ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু❤ পর্ব_৪

0
1534

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু❤
পর্ব_৪
#সুলতানা_সিমা

বাসর ঘরে স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকা মেয়েটি যখন জানতে পারে, তাঁর স্বামী মারা গেছে। তখন মেয়েটার কতটা কষ্ট হবে? কীভাবে সামলাবে নিজেকে? তাও মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ভাবতেই দিহানের বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। অরিনের জীবনে এতো কষ্ট কেন? আর কে সে যে অরিনের স্বামীকে মেরে দিলো। লাশ যেহেতু তমালপুরে পাওয়া গেছে সেহেতু খুন তমালপুরেরই কেউ করেছে। কে করতে পারে এমন খুন? অরিনের কোনো বিএফ ছিলো কী? প্রশ্নটা মগজ নাড়িয়ে তুলতেই দিহান শাওনকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,”আচ্ছা শাওন,মেয়েটার স্বামীকে এভাবে কে মেরে দিলো? কেউ কী কাউকে সন্দেহ করেনি।
_সন্দেহের চোখে ছিলো আমাদের গ্রামের আলাউদ্দিন চাচা। উনি আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন। আজ যে বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে আসলাম, উনার ছেলে। কিন্তু উনাকেও কেউ মেরে দিয়েছে।
_অরিনের কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো?
_আমি যতদূর জানি ওর কারো সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না।
_আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এইসব কিছু যে করেছে, সে অরিনকে চায়। আর সেজন্যই সে তাঁর স্বামীকে মেরে দিয়েছে।
_ আচ্ছা বাদ দে। চল বাড়ি যাই,আম্মু অপেক্ষা করছে হয়তো।
_হুম চল।

দিহান আর শাওন পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। সারা রাস্তা আর কারো মুখে কোনো রা ছিলো না। চুপচাপ হেঁটে এসেছে দুজন। বাড়ির গেটে এসে ঢুকতেই, নীল সারপ্রাইজ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। দিহান আর শাওন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। শাওন ঢাকা ছিলো দুদিন। আসার সময় তাঁর মামাতো ভাই বোন ইশি,দিশা,লুপা,দিহান,রুহান,দিয়া আর তাঁর নানুমনি কে সাথে করে নিয়ে এসেছে। নীলকেও ফোন করে আসতে বলেছে। নীল আসবেনা বলেছিলো। তাঁর নাকি কাজ আছে। নীল হচ্ছে তাঁর খালাতো ভাই। তাঁর মা আর তাঁর খালা হচ্ছেন তিন ভাইয়ের আদরের দুবোন। এভাবে হঠাৎ নীলের আগমন বড়সড় সারপ্রাইজ ছাড়া কিছুই নয়। শাওন আর দিহানের সামনে এসে নীল দুহাতে দুজনের মাথায় চাপড় দিয়ে বলল,

“কী রে মুখ বন্ধ কর মশা ঢুকে যাবে।” দিহান নীলের পেটে হালকা গুষি দিয়ে বলল,”শালা তুই না বললি আসবি না?” শান্তি চৌধুরী উঠুনে বসে আছেন। নীল শান্তি চৌধুরীকে ডাক দিয়ে বললো,”নানুমনি শুনেছো? তোমার আদরের নাতি আমাকে শালা ডাকে।”শাওন আর দিহান হেসে উঠল। সৌজন্যমূলক কথা বলতে বলতে ভেতরে এসে ঢুকলো তাঁরা। শান্তি চৌধুরী নাতিদের কান্ড দেখে হাসলেন। সব বয়সি বলে একজন আরেকজনকে নাম ধরে ডাকে। এমন ভাবে চলে,যেন তাঁরা কাজিন নয়, বেস্টফ্রেন্ড।

ভিতরে গিয়ে যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে খেতে টেবিলে আসলো। দুইটা বেজে গেছে। দিহানের পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। সবাই একসাথে খেতে বসলো। শাওন দিহান নীল রুহান এক পাশে বসেছে। ইশি দিশা লুপা দিয়া শাঞ্জু(শাওনের বোন) এক পাশে বসেছে। শান্তি চৌধুরী শায়লা বেগম পাশের চেয়ারে সোজাসুজি বসলেন।

