তারকারাজি সিজন 1 পর্ব-১৬

0
279

তারকারাজি- (১৬)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

সন্ধ্যা তখন প্রবেশদ্বারে এসে থেমেছে। শুধু যেন তার প্রবেশের অপেক্ষাটাই রয়ে গেল প্রকৃতিতে। আকাশে তখন যত লাল-নীল রঙের খেলা! ধীর পায়ে নিজের লম্বা বিনুনি হেলিয়ে-দুলিয়ে ভার্সিটির এক পথ ধরে হাঁটতে লাগল মিশমি। রমণীর নিখাদ মনে হঠাৎই ভীষণ প্রণয়নের হাওয়া লাগল। মনোচ্ছবিতে ফুটে উঠল বেশ সুদর্শন, গৌরবর্ণের কৃশকায় ছেলেটি। কানের পিঠে চুল গুঁজে মিশমি ভাবতে লাগল সেই ছেলেটির কথা। আচ্ছা, সানামের দেওয়া শর্তের বাহানায় কি বলে ফেলা যায় তাকে ভালোবাসার কথাটা? কথাটা মনে হতেই ঠোঁটের মিঠে হাসিতে রঙ লাগল… লাল টুকটুকে লজ্জার রঙ। চঞ্চল দৃষ্টি ছুটোছুটি করল পিচঢালা রাস্তার রূঢ় গায়ে। তখনই এলো কারো পিছু ডাক,

“ মিশমি! ”

মিশমি চমকে উঠে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। নিজ কল্পজগতে হারিয়ে যাওয়া মনটা আবার নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনে। বুঝে ওঠার চেষ্টা করে বাস্তবতাটা। তখনই কেউ জুতোয় খটখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসে তার দিকে। মিশমি চোখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় অতি পরিচিত তাম্রবর্ণের পুরুষটিকে। সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে ডাকছিলেন না-কি সায়ান ভাইয়া? ”

সায়ান হাসে। সন্ধ্যামুহূর্তের আরক্তিমে তরুণের হাসি দেখে মিশমি স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, তাম্রবর্ণ সায়ানের হাসিটা খুব সুন্দর। সে হাসলে ঠোঁটের কোণের মৃদু ভাঁজটার গভীরতা নজরে পড়ে মিশমির। মুহূর্তেই সে কেঁপে উঠে আশেপাশে তাকায়। সন্ধ্যার হাওয়ায় তো শীতলতা নেই! তবে এ-কেমন শিরশিরে অনুভূতি তার? মিশমি দৃষ্টি নত করে। তখন সায়ানকে বলতে শোনা যায়,

“ একা-একা ভূতের মতো ঘুরছো কেন? বাসায় যাবা না? ”

মিশমি আরও একবার কানের পিঠে চুল গুঁজে নিল। দৃষ্টি নত করেই জবাব দিল,

“ জ্বি, বাসায়-ই যাচ্ছিলাম। ”

“ যেতে পারবা তো? না মানে শরীর ঠিক লাগছে এখন? ”

সায়ানের প্রশ্ন শুনে মিশমি মৃদু নিঃস্বনে হেসে উঠল। সায়ান বুঝল, মেয়েটি রূপে-গুণেই নিখুঁত না। আমাদের মানবজাতির একান্ত ব্যক্তিগত বা নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা হয় স্রষ্টার দানকৃত অনন্য এক উপহার। এমনই একটি উপহার হলো হাসি। মিশমির হাসিটাও যে তার রূপ-গুণ ছাপিয়ে যাওয়ার মতো নিখুঁত তা সায়ানের আগে জানা ছিল না। অতিরিক্ত মানুষ-জনের সামনে মেয়েটি কেমন যেন মিইয়ে থাকে! ভাগ্যিস খুব নিভৃতে এই সুস্মিতার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো তার! সে যাইহোক, পাশের রমণীকে নিয়ে সায়ানের এ-সকল জল্পনা-কল্পনা ভঙ্গ হলো সেই রমণীর পাল্টা প্রশ্নে,

“ সারাদিন শেষে এখন আমার খোঁজ নিচ্ছেন যে, আমি ঠিক আছি কি-না? খুব হাসালেন সায়ান সাহেব! ”

ব্যাপারটা বুঝে নিল সায়ান। অতঃপর মাথা চুলকে নিজের বোকামো ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে বলল,

“ সারাদিন তো বন্ধু-বান্ধবের সাথে ছিলেন, ম্যাডাম। তাই আর কথা বলি নাই তখন। ”

“ আচ্ছা তাই না-কি? আমাদের মধ্যে কি দূরত্বটা এমন-ই ছিল যে, কাছে এসে আমার খোঁজটাও নিতে পারলেন না আপনি? ”

মিশমির প্রশ্নে হঠাৎই কেঁপে ওঠে সায়ানের বুক। কী যেন ছিল সেই প্রশ্নটাতে! ঘনঘন শ্বাস টেনে বুকে হাত রাখল সায়ান। মিশমি দেখছে না। সায়ান খেয়াল করেছে অনেক, মেয়েটা নিশান বা রিশান ছাড়া অন্যকোনো ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। এটা কি শুধুই ছেলেদের ক্ষেত্রে? না, এই ব্যাপারটা জানা নেই সায়ানের। তাই নিজের অস্থিরতা প্রকাশ পেলেও ধরা পড়ার ভয় করল না ছেলেটি। বরং সৎসাহস দেখিয়ে বলল,

