প্রস্থান — ১১ম পর্ব।

0
723

প্রস্থান — ১১ম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৩.
রাত প্রায় দেড়টা! হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। সুলতানা একতলার রুমটাতে থাকে, একাই, এতরাতে কলিংবেল বেজে উঠায় বেশ সংকুচিত সে! ড্রয়িংরুমের আলো জ্বালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে তখনও ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টি। প্রকৃতির এইরকম দূর্যোগের সময় কে আসতে পারে, তা ভেবে কূল-কিনারা খুঁজে পেলো না সে। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে এসে যে দাঁড়িয়েছে, এরপর আর এক চুল পরিমাণও নড়েনি। একদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ, মেঘের গর্জন, অন্যদিক একাধারে কলিংবেলের বেজে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে আতঙ্কিত হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে সে।
হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে সুব্রত ভাই নেমে এলো, খুব উদ্বিগ্ন হয়ে, প্রায় ছুটে! সুলতানাকে দেখে ধমক দিয়ে বলল, “সুলতানা, এতক্ষণ ধরে কলিংবেল বেজে যাচ্ছে, দরজা কেন খুলছো না?”
সুব্রত ভাইকে দেখে সুলতানার দেহ সচল হলো। সে কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “খুলবেন না ভাইজান। ডাকাত হতে পারে। ভেবেছে এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে চেঁচালেও আশেপাশের কেউ শুনবে না।”
সুলতানাকে উপেক্ষা করে সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতে সুব্রত বলল, “ডাকাত না। রশ্মি এসেছে। আমি জেগে ছিলাম, জানালা দিয়ে দেখলাম ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো!”
সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে সুলতানার চোখ প্রায় কপালে!
ঠিক। রশ্মিই দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। ভীত চেহারা, শরীর কাঁপছে থরথর করে, শরীরের জামা ভিজে একাকার! মেয়েটা কাঁদছে খুব। বৃষ্টির পানির মধ্যেও চোখের পানি আলাদা করা গেল।
সুব্রত শঙ্কিত গলায় জানতে চাইল, “কী হয়েছে রশ্মি? এতরাতে তুমি এখানে কী করছ?”
“আ-আ-মি-মা….!” কান্নায় ভেঙে পড়ল রশ্মি, কথা বলতে পারল না। যেটুকু বলল, তা-ও অস্পষ্ট।
তবুও যেন সুব্রত কিছুটা অনুমান করতে পারল; সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার বলল, “তোমার মা? আন্টির কিছু হয়েছে?”
রশ্মি মাথা ঝাঁকিয়ে আগের মতো আধো আধো ভাবে জানাল, ‘তাঁর মা কেমন যেন করছে। সে অনেকক্ষন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি আস্তে আস্তে প্রলয়ে রূপ নিয়েছে। শেষে আর উপায় না পেয়ে এখানে এসেছে সাহায্য চাইতে।” কথা বলতে বলতে হাতজোড় করে সুব্রতর সামনে বসে পড়ল রশ্মি। কাঁদতে কাঁদতে কেশে উঠল সে।
সুব্রত সুলতানার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, “ছাতাটা নিয়ে এসো, তাড়াতাড়ি।”
সঙ্গে সঙ্গে সুলতানা ছুটল ছাতা আনতে। সুব্রত রশ্মির দুই কাঁধে হাত রেখে ওকে দাঁড় করালো। আশ্বস্ত করে বলল, “চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি দেখছি।”
রশ্মি কিছু বলল না। কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল সুব্রত ভাইয়ের দিকে। এরপর হঠাৎ কী যেন ভাবল সে, তাঁর চোখ-মুখ পাল্টে গেল সহসা, হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেল মায়ের কাছে!
রশ্মি চলে যেতেই সুব্রত পিছনে তাকাল। সুলতানার দেখা নেই। আর অপেক্ষা করতে পারল না সে। ঝড়-বৃষ্টির কথা না ভেবে ছুটল।