প্রথম লুকমা মুখে নিতে গিয়েই দিহানের মনে পড়ে গেলো অরিনের কথা। মুখে ভাত না নিয়ে আবার প্লেটে রেখে দিলো। তাঁর ভিতরে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। কেন জানি খুব ইচ্ছে করছে অরিনকে এখান থেকে নিয়ে আসতে। কিন্তু কেন তাঁর এরকম মনে হচ্ছে? সে কী দয়া করছে? নাকি অন্যকিছু? শায়লা বেগমের ডাকে চমকে ওঠে সে। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়া শুরু করলো। ভাত যেন গলা দিয়ে নামছে না তাঁর। ভিতরে তোলপাড় চলছে। অরিনের বিষয়ে এসব কথাগুলো না শুনলেই হয়তো ভালো হতো।

দিশা চিকেন তেমন একটা খেতে পারেনা। এগুলা তাঁর ভালো লাগছে না। মাছের বাটিটা একটু দূরে। নীল আর লুপার সোজাসুজি। কারো নাম না নিয়েই সে বলল,”দেখি মাছের বাটিটা দাও তো।” নীল লুপা এক সাথে বাটিতে ধরল। একজনের হাতের সাথে আরেকজনের হাতের স্পর্শ লাগে। লুপা চট করে হাত সরিয়ে নেয়। নীল বাটিটা দিশার সামনে দিয়ে উঠে চলে যায়। শায়লা বেগম পিছন থেকে ডেকে বলেন,”আরে নীল এইটুকু খেয়ে উঠে গেলি কেন?
_আমার পেট ভরে গেছে খালা।” নীলের কণ্ঠ অন্যরকম শুনালো। দিহান শাওন শান্তি চৌধুরী পিছন থেকে ডাকলেন। নীল না থেমেই চলে গেলো উপরে। সবার খাওয়া শেষ হলে একে একে সবাই চলে যায়। শুধু বসে থাকে লুপা। চোখ দিয়ে তাঁর মুক্তদানা ঝরে পড়ে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে। প্লেট নিয়ে কিচেনের দিকে যায়। ক্ষিধে নিয়ে খেতে বসলেও খাওয়া হয়নি তাঁর।

___________________________________________

একতলার একটা পাকা বাড়িতে এসে বসে আছে অরিন। তাঁর মা তাকে পাঠিয়েছেন। এই বাড়িটা করিম মিয়া নামে একজন ভদ্রলোকের। করিম মিয়ার বউ সাহেরা খাতুনের কাছে এক হাজার টাকা পান জহুরা। অনেক আগে কয়েকটা জামা সেলাই করেছিলেন। টাকা দিবো দিবো বলে এতোদিনেও দেননি। আজকাল সেলাইয়ের কাজকর্ম তেমন একটা না হওয়ায় হাতে টাকাও আসেনা। এখন হাতে একটা টাকাও নেই। ঘরে রান্না করার কিছুই নেই। দুপুরে আলুভর্তা করেছিলো। অরিন আলু তেমন একটা খেতে পারেনা। তাই দুপুরে সে খেতে পারেনি। দু লোকমা খেয়ে উঠে গেছিলো। তাঁর কাছে আলুর থেকে ডাল ভালো। এখন তো আলুও নেই যে রাতে কিছু করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসলো অরিন। করিম মিয়া নাকি বাড়িতে নেই। সাহেরা খাতুন অরিনকে বসতে বলে ঘরে গেছেন অনেক্ষণ হলো। অরিনকে একবারও ঘরে যেতে বলেননি। বসতে বসতে এক সময় অরিনের কানে ধ্বনি এলো আসরের আজানের। এবার সে উনাকে ডাক দিলো,”চাচি শুনছেন?” উনি ঘর থেকে বের হলেন। অরিনকে বসা দেখে বললেন,”আরে তুমি এখনো বইসা আছো? কইলাম না আজ তোমার চাচা বাড়িতে নাই?
_আপনি তো বললেন চাচি বসতে?
_বইতে তো এমনিই কইছি। টাকা দিমু তো কইনাই।”

