ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৮
* * ২১ * *
কাল সুজাতার কাছে ধরা পড়ে যাবার পর আর এখানে থাকার অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার থেকেও বড় কথা ওই ছেলেটাকে আর সুজাতাকে একসাথে হাত ধরে বসে থাকতে দেখছিলাম চোখ বন্ধ করলেই। আজ তাই ভাবছিলাম শিলিগুড়ি ফিরে যাবো। তাই সকালে উঠেই ব্যাগটা গোছাচ্ছিলাম। দুপুরে বেড়িয়েই যাবো। আর খালি মনে হচ্ছিলো সুজাতা তোমাকে আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছি যদি তুমি জানতে! কি ভেবে এসেছিলাম আর কি হলো। তোমার কাছে ধরা পড়ে গেছি এ নিয়ে আমার দুঃখ নেই, তোমার কাছে বারবার ধরা পরতেই আমি চাই। কিন্তু তোমাকে অন্য কারোর সাথে আমি দেখতে পারব না।
বসে বসে এসব ভাবছি, খানিক পরে গাড়ী এলেই বেড়িয়ে যাবো। এমন সময় দরজায় কড়া। কে এলো? গাড়ী! কিন্তু সে তো আমার নম্বরে ফোন করবে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই আবার থমকে গেলাম। কারণ দরজা খুলতেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল সুজাতা। ঘরে ঢুকেই বলল দরজা বন্ধ করুন। কথা আছে। হাঁফাচ্ছিলো ও। আমি দরজা বন্ধ করে ওর কাছে এসে দাঁড়ালাম। ও ঘরে ঢুকেই আমার গোছানো লাগেজের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো। বললাম কি হয়েছে? এরকম হাঁফাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান আগে জল খান। ও তার প্রত্যুত্তরে কোনো রকম ভনিতা না করেই বলল সময় নেই। খুব আর্জেন্ট দরকারে এসেছিলাম। কিন্তু আমি মনে হয় ভুল সময় এসে পড়েছি। আপনি হয়ত কোথাও বেরোচ্ছেন। সরি ভুল সময় এসে ডিস্টার্ব করে ফেল্লাম। বলেই আমাকে পাশ কাটিয়ে যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিলো তেমনই ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। আবার আমার কাছে এসেও ও চলে যাচ্ছে দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। ওর হাতটা একঝটকায় টেনে ধরলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ও চমকে গেছিলো, বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকালো। ওর চোখদুটো যেন অস্থির হয়ে আছে। কিছু বলতে চাইছে আমাকে, কিন্তু পারছে না। কিছু কি ঘটেছে? কোনো বিপদ ঘটে নি তো ওর! আমকে জানতেই হবে। আমি এবার একটু গম্ভীর হয়েই ওকে বললাম কোত্থাও যাবে না তুমি। বসো এখানে। বলো কি হয়েছে। আমার কথা না শুনলে খুব খারাপ হবে। ও মাথা নীচু করে বলল আপনি তো কোথায় বেরোচ্ছিলেন। উফ! এই মেয়েটা না! কোনো দিন আমাকে বুঝবে না। এবার ওকে একটু শাসন করতেই হবে আমাকে। কড়া গলায় ধমকে বললাম আমি কোথাওই যাচ্ছি না। এবার কি বলবে কি হয়েছে? এবার ও আমতা আমতা করে বলল এখানে বলতে গেলে দেরী হয়ে যাবে অনেক। আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে পারবেন? যদি আপত্তি না থাকে। পথে যেতে যেতে আমি সব বলব, তারপর আপনি ঠিক করবেন আমায় সাহায্য করবেন কিনা। বড় বিপদে পড়েছি তাই আর কি!
