মোনালিসা পর্ব ৫

0
1303

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৫

আবীরের উদ্বিগ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে রাজীব বলতে শুরু করে –
“কলকাতা থেকে মন্দারমণির দূরত্ব চার – পাঁচ ঘন্টা । ভোর পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে।
ভোরবেলা বেরোনোর কারণ, রাতের শহরের জেগে ওঠার সাক্ষী হয়ে হাওয়ার বুক চিড়ে এগিয়ে চলা ।
জানিস, একাকী জীবনের একাকীত্বেরও একটা ছন্দ আছে। একটা উন্মাদনা আছে, সেদিন প্রথম উপলব্ধি করি।
যেখানে স্বাধীন মন, মনের সীমানা ছাড়িয়ে দূর – দূরান্তে ভেসে বেড়াতে পারে।ঠিক এ রকমই সেইদিন মনে হচ্চিল গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে চলার সময়।
কোথাও আলোর প্রগাঢ়তার সাথে সাথে ছোট দোকান পাটগুলো জেগে উঠছে তাদের কাজের জন‍্য, কোথাও কুন্ডলি পাকিয়ে আলসেমিতে ভর করে থাকা কুকুরটা গা ঝাড়া দিয়ে নড়েচড়ে উঠে বসছে, তো কোথাও মানুষ জন নিজের নিত‍্য কর্মব্যস্ততার সূচনায় নিজেদের কাজে মত্ত।
এইসব কিছুর মাঝে একটা ঠান্ডা বিয়ারের কয়েক সিপ নিয়ে , হালকা মিউজিক চালিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি । সেদিন হঠাৎই একাকীত্ব ছেড়ে আমার মন যেন নিজের সাথেই মত্ত হয়ে উঠেছিল।
আচমকা মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন এক অনাবিল আনন্দের মুহূর্ত আমাকে উপহার দিতে চলেছে । যা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার মনে। কিন্তু , বিশ্বাস কর তা তীব্র যন্ত্রণার কারণ হবে আমার কাছে তা আমি কখনো ভাবিনি।
সেই মুহূর্তে আমি একবারও ভাবিনি অন‍্য কোনো কথা । শুধু আমার মাথায় একটা কথাই চলছিল। তুই, দিদি তোরা সবাইও একা একা নিজেদের মতো জীবনে এগিয়ে চলছিস, আমাকেও এগোতে হবে।
মাঝে রাস্তায় একবার গাড়ি থামিয়ে একটা ধাবায় কিছু খাবার খেয়ে বেলা দশটা – সাড়ে দশটা নাগাদ আমি রিসর্টে পৌঁছাই।

স্নান সেরে শর্টস পরে একটু রিলাক্সেসনের জন‍্য একটা বিয়ারের বোতল আর বাইনোকুলার নিয়ে ব‍্যালকনিতে গিয়ে বসলাম ।
বিয়ারটা শেষ করে বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি প্রত‍্যক্ষ করতে করতে আচমকা সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা একদল মেয়ের মাঝে সবথেকে উচ্ছ্বসিত একটি মেয়েকে দেখে চোখ স্থির হয়ে যায়।
ওয়েস্টার্ন আউটফিঠে সাদা রঙের লং ড্রেসের সাথে মানানসই বড় একটা টুপি , চোখে সানগ্লাস আর সাদা মুক্তোর মত সাজানো দাঁতের উপচে পড়া নিষ্পাপ হাসি যেন আমার হৃদপিণ্ডকে খন্ড খন্ড করে দিচ্ছিল।
আমি শুধু পাথরের মতো তাকেই নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিলাম। ততক্ষণে বিয়ারের নেশা কেটে মোহময়ীর নেশায় আমার মন ধাবিত হয়ে পড়েছে।”

“স‍্যার প্লেটগুলো নিয়ে যাবো? আপনাদের আর কিছু লাগবে?” সামনে রেস্টুরেন্টের পোশাক পরিহিত ওয়েটার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।

তাকে প্লেটগুলো নিয়ে যাওয়ার এবং ঠাণ্ডা পানীয়ের অর্ডার দিয়ে আপাতত বিদায় জানায় রাজীব।

“তারপর কী হল ?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করে আবীর।

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রাজীব বলে ওঠে, “প্রায় পাঁচটা বাজতে যায়। ঠাণ্ডা পানীয়টা পান করে চল এখান থেকে উঠে পড়ি। কারণ , সবটা শুনতে গেলে রাত হয়ে যাবে। তোর কী অন্য কোনো কাজ আছে?”

“নাহ্, আমার কোনো কাজ নেই আপাতত। কোথায় যাবি?”

“কোনো নিরিবিলিতে গিয়ে বসি চল।”

“সে সব ঠিক আছে। কিন্তু, একটা কথা ভেবে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।” এইবলে চুপ করে যায় আবীর।

“তোর আবার কোন কথা খারাপ লাগলো!” বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞাসা করে রাজীব।

“এই যে তোর জীবনের এতকিছুর কিছুই আমি জানতে পারলাম না। সেটা কি শুধুমাত্র দূরে থাকার জন‍্য! নাকি মন থেকে আমাকে অনেকটা দূর তুই আগেই করে দিয়েছিলিস , সেটাই বুঝতে পারছি না! অ্যানি ওয়ে বাদ দে, ক‍্যারি অন।”