কথাটা শুনে অরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। নিজের রাগ দমিয়ে নিলো সে। কিছুই বলল না। আসছি বলে চলে আসলো বাড়ি থেকে। শুধু শুধু তাঁর সময়টা নষ্ট হলো। এই সময়টা যদি মায়ের কাজে হাত লাগাতো তাহলে উনার কাজ এগুতো। কিন্তু এসব কাজ করেই বা কী হবে? শুধু শুধু কষ্ট। সব মানুষ টাকা দিবে দিবে বলে বছর ঘুরিয়ে নেয়। অরিন বাড়িতে ঢুকে দেখলো সেলিনা বেগম চালের ধান আলগা করছেন। অরিনকে দেখে কপাল কুঁচকে তাকালেন। অরিন কিছু না বলে পাশ কেটে চলে গেলো ভেতরে।

ঘরে এসে জহুরাকে বলল,”এসব লোকের কাজ করো কেন তুমি? যে টাকা দিবেনা তাঁর কাপড় দিবানা।
_টাহা কী দেইনাই?
_হ্যাঁ দিয়েছে। টাকার বস্তা মাথায় তুলে দিয়েছে। আমি আগেই বলেছিলাম যাবোনা।” রাগে কথাটা বলে বিছানায় বসে ফুঁসতে লাগলো অরিন। খুব রাগ হচ্ছে তাঁর। এভাবে মানুষ কেন অবহেলা করে তাঁদের? তাঁরা গরিব বলে? রাগে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। জহুরা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,”রাইতের লাইগা কি করমু? কিছুই তো নাই।
_যা খুশি করো আমাকে বলছো কেন?” জহুরা কথা বাড়ালেন না। টাকার জন্য করিম মিয়ার বাড়ি অরিন যেতে চায়নি, তিনি জোর করে পাঠিয়েছিলেন৷ যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো “টাকা যদি দেয়না শুধু শুধু মানুষের বাড়ি গিয়ে লজ্জা পেতে পারবো না।” জহুরা বলছিলেন দিবনা না কেন? তুই যা টাহা দিব নে।” এখন টাকা দেয়নি রাগ তো করবেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরিনকে বললেন,

“কারও তাইকা টাহা ধার নিয়া আহি?” অরিন রাগি চোখে তাকালো। ধার জিনিসটা তাঁর ভালো লাগেনা। এটা হাত পাতার মতো বিষয়। মানুষের থেকে টাকা আনলে সময় মতো দিতে না পারলে,মানুষ কতো অপমান করে কথা বলে। এর থেকে কাজ করে খাওয়া ভালো। জহুরা বললেন,”তাইলে দোকান থাইকা বাকি কিছু নিয়া আহি?
_তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।
_তোরে যাইতে অইবো না। আমি পারমু।” অরিন আর কথা বলল না। বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। উনি গেলে আলু নিয়ে আসবেন। যা অরিনের ভালো লাগবে না। সেলিনা বেগম এখনো উঠুনে বসে আছেন। অরিন যাওয়ার সময় উনি অগ্নি চোখে তাকালেন অরিনের দিকে।

