ভালোবাসা পর্ব ৭

0
562

ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৭

* * ১৮ * *

সুজাতাকে ওই ছেলেটার সাথে ওই ভাবে হাত ধরে বসে থাকতে দেখে মাথা কাজ করছিলো না। একরকম টলতে টলতেই ফিরেছিলাম, স্টেশনের কাছে। তারপর কিভাবে যে দার্জিলিং ফিরেছি আমিই জানি। দার্জিলিং ফিরে ম্যালের দিকে হেঁটে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। এত লোকের ভীড়েও সব ফাঁকা লাগছিলো। সুজাতা কি তবে অন্য কারোর? ওই ছেলেটা কে? কি সম্পর্ক ওদের? এরকম নানা প্রশ্নে মন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিলো। সুজাতা আমার নয় এটা মনে এলেই সারা শরীর শিউরে উঠছিলো। কতক্ষণ যে ওভাবে বসেছিলাম জানি না। রাত বাড়তে ঠান্ডা বাড়তে হুঁশ এলো। হোটেলের পথে পা বাড়ালাম।

হোটেলে পৌছে দেখি সুজাতা রিশেপশনে বসে আছে। আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম, রুম নাম্বার বললাম। ও অন্যমনস্ক ভাবে চাবিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমার মুখের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখলো না। কিন্তু আমি নিজের চোখ ওর দিক থেকে সরাতে পারছিলাম না। একটা ডেস্কের অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ভালোবাসা! কিন্তু আদৌ তার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব আছে কি না জানি না। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। চলে এলাম ওখান থেকে।

পরদিন সারাদিন আর ঘর থেকে বেরোই নি। ভালো লাগছিলো না কিছু! ঘরেই খাবার আনিয়ে খেলাম। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে সব কিরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অস্থির লাগছে নিজেকে। সুজাতার চোখদুটো বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর ততই মনে পড়ে যাচ্ছে ওই ছেলেটার হাত ধরে ওর বসে থাকার দৃশ্যটা। শেষে পাগল পাগল লাগতে থাকায় আর ঘরেও থাকতে পারলাম না, বেড়িয়ে পরলাম। বিকেল হয়ে গেছে। ম্যালের দিকে হাঁটা দিলাম। লোকজনের মাঝে যদি একটু ভালো লাগে।

ম্যালে পৌছে বাজারে ঘুরছি এমন সময় কারুর একজনের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেয়ে রাস্তাতেই ছিটকে পড়লাম। অন্যমনস্ক ছিলাম মানছি, কিন্তু তাই বলে এভাবে ধাক্কা খেয়ে পড়ব! ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে যা দেখলাম তাতে আমারই মাথা খারাপ হবার জোগাড়! এ তো সুজাতা! ঠিক দেখছি তো! নাকি কাল থেকে ওর কথা ভেবে ভেবে ওকেই হ্যালুসিনেট করছি। এই ভাবতে ভাবতে ও ধড়মড়িয়ে আমার ওপর থেকে উঠে গেলো তারপর ছোট্ট করে সরি বলে খানিকটা দৌড়েই পালালো। রাস্তায় লোক জমে গেছিলো আমাদের দেখে। ওকে কেয়ারলেস ও অনেক কিছু বলছিলো জনতা। আমি তাড়াতাড়ী উঠে লোকজনের দিকে তাকিয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে “ইটস ওকে! অ্যা’ম অলরাইট” বলে ও যেদিকে গেলো সেদিকে হাঁটা লাগালাম।

বাজারটা ধীরে সুস্থে পেরিয়েই পায়ের গতি বাড়ালাম। সোজা রাস্তা ধরে একটু দ্রুত পায়ে হাটতেই দেখতে পেলাম সুজাতাকে! কেমন অন্যমনস্ক হয়েই দ্রুত হাটছে। কাল বিকেল থেকেই ওকে অন্যমনস্ক দেখছি, কি হয়েছে! ওই ছেলেটা সংক্রান্ত কিছু কি? কৌতুহল দমন করতে না পেরে ওর পিছু নিলাম। দেখলাম খানিক গিয়ে রাস্তার পাশের একটা বাড়ীতে গিয়ে ঢুকলো ও! এখানে ও কি করছে! কিছু বুঝতে পারলাম না। তাই বাড়ীটা থেকে একটু দুরত্ব রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো সুজাতা এখনও বেরোলো না! এবার একটু অধৈর্যই লাগছিলো। কি করব ভাবছি এমন সময় বাড়ীটার দরজা খুলে গেলো। বাড়ীর ভেতরের আলো আর রাস্তার আলো মিলিয়ে দেখতে পেলাম ভেতর থেকে সুজাতা আর ওরই বয়সি একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুজাতা মেয়েটার হাত ধরে নীচু গলায় কিছু একটা বলল শুনতে পেলাম না, তারপর ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ছেড়ে দিয়ে একে অপরকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো, এরপর সুজাতা ফেরার পথ ধরলো, আর মেয়েটাও বাড়ীতে ঢুকে গেলো!

