তারকারাজি সিজন 1 পর্ব-১৮

0
239

তারকারাজি- (১৮)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

ইয়াসিন চৌধুরী নিজের অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরে অস্থিরতা ঢেলে প্রশ্ন করে বসলেন,

“ কী উপায়? ”

সুপ্রশস্ত বসার ঘরে অবস্থানরত দুই টগবগে তরুণ, ও অসহায় মাতা-পিতাকে বড্ড বেশিই ভাবুক দেখায়। আহসান চৌধুরীর পরিকল্পনা কী হতে পারে তা ধারণা করাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাকিদের কাছে। অন্তরে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সকলের সেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিয়েই আহসান চৌধুরী বললেন,

“ ওকে ওর বন্ধুদের সাথে ট্রিপে যেতে দে। বন্ধুপ্রিয় নীলাশা ঘরের বাঁধা মানবে না। নীলাশা যেভাবে নিজের বন্ধুদের সাথে যেতে চায় ঠিক সেভাবেই ওকে যেতে দে। ”

ইয়াসিন চৌধুরী প্রথমেই নঞর্থক মনোভাব ব্যক্ত করলেন,

“ না, না। কী বলিস এগুলা? আমার মেয়ে-ই তো ভালো না। দেখা যাবে যে, বন্ধুদের সামান্য কথা কাটাকাটির জন্যই রেগেমেগে বসে আছে। যদি কোনো অঘটন ঘটায়? ওর বন্ধুরা ভালো। ওকে দেখে রাখবে। ওর দুই বান্ধবীর দ্বারা ওকে সামলানো অসম্ভব। বাকি দু’জন ছেলে। ওরা পারবে কিন্তু কতক্ষণ? এতো বড় মেয়ে যদি কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করে তখন ওর বন্ধুরা ওইটা মেনে নিবে? ওদের-ও তো ট্রিপটা এনজয় করার তাগিদ আছে! ”

আহসান চৌধুরী চকিতেই নিজের ছাত্র জীবনের বন্ধুকে পুরনো দিনের মতোই ধমকে উঠলেন। ধমকানোর সুরটাই শুরু হলো এমন, ‘আরে ব্যাটা শোন আমার কথা! ’ অতঃপর নিজের পরিকল্পনা উন্মুক্ত করে বললেন,

“ নীলাশারা যদি দুই তারিখে ট্রিপে যায় তো আমি বলব ওরা আরাভদের সাথেই যাক। এতে কী হবে বুঝলি ইয়াসিন? ওরা যখন একসাথে থাকবে তখন একে-অপরের প্রতি একটা দায়িত্ব থাকবে। একজন কেয়ারলেস হলেই তো আর বাকি সবাই তা হবে না! আর ভার্সিটির সিনিয়রদের দেখে জুনিয়ররা বরাবরই কিছুটা ভয়ে-ভয়ে থাকে। নীলাশা আর যাইহোক, আরাভদের অমান্য করতে পারবে না। আরাভ, তুই কী বলিস? তোরা বন্ধুরা মিলে ট্রিপে যাচ্ছিস, আনন্দ-ফূর্তি করবি ঠিক আছে। তোদেরও তো প্রাইভেসি বলতে কিছু আছে! নীলাশাদের নিয়ে যেতে রাজি করাতে পারবি তো তোর বন্ধুদের? ”

বাবার পরিকল্পনা শুনে আরাভ বেশ অপ্রস্তুত হয়। যাচ্ছে বন্ধুদের নিয়ে আর সেখানে আরেকটা বন্ধুদল হাজির হবে? কিন্তু সে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বাবার কথাটাও বিচার করে দেখে। নিমরাজি হয়ে বলে,

“ বাবা, নীলাশার ফ্রেন্ডস মানে নিশান-রিশানদের সাথে আমাদের বন্ডিংটা ভালো। ওদের রাজি করানো কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তিনটা মেয়ে এতজন ছেলের মাঝে… মানে কী-করে কম্ফোর্ট ফিল করবে, বাবা? আর এতজনের মাঝে ওদের নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ”

ছেলেকে আমতা-আমতা করতে দেখে আহসান চৌধুরী মৃদু হাসলেন। বেশ আদুরে ভঙ্গিতে ছেলের পিঠে চাপড় মেরে বললেন,