গ্রামের মাঝখানে রাস্তার পাশের দোকানে গেলো সে। এই দোকানে সব কিছু পাওয়া যায়। বাকিতেও জিনিস দেয়। দোকানের পাশে এসে অরিন থেমে গেলো। শাওন দিহান আর একটা ছেলে ব্রেঞ্চে বসে গল্প করছে। অরিন চলে যেতে ঘুরে যায় তখনই শাওন বলে উঠে “আরে অরিন?” শাওনের কথায় নীল দিহান এক সাথে তাকায়। দিহান নীল এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে গল্প করতে লাগে। অরিন আড়চোখে একবার দিহানের দিকে তাকালো। অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। শাওন বলল,”চলে যাচ্ছো কেন? ওরা আমার কাজিন। লজ্জার কিছু নাই। আসো তোমার কী লাগবে নিয়ে যাও।” অরিন অস্বস্তি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। তাঁর খুব লজ্জা লাগছে। হার্টের গতিও যেন বেড়ে চলছে। এমন হওয়ার কারণটা যে এই দিহান নামের মানুষটা এটা তাঁর খুব ভালো করে জানা। সকালেও তাঁর এরকম হয়েছিলো। যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো এই মানুষটার আগে আগে। আড়চোখে একবার দিহানের দিকে তাকালো। দিহানও আড়চোখে তাকিয়েছিলো দুজনের চোখে চোখ পড়ে যেতেই চট করে যে যার চোখ সরিয়ে নিলো। দোকানের সামনে এসে দোকানদারকে বলল,”চাচা আধা কেজি আলু দেন তো।” দোকানদার পাল্লায় আলু মাপতে লাগলো। শাওন এসে অরিনের পাশে দাঁড়ালো। দিহান নীল তাঁর ভার্সিটি নিয়ে কথাবার্তা বলছে। অরিনের মনের হলো শাওন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চিত হতে তাকিয়ে দেখল শাওন সত্যিই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাই নয় মিটিমিটি হাসছেও। অরিনের অস্বস্তি এবার বেড়ে গেলো। অরিনের কপাল কুঁচকে গেলো। শাওন অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “তোমার কলেজের কী খবর অরিন?
_জ্বি ভালো।
_কিছুদিন পরে মনে হয় তোমার এক্সাম শুরু হয়ে যাবে।
_জ্বি।” দোকানদার অরিনের হাতে আলু দিয়ে বলল,”আর কিছু লাগব? চাইল ডাইল?” অরিনের মনে পড়লো সে ডালের উদ্দেশ্যে এসেছিলো৷ কিন্তু এখন এটা ফিরিয়ে দেওয়াও লজ্জার বিষয়। ক্ষীণ স্বরে বলল,”
_জ্বি না চাচা। আর কিছু লাগবে না। টাকাটা পরে দিবো।
_আইচ্ছা।
শাওন বলে উঠে, “আমি টাকা দিচ্ছি।
_না না ভাইয়া এসব কী বলছেন। চাচা আপনি রাখবেন না। আমি কাল এসে দিয়ে দিবো।
_আমি দিলে সমস্যা কী অরিন। সব সময় বাধা দাও কেন?
_আপনি কেন দিবেন, আমার টাকা আমিই দিবো।” অরিনের গলাটা ধারালো শুনালো। আর কিছু না বলেই চলে আসলো অরিন। মাঝে মাঝে শাওনের এমন বাড়াবাড়িতে খুব বিরক্ত হয় সে। বুঝে উঠতে পারেনা শাওন কেন এমন করে।

দিহান নীলের সাথে কথা বলার ফাঁকে একবার অরিনের যাওয়ার দিকে তাকালো। এক পলক দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। এতোক্ষণ নীলের সাথে কথা বললেও তাঁর কান খাড়া ছিলো। অরিন টাকা দেয়নি তারমানে তাঁর হাতে একটা টাকাও নাই। বুকটা ভারি হয়ে এলো দিহানের। ইচ্ছে করছে অরিনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। আবার মনে মনে ভাবছে,”একবার মেয়েটার জীবনে এক ঝড় ডেকে এনেছি। সেটারও ক্ষমা পাবো কিনা। এখন যদি সাহায্য করতে গেলে উল্টা পাল্টা কিছু ভেবে নেয়?” দিহানের মনে হলো যা করতে হবে ভেবে চিন্তে করতে হবে। তবে কিছু তো একটা করতেই হবে।

শাওন এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরিনের যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলো। অরিন চোখের আড়াল হতেই এসে ব্রেঞ্চে বসে লম্বা একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এই নিশ্বাসের সাথে যেন অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। নীল বলল,”শাওন এটাই কী সেই মেয়েরে যার কথা বলছিলি?” শাওন কিছু বলল না। সে কী একটা ভাবনাতে মগ্ন। দিহান বেশ আগ্রহ নিয়ে নীলকে জিজ্ঞেস করলো,”কী বলছিলো?” নীল শাওনকে বলল,” কি রে বলি?” মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের সু’মধুর স্বর ভেসে এলো। শাওন বলল,”চল নামাজে যাই। চাচা যাবেন নামাজে?
_হ বাজান।” দিহান বলল”
_আরে কথা এড়াচ্ছিস নাকি? নীল বলিস না কেন কী বলছিলো?” নীল ইশারায় দোকানদারকে দেখালো। দিহান বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলো। পরেও জানা যাবে বিষয়টা। সবাই মসজিদের পথে পা বাড়ালো। দিহানের কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন ঘাপলা লাগছে। শাওন কী অরিনকে ভালোবাসে? বাসলে বাসুক তাতে তার কী।