ব্যাপারটা পুরোটাই দেখলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কি হচ্ছে আমার মাথায় কিছু ঢুকলো না। মেয়েটা বাড়ীর ভেতর ঢুকে যাওয়ার পরই আমি আবার সুজাতার পিছু নিলাম।

* * ১৯ * *

কুহেলীদের বাড়ী থেকে বাজার অবধি রাস্তাটায় লোকজনের চলাচল কমই আছে। আমি ধীরে ধীরে আসু কর্তব্য কি ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎই মনে হলো কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। আমাকে কে‌ অনুসরণ করবে ভেবেই পিছন ফিরে দেখলাম। না কেউ নেই তো! আমার মনের ভুল ভেবে এগোতে লাগলাম। কিন্তু আবার মনে হল আমার পিছনেই কেউ আসছে। একটু ভয় হতে লাগলো। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। হাতের মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরাটা অন করে এমনভাবে ধরলাম যাতে আমার পেছনে কেউ এলে তাকে আমি দেখতে পাই কিন্তু সে আমার মোবাইলের ক্যামেরা না দেখতে পায়।

উফ! কি বুদ্ধি আমার। একেবারে ফেলুদা! যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ওরকম করতেই রাস্তার আলোর আলো আঁধারীতে দেখলাম সত্যিই একজন আমার পেছনে আসছে। ভালো করে দেখলাম যদি চিনতে পারি, কে! ভালো করে দেখতেই দেখলাম আরেহ! এ তো আমাদের সেই নতুন বোর্ডারটা। এ আমাকে এভাবে ধাওয়া করছে কেন! আমিও তাড়াতাড়ী পা চালালাম। বুঝলাম সেও তাল মিলিয়েছে। বাজারে এসে ইচ্ছে করে ভীড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে নিলাম। দেখলাম লোকটা আমাকে খুঁজছে। আশ্চর্য সন্দেহজনক লোক তো! এর ডিটেইলস জানতে হবে আজই হোটেলে গিয়ে।

তারপর লুকিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। এসেই রিশেপশনে এন্ট্রি খাতাটা খুলে নাম খুঁজতে লাগলাম। খানিকবাদে যে নামটা পেলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ! এটা কি করে সম্ভব! বোর্ডারের নাম রজত কুমার মিত্র। আই.ডি প্রূফ হিসাবে আধার কার্ড এন্ট্রি করা আছে! আমি যে রজত মিত্রকে চিনি সে আমাদের হোটেলের মত এত ছোটো জায়গায় সে থাকতে পারে এটা আমার কল্পনারও অতীত। কিন্তু এই লোকটা কে! জানতেই হবে আমাকে!

খানিকপরে লোকটা এসে ঢুকলো হোটেলে, রিশেপশনে রুমের চাবি নিতে এসে আমার মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। লোকটা চাবি নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতেই আমিও ভাইকে ডেকে রিশেপশনে বসিয়ে লোকটার পিছু নিলাম। লোকটা দরজা খুলে রুমে ঢুকে গেলো। আমি রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। খানিক অপেক্ষা করে নক করলাম, কিন্তু লোকটা দরজা খুলল না। আবার নক করলাম। এবার লোকটা দরজা খুলে আমাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো। আমি একটু হেসে বললাম স্যার, সরি টু ডিস্টার্ব। অ্যাকচুয়ালি উই ওয়ান্ট টু রি-চেক ইওর আই.ডি প্রূফ। প্লিজ কো-অপরেট।
লোকটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল এনি প্রবলেম?
-নো নো জাস্ট আ সিকিউরিটি ইস্যু। আমার কথা শুনে লোকট সন্দেহের চোখে আমাকে দেখল। তারপর ব্যাগ খুলে আধার কার্ডটা খুঁজতে লাগলো। আমি চুপচাপ লোকটাকে দেখছিলাম। লোকটা যেদিন এসেছিলো বাবা ওর ডক্যুমেন্ট ভেরিফিকেশন করে সিকিওরিটি চেক করেছিলো। বাবা তো রজত মিত্রকে চেনে না, তাই হয়ত বুঝতে পারে নি। কিন্তু এবার আমি দেখলেই চিনতে পারব ইনি কে!

লোকটা আই.ডি কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অদ্ভুত! এরকম মাথা নীচু করে থাকার কি আছে? আমি কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখেই চমকে উঠলাম। আমার সন্দেহই সত্যি, যদিও আধার কার্ডের ছবি এমনিই ভয়ঙ্কর হয়, এবং সুপারস্টার রজতকুমারকে যেভাবে সেজে থাকতে দেখেছি তার সঙ্গে এর মিল নেই। কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে সুপারস্টার রজতকুমার আর এই রজত কুমার মিত্র একই ব্যক্তি। অন্তত আমার চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