ভদ্রমহিলা এখনো অস্থিরতায় ছটফট করছেন। বুক উঠানামা করছে দ্রুত। বুক উপরে উঠলেই চোখ বড় বড়-গোলাকৃতি হয়ে যাচ্ছে, আবার বুক নিচে নামতেই চোখ ছোট হয়ে এমন হচ্ছে যে, মনে হয় উনার দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল!
সুব্রত কাকভেজা হয়ে রশ্মির মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল উনাকে। দেখে ঘাবড়ে গেল সে। বিছানার কাছে হাটু মুড়িয়ে বসে, ভদ্রমহিলার মাথায় হাত রেখে উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চাইল, “আন্টি, কী হয়েছে আপনার? আমি সুব্রত। আমাকে বলুন।”
রুমানা বেগম কি যেন বলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কথাগুলো এমন এলোমেলো শোনাল যে, সুব্রত কিছুই বুঝতে পারল না। এমনকি রশ্মিও না। সুব্রত শুধু দেখল, রশ্মির মা তাঁর একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে আছেন। এমন জোর উনার হাতে, যে সুব্রত চমকে উঠল! শক্তি অনুভব করে মনে হলো, যেন অশরীরী কোনো শক্তি! সে ভদ্রমহিলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রশ্মির উদ্দেশ্যে বলল, “আন্টির কোনো অসুখ ছিল আগে?”
রশ্মি মায়ের পাশে বসে অবিরাম অশ্রু ঝরাচ্ছিল, সুব্রত ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে বলল, “জানি না আমি।”
“তা জানবে কেন? ইডিয়ট!” ভীষণ রাগ হলো সুব্রতর। কেউ মা না থাকায় কাঁদে, কেউ যেন মা থাকায় কাঁদে! এত দূরত্ব মায়ের সাথে! অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। কিছুক্ষণ ভেবে আবার বলল, “খোঁজো। পুরো ঘর খুঁজে দেখো কোনো মেডিকেল কাগজপত্র পাও কী না।”
রশ্মি বলল, “কোনো অসুখ থাকলে মা আমাকে বলবে না?”
সুব্রত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “যেটা বলেছি সেটা করো। কুইক!”
রশ্মি আর কথা না বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল ঘরময়। ড্রয়ার শেষ করে আলমারি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুই পেল না। আবার সুব্রত ভাইয়ের সামনে এসে বলল, “কিছু পাইনি।”
“তা কী করে হয়?” বিড়বিড় করে বলে এবার নিজেই খুঁজতে শুরু করল সুব্রত। রশ্মি অবাক চোখে দেখল, এক।মুহূর্তে গোটা ঘরে তান্ডব বয়ে গেল!
আলমারির ভিতরে কতকগুলো শাড়ির ভাজে ফাইলটা দেখতে পেলো সুব্রত। বের করে রশ্মির দিকে কঠিন চাহনি রেখে বলল, “তোমাকে দিয়ে একটা কাজ যদি হয়!”
রশ্মি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। ওদিকে মায়ের ছটফটানি কমেনি সামান্য! সুব্রত আবার বিছানার কাছে এসে ফাইলটা খুলল। ভুরু উপরে টেনে পড়তেই সুনিশ্চিত হলো। রশ্মির মায়ের হাঁপানি রোগ আছে। সে ফাইলটা রেখে, ব্যস্ত গলায় বলল, “তোমার মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব। এতক্ষণে শ্বাস যে পুরোপুরি থেমে যায়নি, সেটাই আল্লাহর রহমত।”
সুব্রত ভাইয়ের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রশ্মির ভিতরে যেন ভয়ংকর বিস্ফোরণ হলো! এতবড় অসুখের কথা মা তাঁর কাছে গোপন রেখেছিল। সে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি যে, মায়ের এমন একটা রোগ আছে।
প্রাথমিক যে চিকিৎসা সুব্রতর জানা আছে, সেটুকু প্রয়োগ করল রশ্মির মায়ের উপর। কিন্তু এখন আর এটা যথেষ্ট নয়। শ
শুরুতেই এই চিকিৎসাটুকু দিলে এতক্ষণে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যেতো। রশ্মির উপর আরেক দফা ক্ষিপ্ত হলো সুব্রত। কিচ্ছু জানে না মেয়েটা! নির্বোধ একটা!
এমন সময় সুলতানা ঘরে প্রবেশ করল। হাতে ছাতা। রশ্মির মা-কে দেখে ভয়ে তাঁর বুক কেঁপে উঠল। আত্মা শুকিয়ে গেল।
সুব্রত কিছুক্ষণ ভেবে, সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুলতানা, উনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তুমি ঘরে গিয়ে আমার গাড়ির চাবি, মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে এসো।”
সুলতানা সন্দিহান চোখে সুব্রত ভাইকে দেখতে দেখতে বলল, “এই ঝড়ে আপনি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে যাবেন? মানে সত্যিই? যদি কিছু হয়ে যায়? সন্ধ্যায় টিভিতে দেখেছি, গোটা শহর তালাবদ্ধ।”
“উপায় নেই। রিস্ক নিতেই হবে। হাসপাতাল নিশ্চয়ই খোলা থাকবে। তুমি দেরি না করে চাবিটা নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
সুলতানা চলে গেলে সুব্রত রশ্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “ফাইলটা একটা পলিথিন কাগজে ভরে নাও। ভিজে না যায় যেন।”
রশ্মি তাই করল। রান্নাঘর থেকে একটা পলিথিন এর কাগজ নিয়ে এসে ফাইলটা ভরে ফেলল। সুব্রত ততক্ষণে রুমানা বেগমকে ঘর থেকে বের করে ড্রয়িংরুমের সোফায় শুইয়ে দিয়েছেন। রশ্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আন্টিকে ধরে রাখো। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”
সুব্রত জানে এই ঝড়ে কোনো এম্বুল্যান্স আসবে না। তাই তাকে এই ঝুঁকি নিতেই হবে। সে দ্রুত বাড়িতে গিয়ে সুলতানার থেকে চাবি, মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে নিলো। গ্যারেজ থেকে দ্রুত গাড়িটা বের করে রশ্মিদের বাড়ির সামনে এলো। আবার গাড়ি থেকে নেমে, ড্রয়িংরুমে গিয়ে রশ্মির মা-কে তুলে গাড়িতে বসাল।
মা-কে নিয়ে পিছনে বসল রশ্মি, মায়ের মাথাটা তাঁর কোলে, এই প্রথম বোধহয়! মা খুব কষ্টে শ্বাস নিচ্ছে। সে মায়ের বুকের উপরে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগল, যেভাবে সুব্রত ভাই দিয়েছিল তখন। গাড়ি চলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। হাইওয়ে উঠতেই গাড়ির গতি খুব বেড়ে গেল। তীব্র বাতাস এসে ঝাপটা মারছে গাড়িটাকে। প্রাইভেটকার গাড়ি, ঝড়কে উপেক্ষা করতে পারছে না। সুব্রতর হঠাৎ মনে হতে লাগল, গাড়ি যেন তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনা-আপনি এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা পুরো ফাঁকা। তবুও বৃষ্টির পানিগুলো সামনে এমন একটা দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে যে, রাস্তা দেখার উপায় নেই। গাড়ি যেন হাওয়ায় উড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যে!