নামাজ শেষে দিহানরা বাড়িতে এসে সবাই বসার রুমে বসলো। শান্তি চৌধুরী দিশা ইশি আগে থেকেই বসা ছিলো। তারা টিভি দেখছিলো। দিহানদের দেখে ইশি টিভি বন্ধ করে দিলো। শায়লা বেগম দু প্লেট চিকেন পাকোড়া দিয়ে গেলেন। কিচেন থেকে আরেক প্লেট পাকোড়া আনতে আনতে লুপা রুহান দিয়াকে ডাক দিলেন। লুপার নাম শুনে নীলের কপাল কুঁচকে এলো। বসা থেকে উঠে যেতে লাগলো। শাওন হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে বলল,”এই কুত্তা তুই তো পাকোড়া করতে বললি তাহলে না খেয়ে যাচ্ছিস কই?
_আমার ভালো লাগছে না ইয়ার তোরা খা।
_ভালো লাগছে না কী? চুপচাপ বসে খা।”
দিশা বলল,”না না বসবে কেন। তাঁর শামুক হয়তো ফোন দিয়েছে। যা ভাই যা তুই গিয়ে কথা বল।” শায়লা বোকার মতো বললেন,”শামুক কেরে? এটা আবার কেমন নাম?” নীল রাগি লুকে দিশার দিকে তাকালো। তারপর কথা ঘুরাতে বলল,”নানুমনি দেখেছো। তোমার নাতনি আমাকে তুই তোকারি করে। আমি কী তাঁর বড় না?” শায়লা চৌধুরী বললেন,”
_হ্যাঁ সত্যিই তো তুই তোকারি করিস কেন দিশা?
_ইশ উনাকে আমি আপনি আপনি করে বলবো। হুহ্। ও কী আপনি শব্দের যোগ্য নাকি। শামুক কোথাকার।
_খালামনি তোমার ভাইজিকে চুপ করতে বলো নয়তো ওকে আমি মেরে দিবো।” দিহান বলল,” কেন রে? তোকে তুই তোকারি করছে বলে তুই ওকে মেরে দিবি। আমি যে গুনে গুনে তোর থেকে তিন মাসের বড়। কই তুই তো আমাকে কখনো তুমি করে বলছিস নি৷ আর সব সময় তো দিহান দিহান বলে ডাকিস। কখনো দিহান ভাই বলেছিস?” শাওন দিহানের মাথায় চাপড় দিয়ে বলে,”তুই যে আমার ছ’মাসের ছোট। তুই কখনো আমাকে শাওন ভাই বলেছিস? তুই ওতো আমাকে নাম ধরে ডাকিস।” এভাবে তর্কাতর্কি করতে করতে তাঁদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হয়ে যায়। একজন আরেকজনের দিকে কুশন ছুঁড়ে মারে। শান্তি চৌধুরী ওদের ধমক দিবেন কী নিজেই হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। শায়লা এসে বললেন,”এই চুপচাপ খাও তো আর মারামারি করবা তাহলে ঝাড়ু দিয়ে পিটাবো।” সবাই ঝগড়া থামিয়ে খেতে শুরু করে।

