়েক বছর ধরে নীলাশার ব্যবহারে আর ইচ্ছা করে না বেঁচে থাকতে। এমন অহেতুক অশান্তি কার সহ্য হয়? আহসান চৌধুরী সব কথা শোনার পর মলিনমুখে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। অতঃপর প্রশ্ন করলেন,
“ আচ্ছা ভাবী, নীলাশা কি এমন কিছু ভাবছে যে, স্টেসি তাকে বাঁচাতে গিয়েই যখন মারা গিয়েছে তখন বন্ধুদেরকে এক্সট্রা প্রায়োরিটি দিয়েই… ”
তিনি কথা শেষ করার আগেই নৌশিন আহমেদ বললেন,
“ না ভাইজান, এই কথা তাকে আরও অনেকবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। মেয়ের উত্তর ‘বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করা যায় না। সেই বৃথা চেষ্টা কোনোদিনও করবে না সে।’এরপরও এমন কিছু কীভাবে ভাবতে পারে ও? ”
সবকিছু শুনে আহসান চৌধুরী সোজা হয়ে বসলেন। বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় বললেন,
“ দেখ ইয়াসিন, আমি কোনো ডক্টর বা সাইকিয়াট্রিস্ট না। বাট প্রফেসর হওয়ায় আমি অনেক ছেলে-মেয়েদের দেখেছি। আর সেই থেকে এটা অন্তত বলতে পারি যে, দোষটা তুই করছিস। মেয়েকে সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এতো-এতো আয়োজন না করে, তোর উচিত ছিল আগে মেয়েটার মন বোঝা। যাইহোক, যে ভুলটা করে তুই এতদিনে মেয়ের মন বিষিয়ে ফেলছিস সেই ভুলটা এইবার ঝেড়ে ফেল। পুরাতন কাসুন্দি ঘেঁটে তো লাভ নাই! মেয়েকে স্বাভাবিক করার একটাই উপায় আছে বলে আমি মনে করি। ”
বরাবরের মতোই মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে ফিরে পাওয়ার প্রলোভনে এবারও নীলাশার বাবা-মা আশার আলো খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়ল৷ ইয়াসিন চৌধুরী নিজের অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরে অস্থিরতা ঢেলে প্রশ্ন করে বসলেন,
“ কী উপায়? ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!