প্রস্থান — ২৮তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৩৩.
বিকেলের দিকে মিসেস আজিম আবার এলেন৷ এসে বললেন, “মিসেস রুমানা, আজ আপনার জামিন হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই। আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনার প্রতিবেশী বাড়ির লোকজন খুব চেষ্টা করেছেন। কোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আজ আর হলো না।”
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহটা দুর্বল হলো। বসে পড়ে, মাথার চুল টানতে টানতে রুমানা বেগম বললেন, “আরও একটা রাত নিশ্চিত এই নরকে বাস করতে হবে আমাকে। হায় খোদা! এর থেকে মরণ ভালো।”
মিসেস আজিম বললেন, “মিসেস রুমানা, আপনি এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিবেন না। আপনি দুর্বল হলে ফায়দা হবে অপরপক্ষের। এটা হতে দেওয়া যাবে না।”
কান্নারত গলায় রুমানা বেগম বললেন, “কিন্তু, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আর সম্ভব হচ্ছে না আমার দ্বারা। এখানে তো শান্তিতে শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই।”
নির্বিকার ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মিসেস আজিম। এরপর সহসা নতকণ্ঠে বললেন, “তবে একটা উপায় আছে, মিসেস রুমানা।”
মাথা থেকে হাত সরিয়ে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালেন মিসেস রুমানা। ভুরু কুঁচকালেন সামান্য!
মিসেস আজিম আরও তীক্ষস্বরে বললেন, “একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, আমি। জানি, প্রস্তাবটা খুব অন্যায়, কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়েই আসতে হলো।”
কথাগুলো শুনে ভদ্রমহিলার দিকে আরও উৎসুকভাবে তাকিয়ে রইলেন রুমানা বেগম।
মিসেস আজিম আবার বললেন, “স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, আপনি যদি উনার কাছে ক্ষমা চান, তবে উনি আপনাকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিবেন।”
“ক্ষমা চাইব?” ভড়কে গেলেন রুমানা বেগম। “কিন্তু আমি তো অপরাধী না। তবে কেন?”
“বড় কিছু প্রাপ্তির জন্য যেমন ছোট ছোট জিনিসগুলো বিসর্জন দিতে হয়, তেমনি ভবিষ্যতে উনাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে উনার কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে।”
রুমানা বেগম বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসেস আজিম বলে যাচ্ছেন, “আমি জানি এটা আপনার জন্য সহজ কাজ নয়। আপনার আত্মসম্মান প্রখর। কিন্তু এটাও ঠিক, গরীবের আত্মসম্মানই গরীবের সফলতার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। একবার ভেবে দেখুন মিসেস রুমানা, আপনার জামিন হয়ে গেলেও কী আপনি সম্পূর্ণভাবে এখান থেকে মুক্ত হতে পারবেন? বাকি জীবন স্বস্তিতে কাটাতে পারবেন? তাছাড়া দুনিয়াতে সবারই কী সঠিক বিচার হয়? এটা এমন জগৎ, যেখানে কিছু কিছু অপরাধী যেমন ক্ষমতার জোরে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায়, তেমনই কিছু কিছু নির্দোষ ব্যক্তিকেও কারাগারে আবদ্ধ হতে হয়। তবে আসল জীবনে অপরাধীদের সঠিক ওদের বিচার হবে। নির্দোষরা ন্যয় পাবে।”
নিজের দুর্বলতা উপলব্ধি করে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন রুমানা বেগম।
মিসেস আজিম ধরা গলায় আবার বললেন, “যদি আমার কথা বলেন, তবে মন থেকে আমিও চাই না, আপনি ওই লোকটার কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু সবসময় মনের কথা শুনলে হয় না। উনি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন একটা। আপনি যদি উনার প্রস্তাবে রাজি হন, তবে উনি এক্ষুণি ওসিকে ফোন করে মামলা তুলে নেবেন। এক্ষুণিই হয়তো আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবেন। মেয়ের কাছে ফিরতে পারবেন। আপনাকে ছাড়া একদম অচল, ও।”
রুমানা বেগম জবাব দিতে পারলেন না। তিনি নির্বিকারে অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। মিসেস আজিমও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। মহিলার নীরবতায় তিনি কিছুটা একটা বুঝতে পেরে, হতাশ ভঙ্গিমায় ফিরে যেতে অগ্রসর হলেন।
মিসেস আজিমকে চলে যেতে দেখে আচমকা রুমানা বেগম বলে উঠলেন, “আমি রাজি। উনাকে বলবেন, আমি রাজি। কখন, কোথায়, কীভাবে ক্ষমা চাইতে হবে, তা জানাতে বলবেন। আমি ক্ষমা চেয়ে নিবো। তবে একটা শর্ত, এই ব্যাপারটা যেন চতুর্থ কোনো ব্যক্তির কানে না যায়।”
কথাটা শোনার পর চমকিত হলেন মিসেস আজিম! যদিও তিনি এটাই শুনতে এসেছিলেন। কিন্তু কেন জানি মানতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি ঘুরে, অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর থানা ত্যাগ করলেন।
৩৪.
