যখন_তুমি_এলে পর্ব : ৫০( শেষ পর্ব)

0
1732

#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু
পর্ব : ৫০( শেষ পর্ব)

***—————–***

আমার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছিলো, আমি তুহিনকে ভালোবাসি।কিন্তু আমার মন ঐ রোবটে হারিয়ে গিয়েছিলো। আর অদ্ভুতভাবে সেটা আমি নিজেও টের পাই নি! অবিশ্বাস্য হলেও,এটাই সত্য। যে সত্যটা আমিই গত একটা বছর যাবত মানতে পারছিলাম না। যে অনুভূতি এতোদিন তুহিনের প্রতি ছিলো ভাবতাম,সেটা কখন আরাদে বদলে গেলো,আমি ঠাহরও করতে পারলাম না। যেন সে আমার অনুভূতির রাজ্যে প্রবেশ করে,দরজা তালাবদ্ধ করে দিয়েছিলো। আমাকে কিছু ভাবার অবকাশ দেয় নি।
মন মস্তিষ্কের দ্বন্দে,আমি আমার নিজের স্বত্বাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট জানি,আমি কি চাই। আর এখন সেটাই করবো। অনেকের চোখে হয়তো আমি অন্যায়কারী হবো,কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত কতশত মানুষ,কতশত অন্যায় করে চলেছে,কেউ তা নিয়ে পড়ে থাকেনা। জীবন নিজ গতিতে ছুটে চলেছে। সেখানে আমি যদি আমার মনের সঠিক ভালোবাসাটা বেঁছে নেই,তাতে আমি কোন ভুল খুঁজে পাচ্ছি না। হ্যাঁ,ভুল ভাবতাম, অন্যায় ভাবতাম, যদি তুহিন আঘাত পেতো। যদি তাকে ঠকানো হতো। যদি সে ভেঙে পড়তো। কিন্তু সে পড়েনি। বরং সেই আমার ভুলটা শোধরে দিলো। সেই আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো,আমি কাকে ভালোবাসি। তুহিনকে আমি ভালোবাসতাম,আর ঐ রোবটকে ভালোবাসি। একজন অতীত,আরেকজন বর্তমান,ভবিষ্যৎ দুটোই।
যদিও সেটা বুঝতে আমি অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেছি। একটা বছর কেঁটে গেছে। হয়তো সেটা খুব বেশি নয়,আবার ভাবতে গেলে একটা বছরে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।

অনেকসময় এমনটা হয়। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারিনা, আমরা আসলে কাকে ভালোবাসি। আমাদের মন-মস্তিষ্কও আমাদের সাথে খেলা করে। আর আমরা সেই খেলায় হেরে গেলেই বিপদ। তখন জীবনের কোন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে, আমাদের মনে হয়, আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিংবা ভালোবাসাটা ভুল ছিলো। ভুল মানুষকে বেঁছে নিয়েছিলাম। আর সাচীও সেই ভুলটাই করতে যাচ্ছিলো। তবে এখন আর সাচী সেই ভুলটা করবেনা। মন,মস্তিষ্ক দুটো মিলিয়ে যাকে ভালোবেসেছে,তাকেই নিজের করে নিবে। সেটা যত কঠিনই হোক না কেন,সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে। মানুষ ভুল করে,আবার সেই ভুলটা বুঝতে পারে। সবাই পারেনা অবশ্য। কিংবা কেউ কেউ সময় হারিয়ে বুঝে। তবে সারাজীবন ভুল ধরে বসে থাকার চেয়ে,ভুলটা একেবারে শোধরে ফেলা উত্তম।
তাতে সাময়িক অসুবিধা হলেও,একসময় ঠিকই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। জীবনটা আসলে সরল,আমরাই জটিল করি। তবে সেই সরল জীবনেও, অনেক অপ্রত্যাশিত,অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। আর তা মানতে আমরা বাধ্য।

সাচী নিজে কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি,সে আরাদের মতো ছেলেকে ভালোবেসে ফেলবে। একসময় যার সাথে দা-কুমড়ো সম্নন্ধ ছিলো। হ্যাঁ, পরবর্তীতে একটা স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিলো বটে।
সে নিজেও জানেনা,কখন ভালোবাসলো। এমনটাও হয় নাকি!
কিন্তু এখন বেশ অনুভব করতে পারছে। তখন হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো। কিংবা সাচীই অনুভূতির খবর নেয় নি।

সেদিন এয়ারপোর্টে যখন আরাদকে জড়িয়ে ধরেছিলো,তখন তেমন কোন অনুভূতিই হয় নি। ভেবেছিলো স্বাভাবিক ভাবেই ধরেছে,বন্ধু হিসেবে। কিন্তু আজ সাচী বুঝতে পারছে,সে ভুল ছিলো। আরাদ বলাতেই সে কেন এভাবে পাবলিক প্লেসে জড়িয়ে ধরবে?
শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে?
সাচী তখন এমন কিছু নিয়ে ভাবেইনি আসলে।

