শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৬

0
1175

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৬
#আমিনা আফরোজ

পুরো ঘর আলো-আঁধারিতে মগ্ন। ঈষৎ আলো আবার ঈষৎ অন্ধকার। এ যেন এক অন্যরকম আলোর খেলা চলছে। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে আসছে। সেই মৃদু আলোতেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে জানালার পাশে থাকা দুটি অবয়বকে।

টিক টিক শব্দে সময় তার আপন খেয়ালে ছুটে চলেছে ‌। আকাশে আজ চাঁদের ছিটেফোটাও নেই। বাইরের জগৎটা আজ নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। নিছিদ্র অন্ধকার এ রাত। আজ হয়তো কোন এক অজানা কথা সাথী হতে চলেছে এই নিকষ কালো অন্ধকারছন্ন রাতটি।

রাতের এই নীরবতা ছাপিয়ে শোনা গেল এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের ভরাট কণ্ঠস্বর । বড় গম্ভীর সে স্বর।

–” আমি জানতাম তুমি আসবে।”

পুরুষ কন্ঠ শুনতে মৃদু হেসে উঠল নারী অবয়বটি। রিনরিনে গলায় বলে উঠলো,

–” আমাকে যে আসতেই হতো বাবা। অনেক কিছু জানার আছে আমার।”

–” আমিও কখনো ভাবি নি কথাগুলো তোমাকে এভাবে বলতে হবে।”

–” আপনি নির্ভয়ে সবটা বলতে পারেন বাবা।”

মধ্য বয়স্ক লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” সহ্য করতে পারবে তো সবটা।”

–“সত্য যতই যতই হোক না কেন তাকে মেনে নিতে হয়। আমিও পারবো ইনশাআল্লাহ। ”

লোকটি আবারো দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,

–” গল্পটা শুধু তোমার অস্তিত্বের নয় এই গল্পটা আমাদের গল্প । আশরাফ , আমার, ইমতিয়াজ, পরি আর মনোয়ারার গল্প । যে গল্প শুরু হয়েছিল আজ থেকে আঠারো বছর পূর্বে, যা এখনো প্রবহমান। আমি আর আশরাফ খুব ছোটবেলার বন্ধু ছিলাম।একই গ্রাম অথ্যাৎ রূপগঞ্জেই ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে আশরাফদের বাড়ি খুব একটা দূরে ছিল না। মিনিট পাঁচেকের পথ। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম দুরন্ত স্বভাবের কিন্তু আশরাফ ছিল বরাবরই শান্ত । ওর জন্যই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বটা আরও গভীর হয়েছিল।আশরাফ আর আমি গ্রামের হাই স্কুল থেকে এসএসসি দিয়ে পাড়ি জমাই ঢাকা শহরে। ঢাকার নামি কলেজেই ভর্তি হই দুজনে। তারপর জান-প্রাণ দিয়ে শুরু করি পড়ালেখা । গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা আর যাই করুক না কেন পড়াশোনা ভালো মতোই করে। আগেই বলেছিলাম আশরাফ সব কিছুতেই সিরিয়াস ,তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রে ও ছিল খুব মনোযোগী। ওর ওমন মনোযোগ দেখে আমিও বাদরামি বাদ দিয়ে আদা জল খেয়ে লেগে পড়ি পড়াশোনায়। আমাদের এত পরিশ্রম শেষ অব্দি বৃথা যায় নি। দুই বন্ধুই এসএসসি দিয়ে ভর্তি হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । আমরা দুজন একই বিভাগে চান্স পায় । বিষয়টা কাকতালীয় হলেও এটাই সত্যি। আশরাফ আর আমি দুজনেই ইংরেজি বিভাগে চান্স পাই। সেদিন আমাদের দুই বন্ধুর খুশি দেখে কে? আমার আজো মনে আছে সেদিন আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলাম। তারপর ভার্সিটিতে আমাদের সাথে পরিচয় হয় ইমতিয়াজের। বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান ছিল সে। ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্বটা গভীর হয়। সেই থেকে তিনজনে মিলে হলাম এক প্রান।
আমরা তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে তখনই গ্রাম থেকে খবর এলো যে পরীও আশরাফের মত শহরের স্কুলে পড়তে চায়। পরি ছিল আশরাফের একমাত্র ছোট বোন। আশরাফ খুব ভালোবাসতো পরিকে। ছোট বোনের আবদার শুনে চিন্তায় পড়ে গেল আশরাফ। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় ও কোথায় রাখবে আদরের বোনকে? এই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই আশরাফের। শেষ অব্দি দু’বন্ধু মিলে ঠিক করলাম একটা বাসা ভাড়া নিব । তারপর আমিও ভাবলাম মনুকেও নিয়ে আসবো ঢাকায়। যেহেতু মনুও এসএসসি দিয়েছে তাই ওকেও ভর্তি করাবো পরির সাথে। যেই ভাবা সেই কাজ । যথারীতি দুই বন্ধু মিলে বাসা খোঁজা শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সব থেকে বেশি সাহায্য করল ইমতিয়াজ। ওর বাবার কোন এক বন্ধুর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিল আমাদের। দুজনের লেগে গেলাম বাসা সাজাতে। তারপর হুট করে একদিন গ্রামে গিয়ে নিয়ে আসলাম পরী আর মনোয়ারাকে। পরি আর মনোয়ারা অবশ্য এখানে এসে পরিচয় হয়েছিল। আসলে মনু আমার নানাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করতো তাই আগে থেকে ওদের পরিচয় ছিল না।”