-বেশ চলো। বলতেই ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুজনে বেরোলাম, তবে ওর কথা মত আমরা হোটেল থেকে আলাদা আলাদা বেরোলাম, আগে আমি, পরে ও। বাইরে মিট করতেই ও বলল এখান থেকে হেঁটেই যাবে কাছেই কোনো মন্দিরে। মন্দিরে! অবাক লাগলো, কিন্তু বিনা বাক্য ব্যয়ে চলতে লাগলাম ওর সাথে। পথে যেতে যেতে ও যা বলল তার সারমর্ম এই- ওর দুই বন্ধু একে অপরকে ভালোবাসে, মেয়েটার পরিবার সেই সম্পর্ক মানছে না কারণ ছেলেটি একে অন্য জাতের, তার ওপরে এখনোও বেকার, কিন্তু দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক। ছেলেটি আজ না হোক কাল চাকরী ঠিকই পাবে। কিন্তু মেয়েটির বাড়ী ততদিন অপেক্ষা না করে মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবে, আর তা হলে মেয়েটি আত্মহত্যা করবে বলেছে। তাই সুজাতা নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওদের বিয়ে দেওয়াচ্ছে মন্দিরে গিয়ে, কিন্তু মেয়েটির বাবা এই এলাকায় প্রভাবশালী। তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে বিয়ে বানচাল করতে পারেন তাই সুজাতা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে যাতে আমি আমার প্রভাবে বিয়েটা দেওয়াতে পারি! হায় রে ঈশ্বর! আমার ভালোবাসাকে আমি পাবো কি না জানি না, আমি চলেছি অন্যের ভালোবাসা মেলাতে। কি কপাল! তবে ঘটনা শুনে মনে হল এটি কালকের সেই মেয়েটি। আর ছেলেটি যদি…………… নাহ আগে থেকে কিছু ভাববো না। দেখি না কি হয়।
* * ২২ * *
একটি স্থানীয় শিব মন্দিরে এসে পৌছে ও কাকে যেন ফোন করে বাইরে আসতে বলল। চমকটা আমার জন্য ছিলো এবার। মন্দিরের ভেতর থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বেড়িয়ে এলো। আমার সন্দেহই ঠিক এটি কালকের সেই মেয়েটি। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে আমার ওইখানেই আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা করছিলো। এটা সেই ছেলেটাই, যার সাথে আমি সুজাতাকে দেখেছিলাম! তার মানে এদেরই বিয়ে! উফ্! আমি কি বোকা! সত্যিটা না জেনে বেকার নিজেই কষ্ট পেলাম। আমার তো ইচ্ছা করছিলো ওদের বিয়ে, বাসর, ফুলশজ্জা সব আমি অ্যারেঞ্জ করে দিই। উফ! বুকের ভেতর থেকে কত বড় পাথর নেমে গেছে আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমার লাইন ক্লিয়ার!
ছেলেটির নাম পলাশ আর মেয়েটির নাম কুহেলী। ওরা সুজাতার স্কুল ফ্রেন্ড। তবে আমার আসল পরিচয় জেনে ওরা দুজন আমার থেকেও বেশী চমকে গেছে। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলছিলো ওরা দুজন সুজাতাকে। আমিই মধ্যস্থতা করে বাঁচালাম ম্যাডামকে। বললাম তাড়াতাড়ী বিয়ে সারতে, কুহেলীর বাড়ীর লোক চলে আসতে পারে। ওরাও আমার কথা মেনে তাড়াতাড়ী তৈরী হয়ে বিয়েতে বসল। মহারাণী এদিকে সব জোগাড় করেই রেখেছিলেন। হিন্দু মতেই বিয়ে হচ্ছিলো। যত বিয়ে পরিনতির পথে এগোচ্ছে আমি লক্ষ্য করছি সুজাতার মুখের উজ্জ্বলতা ততই বাড়ছে। তার মানে এই নিয়েই মহারাণী গত কদিন চিন্তিত ছিলেন। আমাকে আগে বললেই পারত। আরোও আগেই ওর প্রবলেম সলভ করে দিতাম। অবশ্য ফাইনালি যে বলেছে তাতেই আমি খুশি। কারণ এর থেকে দেরী হলে আমারও সত্যি জানা হত না, আর সুজাতার দুশ্চিন্তাও কাটতো না। মহাদেব মহাকাল আমাদের দুকুলই বাঁচিয়েছেন।
