#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩০
মাশরাত চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে তার বিয়ের শেরওয়ানি। খাটের উপর বিয়ের পাগড়ি রাখা। মাশরাত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে তাকাল। আজ সে বুঝতে পারছে না নিজের অনুভূতিকে। এক সময় ভালো আর এক সময় খারাপ লাগছে। খারাপ লাগলে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মালিহা আসলো। ভাইকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেঁটে গেল। মাশরাতের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। মাশরাত যেন হারিয়ে আছে। মালিহার ডাকে তার হুঁশ ফিরলো।
“কিছু বলবি?”
“আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আম্মু ডাকছে চল।”
“আসছি”
“তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব চাই।”
“হয় তো তোর প্রশ্ন কি আমি জানি।”
“তো জবাব দে।”
“ভালো লাগছে খুব। আবার খারাপও লাগছে। নিজেকে প্রতারক মনে হচ্ছে। বিয়ের পর যদি তাবাসসুমের কথা প্রায়ই মনে আসে আমি কি করবো তখন?”
“তুই কি পারবি তার কাছে ছুটে যেতে? না, সে কোথায় আছে তুই তো জানিস না ভাই। মনে আসলে হয় তো তোর খারাপ লাগবে। কিন্তু ভাই, তুই আপুকে মিস করে কষ্ট পাবি না তা জানি। খারাপ লাগা আর কষ্ট পাওয়ার মধ্যে খুব পার্থক্য।”
“আধুনিক্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি আজও তাবাসসুমকে ভালোবাসি কি না। আমি জানি ও ভয় পায় যদি আমি কোনোদিন তাকে ভালোবাসা ছেড়ে দেই। বা তাবাসসুম ফিরে আসলে তাকে ভুলে যাই। মেয়েটা খুব ভীতু রে আমার প্রতি। ওর মায়ায় পরতে আমি বাধ্য হয়েছি। এখন তো মনে হয় ওকে ছাড়া আমি প্রাণহীন।”
মালিহা মুচকি হেসে মাশরাতের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। মাশরাতের চেহারায় চিন্তার ছাপ। মালিহা হাসি মুখে বলল-
“ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভেবে লাভ নেই। কারণ আমরা অনেক সময় ভাবি এক রকম হয়ে যায় আর এক রকম। তাই ভবিষ্যত আল্লাহ তায়ালার হাতে দিয়ে দে। বর্তমান নিয়ে ভাব ভাই।”
“আমি এখন ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভাবিনা। আরে আমি তো অপেক্ষা করাও ছেড়ে দিয়েছি। ভাবছি, এখন অপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই। যে মানুষটার হতে চলেছি তাকে নিয়েই ভাববো।”
“দ্যাটস লাইক মাই ব্রাদার। এখন মুখে হাসির রেখা টেনে পাগড়ি পড়ে নে। তোর বউ তো অপেক্ষা করছে। দেরি হলে সবার সামনে অপমান করবে।”
মাশরাত হেসে দিলো। সত্যি তো, দেরি করে গেলে আধুনিক্তা তাকে চিবিয়ে খাবে। মাশরাত হেটে গিয়ে পাগড়ি হাতে নিয়ে মালিহার দিকে এগিয়ে দিলো। মালিহা হাসি মুখে পাগড়ি নিয়ে মাশরাতকে পড়িয়ে দিলো।
“চলো তাহলে তোর ভাবীকে নিয়ে আসি।”
“হ্যাঁ চল ঘর সাজানোর জন্য মানুষ এসেছে নিচে। আমরা গেলে উনারা আসবে ঘর সাজাতে।”
মাশরাত কিছু বলল না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘর সাজানোর কথা শুনেই তার লজ্জা লাগছে।
অন্যদিকে…..
