ভালোবাসা অন্তিম মুহূর্ত

0
1589

ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
অন্তিম মুহূর্ত

* * ৪৮ * *

সুজাতাদের ফ্ল্যাট থেকে যে কি করে ফিরেছি নিজেও জানি না, পা টলছিলো। মাথা কাজ করছিলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে, সুজাতা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেছে। মনে হচ্ছিলো চিৎকার করে কাঁদি। আমার ওরকম অবস্থা স্যোসাইটির লোকজন কৌতুহলী নজরে দেখছিলো, কিন্তু আমার কাছে তখন সবই অর্থহীন। কোনোরকমে ফ্ল্যাটে ফিরতেই মা বাবা একরকম দৌড়ে এলো কি হয়েছে জানতে। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না, শুধু ওদের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ওরা অনেক আশা করে বসে আছে। কি বলবো ওদের? কিন্তু আমি পারলাম না ওদের থেকে লুকোতে। মা মাথায় হাত দিতেই সব কেমন কান্না হয়ে বেড়িয়ে এলো। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললাম, মা আমাব সব শেষ হয়ে গেলো। সুজাতা চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। ওরা প্রথমে বুঝতে পারছিলো না কি হয়েছে। দু তিনবার কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করার পর ওরাও আমাকে শান্ত হতে সময় দিলো। এই পুরো সময়টা আমি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ভাসিয়েছি, আর মা ক্রমাগত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে শান্ত করে গেছে।

খানিকটা পর আমি ধাতস্থ হতেই বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কি হয়েছে? এবার বল। সুজাতা না বলে দিয়েছে? আমি শূন্য চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম বাবা ও চলে গেছে। আমার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে দুজনে সমস্বরে বলে উঠল, মানে? আমি মাথা নীচু করে খানিক নিজেকে সামলে একে একে পুরো ঘটনাটা ওদের খুলে বললাম। সুজাতার পিসি যা যা বলেছে সব। সব শুনে বাবা মা-ও চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। হয়ত ওরাও আমার মতই শকড ব্যাপারটায়। কিন্তু খানিক পরে বাবা রাগী রাগী গলায় মাকে বলল এই বুদ্ধি নিয়ে তোমার ছেলে সিনেমায় অভিনয় করে? আর প্রেম করতে গেছে? মা-ও হতাশ গলায় বলল আমার নয় তোমার ছেলে, তাই এরকম বুদ্ধি হয়েছে, তোমারই মত। সবই লেটে বোঝে। একেবারে টিউবলাইট। মা বাবার এরকম কথার বিন্দু বিসর্গ আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না। আমার এদিকে সব শেষ হয়ে গেলো আর বাবা মা আমি কার ছেলে এটা নিয়ে ঝগড়া করছে! আই মিন হোয়াট ননসেন্স! এমনিতে সাধারণত আমি বাবা মায়ের ঝগড়ার মাঝে আমি ঢুকি না। কিন্তু এখন আমার একেই ফ্রাসট্রেটিং লাগছিলো। তার মধ্যে ওদের ঝামেলা নিতে পারলাম না। বাধ্য হয়েই ওদের ঝগড়ার মাঝে চেঁচিয়ে উঠলাম উফ্! থামবে তোমরা? আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তোমরা এখন এসব নিয়ে পড়লে? কিন্তু অবাক কান্ড! আমার চিৎকারে ওদের ঝগড়া তো থামলো, কিন্তু বাবা আমাকে বকতে শুরু করল। ইডিয়টের মত কাজ করলে জ্বলবি না তো কি?
-আ-আমি কি করলাম।
-আজ কত মাস ধরে দেখছি, সুজাতা মালা জপছিস, ছুটিতে ওর বাবার হোটেলে এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসছিস, রাতে এখানে থাকলেও তাড়াতাড়ী ডিনার সেরে ফোন নিয়ে দরজায় খিল দিচ্ছিস, এখানে এলেই সুজাতার খোঁজ নেওয়া, অথচ যাকে নিয়ে এতকিছু তাকেই মনের কথাটা বলে উঠতে পারলি না। হতভাগা!
এবার মা ও সঙ্গ দিলো বাবার। আমার কান ধরে বলল বলি হ্যাঁ রে গাধা! সুজাতা কি মঙ্গল গ্ৰহে থাকে? মায়ের এরকম আক্রমণে হকচকিয়ে গেছিলাম। ছোটোবেলায় গন্ডোগোল পাকালে মা এরকম আক্রমণ করত। মায়ের রুদ্র রূপ দেখে আমি ভয়ে তোতলিয়ে বললাম ঘুম-এ।
-আর জায়গা এই পৃথিবীতেই তো?
-দার্জিলিং-এ।
-যাওয়া যায় নিশ্চয়ই জায়গাটায়!
মা বলতে কি চাইছে বুঝতে না পেরে ক্যাবলার মত হ্যাঁ তে ঘাড় নাড়লাম। এবার মা এক দাবড়ানি দিয়ে বলল তাহলে বসে বসে এরকম ন্যাকা কান্না কাঁদছিস কেন? আমি এখনও মায়ের বকুনিকে খুব ভয় পাই, তাই বকুনি খেয়ে ক্যাবলার মত ফ্যালফেলিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে বাবা বিরক্ত হয়ে বলল ওর দ্বারা কিস্যু হবে না বুঝলে, নামেই হিরো। আসলে জিরো। যা করার আমাদেরই করতে হবে। মা-ও বাবার দিকে তাকিয়ে বলল হ্যাঁ সে আর বলতে? ছেলের জন্ম দাও, বড় করো, পড়াশোনা শেখাও, মানুষ করো, তারপর ছেলে প্রেম করবে সেই সেটিংও করো। কপাল আমাদের। তারপর আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল আমরা যাবো ঘুম-এ। সুজাতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু এবার যদি আমাদের বৌমাকে নিজের মনের কথা বলতে না পেরেছ। এই জেনে রাখো, বাড়ীতে ঢুকতে দেবো না। মনে থাকে যেন, হয়ত বৌমাকে ঘরে নিয়ে এসো, নইলে দুর হয়ে যাও। এতক্ষণে আমার কাছে সব ক্লিয়ার হলো। মানে আমার সাহসে যা কুলায় নি, সেটা করতে আমার বাপ-মা মাঠে নামছে। কথাটা বুঝতে পেরে আমিও লজ্জায় হেসে ফেললাম। মাথা চুলকে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আর মনে মনে বললাম, আসছি সুজাতা। এবার তোমায় না নিয়ে ফিরছি না।

