শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৫
#আমিনা আফরোজ
বিকেল প্রায় শেষ, মাথার উপরে নীল আকাশে কতগুলো চিল উঠছে শেষ রোদ টুকু শুষে নেবে জন্য। হালকা কুয়াশা এলোমেলো ভাবে লেপ্টে আছে চারিদিকে, শীত আসেনি বলে এখনও তারা জমে উঠতে পারেনি। চারিদিকে ধূসর আবহ ঘিরে রেখেছে, শেষ বিকেলে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামছে সন্ধ্যা।
মনোয়ারা বেগম চলে যেতেই ড্রইংরুমে নীরবতা বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। শুধু দুটি চোখ কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাবেয়া বেগমের দিকে। রাবেয়া বেগম যেন তা দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন। এখনো সময় আসেনি সন্ধ্যাকে সব বলার। তাই আর এ নিয়ে কোন কথা না বাড়িয়ে সন্ধ্যের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। তারপর সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বললেন,
–“কলেজ থেকে এসেছো, যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো।”
সন্ধ্যা ছলছল বৃষ্টিতে রাবেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–” ফুপি এসব কি বলে গেল মা? আমি কি তবে আমার বাবার মেয়ে নয় আর এই পরিটাই বা কে?আমার সাথেই বা তার কি সম্পর্ক?”
সন্ধ্যার কথা শুনে মনোয়ারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–মনুর কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল সন্ধ্যা। যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো।”
তারপর সন্ধ্যাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাবেয়া বেগম নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। যেন সন্ধ্যার থেকে এক প্রকার পালিয়েই চলে গেলেন। সন্ধ্যা তখনো রাবেয়া বেগমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সন্ধ্যা শতভাগ নিশ্চিত রাবেয়া বেগম ওর কাছে কিছু লুকাচ্ছেন? কিন্তু কি এমন লুকাচ্ছে? ওর মনের কোণে উদয় হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তরই বা কার কাছে পাবে?
এদিকে তুলি তখনও নীরব দর্শকের মত তাকিয়েছিল সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার মত আজ নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেছে ও। মনোয়ারা আর রাবেয়া বেগমের ভাবভঙ্গি দেখে ও কেমন যেন রহস্যের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে তবে এ রহস্যে যে ও একা উন্মোচন করতে পারবে না এইটা শতভাগ নিশ্চিত তুলি।তাই যত দ্রুত সম্ভব রোদ আর প্রিয়ন্তির সাথে কথা বলতে হবে ওর। আপাতত এসব চিন্তা দূরে সরিয়ে তুলি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সন্ধ্যার দিকে।
তুলিকে সামনে দেখে সন্ধ্যা দুচোখ যেন আবারও অশ্রুতে ভরে গেল । নিজেকে কোন রকমে সামলিয়ে নিয়ে বললো,
–“এসব কি হচ্ছে বলতো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ?”
সন্ধ্যাল কথা শুনে তুলিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“ভাবি তুমি ঠিক যেখানে আটকে আছো আমিও ঠিক সেখানেই আটকে আছি তবে চিন্তা করো না এই রহস্যর শেষ দেখে ছাড়বো আমি।”
–“তুমি কি পারবে?”
–“পারতে তো আমাকে হবেই ভাবি। তুমি চিন্তা করো না । আপাতত ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি।”
–” ঠিক আছে দেখো কি করতে পারো তুমি।”
কথাগুলো বলে সন্ধ্যা ওর চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সন্ধ্য চলে যেতেই তুলিও ওর মায়ের ঘরের দিকে চলে গেল।অনেক প্রশ্ন জমে আছে ওর মনে। ওর সব প্রশ্নের উত্তর ওর মায়ের থেকেই জানতে পারবে ও। আর এই পরি আর আশরাফ নামটা এর আগেই কোথাও শুনেছে তুলি। কিন্তু কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারছে না ও।দেখা যাক মায়ের কাছ থেকে কিছু জানতে পারে কি না?