“ সেই দূরত্বটুকুও ঘুচে দেওয়া উচিত! ”

তিহামের ভাবনায় অন্যমনস্ক মিশমি হঠাৎই সতর্ক হয়ে বলল,

“ হুম? কী বললেন? ”

সায়ান ঝটপট কথা ঘুরিয়ে নিল,

“ বললাম যে, এই সন্ধ্যায় একা বাসায় যাচ্ছ দেখে আন্টি কিছু বলবে না? রিশানদের থেকে শুনলাম তোমার আম্মু না-কি খুব কড়া? ”

মিশমি প্রথমে বিস্মিত ও পরে অভিমানী স্বরে বলল,

“ ওরা শুধু এটুকুই বলছে আপনাকে? ভাগ্যিস ওদের কথাগুলোর সমার্থক হিসেবে ভদ্র-নম্র একটা ওয়ার্ড ইউজ করলেন, কড়া! ওরা যে বাড়িয়ে-বাড়িয়ে কিছু বলেনি তা আমি কোনোদিনও বিশ্বাস করব না। ”

সায়ান হাসে, “ বন্ধুত্বে একটা অলিখিত নিয়ম হলো বাড়াবাড়ি করা। এদের বন্ধু বলে ঘোষণা করা হলে বাড়াবাড়ি করবেই। তবে যে যাই বলুক, আমি কিন্তু আন্টির ফুল সাপোর্টে! নিজের মেয়েকে তার ভালোটা দেখাবে, এটাই তো মায়ের উত্তম বৈশিষ্ট্য। তবে হ্যাঁ, তোমাকে ভালোটা দেখালেই তো আর হবে না! তোমার নিজেকেও নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখতে হবে। নয়তো পিছিয়ে পড়বে সবার থেকে। ”

আরে, এই একই কথা নীলাশাও বলেছিল না তাকে? মিশমির মনে পড়ল সেই কথা। কিন্তু এইদিক দিয়ে মিশমির অলসতার যেন শেষ নেই! মা তো আগেভাগেই বুঝে নিচ্ছে তার ভালো-মন্দ। তাহলে নতুন করে আর কী ভালো-মন্দ বোঝা যায় যা সে বোঝে না? মিশমি এমন কিছু খুঁজেছিল অনেকবার। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। ভাবনার মাঝেই শোনা গেল আযানের হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি। রক্তিম আলোয় পরিপূর্ণ হলো মাগরিবের সময়ক্ষণ। মিশমির পড়ল তাড়া! বাংলাদেশের ঘরে-ঘরে এখনও এমন নিয়ম আছে যে, মেয়েরা বাহিরে যেখানেই থাকুক না কেন, মাগরিবের আযানের আগে গৃহস্থলে প্রবেশ করতে হবে তাদের। মিশমি অবশ্য এই নিয়মের বাহিরে! তবে সন্ধ্যা নামলেই একা-একা বাহিরে থাকতে ইচ্ছা করে না তার। অস্বাভাবিক ভয়ে কাতরে উঠে সে। এই শহরের সন্ধ্যা-রাত্রি যে মেয়েদের জন্য খুব একটা নিরাপদ নয় তা মিশমি খুব করে মেনে চলে। অবশ্য দিনই-বা কীসের নিরাপদ? সাথে কোনো বন্ধু কেন, একজন বান্ধবী থাকলেও হয়তো ভরসা পেত সে। তবে… না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কথাটা মাথায় আসতে না-আসতেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ইংরেজি বর্ণে লেখা ‘আম্মু’ শব্দটি পর্দায় দেখেই বুক ধকধক করতে লাগল তার। ফোন না তুলেই হুড়মুড়িয়ে সায়ানকে বলে উঠল সে,

“ সায়ান ভাই, একটু রিকশায় তুলে দিবেন জলদি? আমাকে যেতে হবে। ”

সায়ান দেখেছে মিশমির মা ঝুমুর বেগমের কল করাটা। সেই সাথে দেখেছে মিশমির মুখে ভীতির ছাপ। সে উত্তর দিল,

“ শোনো, আন্টি কিছু বললে বলবা রাস্তায় জ্যাম ছিল। অবশ্য মিথ্যা-ও বলতে হবে না! আজকে ওইদিকে কীসের যেন মিছিল হচ্ছে। ভীড় অনেক। তুমি আসো আমার সাথে। দেখি রিকশা পাওয়া যায় কি-না! ”

কথাটা বলতে না বলতেই মিশমি সায়ানের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। যেন ত্বরান্বিত না হলেই বিপদে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে পারে না একটুও। ফলস্বরূপ হোঁচট খেয়ে একদম বসেই পড়ল রাস্তাতে। পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে বোধহয় লেগেছে খানিকটা। ব্যথিত আর্তনাদ যেন আপনা-আপনিই অবস্থান করল তার ঠোঁটে। মুহূর্ত ব্যয়ে খিঁচিয়ে বন্ধ করা চোখ জোড়া মেলে মিশমি যখন তাকাল, তখন সে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করার পাশাপাশি খেয়ালও যে, তার হাতটা সায়ান খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার আঙুলের ফাঁকে বদ্ধ হয়েছে মিশমির আঙুলসমূহ। সেই মুহূর্তে দৃষ্টি বিনিময় হতে না হতেই চোখ নামিয়ে নিল মিশমি। লাজে নিজের হাত সরাতে নিতেই সায়ান তার দুই হাত টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। সেই সাথে বিচলিত ভঙ্গিতে প্রশ্নও করল,

“ লাগল না-কি? ”

মিশমির লেগেছে। কিন্তু সে নঞর্থক মাথা নাড়িয়েই অবিজ্ঞভাবে প্রশ্ন করে বসল,

“ আশ্চর্য, এইটা নিয়ম হয়ে গেল না-কি যে, আমি পড়ব আর আপনি ধরবেন? সকাল থেকে আমরা দুজন এগুলাই করতেছি, তাই না? ”

মিশমির নির্বোধ প্রশ্নে হেসে ফেলল সায়ান। এক সাথে পথ চলতে চলতেই সায়ানের মনে হলো, বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে মিশমি যে কথাটা বলল তা বাস্তবতায় পরিণত হলে খুব একটা মন্দ হয় না। সায়ান নিজেও মুখে-মুখে অস্বাভাবিক কিছুর সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করল। তবে মনের গহীন থেকে আওয়াজ এলো,

“ মিশমি? এই নিয়মটা আমাদের জন্যই বরাদ্দ থাক, তুমি পড়ে গেলেও আমি তোমার হাতটা ধরে থাকব। ”

বিকেলে সানামের সাথে ঘন্টাময় বাইকে ঘুরে ক্লান্তশ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি নীলাশার। সানামের সাথে কাটানো সময়টাতেও ছিল তার ভালো লাগার কিছু বাহানা। মেয়েটা অন্যরকম বলে তার জানা ছিল। তাই বলে তার বন্ধুত্ব স্থাপনের ভঙ্গিমাটাও অন্যরকম হবে না-কি? যাইহোক, সে অনেক কথা…! এটা ছিল খুবই সুন্দর একটা মুহূর্ত। বর্তমানের এই বিষণ্ণ প্রহরে নীলাশার ইচ্ছা করে না সেই সময়টুকু তার কল্পনাতে আনতে। নীলাশা আলতো করে নিজের মাথাটা টেবিলের পাটাতনে রাখে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ওদিকে বাবার শান্ত কণ্ঠের বাণী শোনা যাচ্ছে। সেই বাণী শুনতে অনাগ্রহী নীলাশা কান চেপে ধরেও লাভ বিশেষ খুঁজে পেল না। সেই-তো স্পষ্ট শোনা গেল বাবার কথা,

“ নৌশিন, তোমার মেয়েকে বলে দাও ওর কোথাও যাওয়া চলবে না। এখনো ও এতটা বড় হয়নি যে, নিজের ইচ্ছা মতো চলবে। যেতে হলে ওকে আমার কথা মতোই যেতে হবে। আর যদি না যেতে চায় তো ভালো। আমি আরেকজন বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কন্টাক্ট করেছি। ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে ত্রিশ তারিখ। ও যেন এইটা মিস না করে। আর হ্যাঁ, আমার বন্ধু ওর ফ্যামিলি নিয়ে আসছে৷ এখন যেন কোনো সিনক্রিয়েট না করে ও, ওকে বলে দিও। ”

কথাটা নীলাশার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাতের কাছে বই-খাতা, জিনিসপত্র, সবকিছু ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ভ্রমণযাত্রার দিন নির্ধারিত হয়েছে নভেম্বরের দুই তারিখ। অথচ আজ অক্টোবরের ছাব্বিশ তারিখ হওয়া সত্ত্বেও কি-না বাবাকে রাজি করাতে পারেনি সে? নীলাশা রাগে-ক্ষোভে জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে। ওপাশ থেকে কলিংবেলের আওয়াজটা কানে আসে না তার৷ নিজের রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে মেয়েটি৷ কেন তার বাবা তার সাথে এমন করে সব-সময়? নীলাশা পারে না সেই রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে। হুড়মুড় করে ক্লোজেট থেকে ঘুমের পোশাকটি পাল্টে নেয় সে। চুলগুলো বেঁধে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়। এই প্রস্তুতি কোনো সাধারণ প্রস্তুতি নয়। এই প্রস্তুতির মূখ্য হাতিয়ার হিসেবে রান্নাঘর থেকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ছুড়িটা হাতে নিতেও ভুল হয়নি তার। আজ হয় বাবার নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাধীনতা থেকে মুক্তি পাবে সে, নয়তো এই নিয়ন্ত্রণাধীনতার স্বাধীন জীবনটাই ত্যাগ করে ফেলবে অতিষ্ঠ নীলাশা!

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here