-আপনি এখানে? আমি বিস্মিত স্বরে বললাম। লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আবার বললাম কি হলো, বলুন! আপনি এখানে কি করতে এসেছেন?
এবার লোকটা আমতা আমতা করে বলল এ-এমনি। বেড়াতে এসেছি।
-আমাদের হোটেলের খবর আপনাকে কে দিল?
এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো, তারপর আবার মাথা নীচু করেই বলল তোমার সরি আপনার বোন। সমর্পিতা।
-হুম। তা এত হোটেল থাকতে এখানেই উঠলেন কেন? আর ছদ্মবেশ নিয়েছেন কেন?
-কারণ আপনাকে আমি চিনি, আর আপনাদের হোটেলটা ছোটো। কেউ ভাবতে পারবে না আমি এখানে থাকব, আর ছদ্মবেশ যাতে কেউ আমাকে চিনতে না পারে।
-হুম। আপনি সত্যিই বেড়াতে এসেছেন তো? আমার এই প্রশ্নে লোকটা চমকে আমার দিকে তাকালো।
-মানে?
-মানে সত্যিই বেড়াতে এসেছেন কি না আমার সন্দেহ হচ্ছে।
-ক-কেন? আপনার সন্দেহের ক-কারণ?
-বেড়াতে এলে একটু আগে দেশবন্ধু রোডের ওখানে আমাকে ফলো করছিলেন কেন?
-আ-আমমি! ম-মানে! কই না তো!
-মিথ্যে বলবেন না, আমি নিজের চোখে দেখেছি। ম্যাল মার্কেটে এসে আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। আপনি আমায় দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক দেখছিলেন। কেন?
-আ-আমি! মানে! তখন পড়ে গে……
-ওহ হ্যাঁ তখন আপনার ঘাড়ে পড়ে গেছিলাম। তার জন্য এক্সট্রিমলি সরি। কিছু মাইন্ড করবেন না।
-ন-না না! ই-ইটস্ ওকে!
আরোও ইনভেসটিগেট করতে যাচ্ছিলাম এমন সময় বাইরে আমাকে কেউ ডাকল সুজাতা তেরী ফোন। আর প্রশ্ন করতে পারলাম না রজতকুমারের রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম।

* * ২০ * *

পলাশ ফোন করেছিলো, কুহেলীর সঙ্গে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইছিলো। ওকে বলেছি কি কথা হয়েছে আমাদের। দুশ্চিন্তা করছিলো, আমি খুব শিগগিরই ব্যবস্থা করছি বলে ফোন রেখেছি বটে, কিন্তু কি করব! সেই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে ভোর রাত্রে একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। সকাল হতেই পলাশকে ফোন করে বললাম দুপুরে কুহেলীকে নিয়ে শিবমন্দিরে চলে আসতে। ওদের আজই বিয়ে দেবো। কিন্তু আমি একা করতে গেলে বিপদ। কুহেলীর বাবার দার্জিলিং-এ অনেক পরিচিতি। উনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে সব বানচাল করে দিতে পারেন। এই মুহুর্তে আমারও কোনো প্রভাবশালীর সাহায্য দরকার। কিন্তু আমি তো এরকম কাউকে চিনি না। যাই আগে তো ওদের বিয়ের জোগাড়ে নামি।

বিপদে ঈশ্বরই পথ দেখান। মন্দিরে যাওয়ার পথে একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেলো আর আমার সমস্যার সমাধানও পেয়ে গেলাম। পোস্টারটা একটা সিনেমার। জীবনদীপ। হিরো আমার অতি পরিচিত সুপারস্টার রজতকুমার। সত্যিই তো। সুপারস্টারের পরিচিতি আর প্রভাব কি কুহেলীর বাবার প্রভাবের থেকে কম হবে? কিন্তু উনি তো একে সুপারস্টার, তার ওপর এখানে এসেছেন বেড়াতে। উনি কি এসব‌ উটকো ঝামেলা‌ নিতে চাইবেন? কিন্তু কিন্তু করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো শিবমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর পলাশ, কুহেলীর জন্য অপেক্ষা করছি। বেশ কিছুটা দেরী করেই কুহেলী এসে হাজির হলো। আর এসে যা বলল তাতে আমাদের ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো। কাল কুহেলীদের বাড়ী যেতে ওর বাবা সন্দেহ করেছিলো। আজ সকাল থেকেই সেই কারণে কুহেলীকে নজরে নজরে রাখছিলো। অনেক কষ্টে বাবা ও বাড়ীর নজর এড়িয়ে ও পালিয়েছে, কিন্তু খুব শিগগিরই সকলেই টের পেয়ে যাবে। আমি কুহেলীকে বললাম চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা করছি। তোরা এখন এখানেই লুকিয়ে থাক। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। আমি ফিরে যতক্ষণ না পলাশকে ফোন করছি তোরা‌ বেরোবি না। আর কোনো বিপদ দেখলেই ফোন করবি আমায়। পলাশ আমাকে জিজ্ঞেস করল তুই কোথায় যাচ্ছিস? আমি সংক্ষেপে আসছি বলে বেড়িয়ে গেলাম।

মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা এলাম আমাদের হোটেলে। ভাই তখন রিশেপশনে বসেছিলো। ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম রজতকুমার তার নিজের রুমেই আছে, সকাল থেকে বেরোয়নি। ঈশ্বর সহায়! আমি দৌড়ে গেলাম ওনার রুমে। দরজায় নক করতেই উনি দরজা খুললেন। আর আমি জলদি ওনার ঘরে ঢুকে পড়লাম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here