* * ৪৯ * *

কলকাতা থেকে একসপ্তাহ হল ফিরেছি। এখানের স্কুলেও জয়েন করেছি। কিন্তু মন যেন এখনও ওই শহর, ওই শহরের লোকজন এদের মাঝেই পড়ে আছে। কিছু ভাললাগে না এখন। কথায় কথায় রজতকুমারের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এই যেমন এখন উঠছে। আছ রবিবার, তাই আমার ছুটি। বাবা আর ভাই হোটেলে গেছে, আর আমি ঘর গোছাচ্ছি। তখনই একটা হার পেলাম। এটা আগের বার এসে রজতকুমার আমায় উপহার দিয়েছিলো। হারটা হাতে নিতেই চোখের সামনে রজতকুমারের অবয়বটা যেন ভেসে উঠল। ওনার কথা, ওনার হাসি, সব। আর ওনার কথা মনে পড়তেই চোখদুটো আচমকাই ঝাপসা হয়ে এলো। ওর কথা ভেবে আমার এই চোখের জলটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। অবাধ্য, খালিই বেরিয়ে পড়ছে।

তাড়াতাড়ী চোখের জলটা মুছে নিলাম। নাহ্ ভাববো না আমি ওনার কথা। আমি ওনাকে ভালোবাসি এটা এই পৃথিবীতে কেউ কোনো দিনও জানতে পারবে না। উনি পল্লবীকে নিয়ে নিজের জীবনে সুখী আছেন। আমি ওনার জীবনে কোনো বাধা সৃষ্টি করবো না। এই কথাটা মনে হতেই আবারো চোখের অবাধ্য জল বেরিয়ে এলো। কেন? কেন? কেন? কেন আমি ওনাকে ভুলতে পারছি না? আমাকে ভুলতেই হবে ওনাকে। বাড়ীতে এখন কেউ নেই তাই আমার কান্না কেউ শুনতে পাবে না ভেবে চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম।