সেদিন সাচীও বুঝতে পারেনি,আরাদ কেন একবার জড়িয়ে ধরতে বলেছিলো। কিন্তু আজ বেশ বুঝতে পারছে,আরাদ ঠিক কতটা অনুভূতি চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলেছিলো। তাও কত উদ্ভটভাবে বলেছিলো। যে সাচী যদি একবার হাগ করে,তাহলে নাকি সে বুঝবে,সাচীর তার প্রতি আর কোন ক্ষোভ নেই। কি পরিমাণ চিটার,বাটপার! সাচী বকতে লাগলো আরাদকে।
যখন জড়িয়ে ধরেছিলো,তখন আরাদের বুকের বা-পাশের যন্ত্রটা অস্বাভাবিকভাবে ছুটোছুটি করছিলো। সাচী স্পষ্ট সেটা অনুভব করেছিলো,তবে সে মাথা ঘামায়নি সেটা নিয়ে।
কিন্তু আজ!
আজ সে সবটা অনুভব করতে পারছে। আরাদ ঠিক কতটা ব্যাকুল হলে পড়ে একবার জড়িয়ে ধরতে চাইছিলো। যেখানে সে সব ব্যথা বুকে চেপে রেখে,চলে যাচ্ছিলো।
ঐ সময়টুকু আরাদ নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গিয়েছিলো।
অথচ জড়িয়ে ধরার পর কি মিথ্যেটাই না বলেছিলো। সেটা ভাবলেই সাচীর হেসে গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। আরাদ বলেছিলো,
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছো,তার মানে হলো আমার প্রতি তোমার আর কোন অভিযোগ নেই।
সেদিন প্রথমবারের মতো আরাদ সাচীকে তুমি করে বলেছিলো। হয়তো মুখ ফঁসকেই বলে ফেলেছিলো। এতোদিনে হয়তো মুখও অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলো আপনি বলে বলে। মনে মনে হয়তো,তুমিই বলতো।

তুহিনের কাছে সাচী দায়বদ্ধ হয়ে গেলো এবার। নিজের ভালোবাসাকে কেউ অন্যের হাতে তুলে দেয়?
এর জন্য কত বড় মন দরকার,সেটা সাচীর জানা নেই। তবে এতে তুহিনের প্রতি শতগুণ রেসপেক্ট বেড়ে গেলো সাচীর।
তুহিন সাচীকে বলেছিলো,

সাচী,তুমি ভাবতে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। হ্যাঁ,হয়তো বাসতেও। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের ব্যবধানেই বদলে গিয়েছিলো।

তুমি ভেবেছো,তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে। হ্যাঁ,হয়তো ছিলেও। কিন্তু সেটাও তোমার মস্তিষ্কের ধারণা। মূলত তুমি আমাদের সম্পর্কটার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলে। যেহেতু তুমি সন্দেহ করে প্রশ্নবিদ্ধ করাতে,আমি রেগে চলে গিয়েছিলাম। তাই সত্যিটা জানার পর,তোমার গিল্টি ফিল হতে লাগলো। কারন আমি নির্দোষ ছিলাম। কিন্তু মূলত সময়ের ব্যবধানে তোমার ভালোবাসাটা ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলো। এতে আমি তোমাকে দোষ দিবো না। মানুষের মনের উপর,তার নিজেরও কোন হস্তক্ষেপ থাকে না। এটাই কঠিন সত্য। আর সেটা মানতে আমরা বাধ্য।
তবে খুব বেশি দেরি করে সেই সত্যটা অনুধাবন করলেই যত সমস্যা। আর তোমারটা এখনো খুব দেরী হয় নি।

সাচী তুহিনের কথা শুনে প্রথমে ভীষণ রেগে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো তুহিন ওকে সন্দেহ করে,তাই এমনটা বলছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো যে,তুহিন সিরিয়াস,তখন সাচী চুপ হয়ে গেলো। সে নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলোনা। এটাও কি সম্ভব!
সে কাউকে ভালোবাসে,আর সে নিজেই সেটা জানেনা।
সে কি উন্মাদ!
নিজেকে তখন সেরকম কিছুই মনে হচ্ছিলো সাচীর। সেদিন সে তুহিনের সাথে রাগারাগি করে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে তুহিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে,নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হতে থাকে। তুহিন এমনটা কি করে ভাবতে পারে?
সে তুহিনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তুহিনও ফোন দেয় না। অথচ কয়দিন বাদেই ওদের বিয়ে! কার্ডও ছাপা হয়ে গেছে।
সবটা খেয়াল করলো বিরুনিকা। সাচী নিজেকে রুমবন্দি করে রাখলো কয়দিন। সবাই ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো।
একদিন রাতে সাচীর রুমে খাবার দিতে গিয়ে,বিরুনিকা বসে কথা বলতে চাইলো। সাচী ভাবলেষহীনভাবে বসে রইলো।
তখন বিরুনিকা বললো,
মানুষের মস্তিষ্কের গঠনটা খুব জটিল জানো। আর তার চেয়েও বেশি জটিল, মানুষের মন। এই মন কারো কথা শুনেনা,এমনকি নিজেরও না।
যখন আমি টের পেলাম, তোমার ভাইকে ভালোবাসি,তখন বেশ পুলকিত হয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ভাইয়ের অবহেলা সহ্য করার মতন ছিলো না। মাঝে মাঝেই ভাবতাম, যার এতো ইগো তার জন্য কেন আমি চোখের জল ফেলবো?

