#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ১৭।
#লেখা- জাহান লিমু।
অভিমান এমন একটা জিনিস,যেটা রাগের চাইতেও ভয়ানক। রাগ হলে আমরা তৎক্ষনাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে ফেলি। কিন্তু অভিমানে সেই প্রতিক্রিয়াটা সুপ্ত হয়ে থাকে মনের গহীনে । আর এভাবে থাকতে থাকতে একসময় সেটা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়।
সাচী তুহিনের ব্যাপারে আর কোন খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছেনা। আর সেটার কারনও একদম স্পষ্ট। যেখানে তুহিন ওকে একদম মনেও করছেনা, সেখানে ওর এতো আবেগ দেখানোর কিছু নেই৷ ভালোবেসেছে,আবেগ বিক্রি করে দেয় নি। আবেগ কোন সস্তা জিনিস নয়। তাই যেখানে সেখানে সেটা অপচয় করার কিছু নেই। তুহিন এখন যেটা করছে,সেটা অতিরিক্ত।
কিছু সময় রাগ দেখিয়ে, পরে বিষয়টা সমাধান করার চেষ্টা করতে পারতো। সাচী শুধু তুহিনকে প্রশ্ন করেছিলো,আর কিছু নয়। এতেই সে এমন আচরণ করেছে যে,সাচী বাকরুদ্ধ!
কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে সে ব্রেকআপ করে দিলো। এতই সহজ ব্রেকআপ?
সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে ছোটখাটো ভুলগুলোকে এতো প্রাধান্য দিলে চলেনা। আর একবার ব্রেকআপ করে দিলেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না। সাময়িকভাবে আমরা কোন বিষয়ে যতটা সিরিয়াস হয়ে যায়, সময়ের গতিতে বুঝতে পারি সেটা হয়তো অতটাও সিরিয়াস ছিলো না। তবে কি অল্প সময়ের সম্পর্ক বলে সেখানে কোন শক্ত ভিতই গড়ে ওঠেনি?
যেখানে আজকাল সাত-আট বছরের সম্পর্কও কত সহজেই ব্রেকআপ হয়ে যায়। সেখানে সাচী কি নিজের কয়েক মাসের সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশিই উচ্চাকাঙ্খী হয়ে গিয়েছিলো?
এতো কম সময়ে কি, আসলেই কোন মানুষকে চেনা যায় না?
আর তুহিন কি সাচীকে সম্পূর্ণরুপে ইগনোর করছে?
তুহিন নামের মানুষটাকে এখন সম্পূর্ণ অচেনা মনে হচ্ছে সাচীর। কত সহজে বদলে গেলো। শুধু একটা ভুলে।
সাচীর এখনো স্পষ্ট মনে আছে যেদিন তুহিন প্রপোজ করেছিলো,সেদিনের বলা কথাগুলো।
তুহিন সাচীকে বলেছিলো,যাই হয়ে যাক সে সাচীর হাত কখনো ছাড়বেনা। আর এখন দিব্যি সে নিজেই হাত ছেড়ে চলে গেছে। যে কথা মানুষ রাখতে পারবেনা,সে কথা বলে কেন?
তুহিন সব ভুলে গেছে এতটুকু সময়ের মধ্যে। তাহলে সাচী কেন ওর জন্য অপেক্ষা করবে?
কিসের আশায়?
সব সহ্য করতে পারলেও,অবহেলা সহ্য করার মত ক্ষমতা মানুষের নেই।
সাচীকে বিছানার পাশে ফ্লোরে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে শফিকুর রহমান রুমে আসলেন। মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। আগের সেই উচ্ছ্বলতাটা নেই। সবটাই বুঝেন শফিকুর, কিন্তু তার যে এখানে কিছুই করার নেই। তিনি তো রাজিই ছিলেন। কিন্তু হুঁট করে যে কি হয়ে গেল। যেন কোন ঝড় এসে মুহুর্তেই সব এলোমেলো করে দিলো। আর মেয়েটাকে কেমন ছন্নছাড়া করে তুললো। এভাবে তো চলতে পারেনা। শফিকুর মেয়ের কাছে এসে বিছানায় বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। সাচী মাথা তুলে তাকালো। মুখটা কেমন শুকিয়ে মলিন হয়ে আছে। এমনিতেই তো নিজের যত্ন নেয় না। সারাদিন কি যে করে, কে জানে। ইদানিং ভার্সিটিও যায় না ঠিকমত।
একদিন গেলে, আরেকদিন যায় না।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শফিকুর বলতে লাগলেন,”একটা প্রশ্ন করি আম্মু?”