রশ্মিদের বাড়ি তালাবদ্ধ করে, নিজেদের বাড়িতে এসে সবাইকে জাগিয়ে তুলল সুলতানা। সর্বনেশে ঘটনাটা বলতেই হতভম্ব হয়ে গেল সবাই! চিত্রার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল। সে ফিরোজকে বারবার অনুরোধ করতে লাগল, ‘এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যাচ্ছে না। আমাদের উচিত এইসময় রশ্মির পাশে থাকা। মেয়েটা মনের দিক দিয়ে খুব দুর্বল, আবেগী। মায়ের কিছু হলে ধাক্কাটা সইতে পারবে না।” অনেক কষ্টে চিত্রাকে থামিয়ে রাখল ফিরোজ। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখল।

১৪.
ভোরবেলা ঝড় থেমেছে। টিভিটে সংবাদ চলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। এমন অতর্কিত প্রলয়ে হতবাক সবাই! কয়েক জায়গায় যানবাহন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। রাস্তায় আশেপাশে পার্কিং করে রাখা ছোট-বড় গাড়িগুলো উলটে-পাল্টে গেছে। কোথাও বড় বড় গাছ ভেঙে পথরোধ করেছে, কোথাও বাড়িঘর একদিকে কাত হয়ে গেছে। কোথাও বিদ্যুতের সংযোগের তার ছিড়ে রাস্তায় পড়ে আছে। টং দোকানগুলোর কোনো হদিস নেই, বাসাতে কোথায় উড়ে গেছে, কে জানে? সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নদী আর সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থানগুলোর।