তাই নিজেকে শক্ত করতে চাইতাম। কিন্তু পারতাম না। মন সায় দিতোনা। তাকে দেখলেই,মন বেহায়ার মতো তার কাছে ছুটে যেতে চাইতো। কিন্তু তার দেখা পাওয়াতো, অমাবস্যার চাঁদ দেখতে পাওয়ার মতো। আর সে জন্যই বাংলা আমার পছন্দের সাবজেক্ট হওয়া স্বত্বেও, আমি ওর কাছে প্রাইভেট পড়েছিলাম। অথচ আমি সব পারতাম। ইচ্ছে করে না বুঝার ভান করতাম, যেন তাকে বেশি সময় দেখতে পাই। আমি ঐ পাগলামীগুলো করতাম না,আমার মন করতো। আর সেখানে আমার মস্তিস্কের কোন হস্তক্ষেপ ছিলো না।
মনের কাছে, মস্তিষ্ক ঠিক এতোটাই অসহায়।
একসময় আমি বুঝে গিয়েছিলাম,তাকে না পেলেও আমি তাকেই ভালোবেসে ফেলেছি। এবং ভালোবাসবো। আর সেখানে আমার কিছুই করার নেই। তাই নিয়তিকে মেনে সব অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী তো তিনিই। আমরা তো উপলক্ষ্য মাত্র।
ঐদিন বিরু কেন এই কথাগুলো বলেছিলো, সেটা সাচীর জানা নেই। কি ভেবে বলেছিলো,তাও জানেনা। কিন্তু কথাগুলো সাচীর ভেতরে ঝড় বয়ে দিয়েছিলো। সারাক্ষণ হাঁসফাঁস করছিলো সে।
সবাই কি শুরু করেছে?

একসময় সাচী পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো। মেয়ের অবস্থা দেখে, শফিকুর অস্থির হয়ে পড়লেন। নিজে তুহিনের কাছে ফোন করে সবটা বললেন। সব শুনে তুহিন, বাসায় আসলো।
সবাই সাচীর রুমে গেলো। সাচী তখন চুল এলোমেলো করে জানালার পাশে উদভ্রান্তের মতো বসে আছে। আবার সেই কোঁকড়াচুলো সাচীকে দেখে,তুহিন ম্লান হাসলো। কেউ একজন বলেছিলো,সাচীকে বোধহয় এভাবেই মানায়।

সেদিন আরাদের সাথে দেখা করতে কেবল সাচীই যায় নি,তুহিনও গিয়েছিলো। দুজন পৃথক পৃথকভাবে। তবে তুহিন সাচীকে এয়ারপোর্টে দেখতে পেলেও,সাচী তুহিনকে দেখে নি। পরে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো অবশ্য।

আরাদ সাচীর থেকে চলে যাওয়ার পর,তুহিন আরাদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তুহিনকে দেখে প্রথমে আরাদ বেশ বিস্মিত হয়েছিলো। তবে পরক্ষণেই কি যেন একটা ভাবলো। তারপর এমন ভান করলো, যেন তুহিনের আসাতে আরাদ খুব একটা বিস্মিত হয় নি। যেন তুহিনের আসারই ছিলো। তবে আরাদকে বিস্মিত হতে না দেখে, তুহিন নিজেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তখন আরাদ কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি হাসলো। যার মানে তুহিনের জানা নেই।
তুহিন আরাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলো,

‘ পালাতে চাইছো?’

আরাদ হেসেই সহজ ভাবে জবাব দিলো,

‘ নাহ,কোন চুরিটুরি করিনি তো।’

‘ তবে?’

‘ এখানে থাকার কোন প্রয়োজন দেখছিনা।’

‘ প্রয়োজন দেখছোনা,নাকি প্রয়োজন আছে তাই পালাচ্ছো?’

‘ সে আপনি যা ভাবার ভাবতে পারেন।’

এবার তুহিনও রহস্যজনক হাসি হাসলো। আরাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তখন তুহিন যেটা বললো,সেটা আরাদের কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। তুহিন শান্ত স্বরে বললো,

‘ সাচীও তোমাকে ভালোবাসে,কিন্তু সে নিজেই সেটা জানেনা।’

আরাদ কিছুক্ষনের জন্য স্তব্দ হয়ে গেলো। মনে হলো বহু আরাধ্য কথাটা সে শুনেছে। কিন্তু সেই ভাবনাটা বেশিক্ষণ মস্তিষ্কে স্থায়ী হতে দিলো না। তাই মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

‘ এটা আপনার মনের ভুল ধারণা। আপনি আমাকে নিয়ে সাচীকে সন্দেহ করেন তাই। তবে আমি বলছি,সাচী অমন মেয়ে নয়।’

‘ খুব জানেন মনে হচ্ছে সাচীকে?’

তুহিনের এ প্রশ্নে আরাদ কোন কথা বললোনা। আরাদকে চুপ থাকতে দেখে, তুহিন আবার প্রশ্ন করলো,

‘ বুকে হাত দিয়ে বলো তো,তুমি সাচীকে ভালোবাসো না?’