এদিকে মনোয়ারা বেগম ড্রয়িংরুম থেকে নিজের ঘরে এসে আয়েশ করে বিছানায় বসলেন। সন্ধ্যাকে কথাগুলো বলতে পেরে অনেকটাই ভালো লাগছে ওনার। আহ কতদিনের মন-বাসনা আজ পূরণ হয়েছে ওনার। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই বিছানা থেকে ওঠে চলে গেলেন সবুজ রঙের ট্রাংকটির দিকে। তারপর রং চটে যাওয়া ট্রাংক খুলে একটা সাদা -কালো ছবি বের করে আবারো বিছানায় গিয়ে বসলেন তিনি। ছবিটি একজন শ্যমবর্ণ সুন্দর পুরুষের যাকে কি না এক সময় মনোয়ারা বেগম পাগলের মতো ভালোবাসতেন। কিন্তু নিয়তির ফেরে তার এক-পাক্ষিক ভালোবাসা পূর্ণতা পায় নি। ভালোবাসতেন বললে ভুল হবে এখনো ভালোবাসেন বোধহয় নাকি ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে গিয়ে ঘৃণায় রূপ নিয়েছে তা কে জানে।
মনোয়ারা বেগম সাদা-কালো ছবিটির দিকে তাকিয়ে ফিশেল হেসে বললেন,
–” আজ আমি খুব খুশি জানেন তো। সেদিন আমি ছোট বলে আমার ভালোবাসাকে আবেগ বলে দূরে গিয়েছিলেন। আপনার জন্য কত কষ্ট পেয়েছি জানেন। সেই কষ্ট আমি সুদে আসলে ফেরত নিবো আপনার থেকে। খেলা তো কেবল শুরু হয়েছে । আরো অনেক কিছু ঘটার বাকি আছে এখনো। আপনার আদরের পালিত মেয়েকে দিয়েই আমি আমার কষ্টের শোধ তুলব। তখন বুঝতে পারবেন প্রিয় মানুষটি হারিয়ে গেলে কেমন লাগে।”
ছবিতে থাকা যুবকটি তখনো স্থির হয়ে রইল যেন মনোয়ারা বেগমের কথাগুলো সেদিনের মতো আজো কিছু শুনতেই পায় নি । ছবির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই মনোয়ারা বেগম কেঁদে ওঠলেন। বিড়বিড় করে বলল,
–“কেন সেদিন ফিরিয়ে দিলেন আমায় মাষ্টার মশাই। সেদিন যদি আমাকে ফিরিয়ে না দিতেন তাহলে আজ হয়তো আমাদের পরিস্থিতিটা অন্যরকম হতো। আমিও পেতাম আমার সুখের ঠিকানা। কেন এমন করলেন?”
মনোয়ারা বেগম আর্তনাদ করে কাঁদছিলেন ঠিক তখনিই ঘরে ঢুকল তুলি। ঘরে ঢুকে মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে ভড়কে গেল ও। এর আগে কখনো মাকে এমন করে কাঁদতে দেখে নি তুলি। মায়ের দিকে তাকাতেই তুলির নজরে এলো মনোয়ারা বেগমের হাতে থাকা সাদা-কালো ছবিটি। এর আগেও মায়ের হাতেই বেশ কয়েকবার এই ছবিটি দেখেছে ও। কিন্তু ছবিটির প্রসঙ্গে মাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি ওর। তুলি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। হয়তো এখনো তুলির উপস্থিতি হয়তো এখনো বুঝতে পারে নি মনোয়ারা বেগম।
–“মা এভাবে কাঁদছো কেন?”
হঠাৎ কারো আওয়াজ পেতেই ছবি থেকে মুখ ঘুরিয়ে আগন্তকের দিকে তাকালেন মনোয়ারা বেগম। তুলিকে দেখতে পেতেই হাতে থাকা ছবিটি শাড়ির ভাঁজে লুকালেন তিনি। তারপর আলতো করে চোখের কোনে লেগে থাকা পানি মুছে জিজ্ঞেস করলেন,
–“তুই কখন এলি?”
–“এসেছি তো বেশ কিছুক্ষণ । কিন্তু তুমি কান্না করছিলে কেন?কি হয়েছে আমাকে বলো না মা?”