“ আরে তুই এতো টেনশন নিতেছিস কেন? একসাথে যাবি, একসাথে ঘুরবি, খাওয়া-দাওয়া করবি আবার একসাথেই ব্যাক করবি। এর চেয়ে বেশি কিছু তো আর না! আর তুই থাকতে আমার মনে হয় না কোনো সমস্যা হবে। দেখ আরাভ, একটা মানুষকে একটা ভালো সময় উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমি তোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। ওরা পাঁচজন যেমন সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তোদের সাথে যাবে, ঠিক সেভাবেই ঘুরে-টুরে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ওদের ফিরিয়ে আনার ভরসাটা আমি তোর উপর রাখছি। তুই শুধু বল যে, তোর বন্ধুদের রাজি করাতে পারবি কি-না আর আমার ভরসার মান রাখতে পারবি কি-না। আমি বড়মুখ করে শুধু নীলাশা-ই না, নীলাশাসহ আরও দুজন মেয়েকে সাথে নেওয়ার কথা বলছি। আশা করি তুই এতো ছোট না যে বুঝবি না। তুই যদি আমাদের অভয় দিস তো ইয়াসিন দেখবে সে আমার কথাটা রাখবে কি-না। হাজার হোক ও মেয়ের বাবা। মেয়েকে কোথায় কীভাবে পাঠাতে হবে তা ওর ভালো জানা। ”

আরাভ উক্ত অভয়টি দেয় তাদের সবাইকে। কিন্তু সে এইটা বিশ্বাস করতে পারে না যে, ইয়াসিন চৌধুরী বিনা বাক্য ব্যয়ে বন্ধুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজি হয়ে যাবেন। এটা বন্ধুর প্রতি সম্মান? না-কি মেয়ের প্রতি করা অবিচারের প্রায়শ্চিত্ত করার মাধ্যমে, মেয়েকে আগের মতো দেখবার তীব্র বাসনা কেবল? বুঝতে পারে না আরাভ। তবে তার মনে সূক্ষ্মতম ভীতিটা থেকেই যায়। দায়িত্বটা ভালোয়-ভালোয় পালন করতে পারলেই হয় এখন! ওদিকে ছোট ভাই নাজিফের থেকে যখন পুরো বার্তাটি পেল তখন নীলাশা কেবল-ই হিম হয়ে বসেছিল নিজের শয়নকক্ষে। ঘটনা কি সত্য? অতঃপর ইয়াসিন চৌধুরী যখন হাজার টাকার নোটগুলো গুচ্ছে-গুচ্ছে তার হাতে তুলে দিয়ে আদর করে বললেন,

“ মাই প্রিন্সেস! তুমি জানো তুমি আমাদের কাছে কী। তোমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে কেবল একটা শর্তে- তুমি সেখানে যেমন বন্ধুদের সাথে এনজয় করতে-করতে যাবে ঠিক তেমনভাবেই ফিরে আসবে হাসিমুখে। একা একা কোথাও যাবে না। আর শোনো, তুমি কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো ঝামেলায় জড়াবে না আর বন্ধুদের সাথে তো আরও না। বুঝতে পারছো? ”

কথাটা শোনা মাত্রই নীলাশার চোখেমুখে লাবণ্যের দীপ্তি যেন তরতর করে বৃদ্ধি পেল। সংশয়াপন্ন মনে লাগল অত্যন্ত নমনীয় এক মিঠে হাওয়া। বাবা-মা এতো সহজেই রাজি হয়ে গেল? ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখল সে। অনেক সমীকরণ মিলিয়ে যখন উত্তর এলো- কোনো ছলচাতুরী বিহীন বাবা-মায়ের স্নিগ্ধ কিছু অনুভূতি, তখন আর রেগে থাকতে পারল না নীলাশা। হন্তদন্ত হয়ে গোছগাছ শুরু করে দিল আজ থেকেই। বন্ধুরা থাকবে সাথে, সাথে থাকবে অত্যন্ত প্রিয় শ্যামবর্ণের পুরুষটিও। কেমন হবে সেই ভ্রমণ? নানান জল্পনা-কল্পনায় কেটে গেল গোটা রাতটা। পরের দিন ভার্সিটিতে এসে যখন অনুমতি পাওয়ার বিষয়টা বন্ধুদের কাছে উন্মুক্ত করল তখন সবার বিস্ময় যেন আকাশ ছোঁয়া! তারা তো জানতো ইয়াসিন চৌধুরী রাজি না হয়ে থাকতে পারবেন না। কিন্তু এর মাঝে যে এতো কিছু ঘটে যাবে তা অনুমান করতে পেরেছিল কি কেউ? নিশান মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে বসল,

