ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ১৬
* * ৪৫ * *
কাল রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে অভিশপ্ত রাত। ভেবেছিলাম এক আর হলো আরেক। পল্লবী এতদিন গায়ে পড়ে কথা বলত, সময় কাটাতে চাইত। কিন্তু ওর মনে যে এসব চলছে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি। পেলে অনেক আগেই রাশ টানতাম। ওর বাবা যে হঠাৎ ওরকম একটা অ্যানাউন্স করে বসবে টেরও পাই নি, আর যখন বুঝলাম ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওই অ্যানাউন্সের পর সকলে এমনভাবে কনগ্ৰাচুলেট করতে শুরু করলো যে পুরো ক্যাবলা বনে গেছিলাম। ধাতস্থ হতেই প্রথম যার কথা মনে হলো, সে হলো সুজাতা। এতক্ষণ ওর পাশেই তো দাঁড়িয়েছিলাম। পল্লবীর বাবা ওরকর অ্যানাউন্স করার পর পল্লবীই গিয়ে আমাকে টেনে এনেছে সবার মাঝে। একথাটা মনে হতেই চোখ চলে গেছিলো সেই খানে, যেখানে সুজাতা দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এখন ওখানে ও নেই! সর্বনাশ! কোথায় গেলো ও? আমার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছিলো। ছুটে গেলাম ওর পরিবারের কাছে, ওনারা জানালেন সুজাতা এইমাত্র চলে গেছে। চলে গেছে! তার মানে এই সব দেখে আমাকে ভুল বুঝে ও চলে গেলো! এখন আমি কি করব! অনেকবার ফোন করলাম। প্রথম প্রথম রিং হয়ে হয়ে কেটে যাচ্ছিলো। ও ফোন ধরছিলো না। পরের দিকে ফোনটা সুইচ অফ বলছিলো। ইচ্ছা করছিলো ছুটে যাই ওর কাছে। বুঝিয়ে বলি সবটা। কিন্তু বাবা-মা, গেস্টস, আর সর্বোপরি ওই পল্লবী আর ওর বাবার মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারি নি।
রাতে কোনোরকমে নিজের ঘরে ফিরেছিলাম। কি ভেবেছিলাম। আর কি হলো। সারা রাত আর দুচোখের পাতা এক করতে পারি নি। সারা রাত বসে ভেবেছি। সকাল হলেই বাবা মা কে জানিয়ে দেবো, তে আমি পল্লবীকে নয়, সুজাতাকেই ভালোবাসি, আর ওকেই বিয়ে করতে চাই। আর সকাল হলেই ছুটবো আগে সুজাতার কাছে। ওকে সবটা খুলে বলতেই হবে।
সকালে বাবা মা ঘুম থেকে ওঠার পরই আমি ওদের সামনে মাথা নীচু করে এসে দাঁড় হলাম। কি ভাবে বলব কথাটা বুঝতে পারছিলাম না। বাবাই আমার সমস্যা সমাধান করে জিজ্ঞেস করল কি হলো? কিছু বলবে? বাবার গলাটা আজ বেশ গম্ভীর। হয়ত কালকের ঘটনায় বাবা অসন্তুষ্ট। কিন্তু আমাকে আজ বলতেই হবে। নইলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমি কোনো রকমে নিজেকে সামলে বললাম তোমাদের সঙ্গে কটা কথা ছিলো। বাবা পেপার পড়ছিলো, আর মা বাবার পাশে বসে চা খাচ্ছিলো। আমার কথা শুনে মাও চায়ের কাপ সরিয়ে আমার দিকে তাকালো, আর বাবাও মুখের সামনে থেকে পেপার সরিয়ে গম্ভীর ভাবেই বলল আমাদের সঙ্গে? কি কথা?
-আ-আমি পল্লবীকে বিয়ে করতে পারবো না।
-কেন?
-আমি ওকে ভালোবাসি না, অন্য কাউকে ভালোবাসি।
-সে কথাটা তোমার কালই জানানো উচিৎ ছিলো না কি?
-আমি বুঝতে পারিনি বাবা, এরকম কিছু হবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি পল্লবীর সঙ্গে ঘুরছিলাম না, বরং ওই-ই আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিলো।
-তাহলে এখন কি করতে চাও?
-তুমি ওদের না করে দাও বাবা। এ বিয়ে আমি করতে পারবো না। ওরা তোমাদের কাছে ডিসিশন জানতে চেয়েছে, তুমি বলে দাও তোমরা রাজী নয়, আর আমারও মত নেই।
এবার বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বেশ। বলে দেবো। আর কিছু?