–“তোর পড়াশোনা নেই । সারাদিন শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়াস। তোর জন্য নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে ভাইয়ের এখানে পড়ে আছি আমি আর তুই কি না স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিস।”
তুলির মায়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা যে ইচ্ছে করেই ওর কথা এড়িয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে ও। এর অর্থ এখন হাজার চেষ্টা করেও মায়ের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না ও। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল তুলি। পরে না হয় আর একবার চেষ্টা করে দেখবে ও। আপাতত এখন মাকে কিছুটা সময় ওনার নিজের সাথে কাটাতে দেওয়া যাক।
এদিকে নেহাল মিনিট পাঁচেকের মাথায় রোদকে কোলে নিয়ে একটি কাঠের দরজার সামনে এসে দাড়ালো। রোদকে নিয়ে দু -তলা অব্দি উঠতে বেশ হাপিয়ে গেছে ও। রোদকে পাশে দাঁড় করিয়ে কলিংবেল চাপল নেহাল। রোদকে কোলে থেকে নামালেও হাত ছাড়েনি নেহাল। বলা তো যায় না এই মেয়ের মাথায় কি চলছে। যদি আবার দৌড় দেয়? তখন কি হবে? তখন যে ওর প্ল্যানের বারোটা বেজে যাবে।
এদিকে রোদ এতক্ষণ নেহালের দিকেই তাকিয়েছিল। ও যেন অন্যরকম এক জগতে ছিল এতোক্ষন। যেখানে ছিল কেবল ওর আর এই কাংখিত পুরুষটির অস্তিত্ব।
কলিংবেলে চাপার মিনিট দুয়েকের মাথায় সামনে থাকা কাঠের দরজাটি খুলে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক মধ্যবয়ষ্ক মহিলা। পরনে তার সাদা রঙের শাড়ি জড়ানো। শাড়িটি অনেকটা শ্রাম্য রীতিতেই পড়েছেন মধ্যবয়ষ্ক মহিলাটি। সাদা শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠেছে ছোট ছোট কালো রঙের ফুল।
রোদ আর মধ্যবয়ষ্ক মহিলাটি একে অপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন কিছু বুঝার চেষ্টা করছে দুজন। নেহাল দুজনের দিকে তাকিয়ে হালকা কেশে বলে উঠলো,
–“দুজন দুজনের দিকে এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?আগে ঘরে আসতে দাও তারপর দেখো।”
নেহালের কথা শুনে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন ভদ্র মহিলাটি। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।
রোদ নেহালের সাথে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল সোফায় বসে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ খবরের কাগজ পড়ছেন আর তার পাশেই বসে আছে তখনকার সেই ভদ্র মহিলাটি। রোদ ওনাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেহালের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
–“এনারা কারা?আর আপনিই বা আমাকে এখানে নিয়ে আসলেন কেন?”
নেহালও রোদের মতো ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল,
–“ছি নিজের শ্বশুর-শ্বাশুড়িকেও চিনতে পারছো না তুমি? এ তো ভারী অন্যায়।”
নেহালের কথা শুনে রোদের শিড়দাড়া বেয়ে যেন শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল। ওনারা তাহলে নেহালের বাবা-মা । কিন্তু ওনারা তো গ্রামে থাকে বলে শুনেছিল ও। নেহাল কখন নিয়ে আসল ওনাদের?তাহলে এই ছিল নেহালের সারপ্রাইজ। ইস্ আগে জানলে ভালোভাবে পরিপাটি হয়ে আসতো ও। এখন তো ওকে পুরো কাজের মেয়ে মতো লাগছে।
রোদকে চুপ করে থাকতে দেখে নেহাল রোদের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। হঠাৎ হাতে টান পরায় চমকে উঠল রোদ সেই সাথে মনে চেপে বসল অজানা ভয়। যদি ওনারা ওকে পছন্দ না করেন তখন কি হবে?
রাত তখন মধ্যরাত । চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আর নেই কোন দূরপাল্লার গাড়ির শব্দ। শুধু রাস্তার পাশে নিয়নবাতিগুলো এই নিস্তব্ধ রাতের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে জেগে রয়েছে। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে শ্রাবনের পাশ থেকে ওঠে ভীরু পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল স্টাডি রমের দিকে। সন্ধ্যা শতভাগ নিশ্চিত সেখানে ও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির দেখা পাবে আর তার সাথে উওর পাবে ওর অজানা সকল প্রশ্নের। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সন্ধ্যা পৌঁছে গেল স্টাডি রুমের সামনে। দরজা হালকা খুলে দেখলো পুরো ঘর আলো-আধারিতে মগ্ন। এই ঈষৎ আলো – অন্ধকারেই থাই গ্লাসের সামনে একজনের ছায়া দেখতে পেল ও। সাথে সাথেই সন্ধ্যার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তারপর দরজা হালকা ভিরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল সেই ব্যক্তিটির কাছে।
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমরা গল্পের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আগামি পর্বে হয়ত সন্ধ্যার বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারবেন। আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।)