“দেখ, আমি কোনো ক্লারিফিকেশন দিচ্ছিনা। তবে এটুকু ঠিক – সেই মুহূর্তে সেটা ভালো লাগা ছিল, না ভালোবাসা ছিল ! সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তাহলে তোকে জানাতাম কীভাবে? এতো দ্রুত আমার জীবনে ঘটনা গুলো ঘটছিল যে, তখন আমার পক্ষে বোঝা সম্ভবই ছিলনা কী হচ্ছে আমার সাথে! আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।
আমি সবটুকুকে একটা ইনফ‍্যাচুয়েশন বা অ্যাক্সিডেন্ট বা নিজের মনের ভ্রম ভাবতে পারতাম কিন্তু পর পর ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেই সবকিছু আমি চাপা দিয়ে রেখেছিলাম এতোদিন। একটা ভুল মনে করে সব ভুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো জানিস!”আবীরের হাত দুটো চেপে ধরে বলে ওঠে রাজীব।

ততক্ষণে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে ওয়েটার হাজির। ওয়েটারকে বিলটা আনতে বলে রাজীবের হাতটা ধরে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আবীর বলে ওঠে, “নে ঠান্ডা টা খেয়ে আপাতত ঠাণ্ডা হ্। তারপর চল আমার সাথে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসবি।ওখানে নিরিবিলিতে বসে সবটুকু শুনবো। আর হ‍্যাঁ, এতো ভেঙে পড়িস না।”

এদিকে সন্ধ‍্যাবেলা রাতের রান্নার সারার কাজে ব‍্যস্ত কনক দেবী……
“ওহ্, মা! ওহ্, মা! লিসা কবে আসবে? আমার যে আর ভালো লাগছে না। বলো না, লিসা কবে আসবে?” রান্নঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে জিজ্ঞাসা করেই চলেছে জোজো।

“বেয়াদব ছেলে কোথাকার ! সকাল থেকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে । লিসা কবে আসবে আর লিসা কবে আসবে করে। হাভাতে হেঁসেলের পঞ্চব‍্যঞ্জন্ রান্না করতে করতে একে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার মধ‍্যে আবার তোর জ্বালাতন।
ভালোয় ভালোয় বলছি জোজো যা এখান থেকে নাহলে তোর একদিন কী আমার একদিন।” রান্নাঘরে রান্নায় ফোঁড়নের ঝাঁঝের সাথে তাল মিলিয়ে ঝেঁঝিয়ে ওঠে কনক দেবী।

হাওয়া খারাপ বুঝে দৌড়ে বাবার ঘরে চলে যায় জোজো।

বিদ‍্যুৎ বাবু তখন অর্ধেক শরীর টেবিলে ঝুঁকিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে ব‍্যস্ত।

সন্তর্পণে জোজো এসে বাবার টেবিলের পাশে দাঁড়ায়। জোজোর উপস্থিতি লক্ষ‍্য করে খবরের কাগজে মনোনিবেশ করা অবস্থাতেই বিদ‍্যুৎ বাবু জিজ্ঞাসা করে ওঠেন,”কী ব‍্যাপার জোজো তুই পড়তে বসিসনি এখনো! কিছু বলবি?”

এবার শান্ত কন্ঠে জোজো বলে ওঠে, “বাবা, লিসা কবে আসবে? আমার আর ভালো লাগছে না। মাকে জিজ্ঞাসা করলেই মা বকা দিচ্ছে। বলোনা বাবা! লিসা কবে আসবে?”

এবার গলাটা যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বিদ্যুৎ বাবু বলে ওঠে, ” আসবে খুব তাড়াতাড়ি আসবে। নতুন জায়গায় তোর লিসা এখন গেছে, সেখানে কিছুদিন থাকুক তারপর আসবে।” কথাটা বলতে বলতে লিসা মুখটা মনে পড়তেই চোখের কোণ জলে ভরে ওঠে বিদ‍্যুৎ বাবুর।

“নাহ্, লিসা এখন আসবে না। তুই যা পড়তে বোস জোজো।” মা কে দেখেই পড়ার ঘরে ছুট লাগায় জোজো।

সেদিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎ বাবু বলে ওঠে, “ওভাবে বললে কেনো? বাচ্চা ছেলে কষ্ট পাবে?”

“আহা, বাচ্চা ছেলে কষ্ট পাবে…..ঢং করোনা! তোমার ঐ ভাইঝি, আপদ ঘাড় থেকে নেমেছে এই ঢের। আর এতো বাড়াবাড়ি করোনা। জোজোকে আস্তে আস্তে ভুলতে হবে লিসাকে। আর শোন লিসাকে ফোন করবে না একদম, বলে দিলাম।”

“কিন্তু, কেনো?”

“বাপ – মা মরা মেয়ে তার সাথে যত কথা বলবে ওর ততই মন খারাপ করবে। তখন আর সংসার করতে চাইবে না। তাই এখন খোঁজ খবর নেওয়ার কোনো দরকার নেই।” এই বলিয়ে মুখ টুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় কনক দেবী।

রান্নাঘরে ঢুকে আগুনের তাপে লালচে মুখে কড়াইয়ের ঝোলের সাথে তার মনটাও যে টগবগিয়ে ফুটতে থাকে তার প্রমাণ ঝরে পড়ে গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জলের বিন্দু ঝরে পড়াতে।

সবার আড়ালে চোখ মুছে নিজের মনেই সে বলে ওঠে, “লিসা, সারাজীবন তোর জেঠিকে খুব কড়া মনের মানুষ ভাবিস তুই। কিন্তু, মা মেয়েদের যে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here