সাচী মাথা নাড়ালো।
আচ্ছা আম্মু, জীবনে কি প্রেম ভালোবাসাটায় সব? বাবার প্রশ্নে সাচী চমকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,না বাবা। ভালোবাসাটায় সব না। আবার এই ভালোবাসা ঘিরেই জীবন।
শফিকুর মাথা নাড়ালেন মেয়ের কথায়। তারপর বললেন,হ্যাঁ ভালোবাসা নিয়েই আমাদের জীবন। কিন্তু সে ভালোবাসা যদি আমাদের হাতে ধরা না দিতে চায়,বা দিয়েও চলে যায়,তবে কি আমরা হাত শূণ্যই রাখবো?
সাচী বাবার এই কথাটার মানে ধরতে পারলনা। শফিকুর বলতে লাগলেন,আমাদের জীবনে ভালোবাসা ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। এই যেমন ধরো,জীবনে সফলতা অর্জন। এটা জীবনে ভালোবাসা পাওয়ার চেয়েও জরুরী। তুমি জীবনে সফলতা অর্জন করো,দেখবে ভালোবাসার মানুষের অভাব হবে না। হয়তো বলতে পারো যে,তখন হয়তো তোমার সফলতা দেখে ভালোবাসতে আসবে। হ্যাঁ,আসলে আসুক। এটা তোমার অর্জন। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলো,যেন কেউ তোমাকে ভাঙতে না পারে। বরং তোমাকে ভাঙতে গিয়ে যেন সে ক্ষতবিক্ষত হয়।
বাবার কথাগুলো শুনে সাচীর মনে অনেক ভাবনার উদয় হলো। তবে সবশেষ সে যেটা বুঝতে পারলো তা হলো, কারো জন্য নিজেকে থামিয়ে দেয়ার কোন মানে হয় না। তাই হুঁট করেই সাচী উঠে বসলো। বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কফি খাবে কিনা। শফিকুর মেয়েকে বসতে বলে,নিজেই কফি বানাতে গেলেন। সাচী ল্যাপটপ অন করে নতুন শর্টফিল্মের ডায়ালগ লিখতে বসে গেলো। বেশ কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করেও,সে মনমতো লিখতে পারছিলোনা। কথাগুলো সাজাতে পারছিলোনা একদম। আজ মনে হচ্ছে সে পারবে। এবার পুরোদমে কাজ শুরু করবে সে। লেটস স্টার্ট এভরিথিং লাইক বিফোর।
.
ড্রয়িংরুমে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রিতি চৌধুরী ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে রোহানীর দিকে তাকিয়ে আছেন। রোহানী অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বসে আছে। রায়হান সাহেব বাসায় নেই। সোহানী কলেজে।
রিতি চৌধুরী মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,
” একজন টপ ক্লাস বিজন্যাসম্যানের মেয়ে হয়ে,কি করে একটা সামান্য সরকারী চাকুরীওয়ালা ছেলেকে পছন্দ করতে পারো? সেটা ভেবেই তো আমার গা গুলিয়ে আসছে। রুচিবোধ এতো নিচে নেমে গেলো কবে?
তুমি ভাবলে কি করে এমন একটা মিডলক্লাস ফ্যামিলির কাছে তোমার বিয়ে দিবো?
তাও যদি বড় কোন বিজনেসম্যানকে পছন্দ করতে,না হয় একটু ভেবে দেখতাম। এখানে তো ভাবাভাবির কোন অপশনই নেই। তাই আমি যেটা বলি,চুপচাপ সেটা শুনবে। তোমার বাবাকেও কিছু বলবেনা। তুমি নিজেই ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে চাও না, সেটা বলবে। এর বাইরে একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। রিতি চৌধুরী হুংকারের সুরে কথাটা বললেন। রোহানী কেঁপে উঠলো। মায়ের সাথে সম্পর্কটা অনেকটা বাঘ,হরিণের মত। বাঘ গর্জন করলেই,হরিণ শেষ!