অনেকটা কাঁদার পর যখন খানিকটা ধাতস্থ হয়েছি ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। দশটা বাজে সবে। নাহ্! এখনও তো ভাইয়ের আসার সময় হয়নি। তবে এখন কে এলো। এসব ভেবেই চোখের জল মুছে, নিজেকে ঠিকঠাক করে নিলাম। যে এসেছে সে তখনও অধৈর্যের মত কড়া নেড়েই যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলতেই যাকে দেখলাম তাকে দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সেই ফর্সা, লম্বা, পেটাই চেহারা। চুল অবশ্য এখন আর ফিল্মি কায়দায় ছাঁটা নয়। বরং একটু উস্কোখুস্কো, এলোমেলো। সেই চোখে সানগ্লাস, পরনে লেদার জ্যাকেট, ডেনিম জিন্স। এই চেহারা আমার অতি পরিচিত। রজতকুমার! ওনাকে বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে আমি হা হয়ে গেছিলাম। উনি? এখানে? আমাদের বাড়ীতে কি করছেন? সারাক্ষণ ওনার কথা ভেবে ভেবে কি আমি ওনাকেই হ্যালুসিনেট করছি? এসব ভাবনার ভীড়েই উনি চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুললেন। ওনার চোখের দৃষ্টি এত গভীর যেন আমার মনের গোপন সব কথা পড়ে নিচ্ছেন আর আমি সম্মোহিতের মত ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
-কি হলো? ভেতরে আসতে বলবে না? ওনার গলার গম্ভীর স্বরে আমার চমক ভাঙলো। না! আমি স্বপ্ন দেখিনি। উনি সত্যিই এসেছেন। কিন্তু কেন? হঠাৎ আমার কাছে? উনি আবার গম্ভীর স্বরে বললেন কি হলো? বাড়ীতে কেউ এলে ভেতরে আসতে বলতে হয় সেটাও জানো না? ওনার কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম আর সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুতে পড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ী দরজা থেকে সরে বললাম আসুন আসুন। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। উনি ঘরে ঢুকে ঘরের চারদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন ইউ শুড বি। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেছিলাম। উনি ঘরে ঢুকে সটান একটা চেয়ারে বসে একই রকম গম্ভীর স্বরে হুকুম করলেন দরজাটা বন্ধ করো, কথা আছে। আমি ওনার কথায় চমকে গেছিলাম। ওনার দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছি দেখে রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বললেন কি হলো, কথাটা কানে গেলো না? দরজাটা বন্ধ করতে বললাম তো? ওনার ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করলাম। তবে খিল দিলাম না। এবার ওনার সামনে ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললাম আপনি এখানে? উনি আমার দিকে সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হেনে বললেন কেন আপত্তি আছে? আমি আবার অপ্রস্তুত হয়ে বললাম এমা না না। এবার উনি আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যেন আমাকে মাথা থেকে পা জরিপ করতে লাগলেন। তারপর গম্ভীর ভাবে বললেন এখানে ফিরে এলে কেন? আমি মাথা নীচু করে বললাম আ-আসলে এখানে একটা চাকরী……… উনি আমার কথা সম্পূর্ন হতে না দিয়েই বললেন আসার আগে একবার বলে আসারও প্রয়োজন বোধ করলে না? ওনার কথায় আমি চমকে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু ওনার অন্তর্ভেদী ফেলুদা সুলভ দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুকের ভেতর হাজারটা ড্রাম বাজছিলো। আমি আবার মাথা নীচু করে ফেললাম। উনি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার সামনে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন কি হলো, বলো। জানিয়ে আসো নি কেন? ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমিও ভয়ে পিছোতে লাগলাম। উনি স্থির দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন আর আমি পিছোচ্ছি। এমন সময় পেছনে ধাক্কা খেয়ে আমি আটকে জেতেই উনি আমার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আবার ধমক দিয়ে বললেন আসার আগে তোমার আমাকে জানিয়ে আসা উচিৎ ছিলো কি না? আমার তো ওনার রাগ দেখেই হয়ে গেছে। কোনো রকমে ঢোঁক গিলে তুতলিয়ো বললাম আ-আ-আপনি ব্যস্ত ছিলেন।
-কে বলল?
-আ-আপনি আর প-পল্লবী….. আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে উনি চেঁচিয়ে উঠলেন শাট আপ। শাট আপ। ওনার চিৎকারে আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। খানিক নীরবতা দেখে ভয়ে ভয়ে চোখ পিটপিটিয়ে যখন তাকালাম, দেখলাম উনি আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছেন। তবে একটু দুরে সরে গেছেন। উনি দুরে সরে যেতেই আমি হাঁফ ছাড়লাম।
-এই বুদ্ধি নিয়ে স্কুলে পড়াও কি করে বলতো? ছাত্র-ছাত্রীরা পাশ করে? আমি চমকে অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললাম,
– এক্সকিউজ মি! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে?
উনি আমায় ধমকে বললেন আই ওয়ান্ট টু সে দ্যাট ইউ আর অ্যান ইডিয়ট। তুমি একটি গবেট। এবার আমারও রাগ ধরে গেলো। বাড়ী বয়ে এসে আমাকে অপমান করছে? আমিও চোখ পাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম হাউ ডেয়ার ইউ? এবার উনি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, গবেট কে গবেট বলবো না তো কি বলব? একটা বাচ্ছাও যেটা বুঝতে পারে সেটা তুমি বোঝো না, একটা বাচ্ছাও নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে। তুমি পারো না। তাহলে তুমি গবেট নয় তো কি? আমি ওনার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। আ-আমি আবার কি বুঝিনি? কি বলছেন কি উনি? কোনোরকমে নিজেকে সামলে বললাম আ-আমি কি বুঝিনি? এবার উনি আবার চেঁচিয়ে বললেন বোঝো নি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি ইডিয়ট। আমার চারদিকটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো এটা শুনে। উনি এটা কি বলছেন? আমাকে ভালোবাসেন? মানে টা কি? আমি ঠিক শুনছি তো? নিজেকে সামলে বললাম এসব আপনি কি বলছেন? আপনি আমাকে ভালোবাসেন মানে? এবার উনি আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বললেন যা বলছি ঠিকই বলছি। তারপর আমার মাথায় একটা টোকা মেরে বললেন ঘটে বুদ্ধি থাকলে প্রথমেই বুঝতে পারতে। আমার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন পৃথিবীতে এত মেয়ে থাকতে কেন বেছে বেছে তোমাকেই আমার বন্ধু করতে, তোমার জীবনের অতীত বর্তমান জানতে, আমার জীবনের অতীত বর্তমান তোমাকে জানাতে এত উৎসাহী আমি কেন? আমি ক্যাবলার মত জিজ্ঞেস করলাম কেন? উনি আমার ক্যাবলামি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে। আজকে নয়, তোমায় প্রথম দেখার দিন থেকেই। হসপিটালেই তোমায় দেখে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু তুমি? তুমি আমাকে জাস্ট পাত্তাই দিতে না। আমি ওনার কথায় অবাক হয়ে