প্রস্থান — ১০ম পর্ব।

0
729

প্রস্থান — ১০ম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

“সুব্রত ভাই, শুনছেন?” দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকল চিত্রা।
ভিতর থেকে সুব্রত বলে উঠল, “কে?”
“আমি চিত্রা।” জবাব দিলো সে।
“এখানে কেন এসেছ?”
“একটা জরুরি প্রয়োজনে। যদি দরজাটা খুলতেন।”
“তুমি কি সন্ধ্যার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলতে এসেছ?”
“না। অন্য একটা প্রয়োজন।”
“খোলা আছে। ধাক্কা দাও।”
চিত্রা দরজাটা ধাক্কা দিলো। ভিতরে তাকিয়ে দেখল, সুব্রত ভাই বিছানায় শুয়ে আছে। হাতে একটা বই। ভীষণ মনোযোগী সে। এদিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল!
চিত্রা কিছু বলছে না দেখে সুব্রত ঈষৎ ধমক শুরে বলল, “জরুরি প্রয়োজনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
চিত্রা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার কী শরীর খারাপ, সুব্রত ভাই?”
“না।”
“আমি কি ভিতরে আসতে পারি? দু’টো কথা বলব শুধু। এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে বলতে পারছি না।” নম্র গলায় অনুরোধ করল সে।
কয়েক সেকেন্ড কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না সুব্রত। যেন চিত্রার কথা সে শুনতে পায়নি। যখন অধৈর্য হয়ে চিত্রা আবার কিছু বলতে চেষ্টা করল, তখনই সুব্রত ভাই হঠাৎ শোয়া থেকে ওঠে বসলেন। বইয়ের যে পাতা পড়াছিলেন, সেই পাতাটা ভাজ করে পাশে রেখে তাকালেন দরজার দিকে। চোখ উন্মুক্ত। ধূসর রঙের চোখের তীক্ষ্ণ চাহনি উপেক্ষা করা গেল না। উনি একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বই পড়ছিলাম, বুঝলে। তোমাদের তো সময়-জ্ঞান নেই। এমন সময় বিরক্ত করতে চলে আসো না।”
অকস্মাৎ ভিতরে ঢুকে পড়ে চিত্রা রাগী গলায় বলল, “আমি আপনাকে বিরক্ত করতে আসিনি, সুব্রত ভাই। একটা অনুরোধ করতে এসেছি।”
সুব্রত চিত্রার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আসারই যখন ছিল, তখন অনুমতির জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করলে কেন?”
“যা করেছি, বেশ করেছি। সময় অল্প, এবার শুনুন আমার জরুরি কথা। আখেরে লাভ আপনারই বেশি।”
সুব্রত বিনা প্রতিক্রিয়ায় ওঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “তাহলে আরও একটু অপেক্ষা করো। বইয়ের টপিকটা মাথা ভারী করে দিয়েছে। ফ্রেশ না হলে তোমার জরুরি কথা ভিতর অব্দি পৌঁছাবে না।”
সুব্রত ভাই চলে গেলে চিত্রা ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল। সেই বিয়ের আগে একবার শেষ দেখেছিল, এরপর আজকে। ঘরটা আর মানুষটার মধ্যে বিস্তর ফারাক! দেখা বুঝার উপায় নেই, এই ঘরের মালিক সুব্রত ভাই। বোধ হয়, ঘরটা যেন তাঁর প্রেমিকা, আর সে একজন অগোছালো প্রেমিক! মুচকি হাসল চিত্রা। এমন গম্ভীর লোকের সাথে প্রেমিক শব্দটা হাস্যকর লাগল! এই লোক প্রেম-ভালোবাসার কী জানে?
বারান্দার দরজাটা খোলা। বেশ ফুরফুরে বাতাস আসছে ভিতরে। জানালার পর্দা, দেয়ালে ঝুলানো নতুন বছরের ক্যালেন্ডারটা-সবই বাতাসে দুলছে। সুব্রত ভাইয়ের ঘরের বারান্দার মতো বারান্দা এই বাড়িতে দ্বিতীয়টি নেই। সে তাকালো ‘স্টাডি রুমের’ দিকে। তালা নেই। তবে দরজাটা ভেড়ানো। এই মুহূর্তে আর সেই কাণ্ডটা করল না সে। সুব্রত ভাইয়ের উপস্থিতিতে এই ঘরে গোপনে প্রবেশের প্রচেষ্টা ভীষণ বিপদজনক!