আধুনিক্তা অনেকক্ষণ হলো স্টেজে বসে আছে। ভারী শাড়ি গহনা পড়ে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসির বাতাস পর্যন্ত গায়ে লাগছে না। মল্লিকা আর মেহরিন ছবি তুলতে ব্যস্ত। আধুনিক্তা তাদের দেখে রাগে গজগজ করছে। বিয়ে তার কিন্তু ছবি তুলতে ব্যস্ত তার বান্ধবীরা। আরমান দৌড়ে স্টেজে উঠলো। তার হাতে চকোলেট। আধুনিক্তার দিকে চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বলল-
“মাম্মাম চকোলেট খাবে? এটা খুব টেস্টি।”
“না ছোটু তুমি খাও”
“তোমার কি মন খারাপ?”
“না তো”
“সত্যি বলছো?”
আধুনিক্তা তাকিয়ে রইলো আরমানের দিকে। তার মনে পরছে সেই মুহূর্তটা যখন তোয়ালে করে পেঁচিয়ে একটা ছোট্ট বাবু তার কোলে দিয়ে দাদী বলেছিল এটা ওর ভাই। আধুনিক্তা সেদিন অনেক কান্না করেছিল। তার একটা বান্ধবী ছিল স্কুলে৷ মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় ক্লাস নাইনে থাকতেই। যেদিন সেই মেয়েটার বাবু হয়েছিল তার ৩ মাস পর আধুনিক্তার ভাই হয়েছিল। ১৭ বছরের আধুনিক্তা তার ছোটো ভাইকেই ছেলের মতো লালন পালন করেছে। তাই তো আরমান তাকে মাম্মাম ডাকে। আধুনিক্তা আরমানকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বাচ্চাটা ঠোটের চারপাশে চকোলেট ভরিয়ে রেখেছে। আধুনিক্তা হাসলো, এই বাচ্চাটাকে ছাড়া সে থাকতেই পারে। কিন্তু যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়েছে তাকেও ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কেন মেয়েদেরই তার পরিবার ছেড়ে যেতে হয়? আধুনিক্তার হঠাৎ রাগ হচ্ছে এমন নিয়মের উপর।
“মাম্মাম তুমি আজ চলে যাবে?”
“হুম, কিন্তু আমি প্রতিদিন আমার ছোটুর সাথে দেখা করতে বাসায় যাব।”
“ওকে, তুমি আমাকে প্রতিদিন এক বেলা হলেও খাইয়ে দিবে। তোমার হাতে খাবার না খেলে তো আমার ভালো লাগে না।”
আধুনিক্তা হাসলো, সোজা আরমানের চুলে হাত বুলিয়ে বলল-
“তোমার কষ্ট হবে না আমি চলে গেলে?”
“হবে, কিন্তু আম্মু বলেছে ব্রেভ বয়’রা মন খারাপ করে না। আমি যখন বড়ো হয়ে বিয়ে করবো আমার বউকেও তার পরিবার ছেড়ে আসতে হবে।”
“তোমাকে এতো কিছু কে শিখিয়েছে।”
“দাদাই বলেছে”
“দাদাই?”
