যখন_তুমি_এলে। #পর্ব- ১৮।

0
738

#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ১৮।
#লেখা- জাহান লিমু।

হাসপাতালের কেবিনে বসে আছে বিরুনিকা,ওর মা,আর বোন। সবার চোখেমুখে উৎকন্ঠা, আতঙ্ক। বারবার অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকাচ্ছে সবাই। স্মরণিকা মুখ চেপে ধরে কাঁদছে। মেয়েটা একটু বেশিই ইমোশনাল। আর যথেষ্ট ভয়ও পেয়েছে।
কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটারের লাইট নিভলো। ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। অপারেশন সাকসেসফুল। তবে রোগীর এখনো সেন্স আসেনি,একটু সময় লাগবে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। পাতলা স্কার্ফ দিয়ে বাঁধলে কি আর রক্ত পরা বন্ধ হয়। তার মধ্যে ক্ষতটা মোটামুটি গভীর। বেশ জোরেই আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। কমপ্লিট বেডরেস্টে থাকতে হবে রোগীকে।
রোগীকে কেবিনে শিফট করা হলো কিছুক্ষণ পর। সবাই দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো।
কিন্তু কমপক্ষে সাতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। এরপর বাসায় নেয়া যাবে। বিরুনিকা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ সবাই তো আর থাকা যাবে না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো বিরুনিকার মা কোমল আর স্মরণিকাই থাকবে। বিরুনিকা বাসায় চলে যাবে। দিনে খাবার নিয়ে আসবে। তাছাড়া বাসায় বিরুনিকার ছোট ভাই একা। হাসপাতালটা বিরুনিকাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই ভাইকে ঘুমে রেখেই তালা দিয়ে চলে এসেছে। খবরটা শোনার পর ভয়ে অস্থির হয়ে যায় ওরা। তাই ঘুমে রেখেই চলে আসে। অবশ্য একদম ছোট নয়। আটবছর বয়স,তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আর একদম চালু,বুদ্ধিমান। দুষ্টের শিরোমণি। এই বয়সেই তার একজন সিরিয়াস ক্রাশ আছে। ভাবা যায়!

সাতদিন পর রোগীকে বিরুনিকাদের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয়। বিরুনিকার মা চাইছেন,যে তার মেয়ের সম্মান রক্ষা করেছে,তাকে তিনি নিজেই সেবা করে সুস্থ করে দিবেন। আজকাল কে কার জন্য এমন ঝুঁকি নিতে আসে?
যেখানে চোখের সামনে খুন হলেও,মানুষ চোখে পট্রি বেঁধে থাকে। তবে ছেলেটা আসতে চাইছিলোনা অবশ্য। স্মরণিকার কান্নাকাটি, আর কোমলের জোরাজুরিতে অবশেষে আসতে রাজি হলো। স্মরণিকা তো ইতিমধ্যে ছেলেটাকে ভাই বানিয়ে ফেলেছে। সারাক্ষণ ভাইয়া ভাইয়া করছে। এটা সেটা করে খাওয়াচ্ছে। ফল কেটে দিচ্ছে,জুস করে দিচ্ছে। সময়মত ঔষুধ নিজে খাওয়ায় দিচ্ছে। সেটা দেখে অবশ্য তার আপন ছোট ভাই বেশ জ্বলছে। যদিও তাদের দুই ভাই বোনের মধ্যে সারাক্ষণ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলে। আর সেখানে একটা অপরিচিত ছেলের জন্য স্মরণিকার এতো ভালোবাসা দেখে,তার বেশ পুড়ছে। যদিও সে বিষয়টা বুঝতে পারছেনা। কারন কেউ ওকে বলেনি। ছোট মানুষ,বুঝবেনা। তার বোন কেমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলো। আর সেই ছেলেটা তার বোনকে বাঁচিয়েছে। আর নিজে আজকে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। তবে সে তো আর এটা জানেনা, বা বুঝেনা।