সুব্রতর সাথে কেউ যোগাযোগ করতে পারেনি এখন পর্যন্ত। তাঁর ফোন বন্ধ বলছে বারবার। রাত থেকেই ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছে সবাই। সকাল হয়েছে, কিন্তু তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাতে শান্ত হলেও চিত্রা এখন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে, রশ্মির সাথে দেখা করবে সে। তাঁর ধারণা, ওরা হাসপাতালেই পৌঁছাতে পারেনি। পথেই কোনো বিপদ ঘটেছে। সেজন্য ফোন বন্ধ, যোগাযোগ রাখার অবস্থাতে নেই।
চিত্রার সাথে একমত প্রকাশ করল সুলতানা। সে বলল, “খুব ঝড় ছিল তখন। বাপরে বাপ! আমি ভাইজানকে বললাম, এখন যাবেন না, কিন্তু ভাইজান শুনলো না। বলে ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বুঝলেন ভাবী, আমি দেখলাম, ভাইজান বাতাসের মধ্যে দিয়েই হুশ করে বেরিয়ে গেল। মনে হলো বাতাস যেন গাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল!”
দীপালি বেগম গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে আছেন। ফিরোজও একহাতে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছ। কনা উদ্বিগ্ন। সহসা সোফা ছেড়ে ওঠে খালেদ সাহেব বললেন, “এভাবে তো চুপচাপ বসে থাকা যায় না। ফোনে যখন যোগাযোগ করতে পারছি না, তখন হাসপাতালে খোঁজ করা উচিত। ছেলেটা ওই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ একজন মানুষকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কী অবস্থায় আছে, কে জানে!”
ফিরোজ বলল, “রাস্তার যা অবস্থা শুনলাম, গাড়ি নিয়ে যাবো কীভাবে?”
“তুই বাইকটা নিয়ে যা বরং। আমি গাড়ি নিয়ে বেরোই। যতদূর করা যায়, করব। কাছের হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করবি আগে।”
চিত্রা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাব তোমার সাথে। এভাবে বসে থাকতে পারছি না আর। অস্থির লাগছে।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আমি তাহলে চিত্রাকে সাথে নিয়ে যাই।”
“সাবধানে বাইক চালাবি। আর ওদের খোঁজ পেলে আমাকে ফোন করবি।”

চিত্রা আর ফিরোজ বেরোনোর কিছুক্ষণ পরই খালেদ সাহেব গাড়িটা নিয়ে বেরোলেন।

১৫.
রাতটা দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে রশ্মির। ধাক্কাটা তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। এতগুলো দিন মা ভয়াবহ রোগটা নিয়ে জীবনযাপন করছিল, আর সে একই বাড়িতে থেকে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি! হাসপাতালে বসে মাঝরাতে থেকে ভোর অব্দি এইসবই ভেবেছে সে। মায়ের সাথে তাঁর দূরত্ব এখন আসমান-মাটি! ভেতরে ভেতরে এই ব্যাপারে তাঁর অনুতপ্ত বোধও হয়েছে। শেষ কবে মা-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কেমন আছো?’ তা মনে করতে পারে না সে। অপরাধবোধ এখানেই।
রশ্মি বসে আছে একটা বেঞ্চিতে। রাতে ভিতরেই ছিল, যখন মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল; ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই কেবিন থেকে বেরিয়ে, বাইরে এসে বসেছে। কাল মাঝরাতে, অনেক কষ্টে, ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করে হাসপাতালে আসতে হয়েছিল তাঁদের। এরপর বাকিটা ডাক্তাররা করেছেন। তাঁর মা এখন সুস্থ আছেন। ডাক্তারদের মতে, শ্বাস নেওয়ার জন্য খুব লড়াই করতে হয়েছে ভদ্রমহিলাকে। সচরাচর অতটা দেরি হয়ে গেলে রোগী বাঁচে না। কিন্তু উনি নিজের দৃঢ় মনোবনের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। ডাক্তারের মুখে সবটা শোনার পর নিশ্চিন্ত হয়েছে রশ্মি। বুকের ধুকপুকানি কমেছে এরপর।
সুব্রত ভিতরে গিয়েছিল রশ্মির মা-কে দেখতে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে তাঁর৷ বাইরে এসে বেঞ্চিতে, রশ্মির পাশে বসে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলো পিছনে। চোখ নিভিয়ে, মৃদু গলায় বলল, “আন্টি ডাকছে তোমাকে।”
রশ্মি এক দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। সুব্রত ভাইয়ের কথার জবাবে সে নাক টেনে বলল, “আমি যাব না।”
“কেন?”
“জানি না। ইচ্ছে করছে না যেতে।”
“ভয় পাচ্ছ নাকি?”
“ভয় পাব কেন?” চোখ টানটান করে সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকাল রশ্মি।
সুব্রত আগের মতোই, বিষণ্ণ, দুর্বল গলায় বলল, “সেটা তুমিই ভালো জানো।”
রশ্মি জোর গলায় বলল, “তবুও আমি যাব না ভিতরে।”
“ওকে।”
আর কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকল সুব্রত। রশ্মি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, “আপনি বাড়িতে চলে যান, সুব্রত ভাই৷ অনেক পরিশ্রম করেছেন আপনি।”
“কর্তব্য পালন করেছি শুধু। প্রতিবেশী হিসেবে এটা আমার কর্তব্য। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তোমাদের পরিবারকে। কীভাবে নিজের কর্তব্য এড়িয়ে যেতাম।”
রশ্মি ঠোঁট কামড়ে, মৃদু হেসে বলল, “আপনাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সুব্রত ভাই। সবসময় নিজেকে একটা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে রাখেন আপনি। কখনো মনে হয় আপনার মতো নিকৃষ্ট প্রাণী এ-জগতে বিরল! কখনো আবার মনে হয়, আপনি যেন এক ফেরেশতা!”
সুব্রত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, “দ্বিতীয় ভাবনাটা কখন জন্মাল? গতকাল রাতে, যখন ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে, নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তোমাদের সাহায্য করেছি?”
রশ্মি জবাব দিতে পারল না। এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব তাঁর কাছে নেই। দ্বিতীয় ভাবনাটা যে কখন জন্মেছে, তা সে জানে না। জন্মের পর থেকেই তো দেখে আসছে মানুষটাকে। কোনো একটা সময় হয়তো অনুভব হয়েছে, সুব্রত ভাইয়ের মতো মানুষ হয় না। পাক্কা ফেরেশতা উনি! মানুষের রূপে বাস করেন!

