শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৭
#আমিনা আফরোজ
সেই কাল রাত্রির পর কেটে গেছে পাঁচদিন। এই পাঁচদিন সন্ধ্যা আর রশিদ সাহেব কেউ একে অপরের সাথে কথা বলে নি তবে দুজনই পরিবারের অন্য সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি ওদের। এমন একটা ভাব করেছে যেন কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ওদের সামনেই আসেই নি কখনও। সবটাই স্বাভাবিক ঘটনা যেন এমন ঘটনা হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
আজ বহুদিন পর রশিদ সাহেবের বাড়িতে খুশির ধুম পরেছে।আজ যে রোদকে দেখতে আসবে। সেদিন রোদকে দেখার পর আর অপেক্ষা করেন নি জমিলা বেগম আর সামাদ মিয়া। দ্রুত রোদদের বাড়িতে খবর পাঠান তারা , প্রস্তাব দেন রোদকে দেখতে আসতে চান সেই সাথে বিয়ের কথাও পাক্কা করতে চান ওনারা। জমিলা বেগমের মতে,মেয়ে যখন তাদের পছন্দ তখন আর দেরি করে লাভ কি? তাড়াতাড়ি বিয়েটা হলেই ভালো।
রশিদ সাহেবও নেহালদের কথা শুনে আর কোন বাঁধা দেন নি। ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে মোটামুটি ভালো তথ্যই পেয়েছেন। আর তাছাড়া যেহেতু দূর্ঘটনায় বিয়ে হয়েই গেছে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সামাজিক স্বীকৃতিতে বিয়েটা দিতে চান তিনি। এমনিতেই সন্ধ্যার বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন রশিদ সাহেব।মেয়েটা নিজেকে শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে যে ভেঙে পড়েছে এইটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এইবার আশরাফকে ঢাকায় আসতে বলবেন তিনি । সেই যে উনিশ বছর আগে পরিকে নিয়ে চলে যাবার সময় দেখেছিল তারপর আর দেখা হয় নি দুই বন্ধুর। মাঝে মাঝে পুরোনো দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে রশিদ সাহেবের। ইস্ সেই সব সোনালী দিনগুলো যদি আবারো ফিরে পাওয়া যেত। কিন্তু আফসোস অতীতে ফেলে আসা দিনগুলো আর ফিরে আসে না। শুধু সারাজীবন স্মৃতির পাতায় জমা হয়ে কাঁদায়।
আজ মিসেস রাবেয়া বেগমসহ বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে এই প্রথমবার মেয়ে দেখতে আসছে বলে কথা। খুব বেশি আয়োজন না করলেও মোটামুটি আয়োজনতো করতেই হবে। না হলে যে মেয়ের বাড়ির আতিথ্যিয়তা নিয়ে নানা কথা উঠবে। তাই মিসেস রাবেয়া বেগম একাই সবদিকে তদারকি করে চলেছেন।
এদিকে শ্রাবণ বাসার দাড়োয়ানের সাথে বাজার করে এইমাত্র বাসায় ফিরল। সকাল সকাল মিসেস রাবেয়া বেগম বাজারের বড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছিল ওকে। সকাল থেকে একা হাতে বাজার করতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে ও। এত বাজার আগে কখনো করি নি শ্রাবণ। ইস্ আজ অফিসে গেলেই ভালো হতো ওর। তাহলে এত বেকার খাটতে হতো না। কেন যে গতকাল মায়ের কথামতো অফিসে ছুটি নিতে গেল। এখন আর এসব ভেবে কি লাভ। তার চেয়ে বরং ঘর্মাক্ত শরীরটা ফ্যানের বাতাসে একটু জুরিয়ে নেওয়া যাক। শ্রাবণ ফ্যানের বাতাসে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই সন্ধ্যা পানি নিয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। সন্ধ্যাকে দেখেই শ্রাবণ অসহায় গলায় বলল,
–“দেখছো বেলিফুল কাজ করতে করতে তোমার বরের কি বেহাল দশা হয়েছে?”
সন্ধ্যা শ্রাবনের এমন ছেলে মানুষি কথা শুনে মৃদু হেসে বলল,
–“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আহারে কি কষ্টটাই না পাচ্ছে আমার বরটা।”
সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি কি আমার সাথে মজা করছো বেলিফুল?”
সন্ধ্যা শ্রাবণের কথা শুনে শাড়ির আঁচল দিয়ে শ্রাবণের মুখ মুছতে মুছতে বলল,
–“এমা ছি ছি বরের সাথে কি কেউ মজা করে? আপনিই বলুন মহারাজ আপনার জন্য কি করতে পারি আমি?”
শ্রাবণ কিছু একটা ভেবে বলল,
–” তেমন কিছুই করতে হবে না বালিকা আপাতত আমার পাওনাটা আমাকে দিয়ে দাও তাতেই হবে আমার।”
–“ছি কি বলছেন আপনি?বাড়িতে যে লোকজন আছে তা কি আপনার মাথায় আছে নাকি ভুলে গেছেন শুনি?”
সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ ভাবলেশহীনভাবে বলল ,
–“আমি কি অন্য কারো বউয়ের সাথে এমন করছি নাকি? যাক বাবা নিজের বউয়ের কাছে আবদারও করতে পারবো না? এইটা কেমন কথা?”
–“আপনি তো ভালো আবদার করতে পারেন না সব সময় বদ আবদার ঘুরে আপনার মাথায়। বদ লোক একটা।”
সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ রেগে গিয়ে বলল,
–” কি বললে তুমি? আমি বদ লোক? তাহলে বদ লোকের মতো কাজ করি চলো। আজ তোমকে বুঝিয়ে দিবো বদ লোক কাকে বলে?”
শ্রাবণ কথাগুলো বলেই আচমকা সন্ধ্যাকে জরিয়ে নিল নিজ বাহুবন্ধনে। শ্রাবণের এহেন কাজে সন্ধ্যা হতবাক। লোকটার কি কোন হুঁশ-জ্ঞান নেই নাকি? ড্রয়িংরুমে কি সব শুরু করেছে? এখন যদি কেউ এসে যায় তখন কি হবে? সন্ধ্যা শ্রাবনকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো
–“আপনার কি হুশ- বুদ্ধি সব চলে গেছে নাকি ? ছাড়ুন বলছি, কেউ চলে আসবে।”
–“আসুক আমি কি কাউকে ভয় পাই নাকি?”
–“ছি ছি। কেউ দেখলে মান-সম্মান থাকবে? ছাড়ুন তো।”
–“ছাড়তে পারি এক শর্তে?”
–“শর্তটা কি শুনি।”
–” তোমাকে আজ স্বীকার করতে হবে আমি তোমার ভালো বর।”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি পৃথিবীর সব থেকে ভালো বর ।এবার তো ছাড়ুন।”
–” না এভাবে নয়।”
সন্ধ্যা অসহায়ভাবে বলল,
–“তো কিভাবে বলতে হবে?”
–” কান ধরে বলো যে আমাকে আর কোনদিন বদ লোক বলে বলবে না।”
–“কান ধরতেই হবে?”
–“হুম। তবে তোমার কাছে আরো একটা পথ আছে।”
— ” বলুন শুনি।”
–“আমাকে যদি আমার পাওনাটা বুঝে দাও তাহলে তোমার কান ধরতে হবে না। এখন বলো কোনটা করতে চাও আগে।”
–“থাক বাবা কান ধরাটাই ঠিক আছে। কিন্তু তার আগে আমাকে ছেড়ে দিন। তা নাহলে কান ধরব কিভাবে?”
–” ঠিক আছে ।তবে কোন চালাকি করার চেষ্টা করবে না বুঝলে।”
–“ঠিক আছে।”
শ্রাবণ সন্ধ্যার কথামতো সন্ধ্যাকে ছেড়ে দিতেই সন্ধ্যা দৌঁড়ে রোদের ঘরের দিকে চলে গেল। আর শ্রাবণ শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো আর মনে বলল,
–“রাতে দেখবো কিভাবে পালাও?”
এদিকে মিসেস রাবেয়া বেগম শ্রাবনকে কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে বলে ওঠলেন,
–” কাজ রেখে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কত কাজ পড়ে আছে দেখেছিস।”
–“মা তোমার কাজ দেখে মনে হচ্ছে আজকেই রোদকে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে ওরা?”
–“চুপ থাক। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে কাজ কর যা।সব কিছু ঠিকঠাক হওয়া চাই আমার ।”
–“ঠিক আছে মা। এতো চিন্তা করছো কেন? সবকিছু সঠিক সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে।”
–” হুম মুখে ফটর ফটর না করে কাজে লেগে পড়। বাড়ির আর সবাই গেলো কই? যে যার মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে আর আমি বেকার সকাল থেকে খেটে মরছি।”
–“সন্ধ্যাতো রোদের ঘরের দিকে গেল দেখলাম।”
–” হয়তো রোদকে সাজাতে গেছে। প্রিয়ন্তি আর তুলির তো সে হুশ নেই ।ওরা আছে ওদের গল্প নিয়ে। দেখি মনু কি করে? আবার কোন অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে এ মেয়ে।”
কথাগুলো বলে আবারো ফিরতি পথে চলে গেলেন রাবেয়া বেগম। শ্রাবন মাথায় এখনো ওর মায়ের কথাগুলো ঘোরপাক খাচ্ছে। ওর ফুপি আবারো কি করেছে? তাহলে শ্রাবনের অগোচরেই কিছু ঘটে গেছে?
এদিকে রোদ নিজেকে আজ নেহালের পছন্দেই সাজিয়েছে নিজেকে। নেহালের পছন্দেই লাল রঙের শাড়ি পড়েছে আজ রোদ। সেই সাথে দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি, দু-চোখে কাজল দেওয়া আর খোঁপায় পড়েছে বেশিফুলের গাজরা। রোদকে সাজানোর পর ওকে ঘিরে বসেছে প্রিয়ন্তি আর তুলি। গল্পের মূল বিষয়বস্তু নেহাল।
–“সত্যি করে বল সেদিন স্যার তোকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিল?”