আমি মাথা তুলে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি বাবা। আর তাকেই বিয়ে করতে চাই।
বাবা এবার আমার কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসলো। তারপর গম্ভীর ভাবেই বলল সেটা কে জানতে পারি কি?
-সুজাতা। সুজাতা সেন।
আমার এই কথার পর ঘরে ঘরে ক্ষনিকের জন্য নিস্তব্ধতা ভরে গেলো। তার পরে বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নাও অবশেষে তোমার ছেলের পেট থেকে কথাটা বেরোলো। বলছিলে না, কবে বলবে, কবে বলবে। মা-ও দেখলাম এই কথা শুনে হেসে ফেলল, শুধুই কি আমার ছেলে? তোমার নয়? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল মনের কথাটা বলতে এত সময় লাগালে হবে? আমি তো বাবা মায়ের রিঅ্যাকশন দেখে চমকে গেছিলাম। আমার মাথায় ঢুকছিলো না ব্যাপারটা। ক্যাবলার মতই দাঁড়িয়ে আছি দেখে মা-ই হেসে আমার সামনে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল আমরা সবই জানতাম। শুধু তোর স্বীকারক্তির অপেক্ষা করছিলাম। আমি অবাক হয়েই বললাম কি করে জানলে? মা হেসে বলল, মায়েরা সব বোঝে, ছেলেমেয়েরা কি চায়, কি বলতে চায়। বোকা। এবার বাবাও গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল আর মায়েরা জানলে বাবারাও জেনে যায়। এবার দুজনেই একযোগে হেসে উঠল। আমার এবার লজ্জা লাগছিলো, ধরা পরে যাওয়ায়। মা আমার কান ধরে টেনে বলল তা পেটের কথা পেটেই আছে? নাকি তাকে বলাও হয়েছে? আমি মাথা চুলকে বললাম কালকেই বলব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই……..। মা আর বাবা একে অপরের দিকে অর্থপূর্ন দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর বাবা উঠে গিয়ে কাউকে ফোন করল। কথা শুনে বুঝলাম বাবা পল্লবীর বাবাকে ফোন করেছে। এবং বলছে যে এই বিয়েতে ওদের সায় নেই। এমনকি আমারও সায় নেই। আমি জানিয়েছি যে আমি পল্লবীকে ভালোবাসি না, তাকে বিয়েও করতে পারবো না ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরেও আরোও কিছু কথা বলে বাবা ফোন রেখে জানালো, যে ওদের বলে দিয়েছে এই বিয়ে হচ্ছে না। এরপর মা আমায় বলল, যা এবার সুজাতাকে নিজের মনের কথাটা বলে দে, আর দেরী করিস না। এখনই যা। আমিও তাড়াতাড়ী মাথা নেড়ে নিজের ঘরে এলাম তৈরী হয়ে সুজাতার কাছে যাবো বলে।
* * ৪৬ * *
ভাগ্য সব সময় আমার চিন্তাভাবনার প্রতি যে সদয় নয়, তা আবারও প্রমান হলো। ভেবেছিলাম পল্লবীর ঝামেলা মিটেছে। কিন্তু না! মেটেনি। মেয়েটা যে আমাকে নিয়ে এই মাত্রায় অবসেসড বুঝতে পারিনি। বাবা ফোন করে জানানোর আধঘন্টার মধ্যে ও আমাদের বাড়ী এসে হাজির। এসেই তো আমার ওপর চড়াও হলো, আমি ওকে কেন ভালোবাসি না, ওর সঙ্গে ঘুরেছি, তাও ওকে ভালোবাসিনি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি সব আজব আজব প্রশ্ন। আরে বাবা! তুই আসার আগেই আমার জীবনে, আমার মনে আমার সুজাতা এসে গেছে। আর এমনভাবেই এসেছে যে এই জীবনে তো আর ওই জায়গা অন্য কারোর হতেই পারে না। কিন্তু এ মেয়েও নাছোড়বান্দা। কেন ওকে ভালোবাসি না এটা ওকে বলতেই হবে। আজব তো! আমি কাকে ভালোবাসবো তা ওকে বলতে যাবো কেন? বাবা মা-ও বিরক্ত হচ্ছিলো ওর কান্ডকারখানা দেখে। শেষে বাবা রেগে গিয়ে গম্ভীর হয়ে পল্লবীকে বলল আমাদের ফ্ল্যাট থেকে চলে যেতে। এভাবে জোর করে সম্পর্ক তৈরী হয় না। তৈরী করা যায় না। যা বক্তব্য বাড়ীর বড়রা ঠিক করেছেন তাই আমিও মেনেছি, ওকেও মানতে হবে। একথা শোনার পর পল্লবী আমাকে, বাবাকে হুমকি টুমকি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মা বাবাও ওর হুমকিকে ফাঁকা আওয়াজ বলে আমাকে বলল তাড়াতাড়ী সুজাতার কাছে যেতে।