“ দোস্ত, তুই এইডা কী কাম করে ফেলছোস! আমি তো গর্বে গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছি রে দোস্ত। ”

নিশানের কথা শুনে বন্ধুমহলে হাসির রোল পড়ে গেল। হাসির বেগ সামলাতে না পেরে পিহু পেটে হাত রেখে, গোড়ালিতে ভর করে বসে পড়ল প্রাঙ্গণে। এই নিয়েও কম তামাশা হলো না! রিশানও নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,

“ কী-রে পিহু, খুব জোরে চাপছে না-কি? একটু কষ্ট করে আটকায় রাখ দোস্ত। সানাম রে কল করছি। ওই আসার আগে অন্তত জায়গাটা নষ্ট করিস না তুই। আর তুই জানোস না খোলা মাঠে এইসব করতে নাই? ”

সানামকে বিশেষ তাগিদে এখানে ডাকারও একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। অবশ্য তা সানামের উপস্থিতিতেই বোঝা যাবে বেশ! বর্তমানে বন্ধুদের মশকরা দেখে পিহুর হাসিতে ফেটে পড়া নিয়েও হৈচৈটা কম হলো না। বন্ধুগণের আনন্দ দেখে চিন্তিত মিশমিকে বলতে শোনা গেল,

“ উফ, থাম না তোরা! আমার একটুও ইচ্ছা করতেছে না ভাইয়াদের সাথে যেতে। অতগুলো ছেলের সাথে আরামসে ঘোরা যায়? নীলের বাবা এটা মেনে নিতে পারে কারণ আঙ্কেল অন্য সংস্কৃতিতেও থাকছে। আমার আব্বু জানলে কী হবে ভাবছিস? ”

এই কথা শুনে রিশান নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল,

“ আরে আহাম্মক, যখন বুঝতাছিস-ই তোর বাপ জানলে যেতে দিবে না তখন জানাইবি ক্যান? আর এমন করতাছোস যেন তুই একলাই একটা মেয়ে যাবি আমাদের সঙ্গে? দেখ মিশা, আমরা আছি না? হুদাই এখন ট্রিপটার বারোটা বাজাইস না তুই। তোদের আগেই বলছি যে, এইবার ছ্যাড়াব্যাড়া করলে তোদের চারটাকেই রেখে যাব। পরে যদি তোর জন্য আমাদের নীল সুইসাইড করতে যায় তখন কিন্তু… ”

কথা অসমাপ্ত রেখেই যেন রিশান ভয়ঙ্কর কিছু বুঝিয়ে দিল মিশমিকে। এদিকে রিশান আর নীলাশার চোখের ইশারাটাও মিশমির চোখের অগোচরে হলো। নীলাশা এবার দুঃখ আয়ত্ত করার চেষ্টায় বলল,

“ তোরা খালি-খালি আমার সাথে এমন করিস কেন? তোদের সাথে ঘুরতে চাই দেখেই তো ড্যাডের সাথে এতো ঝগড়া করে আসলাম। মিশমি, তুই পারতিস বন্ধুদের জন্য আন্টির সাথে এমন ঝগড়া করতে? অথচ আমি করলাম আর তোরা দাম-ই দিচ্ছিস না। ইট রিয়েলি হার্টস মি! এর থেকে কালকে ছুরিটা চালিয়ে দিলেই ভালো হতো! ”

কথাটা শেষ করে অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখল নীলাশার। নীলাশার অভিনয় দেখে বাকি তিনজন গড়াগড়ি খেলেও মিশমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকল যা! অতঃপর তাকে নরম কণ্ঠে বলতে শোনা গেল,

“ সুইসাইড একটা করার জিনিস হইলো? আমি যাব। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোদের এতো নাটক করা লাগবে না। শুধু আমার ছবি যাতে ভুল করেও নেটে না ছাড়া হয় সেইটা একটু দেখিস। আম্মু জানলে আমার কলিজা এমনিই ভুনা-ভুনা হয়ে যাবে রে দোস্ত। ”