রোহানী ছোট থেকেই ওর মাকে ভয় পায়। মায়ের আদর কি,সেটা ওরা দুইবোন বলতে পারবেনা। ওর মা অন্য মায়েদের মত নয়। তিনি সবসময় নিজের ফিগার,স্ট্যাটাস এসব নিয়ে চলেন। তার কাছে ক্লাসটাই আসল। আর তার জন্য তিনি যেকোন কিছু করতে পারেন। রোহানী এটাও জানে ওর মা ওর বাবাকে ভালোবাসে না। হ্যাঁ,নিজের মা বাবার ব্যাপারে এভাবে বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু যেটা সত্য, সেটা সত্যই।
স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্কে যে ভালোবাসা,শ্রদ্ধাবোধ থাকে,সেটা উনাদের মাঝে নেই। কতদিন,কতরাত রোহানী মাকে, তার বাবাকে ইচ্ছেমত অপমান করতে দেখেছে। মা কেন যেন বাবাকে সহ্যই করতে পারেনা। আর ওদেরকও অন্য মা রা যেমন ভালোবাসে,তার একফোটাও ভালোবাসে না।
রোহানী ভেবে পায় না,মা কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করে?
বাবাকে তো কাছেই পাই না। তবুও একবার প্রশ্ন করেছিলো, ওদের মা এমন কেন?
কিন্তু বাবা কোন কথায় বলেননি। এরপর রোহানী আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার ইচ্ছে পোষণ করেনি। মেনেই নিয়েছিলো,ওদের ভাগ্যে মায়ের আদর নেই। আর বাবার সময় নেই। এভাবেই বড় হয়েছে ওরা দু’বোন।
তানিমের সাথে রোহানীর এখনো কথা হয়নি। রোহানী অনেকবার ফোন দিয়েছিলো, তানিম ধরেনি। একপর্যায়ে তানিম ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। এবার রোহানী ক্ষোভে ফেটে একটা চরম ডিশিসান নিয়ে নিলো। মায়ের কথাতেই সে রাজি হয়ে গেলো।
রোহানীর বাবা যে তানিমদের বাসায় গিয়েছিলো,সেটা রোহানী জানেই না। রায়হান সাহেবকে কোনকিছু বলতে নিষেধ করেছিলো তানিম। একেবারেই জানাতে চায় সে।
আর অন্যদিকে সোহানী যে ওর বাবাকে সব বলে দিয়েছে,সেটা তো রোহানীকে জানায়নি সে। ভেবেছিলো বোনকে সারপ্রাইজ দিবো। তানিমের সাথে মিলে সেই প্ল্যান করছিলো দুজন। কিন্তু তারা দুজন যে আরো বড় সারপ্রাইজ পেতে চলেছে,সেটা বোধহয় তাদের ধারণার বাইরে।
.
কয়েকটা ছেলে রাস্তায় একটা মেয়েকে টিজ করছে। একপর্যায়ে ছেলেগুলো পেছন থেকে মেয়েটার স্কার্ফ ধরে টান শুরু করলো। মেয়েটা ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। রাস্তাটা সরু হলেও,আশেপাশে বেশ কয়েকজন মানুষ আছে। সামনেই একটা চায়ের দোকান। সেখানেও কয়েকজন বয়স্ক লোক, আর কয়েকটা ছেলে বসে আছে।অথচ কারোই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হঠাৎ একটা ছেলে এসে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে,ইভটিজার গুলো তাকে মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে আচমকায় ছেলেটার পেটে ছুঁড়িকাঘাত করে বসে ইভটিজার গুলোর মধ্যে একজন। মেয়েটা ভয়ে অস্থির হয়ে গেলো। অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর চিৎকার শুরু করলো মেয়েটা। ততক্ষণে মানুষ জড়ো হলেও,ছেলেগুলোও পালিয়ে গেছে দৌঁড়ে। মেয়েটা দৌঁড়িয়ে ছেলেটার কাছে আসে। পাশেই একটা সিএনজি ছিলো,সেটাকে ডাকলো সে। ছেলেটার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিলো। মেয়েটা তার স্কার্ফ দিয়ে ছেলেটার পেট বরাবর শক্ত করে বেঁধে নিলো। ড্রাইভারকে দ্রুত হাসপাতালের দিকে যেতে বললো। ভীষণ ভয় হচ্ছে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়! মেয়েটা কান্না করতে লাগলো অনবরত। আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। মেয়েটার কাছে ফোনও নেই,যে বাসার কাউকে ফোন দিয়ে বলবে। ছেলেটার পকেটে ফোন আছে কিন্তু লক করা। ছেলেটার অবশ্য এখনো সেন্স আছে। তবে অবস্থা ভালো ঠেকছেনা। চোখ বন্ধ করে ফেলতে চাইছে। মেয়েটা বারবার জোরে জোরে বলতে লাগলো যেন চোখ বন্ধ না করে। হাসপাতালে এসে গেল বলে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে হাসপাতালের কাছে এসে, চোখ বন্ধ করেই ফেললো।
#চলবে…