রাতের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে এলো চিত্রা, রশ্মি বিছানায় আরাম করছিল। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দুজনেই সংকুচিত হলো। চিত্রা রান্নাঘর থেকে বেরোলো, রশ্মি নিজের ঘর থেকে। দুজনেই উদগ্রীব। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ৮টা।
চিত্রা ভেজা হাত ওড়নায় মুছতে মুছতে বলল, “এইসময় আবার এলো?”
“মা এসেছে বোধহয়।” জবাব দিতে গিয়ে রশ্মির সারা মুখে চমক খেলে গেল! যেন মেঘলা আকাশে হঠাৎ বিজলি!
চিত্রা বলল, “ধুর! তা কী করে সম্ভব? সুব্রত ভাই তো বলল, এখনো চেষ্টায় আছে।” এরপর আরও গম্ভীর হয়ে চিত্রা বলল, “বোধহয় ফিরোজ এসেছে। বাড়িতে ফিরে শুনেছে, আমি এসেছি।”
রশ্মি চোখ মৃদুস্বরে বলল, “আমি গিয়ে খুলব?”
“যাও।” নির্বিঘ্নে বলে দিলো চিত্রা। এই কারণেই যে, রশ্মির কাছে আর কিছু গোপন নেই। বিকেলে যখন দুজন বসেছিল, তখনই রশ্মির একটা ‘সাধারণ’ প্রশ্নের জবাবে তাকে সব সত্যি বলতে হয়েছিল।
রশ্মি এগিয়ে গেল দরজার দিকে। চিত্রা উল্টো ঘুরে, হাত জোড়া বুকের নিচে ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। হঠাৎ একটা চিৎকার হলো! একটা শব্দের প্রতিধ্বনি হতে লাগল যেন সারা বাড়িতে। শব্দটা হলো, ‘মা’।
চিত্রা ব্যাকুল হয়ে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল আবার, রশ্মি দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মৃদু পায়ে সামনে এগিয়ে, যেটুকু ফাঁকা আছে, সেটুকুতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে খুঁজতে লাগল। একসময় দরজার কাছে চলে এলো সে-ও।
সত্যিই রশ্মির মা এসেছে। চিত্রা যতটা উত্তেজিত, ততটাই চিন্তিত; উনি মুক্ত হলেন কীভাবে, সেটা ভেবে।
রশ্মি মা-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর অনর্গল বলে যাচ্ছে, “সরি, মা। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি। আমি ক্ষমা চাচ্ছি আজ। আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না। তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি যেভাবে চলতে বলবে, সেভাবেই চলব। সমস্ত খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না আর। প্লিজ মা। তোমার অনুপস্থিতিতে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি, তোমাকে ছাড়া আমি অচল। আমার জীবনটাই অসম্পূর্ণ তোমাকে ছাড়া। প্লিজ মা, আমাকে কথা দাও, আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।”
মেয়ের মুখে এই ধরনের কথা শুনে অত্যন্ত আবেগি হয়ে উঠলেন রুমানা বেগম। তাঁর হৃদয়াবেগ থেকে কান্না ছিটকে পড়ল। মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরে বললেন, “আমি তো এসে গেছি, মা। চিন্তা নেই তোর। আর কখনো তোকে ছেড়ে যাব না আমি। এই তোকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।”
মা-মেয়ের করুণ দৃশ্য দেখে চিত্রার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চোখে জল আর মুখে একফালি হাসি নিয়ে সে বলল, “রশ্মি, আন্টিকে আগে ভেতরে আসতে দাও। আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে?”
রশ্মি হাস্যজ্বল ভাবে মা-কে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তাই তো। এসো মা, ভেতরে এসো। একটা রাত আর একটা দিন পর বাড়িতে এলে তুমি। কেমন লাগছে তোমার?”