ততক্ষণে লুপা দিয়া রুহান নিচে নেমে আসলো। সাথে শাওনের বোন শাঞ্জুও। ইশি পাকোড়া খেতে খেতে বলল,”ফুপি এজন্যই বলি নীল কেন তোমার হাতের চিকেন পাকোড়া খেতে চায়। তোমার হাতে চিকেন পাকোড়া খেলে তো আমি তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারবো।” শাওন বলল,”
_যেভাবে রাক্ষসের মতো খাস। তিন না খেলে ওতো ক্ষিধা লাগার কথা না।” ইশি কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে বলল,”
_দাদুমনি দেখেছো। তোমার নাতি আমায় রাক্ষস বলে।
_শাওন তুই ওকে রাক্ষস বললি কেন?
_ওরে আমার শান্তি রে। তুমি চুপচাপ মুখ বন্ধ করে শান্তি মতো খাও। এই রাক্ষসের পক্ষ টানবা না।
_শাওলা শুনেছিস? এ কেমন শিক্ষা দিয়েছিস তোর বাচ্চাকাচ্চাদের? মুরুব্বিদের নাম ধরে ডাকে।
_এমনভাবে বাচ্চাকাচ্চা বলছো যেন আমার একশোটা বাচ্চা। মাত্র একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। এগুলাই চোখে পড়ে গেছে?
_হ্যাঁ আম্মু দেখেছো তোমার মা কিন্তু নামে শান্তি হলেও কামে শান্তি না।” লুপা বলল”
_ওয়াও সো সুইট। তোমরা ঝগড়া করো। আমি ভিডিও করছি।” বলেই ফোনের ভিডিও ক্যামেরা অন করলো। নীল বিরবির করে বলল,”
_শুরু হয়ে গেছে ন্যাকামো। যত্তসব ফাউল।” নীলের কথাটা আর কারো কানে না গেলেও দিশার কানে ঠিকই গেছে। কিছু বলল না সে। চা খেয়ে শান্তি চৌধুরী শায়লা বেগম চলে গেলেন উপরে। তাঁদের পিছু লুপা সাঞ্জু দিয়া রুহানও চলে গেলো। সবাই যাওয়ার পরে দিশা নীলকে বলল,”নীল ভাই আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি তুই লুপাকে দেখলেই বিরবির করে ওকে বকতে থাকিস। তুই ওকে সয্য করতে পারিস না কেন?
_ও সয্য করার জিনিস যে ওকে সয্য করবো?” নীলের কথায় সবার কপাল কুঁচকে গেলো। ইশি বলল,” এভাবে বলছিস কেন ভাইয়া? ও ছোট মানুষ ওর মাঝে একটু চঞ্চলতা থাকবেই। এখানে অসয্য হওয়ার কী আছে।
_ও ছোট? তুই জানিস ওর চরিত্র কতটা খারাপ?” নীলের কথা শুনে দিহান কিঞ্চিৎ রেগে যায়। যতই হোক লুপা ইশিকে সে দিয়া দিশার মতো দেখে। এভাবে তাঁর বোনের চরিত্র তুলে কথা বললে তাঁর তো খারাপ লাগবেই। কণ্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে নীলকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”
_কেন ও কী করছে? তুই কখনো ওকে খারাপ কাজে পেয়েছিস?
_তুই জানিস ওর কতটা ছেলের সাথে রিলেশন আছে? ওদের কলেজের নাম্বার ওয়ান প্লে বয়ের সাথেও ওর রিলেশন বাদ যায়নি। আরে কিছুদিন আগে ও তন্ময়ের সাথেও রিলেশনে ছিলো। এখন আবার তন্ময়ের ছোট ভাইয়ের সাথে। ” শাওন দিহান অবাক হয়ে তাকালো। দিশা বলল,”
_নীল ভাই আমার মনে হচ্ছে তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। অথবা কেউ তোকে মিথ্যে বলেছে। লুপা এমন মেয়ে নয়।
_আমার থেকে ভালো ওকে কেউ চিনেনা।” কথাটা বলেই নীল চলে গেলো।

দিহান চুপ করে বসে আছে। তন্ময় হচ্ছে দিহানের এক ফ্রেন্ডের নাম। তন্ময়ের সাথে সে একবার লুপাকে রেস্টুরেন্টে দেখেছিলো। দুজন বসে বসে কথা বলছিলো। দিহান যাওয়ার পরে লুপা বলল সে এসে দেখেছে তন্ময় বসে আছে তাই কথা বলছিলো। তারপর উঠে গেছিলো রেস্টুরেন্ট থেকে। তাহলে কী নীল সত্যি বলছে? সত্যিই কী লুপার তন্ময়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো দিহান। মাথার ভেতর ভনভন করছে তাঁর। নীল সত্যি বলছে নাকি সন্দহের উপর বলছে এসব। না জেনে লুপাকে দোষী ভাবা ঠিক হবেনা।