ফিরে এলো সুব্রত ভাই। মুখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে ফ্লোরে। হাতও ভেজা। ফ্যানটা বন্ধ ছিল এতক্ষণ, সুব্রত ভাই সুইচ-বোর্ডে হাত রাখল।
চিত্রা অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “সুব্রত ভাই, কী করছেন কী!”
চিত্রার গলার আওয়াজ এমন শোনালো যে, সুব্রত সামান্য ঘাবড়ে গেল! সুইচ-বোর্ড স্পর্শ করল না আর। পিছিয়েও এলো কিছুটা।
চিত্রা উদ্বিগ্ন গলায় আবার বলল, “এক্ষুনি তো কারেন্টের শক খেতেন। ভেজা হাত নিয়ে কেউ ফ্যান চালু দিতে যায়? শরীরে যে কারেন্ট চলে আসতে পারে, তা আপনি জানেন না?”
সুব্রত জানে। অনেক আগে একজন জানিয়েছিল তাকে। এরপর বেশ ক’বার ইচ্ছাকৃত ভাবেই কর্মটির পুনরাবৃত্তি করেছিল সে, কিন্তু আজকেরটা অনিচ্ছাকৃত; এবং চিত্রার এই বাঁধা দেওয়াও অপ্রত্যাশিত ছিল। কয়েক বছর ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল।

সেদিন শহরে খুব বৃষ্টি ছিল। ঘরে নববধূ, বিয়ের মাত্র ১০ দিনের মাথায়, সে বিকেলের আগেই বাড়িতে চলে এলো। গাড়িটা বাইরে রেখে আসতে হয়েছিল কারণ, বৃষ্টিতে বাড়ির সামনের লাল মাটির জায়গাটা খুব পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। এদিকে গাড়িতে কোনো ছাতা ছিল না, হঠাৎ বৃষ্টি হয়েছিল বলে। সে গাড়িটা খানিক দূরে রেখে, অনেকটা বাধ্য হয়েই ভিজে এসেছিল বাড়িতে। সদর দরজার কাছে আসার আগেই কাকভেজা হয়েছিল সে। সেভাবেই সোজা ঘরে চলে যায়। দরজায় টোকা দিতেই ভিতর দেখে একটা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে আসে, “আসুন।” যেন সে জানতো, দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে আছে!
সুব্রত ভিতরে ঢুকে ভেজা শরীরেই, জানালার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় রুশাকে। একটা নির্লিপ্ত, অথচ সুশ্রী-মায়াবী মুখ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল, “ভিজে না আসলে হতো না বুঝি? বাড়িতে ফোন করলেই সুলতানা ছাতা নিয়ে যেতো।”
সুব্রত বুঝতে পারে, রুশা জানালা দিয়ে সবটা দেখেছে। সে কোনো জবাব দিলো না। ইতোমধ্যে ভেজা কাপড় থেকে পানি ঝরে ঘর ছিপছিপে হয়ে যাচ্ছিল। সে সুইচ-বোর্ডের দিকে হাত বাড়ালো ফ্যান ছাড়ার জন্য, যাতে ভেজা অংশটুকু দ্রুত শুকিয়ে যায়; তখনই সেই বিস্ময়কর ঘটনার সূচনা হয়! রুশা প্রায় চিৎকার করে ছুটে আসে, শক্ত করে হাতটা ধরে ফেলে। তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, “ভেজা হাত নিয়ে কেউ ফ্যান চালু দিতে যায়? শরীরে কারেন্ট চলে আসবে না?”
সুব্রত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল রুশার দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য বেশ অপরিচিত লাগছিল মেয়েটাকে।
রুশা তখন হাত ছেড়ে দিয়ে বলে উঠল, “এই কাজ আর কখনো করবেন না, বুঝেছেন?”
সেদিন বোবা বনে গিয়েছিল সুব্রত। কিন্তু তাঁর মন বারবার বলতে চাচ্ছিল, “এই স্পর্শটুকু পাওয়ায় জন্য আমি বারংবার কারেন্টের শক খেয়ে মরতে রাজি আছি।”
এরপর বেশ কয়েকবার সে ভেজা হাতে সুইচবোর্ড স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে! কখনো ফ্রেশ হয়ে এসে, কখনো গোসল করে এসে, কখনো-বা অযথা হাতে পানি ঢেলে! কিন্তু রুশা আর কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। কখনো শক্ত করে হাত ধরে বলেনি, “ভেজা হাত নিয়ে কেউ ফ্যান চালু দিতে যায়? শরীরে কারেন্ট চলে আসবে না?” মেয়েটা যেন তাঁর এই প্রচেষ্টা আর কোনোদিন খেয়ালই করেনি!