ড্রয়িংরুমে পা রেখে, চারিদিকে তাকাতে তাকাতে রুমানা বেগম বললেন, “খুব আরাম লাগছে। মনে হচ্ছে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে ফিরলাম; ভেতরটা এত শান্তিপূর্ণ হয়ে আছে!” চোখ বুজে দীর্ঘঃশ্বাস নিলেন তিনি। আবার বললেন, “কোথায় গিয়ে পড়েছিলাম; বাবাহ্!”
রুমানা বেগম সোফায় বসলেন। চিত্রা সহসা জানতে চাইল, “কিন্তু আপনার জামিন কীভাবে হলো, আন্টি?”
রুমানা বেগম নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, “উনিই মামলা তুলে নিয়েছেন। তাই ছেড়ে দিলো।”
চিত্রার বিস্মিত হয়ে গেল কথাটা শুনে। অবাক ভঙ্গিতে বলল, “এত সহজে মামলা তুলে নিলো?”
“হয়তো পরবর্তীতে উনার উপলব্ধি হয়েছে, আমিই ঠিক, উনি ভুল।” রুমানা বেগম সাবলীল। যদিও ভিতরে একটা ক্রোধ চেপে বসে আছে। তাকে জ্বালাচ্ছে ক্রমাগত। যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব।
চিত্রা আর কিছু বলল না। ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো রশ্মির মায়ের জন্য।
রুমানা বেগম পানি খেয়ে মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “সারাদিন খুব কষ্ট হয়েছে, তাই না? কী খেয়েছিস?”
রশ্মি মলিন সুরে বলল, “সকালে আর দুপুরের খাবার সুব্রত ভাই দিয়ে গেছে। চিত্রা বলল, রাতের খাবার ও তৈরি করে নিবে।”
চিত্রা পাশ থেকে বলল, “এটাও বলো, যে তুমি খেতেই চাচ্ছিলে না। আমাকে আর কনাকে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে তোমাকে খাওয়ানোর জন্য।”
রশ্মি ঠোঁট টিপে হাসল চিত্রার কথক শুনে। মায়ের একটা হাত মুঠোয় নিয়ে ডলতে লাগল।
চিত্রা আবার বলল, “আন্টি, আপনার জামিনের জন্যও কিন্তু সারাদিন খুব খেটেছেন সুব্রত ভাই। আমাদের বলেছিলেন, কাল সকালেই জামিন নিশ্চিত হয়ে যাবে।”
চিত্রার কথা শুনে রুমানা বেগম শরীরটাকে খানিকটা পিছিয়ে নিয়ে, আয়েশের ভঙ্গিতে বলল, “ছেলেটা কিন্তু অত খারাপ না। উদার মন। অথচ কতকিছু বলেছিলাম আমি। মানুষ তো সারাজীবন একরমক থাকে না। এখন মনে হচ্ছে, ফিরোজের বাবার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে ভুলই করেছিলাম। বিপদে যে সবকিছু ভুলে পাশে দাঁড়ায়, সে-ই তো প্রকৃত বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী!”
রশ্মির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল চিত্রা। রশ্মি টুপ করে চোখ নামিয়ে ফেলল তৎক্ষনাৎ; লজ্জায়, কিংবা অন্য কোনো।কারণে!
রাত আর একটু বাড়তেই দীপালি বেগম আর কনা এলো রশ্মিদের বাড়িতে। তাঁরা এসে দেখল, রশ্মির মা বাড়িতে এসে পড়েছে।
দীপালি বেগম এসে উৎফুল্ল ভাবে বললেন, “আল্লাহ শুকরিয়া। ভাবী, আপনি ঠিক আছেন?”
রুমানা বেগম ঘরে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। বিছানায় শুয়ে ছিলেন। দীপালি বেগমের কথার জবাবে তিনি বললেন, “ভালো আছি, ভাবী। বসুন না। রশ্মি, উনাদের বসতে দে।”
দুটো টুল টেনে আনল রশ্মি; একটা দীপালি বেগমের পাশে রেখে, অন্যটা কনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বসো, কনা।”
কনা মৃদু হেসে বসল টুলে। সাথে সাথে বসলেন দীপালি বেগম। তিনি বললেন, “ফিরোজের বাবাও উকিলের সাথে কথা বলেছিলেন। আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন গতকাল সন্ধ্যা থেকেই। আপনার ফিরে আসার সংবাদ শুনলে খুব খুশি হবেন।”
রুমানা বেগম জবাবে বলল, “শুকরিয়া। ভাইকে আমার ‘কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশের কথা বলবেন। আপনাদের মতো প্রতিবেশী পেয়ে সত্যিই নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে হয়। ধনী-গরিব দেখে বিবেচনা না করে, সবার কথা খুব ভাবেন আপনারা।”
প্রশংসা শুনে হাসলেন দীপালি বেগম। এমন সময় চিত্রা রুমানা বেগমের ঘরে এলো। হাতে চায়ের কাপ। ইতস্ততভাবে একটা কাপ শাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিলো।
দীপালি বেগম মুচকি হেসে বউমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বললেন, “কেমন আছো, চিত্রা?”