তারপর বললো,তুমি আমার ছোট, তাই তুমি করেই বলে ফেললাম।

কিন্তু আরাদ তখন তুহিনের আর কোন কথা শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তুহিন কি তবে কোনভাবে বুঝে গেলো? না না,সেটা কি করে হয়। আরাদ ঘামতে লাগলো।
তখন তুহিন বলতে লাগলো,

জীবন কত অদ্ভুত দেখো। ভালোবাসার জন্য আমরা দুজন একজন মেয়েকেই পেলাম। আর সেই মেয়েটা এটাই জানেনা,সে মূলত কাকে ভালোবাসে। এতে ওর কোন দোষ নেই। ওর মস্তিষ্ক ওর মনের কথা বুঝবার কোন সুযোগ দিচ্ছে না। মস্তিষ্ক দ্বারা চালিত হচ্ছে সে। তাই মনের ভেতর কে আছে,সেটা ভাবার ফুরসত ওর নেই। কিন্তু আমি দেখেছি,ওর মনের ভেতর কে। ও আমার সাথে থাকে,অথচ সারাক্ষণ তোমার কথা বলতে থাকে। তুমি এটা,তুমি সেটা। তুমি এমন করেছিলে,তুমি ওমন করেছিলে। তোমার এটা পছন্দ,তোমার ওটা পছন্দ। সারাক্ষণ ও তোমার নাম জপ করতে থাকতো। প্রথমে আমার ভীষণ রাগ হতো,রাগ দেখাতামও। কিন্তু একটা সময় পর আমি সাচীর এমন ব্যবহারের কারনটা খুঁজে পেয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিলো আমার। সেটা মেনে নিতেও পারছিলাম না। কিন্তু আমার মানা না মানাতে তো সত্যটা বদলে যাবে না।
তাই না?
তাই অনেক কষ্টে নিজেকে মানালাম। আর ভাবলাম তোমাদের দুজনের সাথেই সরাসরি কথা বলবো। কিন্তু তুমি এভাবে চলে যাচ্ছো কেন?

ভেবেছো কিছুই বুঝতে পারবনা?
এভাবে ছেড়ে গিয়ে জিতে যাবে?
এতোই সহজ!

আরাদ তুহিনের কথায় যেন নিজের বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। বোবার মত শুনে যাচ্ছে কেবল। তখন অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে, আরাদ বললো,

‘ ভালোবাসলেই পেতে হবে,এমনতো নয়। আর আপনি সাচীকে ভুল বুঝছেন। ওর চোখে আমি আপনার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি,সেটা কখনোই মিথ্যা হতে পারেনা।

বরং এটা বলতে পারেন,আপনার জন্য ওর ভালোবাসা দেখেই বোধহয়, আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক ওর প্রেমে নয়,ওর ভালোবাসার প্রেমে। তুহিন আরাদের কথা কিছু বুঝতে পারলোনা। আর আরাদ তুহিনের কথা।

ঐদিন কথা অসমাপ্ত রেখেই আরাদ চলে যায়। ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছিলো। তুহিন বুঝতে পারেনা,ওর কি করা উচিত। আরাদ যাওয়ার আগে,ওদের দুজনের বিবাহিত জীবনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো। অথচ তুহিন জানে,ওদের বিয়েটাই হবে না। আরাদ বুঝেও বুঝতে চায়নি,সেটা তুহিন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। তাই এবার সাচীকেই বুঝাতে হবে। আর সেটা যে অনেক কঠিন হবে,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারন কেউ নিজে যদি নিজের মনের খবর না জানে,তাকে সেটা জানান দেয়া এভারেস্ট জয় করার চেয়েও দুষ্কর। আর তুহিন সেটাই করতে চলেছে।

সেদিন বাসায় সবাই মিলে যখন সাচীকে প্রশ্ন করতে লাগলো,বুঝাতে লাগলো,তখন সাচীর নিজেকে টিনেজ গার্ল মনে হচ্ছিলো। অথচ সে একজন গ্র্যাজুয়েট গার্ল।

সবার পীড়াপীড়িতে,সে সবাইকে ধমকে ওর রুম থেকে বের করে দেয়। তখন বিরুনিকা সবাইকে চলে যেতে বলে। কারন এটা সম্পূর্ণ সাচীর মনের বিষয়। আর তাকেই সেটা ঠান্ডা মাথায় বুঝতে হবে। এখানে জোর করে কোনকিছুই বুঝানো যাবে না। কিংবা সেটা ঠিকও হবে না। তাই ওকে সময় দেয়া উচিত।
তুহিনও এটার সাথে একমত হলো। সেদিন সে যাওয়ার আগে সাচীকে সেটা বলেও গেলো। যে সাচী সময় নিয়ে ভাবুক। যদি মনে হয়, সে আরাদকে নয়,তুহিনকেই ভালোবাসে,তবে সেদিনই তুহিন সাচীকে বিয়ে করবে। অন্যথায় সাচীকে আরাদের হাতে তুলে দিয়ে আসবে। তুহিনের কথা শুনে সাচী সেদিন বিস্মিত হতেও যেন ভুলে গেলো!

মানুষ নিজের ভালোবাসাকে আগলে রাখার জন্য কত কি করে। আর এখানে তো ভিন্ন কিছুই দেখছে সাচী। নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে যেন মুখিয়ে আছে কেউ। কত আজব মানুষ রয়েছে দুনিয়াটায়!

দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেলো। সাচীর মাস্টার্সও শেষ। অথচ এখন পর্যন্ত সাচী কোনকিছু জানালো না। একদিন তুহিনই সাচীর নিকট এসে বললো,

এবারতো কিছু জানাও ম্যারি মা। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো। দেখো চুল, দাঁড়ি পেকে যাচ্ছে। তুহিন নিজের চুলে,দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দেখালো। তোমাকে বিয়ে না করলেও,একটা বিয়ে তো অন্তত করতে হবে। কিন্তু বুড়ো হয়ে গেলে তো, তখন কোন মেয়েই বিয়ে করতে চাইবেনা। আমার এতো বড় ক্ষতি তো তুমি করতে পারো না,তাই না?