“সুব্রত ভাই? আপনি কি শুনবেন আমার কথা?” সুব্রত ভাইয়ের নীরবতায় অধৈর্য হয়ে উঠল চিত্রা, খুব!
সুব্রত অতীত থেকে বর্তমানে এলো। বিস্ময় মিশ্রিত চাহনি রাখল চিত্রার মুখের দিকে। কোথাও যেন মিল খুঁজে পাচ্ছে সে; আজই প্রথম এমনটা মনে হলো তাঁর!
চিত্রা আবার বলল, “বলব এবার?”
নিজেকে সামলে নিয়ে সুব্রত বলল, “হুম। তাড়াতাড়ি।”
চিত্রা খুশি হয়ে, মুখে তৃপ্তিদায়ক হাসি ফুটিয়ে বলল, “বাবা আজ একটা খুশির সংবাদ দিলেন সবাইকে। বিদেশ থেকে একটা অর্ডার এসেছে। সেই আনন্দে সবাই মিলে বুদ্ধি করলাম, আজ বাইরে কোথাও রাতের খাবার খাবো।”
“ওহ্!” স্বাভাবিক ভাবে শব্দটা উচ্চারণ করে ওয়্যারড্রব থেকে তোয়ালে বের করল সুব্রত। হাত মুখ মুছতে মুছতে বিছানায় বসল।
চিত্রা আবার সুব্রত ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ওহ্ মানে? আপনাকেও যেতে হবে।”
সুব্রত চমক খেয়ে চিত্রার দিকে তাকালো। মুখে বলল, “পাগল হয়েছ? আমি তোমাদের সবার সাথে ডিনারে যাবো? তোমাদের সইবে?” তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভুরু নাচাল সে। কথায় বিদ্রুপ! ঠোঁটের কোণের হাসিতেও যেন ঈষৎ উপহাস লেপ্টে আছে!
চিত্রা রাগ করে বলল, “সইবে না মানে? এটা কেমন কথা? তাছাড়া সবাই-ই তো বলল আপনাকে ডেকে পাঠাতে। কেউ সাহস পেলো না বলেই আমি এলাম। আমি এই বাড়ির সবচেয়ে সাহসী কী-না!” ঠোঁট টিপে হাসল চিত্রা। কোনো একটা বিশেষ কারণে গর্ববোধ হলো তাঁর।
সুব্রত ভীষণ অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলল, “তুমি এখন যাও তো। আমার অনেক কাজ আছে।”
“কাজ তো করবেন। কিন্তু আজ আপনাকে যেতেই হবে। খুব আশা নিয়ে এসেছি।”
সুব্রত নিজের মোবাইল বের করে নিঃশব্দে কিছু ঘাটতে লাগল।
চিত্রা আবার বলল, “প্লিজ সুব্রত ভাই। অন্তত আমার খাতিরে চলুন। আপনি গেলে আমি খুব খুশি হবো।”
সুব্রত মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তোমার খাতিরে কেন যাবো? কে হও তুমি আমার? যে তোমার অনুরোধ আমাকে রাখতেই হবে।”
“আমি তো আপনার ছোট বোনের মতো। কনার মতো। আপনার নিজের কোনো বোন থাকলে হয়তো আমারই বয়সী হতো। হতো না? এই বোনের খাতিরেও যাবেন না?” চিত্রা শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করল এবার। আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এটি। প্রতিটি ছেলে-ই ‘বোন’ শব্দটির কাছে দুর্বল বোধ করে। সুব্রত ভাই এর ব্যতিক্রম নয়; ব্যক্তিগত জীবনে সে যতই কালো দাঁগ থাকুক!
চিত্রার কথা শুনে সুব্রত দাঁড়িয়ে গেল। তাকে অনেকেই ‘সুব্রত ভাই’ বলে ডাকে। কিন্তু অনেকদিন হলো কেউ বলে না, ‘আমি তো আপনার বোন’। চিত্রার দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হলো তাঁর। কিন্তু? থমকে গেল সুব্রত! আচমকা নিজেকে কঠোর করে বলল, “আমার কোনো বোন নেই। আর কেউ হতেও পারবে না। আমি কোনো সম্পর্কের মায়ায় আটকে পড়তে চাই না। জীবনে কোনো পিছুটান রাখতে চাই না। আমি এমনভাবে নিজেকে স্বাধীন রাখতে চাই, যেন নিজেকে নিঃশেষ করার সময় কারোর কথা ভেবে কষ্টবোধ না হয়। চোখ দিয়ে যেন পানি না পড়ে সেসময়। আফসোসের জায়গা না থাকে। নিজেকে নিজে বিসর্জন দেওয়ার সময়টা যেন আনন্দময় হয়। সে ত্যাগ হবে শুধুই মুক্তির।”
চিত্রা প্রথমে বুঝতে পারল না সুব্রত ভাইয়ের কথা। যখক্ষণে বুঝলো, ততক্ষণে সুব্রত ভাই বিদায়ের পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সে কিছু বলার আগেই লোকটা বলল, “দরজাটা ওদিকে।”
এক দৃষ্টিতে সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘর বের বেরিয়ে এলো চিত্রা। উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত মন নিয়ে নিজের ঘরে গেল সে।