ওনার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। না ওনার চোখে তো কোনো অভিনয় দেখতে পাচ্ছি না! উনি বলে চললেন ভেবেছিলাম গরমের ছুটিতে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই ফেলবো। কিন্তু তুমি? তুমি গরমের ছুটিতে বাড়ী ফিরে এলে। আর আমার সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলে। বাধ্য হয়ে সমর্পিতাকে পটিয়ে তোমার বাড়ী, বাবার হোটেল সবের অ্যাড্রেস জোগাড় করে এখানে এসে হাজির হলাম। অতি কষ্টে যাওয়ার আগে বন্ধুত্বও করলাম। তোমার জীবনের সব জানার চেষ্টা করলাম। তাও তুমি গবেট বুদ্ধি, কিছুই বুঝলে না। আমার বিস্ময় ওনার কথায় উত্তোরোত্তর বেড়েই যাচ্ছিলো। উনি এতক্ষণ একদমে বলে একটু থামলেন। তারপর নিরাশ স্বরে বললেন ভেবেছিলাম কলকাতায় গিয়ে তোমাকে বলবো। কিন্তু তুমি সুযোগই দাও নি। কতবার ঘুরতে যেতে বলেছি, দেখা করতে বলেছি, তুমি এড়িয়ে গেছো। প্রতিদিন রাতে আমি ফোন করেছি, মেসেজ করেছি। তুমি কোনো দিন করো নি। আমি ওনার কথায় বিস্মিত স্বরে বললাম আ-আমি! উনি আবার বললেন হ্যাঁ তুমিই। সবসময় সমাজে কে কি বলবে সেই ভেবে গেছো। আর আমি কি বলতে চাই কোনোদিনও বোঝার চেষ্টাই করো নি। এবার আমার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ঘরের অন্য কোণে গিয়ে আনমনে বললেন সেদিন জন্মদিনের দিন ভেবেছিলাম নিজেই নিজের মনের কথাটা তোমায় জানাবো, কিন্তু……………… এতটা বলে উনি চুপ করে গেলেন। আমার তো এখনও মাথায় কিছু ঢুকছিলো না। তাহলে পল্লবী? কথাটা ওনাকে বলতেই আমার ওপর ক্ষেপে উঠলেন আবার বলেছিলাম না তোমায় কোনোদিন কিছু লোকাবো না। কথা দিয়েছিলাম তোমায়। এমনকি সেদিন তুমি যখন ফোনে জিজ্ঞেস করলে তখনও বললাম সব মিথ্যে। তারপরেও এটা ভাবলে কি করে যে পল্লবী আর আমার কিছু………… আরে ভুত ওর মাথায় চেপেছিলো, আমার না। ওর বাবা ওরকম অ্যানাউন্স করবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। জানলে ওদের ইনভাইট করে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুলটা মারতাম না। কিন্তু তুমি? কার না কার কথা বিশ্বাস করে একেবারে বাড়ী ফিরে চলে এলে। আর জানাবার প্রয়োজনও বোধ করলে না। এতক্ষণ আমি হতবাক হয়ে শুধু ওনার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমি যাকে ভালোবাসি সেও আমাকেই ভালোবাসে। তাও আবার এতদিন ধরে! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো! উনি আবার আমার কাছে এসে আমার হাতদুটো ধরে বললেন কেন আমায় বলে এলে না সুজাতা? কেন এত কষ্ট দিলে আমায়। আমি কি করেছি? উনি এভাবে আমার হাত ধরলে আমার সারা শরীরে কারেন্ট খেলে যায়। কোনোরকমে সামলে বললাম আমি ভেবেছিলাম আপনি পল্লবীকে ভালোবাসেন। তাই সরে এসেছিলাম আপনার জীবন থেকে। উনি আমার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন না সুজাতা, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে কি তুমি একটুও বোঝো না? আমি কি তোমার এতটাই অযোগ্য? যে আমাকে একটুও ভালোবাসা যায় না? এবার উনি মাথা নীচু করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমার সামনে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলেন। আমার ওনার চোখের জল সহ্য হচ্ছিলো না। যাকে ভালোবাসি, তার চোখের জল সহ্য করার থেকে কষ্টকর আর কিছু হয় না। আমিও এবার ওনার সামনে মাটিতে বসলাম। পাগল কোথাকার। আগে বললেই পারতেন। তাহলে এত কষ্ট পেতে