তবে বাসার সবাই এখন তার কথা ভুলে,সারাক্ষণ ঐ ছেলের যত্ন নিচ্ছে। তাই সে ঐ ছেলেকে মোটামুটি নিজের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে এখন। সারাক্ষণ গাল, মুখ ফুলিয়ে রাখে। সেটা দেখে স্মরণিকা মুখ লুকিয়ে হাসে। কারন দেখলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বেনা। ভাই বোন সারাদিন টম এন্ড জেরীর মত লেগে থাকে। অথচ দুজনের বয়সের পার্থক্য আট বছর। স্মরণিকা ষোল, সাফুয়ান আট। অবশ্য তাদের দুজনের দেয়া নিজেদের দারুণ দুইটা নাম আছে। সাফুয়ান স্মরণিকাকে সিডর ডাকে,আর স্মরণিকা সাফুয়ানকে ডাকে সাইক্লোন।
এভাবেই চলে তাদের যুদ্ধ।
বিরুনিকা এদের শাসন করতে করতে ক্লান্ত। মা বাসায় থাকেনা সারাদিন। আর দুটোতে চলে মারামারি,কাঁটাকাঁটি। কাঁটাকাঁটি বলছে কারন, একবার সাফুয়ান কামড় দিয়ে স্মরণিকার হাত থেকে রক্ত বের করে ফেলেছিলো। রাগে স্মরণিকাও নেইল কাটারের চাকু দিয়ে সাফুয়ানের হাতে জোরে মেরে বসেছিলো। অবশ্য সাফুয়ানের তেমন লাগেনি।
স্মরণিকার ফোন নিয়ে সে সারাক্ষণ গেমস খেলবে। আবার বিরুনিকারটা নিবে না।
পিটাপিটি ভাইবোন থাকলে বোধহয় এমনই হয়।

.

ছাদে উদাসীন হয়ে বসেছিলো রোহানী। আরাদের সাথেও কথা হয়না অনেকদিন। ফোন দিলে নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে। আর ভার্সিটিতেও আসে না। রোহানী একদিন ভার্সিটি গিয়েছিলো এরমধ্যে । কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করাতে বলে যে,তারা কেউ আরাদকে দেখেনি। বাসায় যেতে পারতো আরাদের,কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে হয়নি। যখন সমস্যার উদ্ভব হয়,তখন সবদিক ঝাপসা হয়ে আসে।
এমন একটা সমস্যার সময়ে বেস্টফ্রেন্ডকেও যখন পাশে পাওয়া যায় না,তখন চূড়ান্ত হতাশা কাজ করে। রোহানী জানেনা সে কি করবে, বা কি করছে!
মা নামক মানুষটা এতো কঠিন যে, যেটা বলবে সেটাই। এখানে অন্য কেউ আর কিছু বলে কোন কাজ হবেনা। তবুও আরাদ থাকলে হয়তো একটা না একটা উপায় বের করতো। সব বিষয়ের একটা না একটা সমাধান বের করতে সে ওস্তাদ।

রোহানী জানতো যে ওর মা এমন। এজন্যই কোনদিন প্রেম, ভালোবাসার কথা মাথায় আনেনি। আর তেমন কেউ আসেওনি জীবনে। কিন্তু সেই অবশেষে প্রেমে পড়েই গেলো। সে জানতো তার মা হয়তো কোনদিনই এ সম্পর্ক মানবেনা। কারন তানিমরা মধ্যবিত্ত। আচ্ছা, ভালোবাসা শব্দটা যদি চিরন্তন হয়,তাহলে সেখানে কেন সবসময় ক্লাসের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে?
রোহানী নিজের মায়ের বিষয়ে জেনেও, কেন এমন একটা ছেলের প্রেমে সে পড়লো,তার উত্তর তার কাছে জানা নেই।
ভালোবাসাটা এভাবে হুঁট করেই হয়ে যায়। কোন কলিংবেল বাজিয়ে তো আর ভালোবাসা আসে না।
আর রোহানী কার জন্য এতো উতলা হচ্ছে?
যে সামান্য রাগারাগিতে তার খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে? তার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তাহলে সে কেন তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে?
তারচয়ে বরং এটাই ভালো।
অন্তত মা,বাবা তো খুশি হবে।
ভালোবাসলেই যে, তাকে নিজের করে পেতে হবে,তার তো কোন প্রয়োজন নেই।
আমাদের জীবনে কেউ কেউ হয়তো ভালোবাসতেই আসে,পাশে থাকতে নয়। পাশে থেকে হাতে হাত রেখে জীবন চলতে নয়। তারা আমাদের রঙিন স্বপ্ন দেখাতে আসে। সেই স্বপ্ন পূরন করতে নয়। তারপর অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।
যখন অন্ধকারেই ফেলবে,তখন কেন ভালোবাসা নামক রঙের ছঁটা দেখাতে আসে?
যারা মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়,তাদের ভালোবাসার অধিকার নেই। ভালোবাসতে হলে,আগে শক্ত করে হাত ধরতে জানতে হয়।

.