তুহিন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো। সাচী হো হো করে হেসে দিলো তুহিনের কথা শুনে। অনেকদিন পর সাচীকে হাসতে দেখলো তুহিন। ভীষণ ভালো লাগছে তার।
তখন সাচী সহাস্য লাজুক মুখে বললো,
আগামী সপ্তাহেই আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। পাসপোর্ট, ভিসা সব রেডি। আমাকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসবেন ঐদিন?

তুহিন কি বলবে বুঝতে পারলনা। সে জানতো সাচী যদি ওর মনের কথা শুনে,তবে ঠিক এই ডিশিসনটাই নিবে। আর তুহিন এটাই চেয়েছিলো যে,সাচী সঠিন ডিশিসান নিক। সাচীর কথায় তুহিনের কষ্ট পাওয়ার কথা,কিন্তু সে আনন্দিত হচ্ছে। এবং সে নিজেই অবাক তাতে!

রোহানীর সাথে কথা বলে সাচী জানতে পেরেছে,আরাদ আগামী মাসে দেশে আসবে। কারন রোহানীর ছেলে হওয়ার সময়,আরাদ আসতে পারেনি। সেই হিসেবে সাচীর ইন্ডিয়া যাওয়ার কোন প্রয়োজন দেখছেনা সবাই। কিন্তু সাচী তো সাচীই। ওর ধারণা, ও নিজে আরাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সিচুয়েশনটা যেমন হবে,আরাদ দেশে আসলে তেমনটা হবে না। আরাদকে যেদিন থাপ্পড়গুলো মেরেছিলো, তার চেয়েও ভয়াবহ সিচুয়েশনে পড়বে,যখন সে সাচীকে ওর সামনে দেখবে। যদিও ওর মনে একটা উৎকন্ঠাও কাজ করছে। আরাদ যদি ঐখানে অন্য কোন মেয়েকে…! সাচী একদম সেসব ভাবতে চাইছেনা,একদম না। এমন কিছু না হোক।
এমন কিছু হলে,ঐ রোবটকে সত্যি সত্যিই রোবট বানিয়ে দিবো আমি। তারপর জাদুঘরে রেখে দিবো। সেখানে সব মেয়েরা শুধু দেখবে। সে আমার না হলে,অন্য কারোও হবে না।

সাচীকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে তুহিন আর সাচীর বাবা গেলো। সায়াহ্ন বিরুনিকাকে নিয়ে ক্লিনিকে গেছে। বিরু প্রেগনেন্ট,আটমাস চলে। সবাই ভীষণ খুশি। আর ওদের দুজনের তো খুঁনসুটি লেগেই আছে। বিরুনিকা সায়াহ্নকে বলে, তার জুনিয়র কুনোব্যাঙ চায়। অন্যদিকে সায়াহ্ন বলে,তার একটা ইডিয়টের কার্বন কপিই চায়। তারপর আবার নিজেই বলে,যাহ!
আমার প্রিন্সেস ইডিয়ট হতে যাবে কেন?
ইডিয়ট তো প্রিন্সেসের মা। এটা বলতেই বিরুনিকা চ্যাঁত করে বারুদের মতো জ্বলে উঠে। আর সায়াহ্ন ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
মেয়েকে সুখী দেখে,কোমলের আফসোস ঘুঁচলো। কখনো কখনো সন্তানের খুশিতেই খুশি হতে হয়। আর সুখ সেটাতো ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দিতে হয়। আমরা তো কেবল সুখী থাকার,আর সুখ খোঁজার চেষ্টাটুকু করতে পারি।

এয়ারপোর্টে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ওরা। একসময় শফিকুর অন্যদিকে কিছু কিনতে গেলে,তুহিন আচমকা সাচীকে একটা প্রশ্ন করে বসলো। যেটা শুনে সাচী চমকে গেলো। একইসাথে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তুহিন বললো,

‘ একবার জড়িয়ে ধরবে,শেষ বারের মতো?’

কিন্তু তখন সাচী ইতস্তত করতে লাগলো। সাচীর অবস্থা দেখে, তুহিন অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। এতে সাচী ভীষণ লজ্জাবোধ করতে লাগলো। সেই সাথে তুহিনের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে বিস্মিতও হলো। যদিও তুহিন গত একটা বছরে সাচীকে, সারা জীবনে যতটুকু না বিস্মিত হয়েছে বা হবে,তারচেয়ে বেশি করেছে। তখন সহসা তুহিন বললো,

‘ একই আবদারটা একই স্থানে, একবছর আগে অন্য কেউ করেছিলো,তখন ইতস্তত লাগেনি?’