নীরবে-নিভৃতে, পাশাপাশি বসেছিল দুটি প্রাণ, এমনসময় উপস্থিত হলো চিত্রা, ফিরোজ এবং খালেদ সাহেব। রশ্মিকে দেখে কাছে এসে ওকে ঝাপটে ধরল চিত্রা। পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে ধরল। এরপর উৎকণ্ঠার সাথে একাধারে কতকগুলো প্রশ্ন ছুড়লো। “আন্টি কেমন আছে? আমাকে একবার জানাবে না? হাসপাতালে আসার পর অন্তত জানাতে পারতে। কী যে ভয়ংকর ঝড় ছিল। সকালে দেখি টিভিতে বলছে, শহরে নানান জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুনে তো আমার আত্মা শুকিয়ে যায়। এদিকে তোমাদের কোনো খবর নেই। আন্টির কিছু হয়নি তো? এখন কেমন আছে?” না থেমে অবিরাম প্রশ্ন করতে লাগল চিত্রা, রশ্মিকে জবাব দেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দিলো না।
খালেদ সাহেব এগিয়ে গিয়ে সুব্রতর সামনে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “রশ্মির মা এখন কেমন আছে?”
সুব্রত চোখ মেলে তাকাল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের দিকে। একপলক দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “ডাক্তার বলেছেন, এখন সব স্বাভাবিক।”
“কী হয়েছিল উনার?”
“হাঁপানি আছে উনার। চিকিৎসা না নিলেও মেডিসিন খাচ্ছিলেন নিয়মিত।”
সুব্রত ভাইয়ের মুখে রশ্মির মায়ের বর্তমান সংবাদ শুনে কিছুটা শান্ত হলো চিত্রা। রশ্মিকে ছেড়ে দিয়ে পাশে বসল সে।
ছাড়া পেয়ে রশ্মি মৃদু হেসে বলল, “তুমিও না, উত্তর দেওয়ার সুযোগই দিলে না। প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলে।”
“কী করব বলো? খুব চিন্তা হচ্ছিল যে। ফোনেও পাচ্ছিলাম না!”
“আমি তো ফোন বাড়িতেই ফেলে এসেছি।”
চিত্রা সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর সব্রত ভাই, আপনি? আপনার সাথে তো ফোন ছিল, তাহলে কেন বন্ধ করে রেখেছেন?”
সুব্রত অবাক হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। দেখল, ওটা বন্ধ হয়ে আছে। ভিতরে পানি গেছে নিশ্চয়ই। ফোনটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করল সে, কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।
জবাব না পেয়ে চিত্রা যেমন বিরক্ত হলো, তেমনি রশ্মি, ফিরোজ এবং খালেদ সাহেবও। সুব্রতকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করে নিজেদের সময় অপচয় করল না কেউ।
কেবিনে ঢুকে ওরা দেখতে পেলো, বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন রুমানা বেগম। তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকিয়েছে। এক রাতের ব্যবধানে তাকে কেমন রূগ্ন দেখতে লাগল! চিত্রা এগিয়ে গিয়ে পাশে বসল। অপলক চোখে তাকিয়ে, একটা হাতের উপর হাত রেখে বলল, “এখন কেমন আছেন, আন্টি?”
মেয়ের বয়সী চিত্রার কথা শুনে রুমানা বেগম মৃদু হেসে বললেন, “এ যাত্রায় বেঁচে গেছি আরকি।”
“এভাবে বলবেন না। আপনার কিছু হলে রশ্মির কী হবে বলুন তো? ও এখনো বাচ্চা মেয়ে। আপনি না থাকলে এই দুনিয়ায় ও একা বাঁচতে পারবে না।”
রুমানা বেগমের গলা ভারি হলো। তিনি বললেন, “আমার শুধু এই ব্যাপারে ভয়। ব্যাস, মরে যাওয়ার আগে মেয়েটাকে একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারলে শান্তি পাবো। এই মেয়ের চিন্তায় আমি দিনরাত চোখের পাতা এক করতে পারি না। মেয়েটা আমার এত অবুঝ, এত আবেগী যে, এই কঠিন পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে একা চলতে পারবে না। কারোর সাহায্য প্রয়োজন ওর। বিশ্বস্ত একটা হাতে ওকে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। এরপর আমার মরণ হলেও ভয় নেই।”
খালেদ সাহেব এগিয়ে এলেন এবার। বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না, ভাবী। রশ্মি তো আমাদেরই বাড়ির মেয়ে। আমি নিজে ওর জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ করব। আপনি শুধু সুস্থ হয়ে উঠুন।”
“আমার আর সুস্থ হওয়া বাকি কই?” মৃদু হেসে কথাটা বলে বালিশে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করলেন রুমানা বেগম। কিন্তু শরীরের দুর্বলতার কারণে ব্যর্থ হয়ে আবার শুয়ে পড়ে বললেন, “আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। বিকেলেই বাড়িতে চলে যাব।”
চিত্রা বলল, “হুম, কতটা যে সুস্থ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। শরীরে একটুও জোর নেই।”
চিত্রার থুতনিতে হাত রেখে রুমানা বেগম আদুরে গলায় বললেন, “মা আমার, বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব। এখানে থাকলে নিজেকে আরও অসহায় মনে হবে। দুর্বল বোধ করব।”
খালেদ সাহেব বললেন, “এ ব্যাপারে আপনার কথা না বলাই ভালো, ভাবী। ডাক্তার যেটা বলবেন, সেটাই হবে।”
খালেদ সাহেব বললেন বটে, কিন্তু রুমানা বেগম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, তিনি আজ বিকেলেই বাড়িতে যাবেন। এখানে থাকা মানেই খরচ বৃদ্ধি। যা সামলান তাঁর পক্ষে অসম্ভবপ্রায়!