কাল থেকে সুজাতাকে ফোন করেই যাচ্ছি, ফোন সুইচ অফই বলে যাচ্ছে ক্রমাগত। কি হলো! সুজাতা ঠিক আছে তো! ও আদৌ বাড়ী আছে কিনা না যেনে তো যেতে পারি না। ও কোথায় আছে যেনে তো ওর কাছে পৌছবো। কিন্তু ফোন বন্ধ রাখলে জানবো কি করে। মা দুবার তাগাদা মারলে, মাকে বললাম কথাটা। মা বলল দ্যাখ হয়ত স্কুলে গেছে। ক্লাস নিচ্ছে তাই ফোন বন্ধ রেখেছে। কিন্তু আমার মনে কু গাইছে। মন বলছে কিছু একটা ঘটেছে। আমি জানি সুজাতা আমাকে নিয়ে পজেসিভ। আর কাল রাতে ও যা নিজের চোখে দেখেছে, নিজের কানে শুনেছে! তার পর তো…………..। আমি তৈরী হয়ে ওর স্কুলে যাবো বলেই বেরিয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু বাবা শেষে বাধা দিয়ে বলল স্কুলটা ওর কর্মস্থল, সেখানে ব্যক্তিগত কথা বলার জায়গা নয়। ওখানে ও পড়াতে গেছে, আলাদা জগৎ। ওখানে এসব কথা বলতে যাওয়া ঠিক নয়। এতদিন যখন চুপ ছিলে, আর একটা বেলাও চুপই থাকো। বিকেলে যেও ওদের ফ্ল্যাটে। তখনই গিয়ে ওকে বুঝিয়ে বোলো সব কথা। আসলে পল্লবীর আচমকা আগমন ও ওই রূপ দেখে বাবা বিরক্ত ও খানিক চিন্তিতও। আমিও কথা না বাড়িয়ে বাবার কথাটা মেনেই নিলাম।
বিকেলের আগেই যে আরোও বড় ঝড় আসতে চলেছে সেটা বুঝতে পারিনি। পল্লবী যে হুমকিগুলো দিয়ে গেছিলো সেগুলো যে ফাঁকা নয়, তা এক বেলার মধ্যেই বুঝতে পারলাম। কারন দুপুরেই ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজালো পুলিশ। পল্লবী নাকী এখান থেকে বাড়ী ফিরেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। ওর বাবা ও বাড়ীর চাকরবাকর রা মিলে ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করায়। সময় মত চিকিৎসা শুরু হওয়ায় ও প্রাণে বেঁচে গেছে। কিন্তু সুইসাইড কেস বলে পুলিশ জড়িয়েছে ব্যাপারটায়। যেহেতু ও সুইসাইড করার আগে আমার কাছে এসেছিলো, আর আজকের খবরের কাগজের সৌজন্য সবাই জেনেছে যে রজতকুমারের জন্মদিনের পার্টিতে পল্লবীর বাবা পল্লবী আর রজতকুমারের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে তাই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমার কাছেই এসে হয়েছে। এবং আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে ওদের ইনভেস্টিগেশনে হেল্প করতে হবে। কি আর করা। দায়িত্ববান নাগরিক, সেলিব্রিটি তাই বাধ্য হয়েই যেতে হলো পুলিশের সঙ্গে।
কিন্তু ইনভেস্টিগেশন যে রাত অবধি গড়াবে এটা জানা ছিলো না। বাবা ভালো লইয়ার হায়ার করেছিলো আর আমার এগেন্সটে সুইসাইড প্রোভোকিং এর অ্যালিগেশন পল্লবী বা ওর বাবা আনে নি বলে ছাড়া পেয়ে গেলাম। কিন্তু রাত দশটা বেজে গেলো সব মিটতে। অত রাত অবধি পুলিশের চক্কর কেটে আর মিডিয়ার নজর এড়াতেই আর সুজাতার কাছে যেতে পারলাম না। মা চিন্তা করছিলো তাই ছাড়া পেয়ে আগে সোজা বাড়ী এলাম বাবার সঙ্গে। আমাকে বাড়ীতে দেখে মা-ও নিশ্চিন্ত হলো।