এবার সাচী বিস্ফোরিত চোখে তুহিনের দিকে তাকালো। তখন সাচীর চোখের দিকে তাকিয়ে, তুহিন শান্ত স্বরে বললো,

‘ সেদিন আমিও এসেছিলাম। তবে তোমাকে পরীক্ষা করতে নয়। আমার প্রয়োজনে। কিন্তু আমার প্রয়োজন পূরন না হলেও, অনেকটা হয়েছিলো বটে। এতোদিনে বুঝেছিলাম,আরাদ তোমাকে ভালোবাসে। তোমার ভাইয়ের গাঁয়ে হলুদের রাতে আরাদ ছাদের এক কোণায় বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে ছিলো। আমি দেখেছি সেটা। ওর লাল টকটকে চোঁখ,অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। তুমি যখন নাচ করছিলে,তখন সে ঘোরের মধ্যে তোমার কাছে চলে যেতে চাইছিলো,আমি পথ আগলে দাঁড়ায় তখন।
বিয়ের পুরোটা সময় আরাদ তোমাকে আমার সাথে দেখে,সহ্য করতে পারছিলোনা। আমি ওর চোখের লুকানো বিষাদ দেখেছি। সেজন্যই মিথ্যা অযুহাত দিয়ে, ও ঐভাবে বিয়ে ছেড়ে চলে যায়। সাচী হতভম্বের মত সব শুনছিলো। আশ্চর্যজনকভাবে সে এসবের কিছুই খেয়াল করেনি।

যখন এয়ারপোর্টে তোমার মলিন মুখটা দেখেছিলাম,সেদিন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম,তুমিও আরাদকে ভালোবাসো। আগে শুধু আমার ধারণা হয়েছিলো। ঐদিন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হই। ঐদিন তোমার চোখে আমি জলের অস্তিত্বও টের পেয়েছিলাম। আরাদ চলে যাওয়ার পর,তুমি চোখ মুঁছে ছিলে। যেটা আমি দেখেছি,আরাদ দেখেনি। আর তুমি পিছু ফিরে যাওয়ার পর,আরাদ তোমার দিকে তাকিয়েছিলো। ওর মুখ মুুঁছে ছিলো রুমাল দিয়ে। কিন্তু আমিতো জানি, সেদিন ও মুখ মুঁছার বাহানায়, চোখ মুঁছে ছিলো। যেটা তুমি দেখোনি। আমি দেখেছি।
সাচী বিস্ময় নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুহিনের কথা শুনে যাচ্ছিলো। তখন সাচীর কেবল একটা কথায় মনে হচ্ছিলো। আমাদের জীবনে কতকিছু ঘটে। আমরা হয়তো তার অর্ধেকও দেখিনা,বুঝিনা। অগোচরেই রয়ে যায় কত শত কাহিনী।

আরো কাহিনী আছে, বলবো? কথাটা তুহিন কেমন যেন কৌতুক করে বললো। সাচী ঠিক বুঝতে পারলনা,আর কি কাহিনী বাকী?
তখন তুহিন বলতে লাগলো,

‘ ঐদিন রাতে তোমার আরাদা বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে তাই না?’

সাচী ভ্রু কুঁচকে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,এ নামে আমার কোন বান্ধবী নেই।

তখন তুহিন বললো,আমি জানিতো। কিন্তু যেহেতু বলেছিলে,বান্ধবীর বাসায় গিয়েছো,তাই নামের শেষে আকার লাগিয়ে মেয়ে বানিয়ে দিলাম। সাচী তুহিনের কথা কিছু বুঝতে পারলো না। বোকার মত তাকিয়ে রইলো।

তখন তুহিন পকেট থেকে একটা সেন্টারফ্রুট নিয়ে সেটা চিবাতে চিবাতে বললো,

আমাদের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। দেখছেন না বউয়ের লাল শাড়ি পরা? এখন মাঝরাতে বউয়ের সাথে ঝগড়া লেগে গেছে। তাই সে রেগে একলাই বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু ঝগড়া হোক,আর যাই হোক,বউটা তো আমারই। তাই আমিই পৌঁছে দিয়ে আসছি। স্বামীর দায়িত্ব আছে না? দেখছেন না রাগে কেমন একহাত দূরত্ব রেখে বসেছে? আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করছেনা। যদি গার্লফ্রেন্ড হতো,তাহলে তো আমার সাথে চিপকে বসে থাকতো। বউ রেগে আছে দেখেই তো, দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। কথা বলা শেষ করেই,তুহিন সাচীর মুখের সামনে ফুঁস করে বাবল ফুলালো। সাচী তখন পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনভাবে কেবল জানতে চাইলো, তুহিন এসব জানে কি করে?

তুহিন তখন বিকট হাসি হেসে বললো,
কারন যে পুলিশটা তোমাদের আঁটকে ছিলো,সে আমার বন্ধু। আর সে তোমাকে চিনে,তোমার-আমার ব্যাপারেও সব জানে।
তোমার হ্যালমেট খোলার পরপরই সে তোমাকে চিনে ফেলে। অবশ্য ওর নাকি চোখ দেখে,আগেই একটু সন্দেহ লাগছিলো। তাই তোমাকে হ্যালমেট খোলার কথা বলেছিলো। তোমাদের ছেড়ে দেওয়ার পরপরই,ও আমাকে ফোন দেয়। আর সেজন্যই আমি তোমাকে রাতে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ফোন তো তখন ঘুমাচ্ছিলো,সাথে তুমিও।
সাচী পুরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সাচীর মুখটা তখন দেখার মত হয়েছিলো।
সেদিন আরাদ যখন এভাবে গরগর করে মিথ্যা বলে যাচ্ছিলো, সাচী তখন লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু বলতেও,পারছিলোনা। কারন বললেই, বিপদ বাড়বে। সেদিন আরাদের প্রতিটা কথা ওর শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু কি আশ্চর্য, তখনও সে কিছুই বুঝতে পারেনি। এখন নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট বলদী মনে হচ্ছে।

তুহিনের থেকে বিদায় নিয়ে সাচী ভেতরে চলে যায়।
তার আগে অবশ্যই তুহিনকে একটা উপদেশ দিয়ে যায়। তুহিনকে বলে,