কেউই ভাবেনি সুব্রত ডিনারে যাবে; এমনকি চিত্রা-ও না। কিন্তু তাকে এবং সবাইকে ভড়কে দিয়ে বাইরে যাওয়ার জামা-কাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়েছে। একটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল সবার মধ্যে। সুব্রত আসতেই সেটা নিভে গেল। সবার কেমন যেন তাড়াহুড়ো করতে লাগল, এবং চারিদিকটা কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বমুহূর্তের ন্যয় স্তব্ধ রূপ নিলো।

বাড়িতে গাড়ি দু’টো। একটা সুব্রতর নিজের, আর একটা মূলত খালেদ সাহেব এবং বাড়ির প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। একজন ড্রাইভার আছেন ওই গাড়িতে। সবাই বেরোলে হঠাৎ সুব্রতর নজর পড়ল সুলতানার দিকে। সে বলল, “সুলতানা, তুমি যাবে না?”
সুলতানা একগাল হেসে বলল, “সবাই চলে গেলে বাড়ি কে দেখবে, ভাইজান?”
“তাই বলে তুমি বাড়িতে একা থাকবে? আমাদের আসতে যদি খুব রাত হয়। একা, এত বড় বাড়িতে তোমার ভয় করবে না?”
সুলতানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। সুব্রত বলল, “যাও, তুমি রেডি হয়ে এসো। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।”
সুলতানা ইতস্তত করে, দীপালি বেগমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু ভাইজান, বাড়িতে তো কাউকে থাকতে হবে।”
খালেদ সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, “সুলতানা, অবাধ্য হচ্ছিস কেন? যা তৈরি হয়ে আয় তাড়াতাড়ি। সদর দরজা ভালো করে তালা দে। যাওয়ার সময় আমি গার্ডকে বলে যাব, এদিকে কড়া নজর রাখতে।”
আনন্দে সুলতানার মন লাফিয়ে উঠল। চোখ ভিজে গেল। কিন্তু সে ওই আবেগীয় উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল।