চিত্রা বিনম্র স্বরে বলল, “আমি ভালো আছি, মা। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি।” মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন দীপালি বেগম। তাঁর মুখের অঙ্গভঙ্গি এমন, যেন মনেমনে খুব দুষ্টুমি! তবে চাহনিটা সে বিদ্রুপের, তা বুঝতে সামান্যও দেরি হলো না চিত্রার।
কথাবার্তা শেষ হলে দীপালি বেগম চিত্রার উদ্দেশ্য বলল, “তাহলে চলো এবার। যাওয়া যাক।”
চিত্রা বিস্মিত গলায় বলল, “কোথায়, মা?”
“কোথায় আবার? বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে।”
চিত্রা ঠোঁটের কোণে ঈষৎ রহস্যময় হাসি টেনে বলল, “যাব, মা। কাল সকালে যাব। ঠিক করেছি, আজ রাতটা এখানেই থাকবো।”
চিত্রার কথা শুনে চমকিত হলেন দীপালি বেগম। চিত্রার মধ্যে যে ব্যাকুলতা তিনি আশা করেছিলেন, তার বিন্দুমাত্র পরিমাণ উদগ্রীবতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তিনি নিজ মনে কিছুক্ষণ ভাবার পর অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, “তাহলে বরং আজ আসি, ভাবি।”
রুমানা বেগম বিছানায় সোজা হয়ে বসে বললেন, “আবার কিন্তু আসবেন।”
“সুস্থ হয়ে আপনিও কিন্তু আসবেন আমাদের বাড়িতে।”
“যাব। আমাকে তো যেতেই হবে একবার।” কথাটা বলে রশ্মির দিকে তাকালেন রুমানা বেগম।
রশ্মি, লাজুক হাসিটা এবার আর আড়াল করতে পারল না কারোর থেকে। সবাই দেখল ওই হাসি।
দীপালি বেগম আর কনা চলে যাওয়ার পর রুমানা বেগমের ঘরের আলো নিভিয়ে চিত্রা আর রশ্মি পাশের ঘরে চলে গেল।
৩৫.
গভীর রাতে রুমানা বেগমের ঘুম ভেঙে গেল, ফোন রিংটোনের শব্দে। হালকা ঘুমেই ছিলেন, আচমকা ফোন বেজে উঠায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। ফোন হাতে নিয়ে, স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলেন, একটা অপরিচিত নম্বর। অবাক হয়ে রিসিভ করলেন।
কিছুক্ষণ নীরব চারিদিক, হঠাৎ ওপাশ থেকে চওড়া গলায় মিস্টার মুজিবর বলে উঠলেন, “মিসেস রুমানা যে, ঘুমানকি নাকি? একবার ফোন দিতেই রিসিভ করলেন।”
রুমানা বেগম কম্পিত গলায় বললেন, “আ-আপনি! এত রাতে ফোন দিয়েছেন?”
“আহা! ঘাবড়াচ্ছেন কেন? সশরীরে অনেকটা দূরে আছি। চিন্তা করবেন না।” ক্ষীণ হেসে, সকৌতুকের সাথে বললেন মিস্টার মুজিবর।
রুমানা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কেন ফোন দিয়েছেন এইসময়? আমার চাকরিটা তো আর নেই। তবে আপনার সাথে আমার কেন যোগাযোগ থাকতে হবে?”
হেসে উঠলেন মিস্টার মুজিবর। বললেন, “আপনার সাথে কি আমার শুধুই কাজের সম্পর্ক? হে হে হে!” হাসতে হাসতে কালো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে ফেললেন তিনি।
রুমানা বেগম দম খিঁচে বসে রইলেন। একদম নীরব তিনি।
জবাব না পেয়ে মিস্টার মুজিবর আবার বললেন, “রাগ করলেন নাকি? ভুলে গেছেন, আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল? আরে, যে কারণে আপনি ছাড়া পেয়েছেন। মনে পড়েছে।”
মনে আছে রুমানা বেগমের। কখনোই ভুলেননি তিনি। এই প্রসঙ্গটা তাকে বাড়িতে আসার পরেও স্বস্তি দেয়নি। অস্থির করে তুলেছে তাকে।
রুমানা বেগম মাথা নুইয়ে, অনুচ্চস্বরে বললেন, “আমি ভুলিনি, স্যার। এইরকম একটা কথা আমি কীভাবে ভুলে যেতে পারি? শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে এই ব্যাপারটা।”
“আত্মসম্মানে লাগছে বুঝি? আপনি তো।অনেক আগেই আত্মসম্মান বিক্রি করে দিয়েছেন। দেননি?”