মিশমি নিজের ভীতি প্রকাশ করতে না করতেই সানামের উপস্থিতি ঘটল। অত্যন্ত উত্তেজিত মেয়েটা এসে বোঝার চেষ্টা চালালো বাকি বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টার কারণ। বলা বাহুল্য, সানাম এখন তারকারাজিতে একজন তারকা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে বন্ধুদলের সাথে। অপরদিকে সানামের উপস্থিতি ঘটতেই বন্ধুদের মাঝে প্রস্তুতি নেওয়ার হুলুস্থুল বেজে গেল। তারা কীসের প্রস্তুতি নিতে এতো তরান্বিত তা বুঝতে পারল না সানাম। তবে আন্দাজটা ঠিকই করে নিয়েছে সে। আজ তার জন্মদিন। সকালেই একসাথে দেখা করার কথা ছিল তাদের। কিন্তু পিহু তাকে এই-সেই বুঝিয়ে রেখে এসে একটু তো সন্দেহটা বাড়িয়েই দিয়েছিল বলা চলে! তবে যাইহোক, সানামের আন্দাজশক্তি যে এতটাও দূর্বল না তা প্রমাণ করে দিতেই হাজির করা হলো একটি কাপকেক। এই কেকের সাথে যখন নিশান তার লাইটার জ্বালিয়ে সানামকে তা নিভিয়ে দেওয়ার আদেশ করল, তখনই যেন মেজাজ চোটে গেল পিহুর৷ বাঘিনীর মতো গর্জন তুলে বলল,

“ বলি লাইটার জ্বালানির কী দরকার ছিল? একটা সিগারেট-ই মোমবাতি হিসেবে খাঁড়া করায় দিতি। ”

নিশান সরল মনে হেসে উত্তর দিয়েছিল বেশ,

“ মনে ছিল না রে বোইন। না-হলে কি মোমবাতি আনতাম না? ”

পিহু ক্ষেপে গেল। সেই বহুদিন আগের সানাম ও সাইফের বিতণ্ডার পরমুহূর্তের ঘটনা…। তখন সানামের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না নীলাশার। তবুও বেশ কয়েকদিন হাতে রেখে সানামকে চমকে দেওয়ার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা এঁটেছিল তিন বান্ধবী। কিন্তু তা বাস্তবায়নে খরচা হবে বহুত! এই একটা ‘কিন্তু’তেই আঁটকে গিয়েছিল নিশান ও রিশান। পরিকল্পনা খুবই আবেগপ্রবণ। তবে তা বাস্তবায়ন কোনোমতেই সম্ভব না৷ তাই তারা দুই ভাই অনাগ্রহ প্রকাশ করল ঠিকি। কিন্তু তা ধরে রাখতে পারল না পিহুর দেখানো সেই ছবিটা দেখে, যা দেখে সাইফরাও চুপ হতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন। সানামের জন্মদিন আসছে মনে হতেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মঠ হয়ে উঠেছিল বন্ধুদল। অতঃপর আজ সকাল সকালই দারুণ একটা খরচা করে সানামকে চমকে দিতে সক্ষম হলো তারা। নামমাত্র কেকটা কাটার পর, বন্ধুদের কেনা উপহারটি যখন সানামের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো তখন সানাম থম মেরে দাঁড়িয়েই থাকল যা! উপহার দেখে সানামের চক্ষুছানাবড়া! বন্ধুদের দ্বারা যে এমন কিছু আয়োজন করা বা উপহার দেওয়া কল্পনীয় তা ভাবতেও অদ্ভুত লাগছে সানামের কাছে। তার বুকে চাপা দুর্দমনীয়, প্রণয়ী অনুভূতিটা উন্মুক্ত হলো ছলছলে চোখের মাধ্যমে। সে বন্ধুদের প্রত্যেকের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখছে যেন, উপহারটা পাওয়ার পর নিজের অবস্থা এমন হিমের মতো হবে তা বন্ধুরা আগের থেকেই জানত। সানামের হাত কাঁপতে থাকে, পা কাঁপতে থাকে… উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে পুরো সানামটাই। অতঃপর সেই সানামকে কম্পিত ধ্বনিতেই বলতে শোনা যায়,

“ এইটা কী করে ফেলে দিছোস তোরা! ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

( কেউ কি অনুমান করতে পেরেছেন কী আছে সানামের হাতে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here