আরমান মাথা নাড়াল। আধুনিক্তা কপালে হাত রাখলো। কি দরকার ছিল একটা বাচ্চাকে এতো কিছু বলার? তখনই আতশবাজি ফোটানোর শব্দ আসলো। আরমান দাঁড়িয়ে লাফাতে লাফাতে বলল-
“মাম্মাম পাপ্পা এসেছে। আমি গিয়ে পাপ্পাকে নিয়ে আসি।”
“আস্তে, পড়ে যাবে তো ছোটু।”
“কিছু হবে না। আমি যাই পাপ্পার কাছে।”
আরমান লাফ দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে দৌড় দিলো। সবাই বলাবলি করছে বরযাত্রা এসেছে। আধুনিক্তার হঠাৎ নার্ভাস লাগছে। তার মনে হচ্ছে কেও তার হৃদপিণ্ড চেপে ধরে রেখেছে। মল্লিকা আর মেহরিন এসে আধুনিক্তার দু’পাশে বসলো। মল্লিকা কনুই দিয়ে আধুনিক্তাকে খোঁচা মেরে বলল-
“তোর বর তো এসে পরলো দোস্ত। ভালোই তোরা বিয়ে করে ফেলছিস কিন্তু আমার কোনো খবরই নেই।”
মেহরিন বলল-
“তোরও হবে অপেক্ষা কর। আধুনিক্তা চল আমরা একসাথে হানিমুনে যাব। তুই জিজু, আমি রিয়াজ।”
“হেই হেই হোয়াট ডু ইউ মিন? আমার বিয়ে বাকি এখনো।”
“তোর দরকার নেই, আমরা চারজন গেলেই হবে।”
“দোস্ত প্লিজ, বিয়ে হলে আমরা তিন জুটি একসাথে যাব।”
আধুনিক্তা বলল-
“আগে আমার বিয়েটা তো হতে দে। আমার খুব ভয় করছে।”
মেহরিন আধুনিক্তার ধরে তার দিকে তাকাতে বলল। আধুনিক্তা মেহরিনের দিকে তাকাল। আধুনিক্তা ভ্রু দু’টো কুঁচকে রেখেছে। মেহরিনের হেসে বলল-
“দোস্ত, অনেক মানুষ বলে বিয়ে মানে জীবন বরবাদ। বিয়ে খুব পবিত্র বন্ধন। এই সম্পর্কে কেই ঈমানদারী দেখালে কখনো ঠকে না। জানিস, বিয়ের পর আমার মনে হচ্ছে আমি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। রিয়াজের মতো মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমি ভাগ্যবতী হয়েছি। আর তুই তো জানিস মাশরাত ভাইয়া কেমন। আমার মন বলে তুইও খুব সুখী হবি।”
আধুনিক্তা মুচকি হাসলো। মল্লিকা দাঁড়িয়ে বলল-
“বিবাহিতদের কথা আমার মাথায় এখন ঢুকবে না। আমি যাই বর দেখতে।”
বলেই মল্লিকা চলে গেল। মেহরিন আর আধুনিক্তা বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহরিনও উঠে দাঁড়াল। আধুনিক্তা তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল-
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
“দোস্ত আসলে.. মানে আমি জিজুকে দেখতে যাই।”
“যা যা সবাই চলে যা। আমি জোকারের মতো এখানে বসে থাকি।”
“কিছুক্ষণের ব্যাপারই, আমরা এসে পরবো তুই অপেক্ষা কর।”
বলেই মেহরিন দ্রুত স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল। আধুনিক্তা মুখ শক্ত করে বসে আছে।
মাশরাতের ৩২ দাঁত বেরিয়ে আছে। তার হঠাৎ খুব আনন্দ লাগছে। দাদী, মেহরিন আর মল্লিকা মিলে গেট ধরেছে। রিয়াজ আর কবির মাশরাতের সাথে দাড়িয়ে আছে। কবির পরিস্থিতি দেখে অবাক হয়ে বলল-
“ইয়ার বিয়ের সময় টাকা দিতে হয়? তার মানে আমারো টাকা দিতে হবে?”
মাশরাত ভ্রু কুঁচকে বলল-
“তুই টাকা নিয়ে টেনশন করছিস? তোর বিয়ে হবে এটা ভেবে খুশী না?”
“তোর তো টাকার অভাব নেই এখন। লক্ষ টাকা দিয়ে দিলেও সমস্যা নেই। শালা আমি তো ফইন্নি।”
মাশরাত আর রিয়াজ হেসে দিলো। রিয়াজ গর্ব নিয়ে বলল-
“আমিই ভালো কোর্ট ম্যারিজ করেছি। কোনো গেট ধরাধরির ঝামেলা নেই।”
“আমিও কোর্ট ম্যারিজই করবো।”
“ঠিক আছে মল্লিকাকে রাজি করাতে পারলে করে কোর্ট ম্যারিজ।”
মল্লিকা ধমকের সুরে বলল-
“এই আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছে?”