সোহানী তার বোনকে জোর করে নিয়ে বাইরে বের হয়েছে। কারণ রোহানী একদম আসতে চাইছিলোনা। সোহানীর পিড়াপিড়ীর কাছে হার মেনে সে আসলো। একটা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। জায়গাটা শহর থেকে একটু দূরে। চারদিকে সবুজের সমারোহ।
ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলো,এটা একটা পার্ক। তবে প্রায় গ্রাম সাইডে পড়েছে। তবে এর আগে রোহানী এখানে আসেনি। সোহানী এই জায়গা কি করে চিনলো,কে জানে।
তবে জায়গাটা দেখে রোহানীর মনটাই ভালো হয়ে গেলো। গ্রামের দিকে হওয়াতে এতো বেশি মানুষের গমগমও নেই। বরং বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মত একটা জায়গা। রোহানী চোখ বন্ধ করে দু’হাত উঁচিয়ে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এখন একটু হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে সব ঠিক আছে,সব স্বাভাবিক।
অথচ জীবনে ঝড় বয়ে চলেছে।
সেই ঝড়ের পরিণতি কি,সেটা জানা নেই।
সব উপড়ে ফেলে দিবে,নাকি মুচড়ে দিবে।
চোখ খুলে পিছনে তাকাতেই দেখে সোহানী সেখানে নেই। আশ্চর্য মেয়েটা ওকে একা রেখে কোথায় গেলো?
রোহানী কিছু বুঝতে পারছেনা। এতটুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটা কোথায় গেলো?
এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ সামনে একটা অবয়ব দেখে, থমকে দাঁড়ালো। পেছন থেকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রোহানী সামনে এগুতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। পা দুটো কেমন অসাড় হয়ে আসছে।
ধীর পায়ে অবয়বটার কাছাকাছি গেল সে। কাছে গিয়ে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,
” কে আপনি?”
লোকটা কোন কথা বললোনা। রোহানী আবার প্রশ্ন করলো,কিন্তু মানুষটা নির্বাক। বোবা নাকি!
হঠাৎ উপর থেকে কি যেন পড়তে শুরু করলো। রোহানী একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো। রোহানী উপরে তাকিয়ে দেখে,গাছ থেকে ফুলের পাপড়ি পড়ছে। তবে গাছটাতো ফুলগাছ নয়। বরং কি যেন একটা রশির মধ্যে, একটা ব্যাগ বাঁধা। সেটার ভেতর থেকেই ফুল পড়ছে।
রোহানী কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে টেনশনে সে এতোক্ষণ খেয়াল করেনি যে,সামনের লোকটার হাতে উপরের ব্যাগের সাথে যুক্ত একটা রশি। সে হাতে ধরে নাড়াচ্ছে,আর ফুল পড়ছে।
হচ্ছে টা কি!
রোহানী লোকটার সামনে যেতে নিবে,তখন সেই ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়। রোহানী এক পা পিছিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
তানিম!
বিড়বিড় করে বলে উঠে নামটা।
তানিমের ঠোঁটের কোনে হাসি। ব্লু জিন্স,শার্ট পরিহিত তানিমকে একপলক তাকিয়ে দেখলো রোহানী। তানিম হাসছে।
মানুষটা কত স্বাভাবিক!
রোহানী বিস্ময় লুকাতে পারছেনা। এতোকিছুর পরও সে এতো স্বাভাবিক কি করে?
আর এখন যা করছে,এসবের কি মানে?
রোহানী চোখ খিঁচে মাথা চেপে ধরলো। ঠিক তখনি তানিম হাঁটুঘেরে বসে পড়লো রোহানীর সামনে। রোহানী সেটা না বুঝতে পারলেও,এতটুকু বুঝতে পারলো যে তানিম ওর কাছাকাছি এসেছে। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই রইলো। তানিমের বলা কথাটা শুনে সে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তানিম আংটি সামনে মেলে ধরে বললো,
” উইল ইউ ম্যারি মি?”
বাক্যটা যেন রোহানীর কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। ঠিক শুনছে তো সে?
নাকি এটা কোন কল্পনা!
মায়ের বলা কথা, সব একটু সময়ের জন্য রোহানী ভুলে গেলো।
আগেপিছে কোনকিছু না ভেবেই মুহুর্তেই তানিমের সামনে ওর ডানহাত বাড়িয়ে দিলো। না হলে যদি এটা স্বপ্নের মতই, হাওয়া হয়ে যায়!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here