সেদিন রাত প্রায় ১০টার দিকে বাড়িতে ফিরল সবাই। একটা গাড়িতে, খালেদ সাহেব বসেছেন ড্রাইভারের পাশে। ফিরোজ, চিত্রা আর দীপালী বেগম বসলেন পিছনে। আর সুব্রতর গাড়িতে বসেছিল কনা আর সুলতানা। কনার ইচ্ছে ছিল না সুব্রত ভাইয়ের গাড়িতে যেতে। কিন্তু ওই গাড়িতে আর জায়গা ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সুব্রত ভাইয়ের গাড়িতে যাতায়াত করতে হয়েছে তাকে। অবশ্য ফিরে আসার সময় মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল, সেজন্য এই ব্যাপারটা তাকে খুব একটা বিচলিত করতে পারেনি আর।

১২.
পরদিন বিকেলে পুরো আকাশ ঢাকা পড়ল কালো মেঘের আড়ালে! কালবৈশাখীর মতো করে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো শহরে। রাস্তায় জনমানবে ভরপুর। অফিস ছুটির সময় এটা। এমনিতেই অন্ধকার, তাঁর উপর বাতাসের সাথে ধূলোর উড়াউড়ি। মানুষের উপচে পড়া ভীড়, আপন নীড়ে ফেরার তাড়না-ছুটোছুটি। কোথাও দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই যেন! এদিকে বাতাস আর ধূলোর কারণে চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না। যতগুলো বাস সে দেখতে পেলো, সবগুলোরই দরজা বন্ধ। ভিতরে যেন সামান্য জায়গা নেই। বৃষ্টি শুরু হয়নি এখনো, তাই রক্ষে! নাহলে যে কী হতো?