চোখ বুজে জল থামালেন রুমানা বেগম। তাঁর বুক চিনচিন করছে। ভয় করছে বড্ড। কিছুক্ষণ নির্বিকার থেকে তিনি শান্ত হয়ে বললেন, “আসলে স্যার, সেদিনের ব্যাপারটার জন্য দুঃখিত। ওভাবে রিয়্যাক্ট করা আমার উচিত হয়নি। আমি ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে।”
রুমানা বেগমের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসির সাথে মিস্টার মুজিবর বললেন, “আপনিও না৷ এটা কোনো সময় হলো ‘সরি’ বলার?”
হতবিহ্বল হয়ে গেলেন রুমানা বেগম। মুখ ‘হা” করে বললেন, “তবে ফোন দিলেন কেন এত রাতে?”
“সবকিছুর পিছনে যদি কারণ খুঁজেন, তবে পৃথিবী থেকে তো ‘অকারণ’ শব্দটাই ওঠে যেতে শুরু করবে। আসলে, আপনি ঠিকমতো বাড়িতে ফিরেছেন কী-না, সেটাই জানার জন্য ফোন দিলাম। আপনাকে এক্ষুণি ক্ষমা চাইতে হবে না। আপাতত বিশ্রাম নিন। কত বড় ঝড় বয়ে গেল আপনার উপর দিয়ে! তাছাড়া আপনি তো মোবাইল ফোনে আমাকে অসম্মান করেননি। তাই না?”
“স্যার।” রুমানা বেগমের গলা ধরে এলো। ঢোক গিলে বললেন, “আপনি আমাকে বলুন, কোথায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইলে আপনার থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারব। আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবেই হবে। ব্যাস আমি শুধু মুক্ত হয়ে আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই।”
“মিসেন রুমানা।” সুর টেনে বললেন মিস্টার মুজিবর। এরপর হাসলেন সশব্দে। আবার বললেন, “এই ব্যাপারে আপনি কেন এত চিন্তা করছেন? এইসময় এত উতলা হলে চলে? নিজের যত্ন নিতে হবে তো। উপরওয়ালা যদি চান, তবে খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে। আসলে উনার পরিকল্পনার কাছে আমাদের পরিকল্পনার কোনো গুরুত্ব নেই। তাই অযথা এইসব ভেবে উদ্বিগ্ন হবেন না। চিন্তামুক্ত থাকুক। রাখছি এখন, কেমন? ভালো থাকবেন।”
এরপরই ফোনটা কেটে দিলেন মিস্টার মুজিবর। রুমানা বেগম আর কোনো শব্দোচ্চারণের সময়ই পেলেন না। যেমন আচমকা ফোনটা এসেছিল, তেমনই আচমকা ফোনটা কেটে গেল।
গত হয়েছে প্রায় আধঘণ্টা, ফোন হাতে নিয়ে অসাড় ভঙ্গিতে বসে আছেন রুমানা বেগম। রাতের অবশিষ্ট সময়টুকু বোধহয় এভাবে অতিবাহিত হবে।
২৮তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=843275719950463&id=100028041274793
বিঃদ্র: গতকাল পর্ব দিতে না পারার জন্য এবং তা বলে না দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে গতকাল দুপুর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আমার নেট কানেশনে প্রব্লেম ছিল। সেজন্য ফেসবুকে আসতে পারিনি।
আর একটা কথা, এই পর্বটা লেখার পর আমি চেক দিইনি। টাইপিং মিস্টেক হবে স্বাভাবিক ভাবেই। এছাড়া বাক্যে অসংগতি দেখা দিলে আমাকে কমেন্ট বক্সে বলবেন, আমি এডিট করে দিবো। পাশাপাশি পর্বটা পড়ে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা করার অনুরোধ রইল। এটা আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি। লেখাতে এমন কিছু থাকে, যা একজন লেখক শুধুমাত্র পাঠকের দৃষ্টি দিয়েই ধরতে পারে। যেহেতু এখন আমি পাঠকের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছি না, তাই এই দায়িত্বটা আপনাদেরই দিলাম।