এতোটুকু বলে থামনেল রশিদ সাহেব । সন্ধ্যার দিকে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে আবারও বাহিরের দূর সীমান্তে তাকালেন। এতক্ষণ যেন অতিতের গহীন অতলে ডুব দিয়েছিলেন তিনি। স্মৃতির পাতায় হাঁতড়ে বেড়াচ্ছিলেন সেই সোনালী দিনগুলো যা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। তারপর আবারো বলতে শুরু করলেন,

–“এরপর দেখতে দেখতে কেটে যায় প্রায় বেশ কিছুদিন। ততদিনে পরি আর মনুকে কলেজ ভর্তি করে দিই আর আমরাও বুফে যায় ব্যস্ততার মাঝে। ক্লাস টাইম বাদে বাকি সময়টুকু টিউশনি পড়ানো শুরু করি দুজনে । মনু আর পরির খরচতো আমাদেরই চালাতে হবে। আশরাফ অবশ্য এর ফাঁকে ছোটখাটো চাকরি খোঁজা শুরু করে দেয়। সেই সময়টুকু পরি আর মনুকে সময় দিতে শুরু করে ইমতিয়াজ। এদিকে আশরাফ রাতে ঘরে ফিরেই মনু আর পরীকেও পড়ানো শুরু করে দিলো। বলতো পড়াশোনায় কোন ছাড় দেওয়া যাবে না ওদের।ছাড় দিলেই নাকি বাদড় হয়ে যাবে ওরা। আশরাফ মনুকে ছোট বোনের মত দেখলেও মনুর কিশোরী মন অজান্তে আশরাফকে ঘিরে স্বপ্ন বুনতে শুরু করল। কিশোরী মনের সে খবর আমরা কেউই জানতাম না। কি অবাক হচ্ছ তো জীবনের ভালোবাসার কথা এমন অবস্থা কেমন করে বলতে পারলাম?”

রশিদ সাহেবের কোথায় ধ্যানন ভাঙ্গল সন্ধ্যার। এতক্ষন ও একমনে রশিদ সাহেবের কথা শুনে যাচ্ছিল । ও গল্পে এতটাই ডুবে ছিল যে ঘটনাগুলো কে যেন ও নিজে প্রত্যক্ষ করছে বলে মনে হচ্ছিল ওর কাছে। ধ্যানন ভাংলেও অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

–” তারপর কি হলো?”