বাসস্ট্যান্ডে অসহায় চেহারা করে দাঁড়িয়ে রইল রশ্মি। গত হয়েছে প্রায় ঘণ্টা খানেক। কোনোভাবেই বাড়িতে যাওয়ার সুবিধা করতে পারেনি। বাস পাওয়াই যাচ্ছে না, সিএনজি পর্যন্ত নেই আশেপাশে। এক ক্লাসমেটের বাড়িতে গিয়েছিল নোটস আনতে, ফেরার সময় এই বিড়ম্বনা! একদিকে ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তার ধূলোময়লা শরীরে লেপ্টে, শরীরটাকে কেমন স্যাঁতসেঁতে করে দিয়েছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? প্রকৃতি যেন তাঁর উপর আজ খুবই অসন্তুষ্ট, এমন ক্ষেপে আছে না! আষাঢ়মাসের শুরু। এখন ঘন ঘন এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
জায়গাটায় কোনো ছাউনি নেই। সে এবং আরও ক’জন দাঁড়িয়ে আছে এখানে। হঠাৎ নিজের নামটা কোথা থেকে যেন ভেসে এলো।
রশ্মি দেখতে পায়নি দেখে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো সুব্রত, “রশ্মি, এদিকে এসো। গাড়িতে।”
রশ্মি এবার তাকালো সুব্রতর দিকে। দুই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। কিন্তু এক চুল পরিমাণও নড়ল না।
অফিস থেকে ফিরছিল সুব্রত, কিছু লোক রাস্তা পাড় হচ্ছিল বলে হালকা থামতে হয়েছে তাকে, তখনই গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রশ্মির মুখটা দেখতে পায় সে।
রশ্মিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুব্রত একরাশ বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। তখনই কিছু ধূলো চোখে এসে পড়ল। চোখে বন্ধ করে ফেলল সে। আবার পিছিয়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠে বসল।
রশ্মি এবার এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। কাঁচটা নামানো ছিল, সে কিছুটা ঝুঁকে বলল, “কিছু বলবেন, সুব্রত ভাই?”
সুব্রত তাকাতে পারল না ভালো করে। চোখ ডুলতে ডলতে জোর গলায় বলল, “গাড়িতে ওঠো।”
রশ্মি বলল, “আপনি চলে যান, সুব্রত ভাই। আমি বাসে চলে যাব।”
সুব্রত আগের থেকেও জোরে বলল, “তাড়াতাড়ি।”
“না।”
“চুপ। ১ মিনিট সময় দিলাম।”
রশ্মি থতমত খেয়ে বলল, “কোথায় বসব?”
সুব্রত দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “জায়গা না পেলে পিছনের ডিকিতে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ওটা নিশ্চিত ফাঁকা আছে।”
কটা চোখ করে সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসল রশ্মি, সুব্রত ভাই গাড়ি চালকের আসনে। সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে, নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে গালি দিলো দু’টো।
সুব্রত চোখ কচলাচ্ছে। খুব বালি গিয়েছে চোখে। জ্বালা করতে শুরু করেছে। চোখের পাতা সামান্যও মেলতে পারছে না সে। রশ্মি দেখল, মানুষটা খুব অসুবিধায় পড়েছে। সে খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর বলল, “সুব্রত ভাই, আমি হেল্প করব?”
সুব্রত বলল, “কীভাবে?”
“এদিকে দেখুন। তাকান আমার দিকে।”
“তাকাতে পারলে তো গাড়ি চালাতে শুরু করতাম। বোকার মতো কথা বলো না তো।”
হঠাৎ কী হলো কে জানে, সম্পর্কের কথা, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত, এইসবকে উপেক্ষা করে রশ্মি সিটের উপর হাঁটু মুড়িয়ে দাঁড়াল। সুব্রত ভাইয়ের দিকে ঘুরে, উনার মাথার দুই পাশে হাত মুখটা নিজের দিকে টেনে আনলো। সুব্রত ভাই তব্দা খেয়ে গেল। পুতুলের মতো প্রতিক্রিয়াহীন রইল সে। রশ্মি নিজেই তাঁর হাত সরিয়ে দিয়ে, চোখের পাতা টেনে ভিতরে ফু দিতে লাগল। কয়েকবার ফু দেওয়ার পরেও যখন কাজ হলো না, তখন পরণের ওড়নার একটা অংশ চোখা চোখা অথচ নরম করে চোখটা পরিষ্কার করে দিলো। এরপর ওড়নায় নিজের মুখের ভেতরের উষ্ণ আর্দ্র দিয়ে ওই চোখকে তাপ দিতে লাগল আস্তে আস্তে।
কিছুক্ষণ পর যখন এই কাছাকাছি আসায় একটা থমকানো বাতাস হঠাৎ আঘাত হানল, তখন রশ্মি ছিটকে পড়ল পিছনের দিকে। নিজের সিটে বসে পড়ল কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে! নিজের কর্মের কথা ভেবে লজ্জায় বা সংকোচে সে আর সরাসরি সুব্রত ভাইয়ের দিকে তাকাতে লাগল না। নিজেকে লজ্জাবতী গাছের মতো গুটিয়ে নিয়ে, সামান্য জায়গায় বসে রইল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল সে; মাঝেমধ্যে চোখ জোড়া কত ডিগ্রি বাঁকা হয়ে যেন আশেপাশের মানুষের নিকটে পৌঁছে যেতে লাগল! মনে পড়ে না, সুব্রত ভাইয়ের এত কাছে আগে কখনো যাওয়া হয়েছিল কী না! তাঁর শরীর শিউরে উঠতে লাগল! দেহে যেন কাঁটা ফুটছে!
সুব্রত প্রতিক্রিয়াহীন। সবরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার একটা অদ্ভুত শক্তি সে অনেকদিন আগেই অর্জন করেছে। না-হলে এই শীতল আবেশে নারী লোকের উষ্ণ স্পর্শ তাঁর বুকের ভিতরে যে ঢেউ তুলেনি, এমন তো না!

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাতাসের তীব্রতা এমন বেজায় যে, স্টিয়ারিং কন্ট্রোলে রাখতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। ধীর গতিতে এগোচ্ছে গাড়ি। গাড়িতে রশ্মি আছে বলেই এত সতর্কতা; নাহলে সে নিজের প্রান নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল না কখনোই।
কিছুটা পথ যাওয়ার পর সুব্রত চোখ টিপটিপ করে সহসা বলল, “প্রথমবার যখন ডাকলাম, আসোনি কেন?”
রশ্মি এখনো বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়িতে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ ছিল এতক্ষণ, সুব্রত ভাইয়ের কথাটা তাকে কিছুটা সচকিত করল। তবুও সরাসরি চোখের দিকে তাকাল না, মৃদু স্বরে বলল, “এমনিই। ভাবলাম শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট কেন দিতে যাব। বাস এসে যেতো এক্ষুণি।”
“কালকের কথাটার জন্য তোমার খুব মন খারাপ হয়েছিল নাকি?” অপরাধবোধ নয়, কৌতূহল থেকে প্রসঙ্গটা তুলল সুব্রত।
রশ্মি জবাব দিলো না। অভিমানটা যেন আবার নাড়িয়ে দিলো। যে লোকটা তাকে অমন করে অপমান করেছিল, আজ তাঁরই গাড়িতে বসে বাড়িতে যাচ্ছে সে। তাঁর আত্মসম্মানে লাগল খুব। কিন্তু করার কিছু থাকল না।
সুব্রত বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলল, “আমি মিথ্যে বলিনি কালকে। কয়লাকে ঘষে হিরে বানানোর চেষ্টা করা বোকামি। হিরের যেমন মূল্য আছে, তেমন কয়লার। কোনোটাই ফেলনা না কিন্তু। আলাদা আলাদা জায়গায়, দুটোর ডিমান্ড দু’রকম। তাই মুখের শ্যামলা রং নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার থেকে, যেমন আছো, তা নিয়ে খুশি থাকাই ভালো। শ্যামলা রঙের মেয়েদের কিন্তু হাসলে চমৎকার দেখায়! আমার মা শ্যামবর্ণা ছিলেন।”
রশ্মির হঠাৎ মনে হলো, সেদিন চিত্রার সাথে সাথে সুব্রত ভাই-ও তাঁর ঈর্ষান্বিত চাহনি লক্ষ্য করেছিল। নিজের ভুলের জন্য খুব লজ্জাবোধ হলো তাঁর। এত হিংসুটে হওয়া ভালো নয়!
সুব্রত আর কিছু বলল না। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। ঝড়ের বেগ কমেছে। সে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দ্রুত চলে এলো বাড়ির কাছে।
মোড়টার কাছে আসতেই গাড়িটাকে দেখতে পেলো রশ্মি। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, “সুব্রত ভাই, থামুন।”
সুব্রত ব্রেকে চাপ দিতেই গাড়িটা স্লিপ কেটে কিছুটা এগিয়ে এরপর ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। সামনে তাকিয়ে সে-ও গাড়িটা দেখল।
রশ্মি তাকিয়ে থাকল তীক্ষ্ণ চোখে। প্রবল বৃষ্টি ভেদ করে তাঁর চোখ স্থির হলো গাড়ির দরজায়। তাঁর মা গাড়ি থেকে নামছে। হাতে ছাতা। ছাতাটা তাঁর মায়ের নয়। বোধহয় ওই লোকটার। গাড়ি থেকে নেমে, বৃষ্টিকে পা চাপা দিয়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগল মা।
গাড়ি ঘুরিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পিছনের বসা লোকটাকে দেখতে পেলো সুব্রত। রশ্মি ফুঁসতে লাগল। সুব্রত রশ্মির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, “তুমি এমন হাঁসফাঁস করছ কেন?”
রশ্মি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আপনি বুঝবেন না।”
“লোকটা তোমার মায়ের অফিসে কাজ করে।”
“আপনি চেনেন উনাকে?” রশ্মি ভুরু কুঁচকে তাকালো সুব্রত ভাইয়ের দিকে।
সুব্রত বলল, “কয়েকবার দেখেছি, তোমার মা-কে অফিসে নিয়ে যেতো, আবার বাড়িতে পৌঁছে দিতো। লোকটাকে বোধহয় বাড়ি যেতে হয় এই পথ দিয়েই, সেজন্যই হয়তো। গাড়ির সামনে কোম্পানির সিল দেখে বুঝেছি, উনি তোমার মায়ের অফিসের উচ্চতর কোনো কর্মকর্তা।”
সত্যিটা লুকালো না রশ্মি। সহসা বিমর্ষ হয়ে বলল, “আমার ধারণা, লোকটার সাথে মায়ের কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে।”
“দুজনেই তো প্রাপ্তবয়স্ক।”
“তাই বলে?” সুব্রত ভাইয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকালো রশ্মি। বলল, “লোকটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। অশ্লীল টাইপের। কেমন বিশ্রী হাসি, চাহনি! চেহারা দেখেই মনে হয় খুব লম্পট।”
“কোন কারণে তোমার মনে হয়, যে লোকটার সাথে তোমার মায়ের কোনো সম্পর্ক আছে?”
“কারণ আছে। লোকটা প্রতিদিন মা-কে নেওয়ার জন্য এখানে অপেক্ষা করে। অত বড় একজন লোক এমনি-এমনি আমার মায়ের পিছনে পড়ে থাকবে? আমার মা-ও তাকে প্রশ্রয় দেয়।”
“হয়তো কোনো প্রয়োজনে। আজ যেমন প্রয়োজনে তুমি আমার গাড়িতে করে বাড়িতে এসেছ। তেমনি হয়তো কোনো বিশেষ প্রয়োজনে তোমার মা-কে তাঁর সাথে যাতায়াত করতে হয়। কখনো প্রয়োজনটা জানার চেষ্টা করেছিলে?”
রশ্মি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “না তো।”
সুব্রত ভাই মুচকি হেসে বলল, “একবার চেষ্টা করে দেখো। এরপর ধারণা নয়, একেবারে নিশ্চিত হয়ে যাবে উনাদের সম্পর্কের ব্যাপারে।”

রশ্মিকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলো সুব্রত। এরপর সে নিজের বাড়িতে ফিরে এলো। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে সদর দরজায় কলিংবেল চাপল।

১৩.
সে রাতে রশ্মি খুব চেষ্টা করল মায়ের সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলার। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারল না। মা-কে আজ অন্যদিনের তূলনায় বেশিই অস্থির দেখালো। ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখল সে। হাঁপাতে দেখল। ঘরেও চলে গেল খুব তাড়াতাড়ি। সে-ও নিরাশ হয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।
ঝড় বেড়ে যায় আবার। সেই সাথে প্রবল বৃষ্টি। শোঁ শোঁ আওয়াজ করছিল বাতাস। এমন বোধ হচ্ছিল রশ্মির, এই পুরোনো একতলা ভবনটা যেন ভেঙে যাবে। রাত তখন প্রায় ১২টা, হঠাৎ মায়ের আর্তচিৎকার শুনতে পায় সে। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ওঠে বিছানা থেকে। দ্রুত মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে, গলা কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করছে তাঁর মা। ঘরময় গোঙানির আওয়াজ। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাইরে প্রলয় আর ভিতরে রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক, এসব নিয়ে মায়ের ঘর আর ড্রয়িংরুম ছুটোছুটি করে সে। কখন থামবে এই তুফান? সে নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কেউ শোনে না সেই কান্নার আওয়াজ; মা যেন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল! জগৎ থেকে, তাঁর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশই।

১০ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=828118718132830&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here