আমি বাড়ী ফেরার পর পল্লবীর বাবা ফোন করেছিলেন। ক্ষমা চাইতে। বললেন পল্লবী ওনার বড় আদুরে মেয়ে, যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, তাই রিজেকশন নিতে পারে নি। ছেলেমানুষীর বশে এরকম কান্ড করে ফেলেছে। মা খুব রেগেছিলো। আর মা রাগলে পুরো ঝাঁসি কি রাণী। প্রবল বিক্রমে ঝগড়া করে পল্লবীর বাবাকে খুব করে কড়া কথা শুনিয়ে ছেড়েছে। তবে উনি মাইন্ড করেননি দেখে রিল্যাক্স হলাম। উনি মায়ের কন্ডিশন বুঝে বললেন চিন্তা না করতে, উনি পল্লবীকে নিয়ে দুবাই ফিরে যাবেন। যতদিন না ও ফিজিক্যালি বা মেন্টালি সুস্থ হচ্ছে আর ওকে ইন্ডিয়াতে পাঠাবেন না।
যাক পল্লবী অন্তত ঘাড় থেকে নামলো। কিন্তু সুজাতা! সেই কাল রাতের পর থেকে ওর আর কোনো খবর নেই। এগারোটা নাগাদ আবারও ফোন করলাম প্রতিদিনের অভ্যাস বশত। কিন্তু এখনও ফোন সুইচ অফ। আচ্ছা, স্যোসাইটির সবাই তো জানে আমাকে পুলিশে নিয়ে গেছিলো। আর ও কি জানে না! নাকি জেনেও খোঁজ নিলো না অভিমানে! উফ্! কি ভাবলাম আর কি হলো! নাহ অনেক দেরী করে ফেলেছি। কাল আর কিছুর ওয়েট করবো না। ওর স্কুল এগারোটায় শুরু হয়, আর আমি জানি ও নটায় বেরোয় বাড়ী থেকে। আমি তার আগে যাবো। দরকার পড়লে ওকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলব আমার মনের কথা। অনেক দেরী করেছি। আর নয়।
* * ৪৭ * *
সকালের আলো ফুটতে আর সভ্য সমাজের ঘুম থেকে উঠতে যেটুকু দেরী। সাতটা বাজতেই ছুটলাম সুজাতাদের ফ্ল্যাটে। টিং টং বেল বাজালাম। প্রথমে কেউ খুললো না। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। তা ঘুমোক, ঘুম থেকে তুলেই তোমায় বলবো আমার মনের কথাটা। আরো বার দুয়েক বেল বাজাতেই দরজা খুলল। থুড়ি দরজা খুললেন, সুজাতার পিসি। ঘুম চোখে একটা বাটি হাতে বেড়িয়ে এলেন, আর বাটিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। নির্ঘাৎ দুধওয়ালা ভেবেছিলেন। আমি আন্টি, গুড মর্নিং। সুজাতা আছে? বলাতেই উনি ঘুম চোখে অতি কষ্টে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে অত সকালে ওনার ফ্ল্যাটের দরজায় যে এক্সপেক্ট করেননি এটা তো বলাই বাহুল্য। তাই চমকে উঠে ঘাবড়ে গেলেন, যে দুধওয়ালা সুপারস্টার রজতকুমার হয়ে গেলো কি করে! তারপর ধাতস্থ হতেই তড়িঘড়ি বাটিটা সামনে থেকে পিছনে লুকিয়ে বললেন আরে! আপনি এখানে! আসুন আসুন! সাধারণ অবস্থায় হলে আমার ওনার অবস্থা দেখে হাসিই পেয়ে যেত। কিন্তু পরশু থেকে একের পর এক যা ঝড় বইছিলো আমার ওপর দিয়ে যে এখন হাসিও পাচ্ছে না। বরং টেনশন হচ্ছে। সুজাতা আমাকে সামনে দেখে কি করবে ভেবে। আমি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলাম। প্রথম এলাম ওনাদের ফ্ল্যাটে তাই উনি শশব্যস্ত। উনি আসুন আসুন, বসুন বসুন করতে লাগলেন। কিন্তু আমার ওসবে নজর নেই। সরাসরি আবার জিজ্ঞেস করলাম আন্টি সুজাতা আছে? এবার ওর পিসি একটু অবাক হয়েই আমার দিকে তাকালো। অনেক প্রশ্ন ভরা চোখে। তারপর বলল সুজাতা! কেন বলুন তো? আমি আমতা আমতা করে বললাম আ-আসলে একটু দরকার ছিলো ওর সাথে। ওনার বিস্ময়ের মাত্রা আরেকটু বাড়লো। উনি বললেন কিন্তু সুজাতা তো নেই। এই কথাটায় আমি চমকে উঠলাম। মনের ভেতরের কু ডাকটা আবার ডেকে উঠলো। কোনোরকমে ঢোঁক-ফোঁক গিলে বললাম ন-নেই মানে? এবার উনি যেটা বললেন এটার জন্য আমি যে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। উনি বললেন, নেই মানে, সুজাতা তো চলে গেছে, পার্মানেন্টলি। “চলে গেছে!” কোথায়? কবে? কখন? আর পার্মানেন্টলি মানে? আমার তো পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল এটা শুনে। মাথাটা ঘুরে গেলো। আমি কোনো রকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, চলে গেছে? কোথায়? কবে? কখন? উনি আমার এরকম অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছিলেন। বললেন রজতবাবু আপনার কি শরীর খারাপ করছে? আপনি এরকম করছেন কেন? আপনি এখানে বসুন প্লিজ। আমি ওনার উত্তর না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম ও কোথায় গেছ? কবে গেছে? আর কখনই বা গেছে। বলুন না! আমার গলার স্বর যে অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে এটা আমিও টের পেলাম। উনি এবার আমাকে আস্বস্ত করে বললেন, আপনি এখানে আগে বসুন, জল খান, তারপর সব বলছি। বলে আমাকে বসতে ইশারা করে কোথাও একটা চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই আমি টাল খেয়ে বসে পড়লাম সোফার ওপর। আমার সব কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে চারিদিক। উনি একটা জলের গ্লাস নিয়ে আমার সামনে এসে ধরলেন। বললেন জলটা খান, প্লিজ, আমি সব বলছি। আমি কোনোরকমে গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুক জল খেয়েই ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি এতক্ষণ আমাকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। আসলে হয়ত বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, যে সুজাতার চলে যাওয়াতে আমার এই রিঅ্যাকশন কেন। তারপর আমার জল খাওয়া হলে উনি আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বললেন, সুজাতা ওর বাড়ী মানে ঘুম-এ চলে গেছে। ওখানে ও একটা স্কুলে চাকরী পেয়েছে।
-আর এখানের চাকরী! আমি বিহ্বল হয়ে বললাম।
-উনি বললেন সে তো রিজাইন করে দিয়েছে!
আমি বিড়বিড় করে বললাম রিজাইন করে দিয়েছে! রিজাইন করে দিয়েছে! উনি সেটা শুনতে না পেয়ে বললেন কিছু বলছেন? আমি ঘোরের মধ্যেই জিজ্ঞেস করলাম কবে গেছে?
-এই তো! কালই সন্ধ্যের বাসে চলে গেছে।
আমি চমকে উঠলাম। কালই চলে গেলো! একবারও জানালো না যাওয়ার আগে? উনি বলে চললেন আসলে ওর বাড়ী তো ঘুমে, আমার দাদা, মানে ওর বাবা আর সবাই ঘুমেই থাকে। ও পড়াশোনার জন্য এখানে এসেছিলো, এবং চাকরী পেয়ে এখানেই ছিলো। কিন্তু অনেকদিন ধরেই ও চেষ্টা চালাচ্ছিলো। ওখানের স্কুলে অ্যাপ্লাইও করেছিলো। পরশুই সেখান থেকে জয়েনিং লেটার এসেছে। পুজোর ছুটির আগে জয়েন করতে বলেছে বলে ও কালই চলে গেছে। আসলে বেশী দেরী করতে চায় নি। পুজোরও তো আর বেশী দিন বাকি নেই। ওনার কথা আমার কানে ঢুকছিলো ঠিকই, কিন্তু মনে ঢুকছিলো না। সেখানে এখন শুধুই প্রশ্ন, সুজাতা কেন এরকম করল? আমাকে একবারও জানালো না কেন? ও কি এই সিদ্ধান্ত আমাকে সেদিন পল্লবীর সঙ্গে দেখার পর নিয়েছে? ও কি তবে আমায় ভুল বুঝে চলে গেলো? ও তো আমায় ভালোবাসে, তাহলে এটা কেন করল? ইত্যাদি ইত্যাদি।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
[আপনাদের একান্ত অনুরোধে এই পর্বটি আজই প্রকাশিত করলাম। পাঠিকা হিসাবে মনের উদ্বেগ কি হয় সেটা আমি জানি। কিন্তু অন্তিমপর্বের লেখা এখনও শুরু হয়নি। সুতরাং অন্তিমপর্ব পরশুর আগে প্রকাশিত করা সম্ভব নয়। তাই আগেই আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। এইটুকু ধৈর্য দয়া করে আপনারা রাখুন। কথা দিচ্ছি নিরাশ হবেন না]