______________________________________

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বাজতেই অরিন বই বন্ধ করে পড়ার টেবিল থেকে উঠল। ক্ষিধায় পেট চোঁ চোঁ করছে তাঁর। দুপুরে অল্প খেয়েছে। শীত নেমেছে থেকে জহুরা বেগম এশারের নামাজ পড়েই শুয়ে পড়েন। ঘুমিয়ে গেলে উঠে আর ভাত খাননা। প্রেশারের অষুধ আছে। রাতে খেয়ে ঘুমাতে হয়। ওটা না খেলে আবার সমস্যা দেখা দেয়। তাই অরিন উনাকে এশারের নামাজ শেষেই খাইয়ে দিছে। জহুরা বেগম ঘুমিয়ে গেছেন। অরিন রান্না ঘরে গেলো খাবার আনতে। রান্না ঘর শুবার ঘর থেকে আলগ করা। রান্না ঘর থেকে খাবার এনে শুবার ঘরে নিয়ে এসে খায়। অরিন খাবার নিয়ে শুবার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। তখন দেখলো ঘরের কোণার কদম গাছের নিচে একজোড়া পা দেখা যাচ্ছে। পায়ে কালো রংয়ের একটা স্যান্ডেল পরা। পা দেখে বুঝা যাচ্ছে এটা কোনো পুরুষের পা। ভয় পেয়ে অরিন দু পা পিছিয়ে গেলো। গাছটা এক কোণায় হওয়ায় লাইটের আলো সেখান পর্যন্ত যায়না। শুবার ঘরের দরজা খুলা বলে ঘরের আসা কিছু আলোয় লোকটার পা দেখা যাচ্ছে। অরিনের ভয় লাগলো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। রাতের বেলায় বাইরে কে থাকবে। তাঁর চাচি উনার দুই মেয়ে আর বৃদ্ধা মহিলা তাঁর মা ছাড়া তো কেউ নেই এই বাড়িতে। অরিন দাঁড়িয়ে থেকেই জহুরা বেগমকে ডাক দিলো।

_মা শুনছো? মা।” জহুরা বেগমের কোনো সাড়া শব্দ নেই। অরিন তাঁর চাচিকে ডাক দিলো,”চাচি মা। চাচি মা শুনছেন?” অরিনের চাচি ভিতর থেকে জবাব দিতেই গাছের আড়ালের লোকটা অরিনের পাশ দিয়ে দৌঁড়ে গেট দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মাথা থেকে পুরো শরীর কালো চাদরে ঢেকে রাখা। লোকটার ধাক্কা লেগে অরিনের হাতের খাবার পড়ে যায়। সেলিনা বেগম দরজা খুলে লোকটার গেট থেকে বের হওয়ার দৃশ্যটা দেখেছেন। তিনি দৌড়ে গেটের বাইরে আসলেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। ভিতরে এসে অরিনকে বললেন,