হতো না দুজনকেই। আমি ওনার চোখের জল মুছিয়ে বললাম, আগে বললে আজ এত কাঁদতে হতো না। আমার কথা শুনে এবার উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনার মুখ দেখে হেসে বললাম, আমিও তো আপনাকে ভালোবাসি। পলকেই ওনার চোখ মুখের ভাষা বদলে গেলো। রাগ-দুঃখ-কান্না সব উধাও হয়ে মুখে হাসি ফুটলো। উনি হঠাৎই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এতটাই আকস্মিক যে আমিও চমকে গেছিলাম। আমার লজ্জা করছিলো, কিন্তু ওনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছাও করছিলো। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেই বললেন এতদিন কেন বলোনি সুজাতা? আমি লজ্জা কাটিয়ে বললাম ভয় করত, যদি আমার অনুভূতি একতরফা হয়। আপনার যদি এটা শুধু মনের খেয়াল হয়। আপনি যদি রিজেক্ট করেন। এবার উনি আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন সাধে কি তোমায় গবেট ইড়িয়ট বলি? আমি প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাবো তার আগেই একজন মহিলার কন্ঠে তুই তো ওর থেকেও বড় ইডিয়ট শুনে কথার উৎস অনুসন্ধান করে তাকিয়ে দেখি ভেজানো দরজা খুলে কয়েকজন কখন না জানি ঘরে এসে হাজির হয়েছে। জয়তি আন্টি, রমেন আঙ্কেল, বাবা আর ভাই। আমরা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে একে অপরের থেকে ছিটকে সরে দাঁড়ালাম। ঈশ! ওরা সব দেখে ফেলল নাকি? দুজনেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। জয়তি আন্টি আমাদের অবস্থা দেখে হেঁসে বললেন থাক আর লজ্জা পেয়ে কাজ নেই। তারপর ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন তুই ওকে ইডিয়ট কি বলছিস? তুই তো তার থেকেও বড় ইডিয়ট। উনি মাথা চুলকে কাঁচুমাচু মুখ করে মাআআআ ! বলতেই আন্টি ওনাকে এক ধমক দিলেন। চুপ কর। বেশ হয়েছে। এসে থেকে আমাকে বিনা কারণে খুব বকছিলো। এবার নিজে খাক বকুনি। আমার ওনার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিলো। এবার আঙ্কেল এগিয়ে এসে ওনাকে সবার সামনেই মাথায় একটা চাঁটি মেরে বললেন, এত সিনেমায় অভিনয় করো আর এটা জানো না? যে ছেলেদেরই আগে মনের কথা বলতে হয়। আন্টি হেসে সমর্থন করে বললেন একদম। আমার বাবা এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে ওনার অবস্থা দেখছিলেন। এবার বললেন আমি সত্যিই এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। তখন আঙ্কেল দায়িত্ব নিয়ে বাবাকে আর ভাইকে প্রথম থেকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন। বাবা আর ভাই তো সব শুনে অবাক! এবার আন্টি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন দাদা আমাদের একটা আর্জি আছে।আমার এই পাগল ছেলেটাকে সামলাতে আপনার এই মেয়েটিকে আমাদের চাই। আমি ছেলেটাকে মানুষ করতে পারি নি, আপনার মেয়েটা ঠিক পারবে। বাবা এরকম আকস্মিক প্রস্তাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এবার আন্টি বললেন কি দাদা দেবেন তো আপনার মেয়েটাকে আমাদের পরিবারে? চিন্তা করবেন না কোনো অনাদর হবে না ওর। আমাদের মেয়ে হয়েই থাকবে ও। বাবা প্রথম ঝটকা কাটিয়ে হেসে সম্মতি দিতেই আঙ্কেল বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন।আর উনি? ওই যে মিচকে বদমাশের মত মিটমিট করে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন। ওমা! আবার চোখও মারলেন। কি শয়তান!