ঠিক তাই হলো, ডাক্তারের সাথে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর বিজয়ী হলেন রুমানা বেগম। তিনি ডাক্তারকে শতভাগ আশ্বস্ত করে বললেন, ‘নিজের বিন্দুমাত্র অযত্ন করবেন না। রোগটাকে অবহেলা করবেন না। আর রুটির অনুযায়ী চেকাপ করাবেন।’ ডাক্তার রাজি হলো। সাথে রোগীর মেয়েকে অনেক করে বলে দিলো, সে যেন কড়া নজর রাখে মায়ের উপর। রশ্মি তখনও বাইরেই ছিল। মা জেগে থাকতে এক মুহূর্তের জন্যও মায়ের কাছে যায়নি সে। চিত্রা কত করে বলল তাকে, কিন্তু সে জেদ ধরে বাইরে বসে থাকল। মায়ের সাথে দূরত্ব কমানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। সবাই অবাক হলো তাঁর আচরণ দেখে। কেউই জানতে পারল না, মেয়েটার মনের কথা-হৃদয়ের যন্ত্রণা!

বিকেলে যখন রুমানা বেগমের রিলিজ হওয়ার সময়, তখন খালেদ সাহেব হাসপাতালের বিল মেটাতে গিয়ে জানতে পারলেন, সুব্রত অনেকক্ষণ আগেই সমস্ত বিল মিটিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে।

১১তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=829266364684732&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here