রিয়াজ কবিরকে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বলল-
“তারাতাড়ি কোনো কথা বানা। নাহলে তোর খবর আছে।”
কবির মল্লিকার দিকে তাকাল। মল্লিকা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কবিরের দিকে। কবির জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল-
“আসলে আমার ইচ্ছে করছে আজ বিয়ে করতে। তোমার সাথে সংসার করতে চাই মল্লিকা। আমার মন বলে তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বউ হবে।”
মল্লিকা ইমোশনাল হয়ে গেল। সে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল-
“আর মাত্র ৪ মাস, এখন অপেক্ষা করো।”
কবির দাঁত বের করে হাসলো। আগে সে জঙ্গলের বাঘ ছিল। এখম সার্কাসের বাঁদর হয়ে গিয়েছে। আর মল্লিজা হচ্ছে রিং মাস্টার। মাশরাত তাদের টাকা দিয়ে ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাশরাতকে অন্য জায়গায় বসানো হয়েছে। স্টেজে বিয়ে পড়ানোর পর নিয়ে যাবে। মল্লিকা আর মেহরিন আধুনিক্তার কাছে গিয়ে মাশরাতের প্রশংসার উপর প্রশংসা করছে। আধুনিক্তার ইচ্ছে করছে মাশরাতকে দেখতে। বিয়ে না পড়া পর্যন্ত এটা সম্ভব না। দাদীর কঠোর অর্ডার আধুনিক্তা স্টেজ থেকে নামতে পারবে না।
অবশেষে বিয়ে পড়ানো হলো। আধুনিক্তা মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদছে। বাবা একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ। কিন্তু কাঁদছে না। মেয়ের সামনে এখন নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। দাদী আধুনিক্তার একপাশে বসে আছেন। দাদাই মাশরাতের সাথে। আরমান মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই স্তব্ধ, কথা বলার মতো কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। মা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে আধুনিক্তার গালে হাত রেখে বললেন-
“শান্ত হও আম্মু। আর নিজেকে সামলাও, তুমি যে পরিবারে যাচ্ছো সেখানের প্রতিটা মানুষ তোমাকে খুব ভালোবাসে।”
আধুনিক্তা নাক টানছে বার বার। নিশ্বাস ভারী হয়ে গিয়েছে তার কাঁদতে কাঁদতে। মা তার চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিলো। তখনই দাদাই এসে বলল মাশরাতকে নিয়ে আসছে। সবাই উঠে দাঁড়াল। আধুনিক্তা মাথা নিচু করে বসে আছে। তার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। আজ থেকে সে মাশরাতের স্ত্রী। ভালো লাগা অনুভব করতে পারছে সে। হঠাৎ পাশে মাশরাতের আভাস পেল আধুনিক্তা। মাশরাত হাসি মুখে বলল-
“আসসালামু আলাইকুম মিসেস মাশরাত তোফাজ্জল হোসেন। নাইস টু মিট ইউ।”
আধুনিক্তা হেসে সালামের উত্তর দিলো।
“আজ আপনাকে সুন্দর লাগছে। মন থেকে বললাম মিথ্যে ভাববেন না দয়া করে।”
“আজ হঠাৎ কি হলো তোমার? এতো মিষ্টি করে কথা বলছো যে।”
“আজ থেকে আমি বিবাহিত। বউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে তাই।”
“ইশশশ এতো ঢং কোথা থেকে শিখেছো তুমি?”
“আমার একজন প্রেমিকা ছিল। সে প্রচুর ঢং করতো। ওর ঢং দেখতে দেখতে আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম।”
আধুনিক্তা মুখ লটকিয়ে ফেলল। মাশরাত হেসে বলল-
“আমি তোমার কথা-ই বলছি।”
আধুনিক্তা ভেংচি কেটে বলল-
“আমি ঢং করি না।”
“করো না, করতে।”
“এভাবে বলতে পারলে?”