* * ৫০ * *

আজ আমার আর রজতকুমারের বৌভাত ফুলশয্যা। পুজোর পরের প্রথম বিয়ের ডেটেই আমাদের বিয়ে হয়েছে‌। কেউই আর অপেক্ষা করতে রাজী হয়নি আরকি। সত্যিই একবছরের মধ্যে আমার জীবনের কাহিনীটা এতটা বদলে যাবে ভাবতেও পারিনি। হসপিটালের কেবিনের প্রথম সাক্ষাৎ যে ছাদনাতলার বেড়া টপকে সোজা এক ছাদের তলায় এসে হাজির হবে কে জানতো! যাকে ধরা ছোয়ার বাইরের তারকা ভেবেছি সে শুধু ধরা দেবে তাই নয় আমার একান্ত আপন হয়ে ধরা দেবে সেটাও তো জানা ছিলো না। আজ এই ঘরে ওনার সঙ্গে আমার পথচলা শুরু হলো, এটা ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

ওনার ঘরের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে এইসবই ভাবছিলাম, টের পাই নি কখন উনি নিঃশব্দে আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ দুটো হাত আমাকে আবদ্ধ করায় চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি উনি। আপনি? এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়? উনি হেসে বললেন কার কথা এত ভাবছ সেটা জানতে হবে না? আমি ওনাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম সে জেনে আপনার লাভ? উনি এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন আমারই তো এখন লাভ, আর লোকসান। আফটার অল বউটা যে আমার। ওনার কথায় হাসি পেয়ে গেলো। বললাম আপনি লাভ লোকসান ভাবুন, আমি চললাম ঘুমোতে। বলে চলে যেতে যাবো উনি আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে এলেন ওনার সামনে। এতটাই আচমকা যে আমিও টাল সামলাতে না পেরে পড়লাম এসে ওনার ঘাড়ে। এই অবস্থায় উনি এমন মুগ্ধচোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন যে আমার লজ্জায় অবস্থা খারাপ। খানিক নীরবতার পর উনিই বললেন আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হলো সুজাতা। তোমায় নিজের করে পেলাম। আমি লজ্জা কাটিয়ে ওনার সাথে মজা করার জন্য বললাম স্বপ্ন আরোও আগেই সত্যি হতো, যদি আপনি নিজের মুখে সত্যিটা প্রথমেই জানাতেন। এবার উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন বলবো কি করে? যা দিদিমনি মার্কা মুখ করে সারাদিন ঘুরতে। ভয় লাগতো, যদি সত্যি বললে স্কুলের মত কান ধরে দাঁড় করিয়ে দাও। আমি ওনার কথা শুনে চোখ পাকিয়ে কিইইইই ???? বলতেই উনি বললেন, এই, এই জন্যেই বেচারী আমি কিছুই বলতে পারি নি। ওনার কথার ঢঙে আমার হাসি পেয়ে গেলো। আমি বললাম তাহলে এখনই বা বললেন কেন? হেসে বললেন নইলে পাখি যে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাচ্ছিলো। আমার হাসি পাচ্ছিলো, কিন্তু ছদ্মরাগ দেখিয়ে ওনার বুকে কটা কিল চড় বসিয়ে দিলাম। তারপর থামতেই উনি হেসে আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন আর কোনো দিন পালাতে পারবে না মহারাণী। এবার তুমি সারাজীবনে আমার মনে বন্দী হয়েই রইলে। আমি ছাড়াবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। উনি বললেন সুজাতা আমায় আজ কটা জিনিস দেবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কি? উনি আমাকে নিজের থেকে সরিয়ে চোখে রেখে বললেন, কথা দাও, যা বলবো তাই দেবে। আমি অবাক হয়ে বললাম বেশ দেবো। কথা দিলাম। উনি বললেন প্রথম কথা, আজ থেকে আমরা আগে একে অপরের কথা শুনবো, অন্যকারোর কথা শুনে একে অপরকে বিচার করবো না। বলো কথা দিলে?
-বেশ কথা দিলাম। আমি হেসে বললাম।
-দ্বিতীয় কথা, একে অপরের থেকে কোনো কথা লুকোবো না। ছোটো বড় সব কথা একে অপরের জানবো। একে অপরকে জানাবো।
-বেশ কথা দিলাম। কোনো কথা লুকাবো না। সব বলবো।
-তৃতীয় কথা, তুমি এই আপনি আজ্ঞে ছেড়ে আমাকে আমার নাম ধরে তুমি করে ডাকবে। ওনার এই কথায় আমি চমকে লজ্জা পেয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি বললেন কি হলো কথা দাও! আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আমার উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু আমি….. কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে উনি হঠাৎ বললেন ঠিক আছে। কথা যখন দিতে পারলে না তখন আমি চলে যাচ্ছি। আর আসবো না তোমার সামনে। বলেই সোজা গটগট করে বেড়িয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি ওনাকে কি করে আটকাবো বুঝতে না পেরে লজ্জা ঝেড়ে জোরেই বলে উঠলাম দাড়াঁও রজত। যেও না। ব্যাস ওষুধে কাজ হলো রজত আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো, তারপর মুচকি হেসে বললো কি বললে? আবার বলো? উফ্! কি শয়তান। বললাম দাঁড়াতে বলেছি তোমায়। কোথাও যেতে হবে না। এবার বদমাশটা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল উফ! ফাইনালি আপনি আজ্ঞের চক্কর থেকে বেরোলে। শান্তি। আমিও হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম ওম শান্তি। দুজনেই হেসে ফেল্লাম। শুরু হলো আমাদের ভালোবাসার নতুন রূপে পথচলা।

* * সমাপ্ত * *

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here