_কে এটা?
_জানিনা। ওই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো।
_ওওওও আচ্ছা। সারাদিন ড্যাংড্যাং করে গ্রাম ঘুরে বেরাইলে তো পুলাপাইন বাড়িতে আসবেই। ইশারা দিয়ে বাড়িতে আসতে বলছস তুই। নয়তো এই টাইমে বাড়িতে আসতে সাহস পাইতো?” সেলিনা বেগমের কথায় অরিনের বুক ফেটে কান্না আসে। উনি অরিনকে বকতে লাগেন। চিল্লাচিল্লি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন জহুরা। কী হয়েছে জানতে চাইলে সেলিনা কিছু না বলে ঘরে চলে যান ঘরের ভিতর। জহুরা অরিনের কাছে জানতে চাইলেন কী হইছে। অরিন কিছুই বলল না। চোখের পানিটা মুছে উঠুন পরিষ্কার কর‍তে লাগলো। আলুভাজি যা করছিলো সব বাটিতে করে নিয়ে আসছিলো৷ যা এখন মাটিতে পরে আছে। জহুরা বেগম অরিনের সামনে এসে বললেন,”আপা কী তোরে মারছে?” অরিন কোনো জবাব দিলো না। নষ্ট হওয়া খাবার গুলা ফেলে, ঘরে এসে শুয়ে পরল অরিন। ক্ষিধে পেট চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু খাবে কী? জহুরা ঘরে এসে বললেন,”ভাত খাইছস? অরিন বলল,” হ্যাঁ খেয়েছি ঘুমিয়ে পড়ো।”
_আপা বকলো কেন?
_এমনি ঘুমাও।” জহুরা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। খাটে এসে অরিনের সামনে শুয়ে পড়লেন। অরিন অন্যদিকে ঘুরে শুয়েছে। তাঁর চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি ঝরছে। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে বাহির থেকে কে গলা উঁচিয়ে ডাক দিলো,”জহুরা ভাবি। জহুরা ভাবি আছেন?” অরিনের মা উঠে আসলেন। মনসুর সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। জহুরা মাথায় কাপড় দিতে দিতে বললেন,”ভাইজান আপনে এসময়?
_হ্যাঁ চেয়ারম্যান বাড়ি ছিলাম। শায়লা বলেছিলো আপনার সাথে একটা বিষয়ে আলাপ করতে। এদিকে যাচ্ছি তাই ভাবলাম বলেই যাই।
_কী ভাইজান কন?” সেলিনা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। জহুরা বেগম একবার তাকালেন। সেলিনা বেগমের চোখে আগুন সাথে বেশ আগ্রহ। মনসুর সাহেব কী বলেন তা শুনার আগ্রহ। জহুরা বেগম চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মনসুর সাহেব বললেন,”ভাবি কিছু মনে করবেন না। আসলে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসেছে। শায়লা একদিনেই হাঁপিয়ে গেছে। কখনো এমন কাজকর্ম করেনি বুঝেন তো। পশ্চিম পাড়ার এক মহিলা ছিলো কাজকর্মে সাহায্য করতো। এখন সে আসেনা। বিদেশ চলে গেছে। তাই বলছিলাম [একটু থেমে] আপনি যদি একসপ্তাহ আমাদের বাড়ির কাজে সাহায্য করতেন। আমরাও আপনাকে খুশি করতাম।” মনসুর সাহেবের কথায় সেলিনার মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো। অরিন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। টাস করে দরজা বেজিয়ে গেলো। কত সুন্দর করে উনি এসে কাজের বুয়া চাইলেন। সোজা কথায় বললেই পারতেন, কাজের বুয়া হয়ে সাতদিন আমার বাড়ি যেও।”

অরিনের এভাবে যাওয়া দেখে জহুরা বুঝে গেলেন অরিন এসবে উনাকে দিতে রাজি হবেনা। আরো অনেকবার এমন প্রস্তাব অনেকে দিয়েছে। অরিন যেতে দেয়নি। জহুরা বেগম বললেন,”আইচ্ছা ভাইজান আমি জানামুনে।
_আচ্ছা ভাবি। কিছু মনে করবেন না কিন্তু। আসছি।” মনসুর সাহেব চলে গেলেন। সেলিনা বেগম ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হো হো করে হেসে উঠলেন। উনার হাসির শব্দ শুনে অরিনের গা জ্বলে ওঠল। জহুরা ভেতরে আসতেই অরিন বলল,”তুমি ওসবে যাবা না। ওই ডাক্তার বাড়ির লোকজন নিজেকে কী মনে করে? খুব সুন্দর করে এসে বুয়া চেয়ে গেলো। এই গ্রামে আর মানুষ নাই? আমাদেরকেই চোখে পড়লো?
_আমাগো গরিবরেই তো চখে পরবো। তয় কিছু টাহার খুব দরকার রে অরিন। আমি পাতশ [পাঁচ’শ] টাহা ঋণী আছি। তোর পরিক্ষাও আইতাছে। টাহা ছাড়া কী পরিক্ষা দিতে দিবো?
“অরিন কিছু বলল না। কান্না পাচ্ছে তাঁর। এমন কেন তাঁর জীবন? আট দশটা মেয়ের মতো সে কেন পারেনা বাঁচতে? চোখের পানিটা মুছে এক গ্লাস পানি খেয়ে পড়ার টেবিলে বসলো অরিন। জহুরা বললেন,” ঘুমাবি না?
_পরে ঘুমাবো। তুমি ঘুমাও।

চলবে,,,,,,।

আমি জানিনা গল্পটা কেমন হচ্ছে। তবে আশা করি শেষ পর্যন্ত পড়লে সবার ভালো লাগবে। ইনশাআল্লাহ। গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন কেমন হয়েছে।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here