‘ ঐ রোবট তোমার গফকে ছিনিয়ে নিয়েছে,তুমিও তার গফকে ছিনিয়ে নাও।’

সাচীর কথা শুনে তুহিন বললো,মানে!
গফ মানে?
ঐ ব্যাটার গফ থাকলে,এখনি তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে,বিয়ে করে ফেলবো। তুমি এটা ভেবোনা,তুমি ওকে ভালোবাসো দেখে,আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমি ছেড়েছি,কারন সেও তোমাকে ভালোবাসে। দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝখানে আমি ভিলেন হয়ে, ইতিহাসে বাঁচতে চায় না। হলাম না হয় সাইড হিরো।
এমনিই এখন আমার বাপ্পারাজ, বাপ্পারাজ ফিলিং আসতাছে। তুহিনের রাগ, আর কথা বলার ধরন দেখে সাচী হাসতে হাসতে বললো,
সরি,সরি। ওর গফ নয়। বরং ঐ মেয়ের ক্রাশ আরাদ। তুমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করে ফেলো।

তুহিন করুণ স্বরে বললো,
মানুষের উপকার করলে,তার প্রত্যুউত্তরে উপকার করতে না পারলেও,অন্তত অপকার করতে নেই। কিন্তু তুমি তো দেখছি,আমাকে কষ্টে দেখার জন্য মুখিয়ে আছো বালিকা।
আমাকে কি বাপ্পারাজ বানিয়েই ছাড়বে নাকি?

তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি,যেন বিয়ের পর তোমার মুখে ঐ কালা মানিকের নাম না শুনি। আর সেই তুমি এমন একজনকে আমার জন্য সিলেক্ট করছো,যে নিজেও ঐ কালা মানিকের নাম জপবে। না ভাই,দরকার নেই। আমি উপকার করেছি খাস দিলে,কোন রিটার্ন চাই না। তোমরা সুখে থাকো,পারলে ঐখানেই বিয়ে করে,দার্জিলিং,রাজস্থান,কাশ্মীরে হানিমুন সেরে,বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরো। তুহিন একদমে কথাগুলো বললো।

সাচী লজ্জায় নুইয়ে পড়লো, লজ্জাবতী লতার মতো। সেটা দেখে তুহিন অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে বললো, থাক আর লজ্জা পেতে হবে না।
আর আমার জন্যও ভাবতে হবে না। কতশত মেয়ে রোজ ক্রাশ খাচ্ছে। ওদের থেকে একটা সুইট সিক্সটিনকে ধরে, টুপ করে বিয়ে করে ফেলবো। তারপর তোমাদেরকে বেয়াই-বেয়াইন বানাবো। এবার সাচীও জোরে হেসে উঠে বললো,তারপর কিশোরী বিয়ে করার অপরাধে লাল দালানে যেও না যেন। তখন ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে,বিখ্যাত আরজে বাল্যবিবাহ করার অপরাধে,কারাগারে গ্রেফতার।
সাচীর কথা শুনে তুহিনও হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
তবে একটা কথা কি জানো?
সাচী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

এই প্রথম নিজে ফর্সা,নেশা ধরানো কন্ঠ থাকা স্বত্বেও, আফসোস হচ্ছে। কারন সেগুলো যে তোমাকে চিরদিনের জন্য টানতে পারেনি। তোমাকে টানলো,সেই কালা মানিক।
আসলে কি জানো,

আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম,তবে তোমাকে ভুলতে পারিনি। তাই ফিরতে হয়েছিলো আমাকে। তবে তোমার মনটা বোধহয় নিয়ে যেতে পারিনি,তাই সেখানে আজ অন্য কারো বিচরণ। আর তাতে তোমার কোন দোষ নেই। তুহিন কিছুক্ষণ থেমে, আবার উদাস কন্ঠে বললো,

‘আই লস্ট ইউ,হোয়েন আই লেফ্ট ইউ। এন্ড দ্যাটস নট ইউর ফল্ট।’

তুহিনের কথায় সাচী স্পষ্ট ব্যথার ছাপ অনুভব করলো। কিন্তু সাচীর কিছুই করার নেই। কখনো কখনো আমরা নিজের কাছেই,নিজে অসহায় হয়ে যায়। তবুও সাচী মনে মনে তুহিনের কাছে ক্ষমা চাইলো। জানে তাতে কোন লাভ নেই।
জীবনে সবকিছুতে তো আর লাভ-লোকসানের হিসেব কষলে চলে না। থাকুক না কিছু হিসেব,বেহিসেবী।
এরমধ্যে সাচীর বাবাও এসে গেলে। সাচী দুজনের থেকেই বিদায় নিয়ে চলে যায়। ঐখানে পৌঁছেই ফোন করতে বলে বাবা।

সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে গিয়ে, সাচীর ঐদিন রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। কত বড় দুর্ঘটনা থেকেই না বেঁচে ফিরলো দুজন। সাচী হঠাৎ দেখতে পায়,আরাদ রাস্তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আর কিছুটা দূরেই, একটা ট্রাক আসছে। সে আরাদকে ডেকে চলেছে, কিন্তু আরাদের হুঁশ নেই। একসময় সে আরাদের পেট বরাবর জোরে চেপে ধরে,সাইডে যেতে বলে। তখন আরাদ শুনতে পায়,আর সাথে সাথে গাড়ি সাইডে সরিয়ে নেয়। তবে আরাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে,সাচী ঐভাবে হাত দিয়ে ওর পেট চেপে ধরেছিলো। যেখানে প্রথমে কাঁধই স্পর্শ করেনি। যদিও সেটা পরিস্থিতে পড়ে করেছে। কিন্তু তবুও ঐ শক্ত করে পেটে জড়িয়ে ধরার অনুভূতি আর এয়ারপোর্টে সাচীর জড়িয়ে ধরা,এতটুকু ভালোলাগা নিয়েই, আরাদ নীরবে চলে যায়।

বিমান টেক অফ করার পরে,সাচী ব্যাগ থেকে আরাদের চিরকুটটা বের করলো। সে এতোদিন চিরকুটটার কথা ভুলেই গিয়েছিলো। কয়েকদিন আগে বের করে পড়েছে সে। হঠাৎ ওর মনে হলো,চিরকুটটাতে একটা ভুল আছে। তাই সেটা জানালার পাশে মেলে ধরলো। যেখানে সবুজ কাগজটায় লাল কালি দিয়ে লিখা,

আমার ঊষর ধরণী, স্পন্দন ফিরে পেলো,
#যখন_তুমি_এলে।
নাই বা তুমি আমার হলে!
নিচে একটু স্পেস দিয়ে লেখা,
আচ্ছা,এটা জানি কোন কবির লেখা?

সাচী প্রথম যেদিন চিরকুটটা দেখলো,সে ভেবে পেলো না,এটা চিঠিতে বলার কি আছে?
সরাসরিও জিজ্ঞেস করতে পারতো। আর তাছাড়া যাওয়ার আগে এই কথাটা চিঠিতে বলার কি আছে? মানুষ কোথাও যাওয়ার আগে,ভালোমন্দ কিছু বলে যায়। আর তিনি কবিতা লিখে,কবির নাম জানতে চান!
তবে সেও তখন বোকার মত গুগলে সার্চ করেছিলো এটা লিখে। কিন্তু এরকম কারো কবিতা নেই।
তাহলে?
সাচী তখন কিছু ভেবে না পেলেও,এখন সব জলের মত পরিষ্কার। ব্যাটা খুব সেয়ানা। যাকে সহজ কথায় বলে গভীর জলের মাছ। একবার শুধু বাগে পেয়ে নিক সাচী,তখন বুঝাবে, এতো ধড়িঁবাজির ফল।

সাচী চিরকুটটার শেষের দুটো লাইন কালো কলম দিয়ে কেঁটে, একেবারে মুছে ফেললো। যেন কোন অক্ষরও না বুঝা যায়। এবার চিরকুটটা পারফেক্ট লাগছে। কাজটা করে, সাচী শান্তি অনুভব করলো। আর মনে মনে ফন্দি আঁটলো,লাইন দুটো কার লেখা,সেটা দুইগালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে জানাবে। মুড ভালো থাকলে অবশ্য, থাপ্পড় দ্বিগুণও হতে পারে। আসছেন উনি দেবদাস হতে। কিন্তু আমি পার্বতী নয়।

আরাদকে চারকোণা ফ্রেমের চশমাতে বেশ মানায়। শর্টফিল্মের জন্য যখন আরাদ চশমা পড়েছিলো,ভীষণ ইনোসেন্ট লাগছিলো দেখতে। যদিও সাচী জানে,সে মোটেও ইনোসেন্ট না। মুখভর্তি চাপ দাঁড়ি,ছোট ছোট দুটি চোখ, কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল। সবসময় শার্টের হাতা ফোল্ড করে পরা যার অভ্যাস।
সাচী আরাদের জন্য একটা চশমা নিয়ে যাচ্ছে। না পরতে চাইলেও,জোর করে পরাবে। চাশমিশ ছেলেদের প্রতি ছোট থেকেই একটা আলাদা দুর্বলতা ছিলো ওর। এজন্যই ওর প্রিয় ক্রিকেটার নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্ররি।

বিমানের জানালার দিয়ে তাকিয়ে দেখে,সাদা সাদা মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে উড়ে যাচ্ছে সাচীর মন। তবে এবার ভুল কারো কাছে নয়। মন, মস্তিষ্ক যাকে চায়,তার কাছেই। হ্যাঁ,তুহিন ভুল কেউ ছিলো না। তুহিন সাচীকে সত্যিই ভালোবাসে। তবে তুহিনের প্রতি সাচীর ভালোবাসাটা,ক্রমেই হ্রাস পেয়ে গিয়েছিলো।
আর সেটা সাচী জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলো কেবল। কিন্তু তুহিন ঠিকই সাচীর মনের পরিবর্তনটা টের পেয়ে গিয়েছিলো। তাই নিজেই সরে গিয়ে,সাচীর নিজেকে বুঝার সুযোগ দিয়েছিলো।
সময়টা যেন কাঁটতে চাইছেনা।
যেন চোখের পলকে সময়টা কেঁটে গেলে, বেশ হতো। জানালার সেই মেঘের ভেলার দিকে দিকে তাকিয়ে, সাচী নিজেও চিরকুটের সেই লাইন দুটো আওড়ালো। তবে একটা শব্দ পরিবর্তন করে।
আমার ঊষর ধরণী,স্পন্দন খুঁজে পেলো,
#যখন_তুমি_এলে।

~ The End ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here