–“এভাবেই চলতে লাগল আমাদের দিনগুলো। কলেজ থেকে টিউশনি, টিউশনি থেকে বাসা এটাই ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটি।ন এদিকে মনুটাও দিনকে দিন আরো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো আশরাফের মায়ায়। কিশোরী বয়স বলে কথা। এরই মাঝে আমাদের মাস্টার্স শেষ হল। কেটে গেল চার চারটা বছর। পরী আর মনু তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। সবকিছু পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয় নি আশরাফের প্রতি মনুর কিশরী মনের ভালোবাসা।
বরং দিনকে দিনটা যেন বেড়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন খবর এলো ইমতিয়াজ বাইরের দেশে যাবে পিএইচডি করতে। আমি আর আশরাফ শুনে তো রীতিমতো অবাক। হলো টা কি? যে ছেলে আমাদের ছেড়ে কি না অন্য কোথাও যেত না সে কিনা বাহিরে দেশে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য । মনে খটকা লাগলেও মুখে কিছু বললাম না দুজনে। মাস দুয়েকের মধ্যেই ইমতিয়াজ পাড়ি জমালো দূর দেশে। ইমতিয়াজের এমন পরিবর্তন আমরা দুজন কেন যেন মানতে পারছিলাম না । ততদিনে আমি জড়িয়ে পড়ি ব্যবসায় আর আশরাফও ভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে।
ইমতিয়াজের চলে যাবার মাস দুয়েকের মাথায় হঠাৎ করে পরি অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরিকে নিয়ে আমরা দুজনে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলে যায়। কিন্তু ডক্টরের কথা শুনে আমাদের মাথায় যেন বাজ পরে।পরি প্রেগন্যান্ট কথাটা শুনেই ফাঁকা করিডরে ধপাস হয়ে বসে পড়ে আশরাফ। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুটে চলে যায় পরির কেবিনের দিকে। পরির নিথর, নিস্তেজ দেহটা তখন বেড়ে শোয়ানো ছিল। দু চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছিল । মনে হচ্ছিল যেন বহুদিনের অযত্নে পদ্মফুল মুছে গিয়েছে। পরী দেখতে আসলেই পদ্মফুলের মত ছিল । ধবধবে ফরসা ছিলো ওর পুরো শরীর, কাজল কালো ছিল দুটি চোখ। যে কাউকে সম্মান করা ছিল ওর দুই মিনিটের ব্যাপার ।এমনি নজরকাড়া সুন্দর ছিল পরি‌। আশরাফ অনেক হম্বি-তম্বি করেও পরির মুখ থেকে কোন কথা জানতে পারি নি সেদিন। এভাবেই কেটে যায় বাকি দিনগুলো। তবে সেই দিনগুলো সবার জন্য ছিল বড্ড কষ্টের। পরির ঘটনা ছড়ে যায় পুরো ভার্সিটিতে । একাজ অবশ্য মনুই করেছিল। কাজটা করেছিল পুরোপুরি জেদের বশবর্তী হয়েই। আমি অবশ্য অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম কথাটা। আশরাফকে মনু অনেকবার ওর অব্যক্ত ভালোবাসার কথা বুঝিয়ে ছিলো কিন্তু আশরাফ বারংবার ফিরিয়ে দেয়েছিল ওকে। শেষে জেদের বশবর্তী হয়ে ওর কষ্টগুলো সবগুলো পরী দিয়ে মেটায়। ঠিক যেভাবে এখন তোমাকে দিয়ে তুলছে। পরীর কথা ছড়িয়ে পড়ায় আশরাফের চাকরি চলে যায় । সবাই কটুকথা বলতে শুরু করে আমাদের। অনেকেই বলতে শুরু করে আমি নাকি পরীর এমন অবস্থার জন্য দায়ী। শেষ অব্দি আশরাফ সিদ্ধান্ত নেয় পরীকে নিয়ে ও গ্রামে ফিরে যাবে । তবুও আমাকে নিয়ে এমন কথা শুনতে পারবে না ও। অনেক বুঝিয়েও আশরাফকে আটকাতে পারিনি সেদিন। মনুও আটকে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারে নি। আমাদের সবাইকে রেখে ও পরীকে নিয়ে চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। সেখানেও শুনতে হয় নানা কটু কথা। গ্রামের চেয়ারম্যান আশরাফের পরিবারকে এক ঘরে করে দেয়। পরির বাবা – মা মেয়ের এমন সর্বনাশ সইতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। আশরাফ তখন পরিকে তখন নিয়ে অকূল-পাথারে পরে । তাই পরীকে দেখাশোনা করার জন্য বিয়ে করে আনোয়ারাকে। দেখতে কেটে যায় বাকি দিনগুলো। যেদিন পরি নবজাতক শিশুকে জন্ম দেয় সেদিনই বাবার নাম বলে দেয় সবাইকে । সবাইকে বলতে আশরাফ আর আনোয়ারাকে। নবজাতক শিশুটির বাবার আর কেউ নয় আমাদের ইমতিয়াজ। আশরাফের ভয়ে নাকি ও পরিকে লুকিয়ে বিয়ে করে । তারপর নিজেকে পরীর যোগ্য করে তুলতেই নাকি পাড়ি জমায় বাহিরের দেশে। কিন্তু পরদেশে পাড়ি জমাতে পরীর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ইমতিয়াজ। পরি চায়নি আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট তাই এতদিন কিছু জানায় নি আমাদের কিন্তু পরি হয়তো সেদিন বুঝতে পেরেছিল এই পৃথিবীতে ওর সময় খুব কম তাইতো সত্যিটা বলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় অজানা দেশে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।

সন্ধ্যা কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

–” তারপর? সেই ছোট শিশুটির বা কি হলো?”

–” সেদিন আশরাফ সেই ছোট্ট শিশুটিকে পরম মমতায় কোলে তুলে নেই। তারপর শ্যাম বর্ণ শিশুটির নাম দেয় সন্ধ্যা।”

একদমে কথাগুলো বলে থামলেন রশিদ সাহেব। চশমা খুলে মুছে নিলেন অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি। সন্ধ্যা তখন নিশ্চুপ। সময় গড়িয়ে শেষ প্রহর উরিস্থিত।আর কিছু সময় বাকি। তারপর আগমন ঘটবে নতুন দিনের।

নিশ্চুপ শহরটা আজ আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কথাগুলো যেন হারিয়ে গেছে শহর থেকে। শুধু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অষ্টাদশী মেয়েটি। দীর্ঘ এই রাততি বহু বছর আগের মতোই আবারও আরো কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।

চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। প্রায় ১৪০০+ শব্দ হয়ে গিয়েছে তাই আজ আর লিখলাম। বেশি বড় হলে অনেকের কাছেই হয়তো বিরক্ত লাগবে। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আশা করি সন্ধ্যাকে নিয়ে আর কোন দ্বিধা নেই আপনাদের। ভালো থাকবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here