–“ওনাদের বাসায়।”
রোদের কথা শুনে প্রিয়ন্তি ভ্রু-কুচকে জিঙ্গেস কলল,
–” তুই একটা ছেলের সাথে খালি বাসায় ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচতে নাচতে চলে গেলি?”
–“আজিব নাচতে নাচতে যাব কেন? ওনার বাইকে করে গিয়েছি।”
প্রিয়ন্তি রেগে বলল,
–“তা তোর ওনার সাথে খালি বাসায় কি করতে গেছিলি শুনি?”
রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিনের কথাগুলো বলতে লাগল,
–“সেদিন যখন নেহাল একটা দুতলা বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিলো সেদিন ঠিক তোদের মতো আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে যেতে চাইছিলাম না কিন্তু নেহালের জোরাজুরিতে শেষ অব্দি যেতেই হলো। বাসাটির ভিতরে গিয়ে দুজন মধ্যবয়ষ্ক পুরুষ-মহিলাকে দেখতে পাই। পরে ওর কাছ থেকে জানতে পারি মধ্যবয়ষ্ক দুজন আর কেউ নয় নেহালের বাবা-মা। আমাদের বিয়ের জন্যই গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে ওনাদের। আমাকে দেখেই মধ্য বয়স্ক মহিলাটি অর্থাৎ আমারর শাশুড়ি বলে ওঠেন,
–“মেয়েটি কে নেহাল? একে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না?”
ওনি তখন মায়ের কথা শুনে মৃদু হেসে বলে উঠলেন,
— “এর নাম রোদ যার কথা তোমাদের বলেছিলাম।”
ছেলের কথা শুনে জমিলা বেগম এবার রোদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন । মেয়েটা দেখতে তার মনের মতো হয়েছে বিধায় হাসি মুখে স্বামীর মুখপানে তাকালেন। কিন্তু স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে ওনার মুখের হাসি যেন মিলিয়ে গেলো। সামাদ মিয়া রোদকে পর্যবেক্ষন করা শেষ করে রোদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠলেন,
–“তোমার বাবার নাম কি?কয় ভাই-বোন তোমরা?”
সামাদ মিয়ার প্রশ্ন শুনে রোদের ভয় লাগল ।মনে মনে ভাবতে লাগল যদি ওনাদের আমাকে পছন্দ না হয় তখন কি হবে?কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উওর দিল,
–“জি আমার নাম নৌশিন আহমেদ রোদেলা। আমার বড় একটা ভাই আছে।”
–” ওও তা তোমার বাবা কি করেন?”
–” বাবা ব্যবসা করেন।”
–“তা বেশ। কিসে পড়ো তুমি?”
–“ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।”
রোদের কথা শুনে সামাদ মিয়া নেহালের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। তুমি বরং ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা পাকা করো। খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাই আমি।”
নেহাল বাবার কথা শুনে ঈষৎ হাসলো। যেন আগে থেকেই জানতো বাবা এমন কথাই বলবে। তারপর মৃদু হেসে বলল,
–“ঠিক আছে ।আমি ওনাদের সাথে কথা বলে দেখছি।”
এদিকে জমিলা বেগম স্বামীর কথা শুনে খুশি হলেন। তার ছেলেটি এতোদিন পর একটু সুখের মুখ দেখতে চলেছে। এখন এই শুভ কাজে সন্ধ্যার অশুভ মুখ না দেখলেই হয়।
এতোক্ষণ রোদের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল প্রিয়ন্তি আর তুলি। ওদের সাথে আরো একজন রোদের এই কথাগুলো দরজার আড়াল থেকে শুনতে পেলো। রোদের মুখে প্রানোচ্ছল হাসি দেখে মনে বলে ওঠল,
–“দোয়া করি সুখি হয়। নিজের সংসার ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো । কোন অশুভ কালো ছায়া যেন তোমার জীবনে না আসে। স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো সব সময়। ”
কথাগুলো বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গৌর বর্নের মেয়েটির ঠোঁটের কোণে প্রানোচ্ছল হাসির দিকে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রাপ্তির হাসি এইটা। প্রিয়জনকে পাওয়ার প্রাপ্তিটা বড়ই আনন্দের। এভাবেই প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠুক সকল প্রিয়সির ঠোঁটের কোনায়।
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আল্লাহর রহমতে জ্বর একটু কমলেও কাশি কমে নি এখনো। হালকা জ্বরের ঘোরে কি লিখেছি নিজেই জানি না। নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে। জানিনা আপনাদের কাছে কেমন লাগবে? গল্প পড়ে সবাই নিজেদের মতামত জানাবেন কিন্তু। সুস্থ হয়ে একটা ধামাকা পর্ব দিবো ইনশাআল্লাহ। ভালো থাকবেন সবাই। আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ)