ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_১৬
#সুলতানা_সিমা
শীতের সকাল বরাবরই কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। তবে আজ যেন একটু বেশিই ঘুমাচ্ছে। বেলা ১১টা বাজে। এখনো মনে হচ্ছে সাত আটটা বাজে। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কুয়াশার ছোঁয়া লেগে গাছের পাতা আর ঘাসে জমেছে শিশির বিন্দু। আকাশের অভিমানী সূর্যটাও আজ উঁকি দিচ্ছেনা। পৃথিবীর সাথে যেন আড়ি দিয়েছে সে। সূর্যের দেখা না মিলায় কুয়াশারাও যেন আনন্দে উল্লাস দিয়ে চারদিকে ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। ডাক্তার বাড়ির উঠুনে রাখা প্লাস্টিকের টেবিল ও চেয়ার কুয়াশার ছোটাছুটিতে ভিজে একাকার। দেখে মনে হচ্ছে রাতে খুব করে বৃষ্টি হয়েছিলো আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সবকিছু। শুকনো একটা কাপড় দিয়ে চেয়ার ও টেবিলটা মুছে নিলেন শায়লা বেগম। উঠুনে বসে সকালের চা খাওয়ার অভ্যাসটা শায়লা বেগমের রক্তে মিশে গেছে। তিনি কিছুতেই সকালের চা উঠুনে না বসে খেতে পারেন না। খেতে যে পারেনই না সেটা কিন্তু নয়। খেতে পারেন,কিন্তু সেটা উনাকে তৃপ্তি দেয়না। ছোটবেলায় উনার বাবা হাসনাত চৌধুরী উঠুনের বসে চা খেতেন। উনার দুই উরুতে দুই মেয়েকে বসিয়ে রেখে চা খেতেন আর জোরে জোরে গল্পের বই পড়তেন। সেই থেকে তিনিও এমন হয়ে গেছেন। বই পড়ে পড়ে চা খান আর অনুভব করেন উনার বই পোকা বাবাকে। উনার বাবার স্বভাবটা পেয়েছে মিহান। সেও তাঁর দাদার মতো বইকে খুব পছন্দ করে। তাঁর মতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের ভালো থাকার বস্তু হচ্ছে বই। শায়লা চৌধুরীও সেটাই ভাবেন। সামনে একটা মোটা বই নিয়ে বসেছেন তিনি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বইয়ের পৃষ্টা উল্টালেন,ঠিক তখনই মনসুর সাহেব দ্রুত পায়ে এসে গেটের ভেতর ঢুকলেন। শায়লা বেগম অবাক হয়ে থাকান। উনি চেম্বারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছেন আধা ঘন্টা হবে। এখনই চলে আসলেন? মনসুর সাহেব আশেপাশে না থাকিয়ে সোজা ভেতরে প্রবেশ করলেন। শায়লা বেগম চায়ের কাপ আর বই রেখে ভেতরে গেলেন। মনসুর সাহেব সোফায় বসে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছেন। পর পর দুগ্লাস পানি খেলেন তিনি। উনাকে দেখে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। শায়লা বেগম উনার পাশে বসে বললেন,”কি হয়েছে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ফিরে আসলে যে কিছু ফেলে গেছো?” মনসুর সাহেব কিছু বললেন না। উনি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। শায়লা বেগম আরেক গ্লাস পানি দিলেন। মনসুর সাহেব পুরোটা খেয়ে নিলেন৷ তবুও উনাকে দেখে তৃষ্ণার্ত লাগছে। যেন কতো কাল পানি খাননা তিনি। গলা যেন উনার মরুভূমি হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে উনার। গলার টাইটা টা ডিলে করে হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছলেন। শায়লা বেগম বিচলিত হয়ে বললেন, “এতো অস্থির লাগছে কেন? কি হয়েছে বলো?” মনসুর সাহেব বললেন,”শাওন কই?
_চা নাস্তা করে আবার ঘুমিয়ে গেছে। তাঁর নাকি ঘুম হয়নি।
_ওকে ডেকে নিয়ে আসো।” উনার গলা গম্ভীর শুনাচ্ছে। শায়লা বেগম কোনো প্রশ্ন না করে উপরে গিয়ে শাওনকে ডাকলেন। শাওনকে ডেকে তুলে উনি আবার ড্রয়িংরুমে আসলেন। কিছুক্ষণ পরে হাই তুলতে তুলতে শাওন নিচে নেমে এলো। শায়লা বসতে বললেন। শাওন বসে প্রশ্ন করলো,” কি হয়েছে এতো সকাল সকাল কি বলবা তোমরা?” শাওনের কথায় শায়লা বেগম বললেন,”এতো সকাল মানে? জানিস কয়টা বাজে? একবার উঠে ঘুমিয়ে এখনো সকাল রয়েছে তোর?” মনসুর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “রাত তিনটায় কই থেকে ফিরেছিলে?” শায়লা বেগম অবাক হয়ে মনসুর সাহেবের দিকে তাকালেন। শাওন বলল,”উত্তরের মাঠে গিয়েছিলাম। আম্মুকে তো বলেই গেছিলাম।
_কেন গিয়েছিলে?
_ব্যাডমিন্টন খেলতে।
_কখন গিয়েছিলে?
_বারোটার দিকে?” মনসুর সাহেব আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। শাওনের চোখে মুখে বিরক্তির চাপ। হয়তো ঘুম থেকে তুলেছেন বলে সে বিরক্ত। নয়তো বাবার এমন প্রশ্নে সে বিরক্ত। নয়তো বা অন্যকিছু। মনসুর সাহেব বললেন,”উত্তরের মাঠে ইমনের কাটা লাশ পাওয়া গেছে।” মনসুর সাহেবের কথায় শায়লা বেগমের মাথায় বাজ পড়লো। শাওন স্বাভাবিক ভাবেই বলল “কখন এসব হলো? আমরা তো রাত দুটো পর্যন্ত ওখানে ছিলাম?”
মনসুর সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
_দুটো পর্যন্ত ওখানে ছিলে বাকি সময় কই ছিলে তুমি? রাত তিনটায় বাড়ি ফিরলে যে?” মনসুর সাহেবের কথা শেষ হতেই শায়লা বেগম বললেন,”আচ্ছা বাবুল ভাইয়ের সাথে কাদের এমন শত্রুতা, কে এমন করে তাদের সাথে?” শাওন বলল,”নির্বাচন আসলে এরকম ঘটনা ঘটেই আম্মু। ইমনকে যতই ভালো দেখাক না কেন ও তো রাজনীতি করতো। ওর শত্রুর অভাব আছে?” শাঞ্জু শাওনের ফোন নিয়ে এসে বলল,”ভাইয়া তোমার ফোন।” শাওন ফোন হাতে নিলো। তাঁদের গ্রামের একটা ফ্রেন্ড ফোন দিচ্ছে হয়তো ইমনের কথা বলবে। শাওন আসছি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। মনসুর সাহেব গম্ভীর মুখ করে বসে রইলেন। কিছু একটা বিষয় উনাকে খুব ভাবাচ্ছে। বিষয়টা ভেতরে ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে উনাকে।
___________________________
শান্তি চৌধুরী গোমড়া মুখ বানিয়ে বসে আছেন। উনার সামনে মেঝেতে বসে কান ধরে আছে মিহান। শান্তি চৌধুরীর মিহানের দিকে তাকাচ্ছেন না। খুব রাগ হয়েছে উনার। কাল দুপুরে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে আজ এক দুপুরে বাসায় আসলো। এতোদিনে দেশে এসেছে বলে পুরো একটাদিন বন্ধুদের দিতে হবে? তাঁর বন্ধুরা নাকি ছাড়ছিলো না। কেন সে বলতে পারেনি আমার দাদুমনি রাগ করবে? শান্তি চৌধুরীর বৃদ্ধ অবুজ মনটা অভিমানে ভারি হয়ে আছে। মিহান অনেক্ষণ কান ধরে বসে থাকতে থাকতে উঠে তাঁর দাদীর পাশে বসলো। উনি একটু সরে বসলেন। মিহানও একটু সরে উনার আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসলো। উনি আবার সরে বসলেন। মিহানও আবার উনার গা ঘেঁষে বসলো। এভাবে করতে করতে শান্তি চৌধুরী একেবারে খাটের সাথে চেপে গেলেন। মিহান উনার পাশ ঘেঁষে বসে বলল,”ইশ আমার রোমান্টিক বুড়িটা দেখি ভালোই নাটক করতে জানে। তো দাদুভাইয়ের সাথেও এমন করতা বুঝি?” শান্তি চৌধুরী অভিমানী স্বরে বললেন,”
_সর তুই আমার সাথে কথা বলবি না।
_কথা বলার জন্য একটা বউ এনে দিলেই তো আর তোমাকে জ্বালাবো না। আমাকে বিয়ে করালেই পারো?” শান্তি চৌধুরী ভেংচি কেটে বললেন,”যা সর তোরা তো একা একাই বিয়ে করতে পারিস।” মিহান দুহাতে শান্তি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলল,”
_উঁহু। বড় বউয়ের সাইন ছাড়া বিয়ে করলে সোজা জেলে যেতে হয়। তাই আমার বিয়েতে আর কেউ থাকুক বা না থাকুক তোমাকে তো থাকতেই হবে।” শান্তি চৌধুরী কিঞ্চিৎ হাসলেন। মিহানের কান টেনে বললেন,”বিয়ে করে বউ নিয়ে আসলে তখন তো আমাকে তোর চোখে পড়বে না। তখন তোর সুন্দরী বউকে নিয়েই পড়ে থাকবি।
_ওর বউ কী সুন্দরী হবে নাকি দাদুমনি। ওর বউ তো একটা পেত্নী হবে দেইখো।” কথাটা বলতে বলতে ইশি এসে রুমে ঢুকলো। মিহান বলল,”আবার বউ সুন্দরী হোক বা না হোক। আমার বউকে বই পোকা তো হতেই হবে।” ইশি আগ্রহী স্বরে বলল”
_বই পোকা হলেই বিয়ে করবি?
_সেটা তোর ভাবতে হবেনা যা সর।
_দেখেছো দাদুমনি? ও এখনি ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। বিয়ে করলে তো আমাদের ঘরেই রাখবে না।
_তোদের ঘরে রেখে বিয়ে করবো নাকি? আগে তোদের ঘর থেকে বিদায় করবো তারপর বিয়ে করবো।” ইশি মিহানকে ভেংচি কাটলো। মিহান হেসে উঠল। তাঁর গজ দাঁতের হাসি দেখে ইশি প্রতিবারের মতো এবারও বেহায়া চোখে তাকিয়ে থাকলো। শান্তি চৌধুরীর রাগ ভাঙিয়ে মিহান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। খুব খিদা লাগছে তাঁর। কিন্তু ফ্রেশ না হয়ে কিছু খেতেও পারবে না। গায়ের শার্ট খুলে ফ্রেশ হয়ে এসে একটা টিশার্ট পড়লো। তারপর দুটো শার্ট হাতে নিয়ে লুপার রুমে গেলো। লুপা ছবি আঁকছিলো। ছবি আঁকতে সে অনেক পছন্দ করে। করতেও পারে খুব সুন্দর করে। মিহান লুপাকে বলল,”ওই আমার শার্টগুলো ধুয়ে দে।” লুপা কিছু বলল না। মিহান বলল,”কি হলো শুনছিস না নাকি? আমার শার্টগুলা ধুয়ে দে।
লুপা ছবি আঁকতে আঁকতে বলল”
_আমি পারবো না।
_দিয়ে দে। তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
_সেটা তো দেশে আসছো থেকেই বলছো।
_দাদুমনির জন্যই তো বের হতে পারিনি। দেখ আসার পরে কাল বের হলাম বন্ধুরা ছাড়েনি তাই আসতে পারিনি এতেই সে রেগে গেছে। এবার নিয়ে যাবো প্রমিজ।
_আগে নিয়ে যাও তারপর এসে ধুয়ে দিবো।
_ওকে একটা ধুয়ে দে একটা আমি দিচ্ছি।
_ না আমি পারবো।
মিহান কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে বলল ”
_মুখে মুখে তর্ক শিখে গেছিস না? আম্মুকে গিয়ে বিচার দিবো?
_যাও না আমিও বলে দিবো তুমি সিগারেট খাও।” মিহান অসহায় চোখে তাকালো৷ যবে থেকে লুপার কাছে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা খেয়েছে তবে থেকেই লুপা তার কথা শুনেনা। ধমক দিলে বলে আব্বুকে গিয়ে বলে দিবো তুমি সিগারেট খাও। দোষটা আসলে মিহানের। লুপা তাকে সিগারেট খেতে দেখে কিছু না বলে চলে আসছিলো। মিহান ভেবেছিলো তাঁর বাবার কাছে বিচার দিতে যাচ্ছে তাই সে দৌড়ে এসে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করে বলছিলো কাউকে বলিস না প্লিজ। এইতো হলো। লুপা যেনে গেছে এটা মিহানের দূর্বল জায়গা। সেই থেকে কথায় কথায় উল্টা ধমক দেয় সে। মিহানও ভয় পায় কারণ একবার যদি তাঁর বাবা শুনে ফেলেন সে সিগারেট খায় তখন উনি মিহানকে ফ্রিতে একটা থাপ্পড় দিবেন। এই বাড়ির কেউ সিগারেট খায়না। তাঁর দাদাও নাকি খেতেন না। লুপা আবার বলল,
_কি হলো বলবো নাকি গিয়ে?
মিহান কোমল গলায় বলল,”আচ্ছা ধুয়ে দে আমি তোকে পাঁচশো টাকা দিবো প্রমিজ।
_তুমি ধুয়ে দাও আমি তোমাকে এক হাজার টাকা দিবো।” মিহান কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো পরে পকেট থেকে দুটো কিটক্যাট বের করলো। তারপর বলল, “চকলেট এনেছিলাম তোর জন্য। নিজেই খেয়ে খেয়ে কাপড় ধুচ্ছি। থাক তুই।” মিহান চলে যেতে লাগে। লুপা দৌড়ে গিয়ে মিহানের হাতের শার্ট ধরে টান দিয়ে বলে,”আমিই দিচ্ছি দাও।
_না না তোর লাগবে না তুই ছবি আঁক যা।
_আমি পারবো তো। তুমি যাওনা বই পড়ো গিয়ে। ওই যে তুমি বলোনা”বই পড়ো বেশি করে, যেন বইয়ে নেশা ধরে।” মিহান শার্ট দিয়ে বলল,”আচ্ছা যা,এতো করে যখন বলছিস তাহলে নে ধুয়েই দে।” শার্ট দিয়ে মিহান চলে যেতে লাগে চকলেট দেয়না। লুপা দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,” চকলেট দাও খেয়ে খেয়ে ধুয়ে দিবো।” মিহান চকলেট দিয়ে তাঁর গজ দাঁতের মিষ্টি হাসিটা দিয়ে নিচে খেতে চলে গেলো। সে আগে থেকেই জানতো লুপা কথা শুনবে না। তাই চকলেট নিয়েই গেছিলো।
____________________________
দিহানের খুব রাগ হচ্ছে অরিনের উপর। আধা ঘন্টা ধরে অরিনের ফোন ওয়েটিংয়ে আছে। দিহানের মেজাজ এতো পরিমাণ খারাপ হয়েছে ইচ্ছে করছে তমালপুর গিয়ে অরিনকে মাথায় তুলে একটা আছাড় দিতে। এতো কথা এই মেয়েটা কার সাথে বলছে? এই নাম্বারে কে ফোন দিতে পারে? কে জানে এই নাম্বার? রাগে দিহান ফোনটা আছাড় মেরে ফেললো। এই মূহুর্তে অরিনকে হাতের কাছে পেলে টাসিয়ে কানের নিচে দুটো দিতো। এতো সাহস পায় কই পেয়েটা? তাঁর কি খেয়াল নাই দিহান তাকে এখন ফোন দিবে। কিছুক্ষণ পরে মেঝে থেকে ফোন তুলে আনলো। ভাগ্যিস ফোনের কিছু হয়নি। আবারও অরিনকে ফোন দিলো এখনো ওয়েটিং বলছে। রাগে দিহান নিজের চুল টেনে ধরলো। দিশা এসে বলল,”ভাইয়া খেতে আয়।” দিহান ঝাঁঝালো গলায় দিশাকে বলল,”খাবো আমি যা বের হ।
_আরে কি হয়েছে তোমার?
_কিছু হয়নি যা তো এখান থেকে।” দিশা খেয়াল করলো দিহানের চোখের কোণে পানি জমে আছে। দিশা দিহানের পাশে বসে দিহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,”ভাইয়া তোর কী হয়েছে?” দিহান দিশার হাত ধরে তাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাগে তাঁর মাথা ফেটে যাচ্ছে। অরিন এতোক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে যে তাঁর কথা ভুলেই গেলো? আবার অরিনকে ফোন দিলো। এখনো ফোন ওয়েটিংয়ে আছে। দিহান লাগাতার ফোন দিতেই থাকলো। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ফোন ওয়েটিং বলল তারপর বন্ধ। রাগে কষ্টে দিহানের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। অরিনের উপর যতটা রাগ হচ্ছে তার থেকে দ্বিগুণ হচ্ছে অভিমান।
সেলিনা বেগমের ছোট মেয়ে তানিয়া কাল রাতে বিএফের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। সেলিনা বেগম মেয়েকে মেরে ধরে ফোন নিয়ে গেছেন। গ্রামের সব থেকে বাজে ছেলের সাথে উনার মেয়ে প্রেম করে। লেখাপড়া করাচ্ছেন কি এমন ছেলে হাতে তুলে দেওয়ার জন্য? রাগে দু’একটা মেরেছিলেন। ফোন এনে আলমারিতে রেখে দেন। তারপর মেয়েকে চোখে চোখে রাখেন যেন উল্টা পাল্টা কিছু না করে। ইমনের লাশ এসেছে তিনটায় তখন সেলিনা বেগম ইমনদের বাড়িতে যান। আর এই সুযোগেই উনার মেয়ে অরিনের ফোন নিয়ে যায় কিছুক্ষণ কথা বলে দিয়ে দিবে বলে। অরিন না বলেছিলো কিন্তু তানিয়ার অনেক জোরাজোরিতে দিতে হলো। সেলিনা বেগম সন্ধ্যা ছয়টায় বাড়িতে আসেন। উনি চলে আসায় তানিয়া অরিনের ফোন এনে দিতে পারেনা। উনি টয়লেটে গেলে এই সুযোগে তানিয়া ফোন দিয়ে যায়। তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। অরিন ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ফোন অফ৷ অরিনের কান্না পেলো। দিহানের গলা শুনার জন্য দম আটকে আসছে তাঁর। আল্লাহ জানে দিহান কয়টা ফোন দিয়েছে। অরিন ফোন চার্জে দিয়ে ফোন অন করলো। ডায়েলে গিয়ে দেখলো দিহানের ১০০+ ফোন। অরিনের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠল। দিহানের নাম্বারে ডায়েল করলো অরিনের ফোনে ব্যালেন্স নাই বলছে। অরিন অবাক হলো। তাঁর ফোনে তো টাকা ছিলো। কালই দিহান ফ্লেক্সি দিলো। অরিন ইমারজেন্সি ব্যালেন্স আনতে চায় মেসেজ আসে তার নাম্বারে অলরেডি লোন নেওয়া হয়ে গেছে। অরিনের এবার তানিয়ার উপর প্রচন্ড রাগ হয়। প্রথমে তাঁর ফোনের টাকা শেষ করলো তারপর লোন এনেও শেষ করলো? অরিন ডাটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে গেলো। দিহান অনলাইন নাই। অরিন অনেক গুলা মেসেজ দিয়ে ফোনটা রেখে পড়তে বসলো। কিন্তু পড়ায় তাঁর মন বসছে না। একটুপর পর গিয়ে মেসেজ চেক করছে দিহান সিন করছে কিনা। এভাবে করতে করতে রাত দশটা বেজে যায় কিন্তু দিহান অনলাইন আসেনা। অরিনের কান্না চলে আসে। তাঁর মায়ের ফোনেও ব্যালেন্স নাই যে ফোন দিবে। অরিন প্রতিটি মিনিটে গিয়ে গিয়ে দেখছে দিহান মেসেজ সিন করেছে কিনা। বুক ভরা আশা নিয়ে যায় দিহান অনলাইন এসেছে এটা ভেবে কিন্তু বার বার নিরাশ হয়ে ফিরে আসছে। জহুরা বেগম খেয়ে ঘুমিয়ে যান। অরিন খায়নি তাঁর কান্না থামছে না। পড়ার টেবিলে বসে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে সে। রাত ১১টায় ফোন দেয় দিহান। অরিন তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে। ফোন ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠে সে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”এখন আমার কথা মনে পড়লো আপনার?
অরিনের গলা শুনে দিহান চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম ছাড়ে। বুকটা হাহাকার করছে তাঁর। অরিনের গলাটা শুনার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ছিলো। তাঁর অভিমানী মস্তিষ্ক বলছিলো আজ রাতে অরিনকে ফোন দিবেনা৷ কিন্তু সে থাকতে পারেনি। আর কিছুক্ষণ গেলে যেন মরেই যেতো। ফোনের ওপাশ থেকে অরিনের ফ্যাসফ্যাসে কান্নার শব্দ আসছে। দিহানের বুকে চিনচিন ব্যথা করছে। ধরা গলায় বলল,”কান্না থামাও।
_এতোক্ষণ ফোন না দিয়ে থাকতে পারলেন তাইনা? একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
_বলছিনা কান্না থামাবে? কান্না থামাও।” অরিন কান্না থামালো না সে কেঁদেই যাচ্ছে। দিহানের এতোক্ষণ কান্না পাচ্ছিলো এবার তাঁর কান্না চলে আসলো। অরিনের কান্নার ফুঁপানো শব্দগুলো তাঁর বুকের পাজর ভেঙে গিয়ে কলিজায় লাগছে। দিহান ভেজা গলায় অরিনকে বলল, “কান্না থামাবে নাকি ফোন রেখে দিবো?” অরিন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু তাঁর নাক টানার শব্দ আসছে। দিহান বলল,”খাইছো?”
অরিন কিছু বলল না। সে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাচ্ছে। কথা বলতে গেলে তার কান্না উথলে উথলে পড়বে। দিহান আবার বলল,”কি হলো বলছো না কেন খাইছো?” অরিন এবারও চুপ। দিহান বলল”ওকে ভালো থেকো। বায়।” অরিন চট করে বলল,”
_খে খে খেয়েছি।” কথাটা বলে অরিন কিঞ্চিৎ শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠলো। দিহান গম্ভীর গলায় বলল, “দুপুরে কার সাথে কথা বলছিলা?” অরিন দিহানকে একে একে সবকিছু বলে দেয়। সব শুনে দিহানের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আদর মাখা কণ্ঠে বলল,”বউপাখি কেঁদো না প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
_আপনি জানেন আপনি ফোন দেননি বলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
_আমারও তো কষ্ট হচ্ছিলো সোনা। জানো ইচ্ছে করছিলো তখনি তোমার কাছে ছুটে যাই৷ [একটু থেমে] উপর ওয়ালা আমাদের মাঝে এতো দূরত্ব কেন দিলো সোনা? ইচ্ছে করলে ছুটে যেতে পারিনা কেন?” অরিন কিছু বলল না। একই প্রশ্ন তারই মনে। কেন তাদের জন্ম একই গ্রামে বা শহরে হলোনা? দিহান আবার বলল,”তুমি খাওনি তাইনা?” অরিন চুপ। দিহান বলল,”খেয়ে নাও সোনা প্লিজ। না খেয়ে থেকো না গো।
_আপনি খেয়েছেন?
_দুপুরে খাইনি তাই এখন খেতে না যাওয়ায় আম্মু খাবার রুমে রেখে গেছে। খেয়ে নিবো তুমি খাও।
_জ্বি।
_আচ্ছা তোমাকে ভিডিও কল দিচ্ছি।
_আগে খেয়ে নিন প্লিজ।
_দুজন দুজনকে দেখে দেখে খাবো।” দিহান কল কেটে দিয়ে ভিডিও কল দিলো। কান্না করার কারণে অরিনের চোখ ফুলে গেছে। দিহান আহ্লাদী গলায় বলল, “বউ পাখিটাকে আজ খুন কাঁদিয়েছি তাইনা?” অরিন হাসলো। কথা বলতে বলতে দিহান খেতে বসে। অরিন উঠে হাত বাড়িয়ে ভাতের প্লেট আনলো। জহুরা বেগম প্লেটে করে ভাত এনে রেখেছেন। অরিনের লজ্জা লাগছে। এই প্রথম দিহানের চোখের সামনে খাবে। দিহান তাকিয়ে আছে। অরিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে সে। অরিন মুখে ভাত নিলোনা। দিহানকে জিজ্ঞেস করলো “হাসছেন কেন?” দিহান আবার ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অরিন বললো”কি হলো হাসছেন কেন?
_আমি তো এভাবে হাসিই। তুমি খাওনা,খাও।
_হাসেন তো। আজকে কারণ ছাড়া হাসছেন।
_কারণ ছাড়া কই? কারণ তো আছে।
_কি কারণ?
_আগে খেয়ে নাও পড়ে বলবো।
_না আগে বলেন।
_বলবো?
_জ্বি।
_তোমাকে যেখানে দেখাচ্ছে সেদিকে একটু তাকাও।” দিহানের কথামতো অরিন তাকে যেখানে দেখাচ্ছে সে দিকে তাকালো। অরিনের ওড়নাটা একপাশে পড়ে আছে এভাবে বসার কারণে খুব বাজে একটা অবস্থা হয়ে গেছে তাঁর। অরিন আস্তাগফিরুল্লাহ বলে চট করে ফোন কেটে দিলো। লজ্জায় তাঁর চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। তার গোবরে ভরা মস্তিষ্ক বলল,”ছিঃ দিহান কী মনে করবে? অরিনের ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। অরিন ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করলো। দিহান মেসেজ দিয়েছে,”আকর্ষণীয়।” মেসেজটা পড়ে অরিন নিজেকে নিজে গালি দিলো। “হাবলির বাচ্চা অরিন।
চলবে,,,,,,,,,।