যা ভয় ছিলো তাইই হলো, কুহেলীর বাবা খবর পেয়ে একেবারে লোকজন নিয়ে এসে হাজির। ওনার মেয়েকে নাকি জোর করে এখানে বিয়ে দেওয়ানো হচ্ছে। এবার আমার ময়দানে নামার পালা! আমিও নেমে পড়লাম ময়দানে। অনেক তর্ক বিতর্কের পর আমি পুলিশের ভয় দেখাতেই ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ালেন। আমি কুহেলীকে ওর বাবার সামনে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ও নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে কি না। ও স্বীকার করল ওরা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। ওরা একে অপরকে ভালোবাসে, আর ওরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। কুহেলীর জবানবন্দী আমি মোবাইলে রেকর্ড করে ওর বাবাকে উল্টো হুমকি দিলাম যে বেশী বাড়াবাড়ী করলে এই রেকর্ড পুলিশের কাছে চলে যাবে। ওষুধে দিব্য কাজ হলো, মহোদয় হম্বিতম্বি সার করে রণে ভঙ্গ দিলেন। আমরাও প্রথম পর্বের জয় উপভোগ করতে লাগলাম।
বিয়ের পর সাধারণত ওদের পলাশের বাড়ীই ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু কুহেলী বলল এত সহজে ওর বাবা হাল ছাড়বে না। পলাশের বাড়ীতে আবার এসে ওকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। তাই অন্য কোথাও ওদের রাখতে হবে। আমার মাথায়ই বুদ্ধিটা এলো। এখন সবে বিকেল হবো হবো করছি এখনই যদি গাড়ী নিয়ে বেরোতে পারি তাহলে সন্ধ্যে হলেও দু-আড়াই ঘন্টার মধ্যে আশা করি শিলিগুড়ি পৌছে যেতে পারবো। আর ওর বাবা যতই প্রভাবশালী হোক শিলিগুড়ি পৌছে কিস্যু করতে পারবে না। পলাশ আর কুহেলীকে জিজ্ঞেস করতে ওরাও রাজী হয়ে গেলো। গাড়ী জোগাড় করতে যেটুকু সময় তার মধ্যে সুজাতা ওদের গুছিয়ে দিলো। তারপর গাড়ী পেতেই পৌছে যোগাযোগ করবো বলে সুজাতার ফোন নম্বরটা আমি চেয়ে নিলাম। এমনিও এটা এখন আমার অনেক কাজেই লাগবে। হা হা হা হা। যাই হোক পলাশের বাড়ীতে সুজাতা খবর পৌছে দেবে বলে দিলো, আমি পলাশ ও কুহেলীকে নিয়ে রওনা হলাম শিলিগুড়ির পথে।
* * ২৩ * *
একটু আগে রজতকুমারের ফোন এসেছিলো। ওনারা শিলিগুড়ি পৌছে গেছেন। উনি কালকের ফ্লাইটের টিকিট কেটে ওদের কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া অবধি ওদের আসার দরকার নেই এখানে। আর রজতকুমার পলাশকে কলকাতায় পৌছে ওনার এক পরিচিতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। চাকরীর ব্যপারে। পলাশ প্রথমে রাজী হচ্ছিলো না। উনিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করিয়েছেন।
সত্যি মানুষটাকে প্রথমে কি ভুলই না ভেবেছিলাম। তবে মানুষটা খুব ভালো। উনি না থাকলে আমি পলাশ কুহেলীর বিয়েটা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারতাম কিনা ঈশ্বরই জানেন! বা বিয়ে দিলেও ওদের এভাবে কুহেলীর বাবার নাগালের বাইরে পাঠাতে পারতাম না। ফলে ওর বাবা জোর করে কুহেলীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতই। তখন কি করতাম? আমার ক্ষমতা কি ওনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর?
আমি ভয় পাচ্ছিলাম উনি এতবড় মানুষ এসব ব্যাপারে নাক গলাবেন না হয়ত। কিন্তু উনি আমাকে ভুল প্রমানিত করে আমার চোখে ওনার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে তুলেছেন। আজ মনে হয় সব ফিল্মস্টার ভিনজগতের জীব হয়না।
ওরা শিলিগুড়ি পৌছেচে এই খবর পেয়েই আমি পলাশদের বাড়ী ছুটেছিলাম। ওদের বিয়ে আর শিলিগুড়ি যাওয়ার খবর দিতে। গিয়ে দেখলাম কুহেলীর বলা কথাটাই ঠিক। ওর বাবা লোকটি সত্যিই পলাশদের বাড়ী এসে হাজির হয়েছে আর কাকু কাকিমার ওপর হম্বিতম্বি করছে। এখন আমি এখানে ঢুকলে বিপদ বাড়বে! তাই আমি দরজার বাইরে লুকিয়ে দেখলাম উনি লোকজন নিয়ে বাড়ী তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওদের খোঁজ না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে দেখে নেবেন ইত্যাদি তড়পাতে তড়পাতে চলে গেলেন। আমি এসব দেখে তাড়াতাড়ি নিজের বাড়ী এসে পলাশকে ফোন করলাম। ওদের দুজনকে সব বললাম। ওরা বলল রজতকুমার ওদের পরদিন সকালের ফ্লাইটেই কলকাতা পাঠিয়ে দিচ্ছে। ততক্ষণ যেন আমি পলাশদের বাড়ী না যাই। যা বলার পলাশই ফোন করে ওর বাড়ীতে জানিয়ে দেবে। সেইমতই আমিও আর সেই রাতে নিজের বাড়ী থেকে এক পাও বাইরে বেরোলাম না।
(চলবে)