“আমার বউকে আমি যা খুশী বলবো। তুমি কে শুনি?”
“বাহ রে, তুমি এক্টিং করতে এক্সপার্ট। এনি ওয়েজ আজ আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে।”
“মাশা আল্লাহ বলো নাহলে তো আরো কালো হয়ে যাব।”
আধুনিক্তা শব্দ করে হেসে উঠলো। মাশরাতের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো। মানুষটা এখন তার স্বামী। কতো-ই না কান্না করেছিল মাশরাতের জন্য এক সময়। হঠাৎ সিটি বাজানোর শব্দ আসলো। আধুনিক্তা আর মাশরাতের হুশ ফুরতেই ঘাড় ঘুরালো। সবাই তাদের দেখে মিটিমিটি হাসছে। আধুনিক্তা লজ্জা পেল। সোজা হয়ে বসে মাশরাতের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজালো।
“এখন তো তুমি আমার বউ লজ্জা পাওয়ার কি আছে?”
“বউ হলেও সবার সামনে চিপকিয়ে বসে থাকবো না-কি? বড়োজনরা আছেন।”
“ইন্টেলিজেন্ট”
“তোমার মতো বোকা না-কি আমি? এখন চুপচাপ বসে থাকো।”
মাশরাত মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
বিদায়ের সময় আসলো, বাবা শেষ মুহূর্তে নিজের কান্না থামাতে পারলেন না। আধুনিক্তাকে বুকে ভরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বাবাকে খুব কম কাঁদতে দেখেছে আধুনিক্তা। আজ বাবার কান্না দেখে সে বলেই দিয়েছে যাবে না মাশরাতের বাসায়। বাবা কোন মতো মানিয়ে আধুনিক্তাকে গাড়িতে বসালো। বাবা মাশরাতের হাত ধরে মিনতির সুরে বলল আধুনিক্তার খেয়াল রাখতে। কথায় কথায় হুমকি দেয়ার মানুষটা আজ কান্না করে রিকুয়েষ্ট করছে। আধুনিক্তার বিদায় বাবার পাথর মনকে গলিয়ে দিলো। মাশরাত গাড়িতে বসে আধুনিক্তার দিকে তাকাল। কাঁদতে কাঁদতে মেকআপ নষ্ট করে ফেলেছে। মালিহা সামনের সিটে বসেছে। মাশরাত মালিহার কাছ থেকে টিস্যু নিয়ে আধুনিক্তার চোখ মুছে দিলো। আধুনিক্তা মাশরাতের বুকে হেলান দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে ফুপাচ্ছে। পুরো রাস্তা মাশরাত কিছু বলেনি। আধুনিক্তাকে শান্তনা দেয়ার শব্দ পাচ্ছে না। বাসায় পৌঁছে মাশরাত গাড়ি থেকে নামলো। আধুনিক্তার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“আমার ছোট্ট রাজপ্রাসাদের রাণী, আপনার নিজের রাজপ্রাসাদে আপনাকে স্বাগতম।”
কান্না করার মাঝেও আধুনিক্তা হাসলো। মাশরাতের হাত ধরে বের হলো গাড়ি থেকে। মা তাদের বরণ করে ভেতরে নিলো। আধুনিক্তা কান্না করতে করতে ক্লান্ত। মালিহা তাদের নিয়ে মাশরাতের ঘরে গেল। ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলা হয় নি। ১৫ মিনিট নানান পোজে ছবি তোলা শেষ করে তারা চলে গেল। আধুনিক্তা মন খারাপ বসে আছে। মাশরাত ড্রইংরুমে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর মা আসলো। আধুনিক্তা সেন্টারে কিছুই খায় নি। তাই উনি প্লেটে বসে খাবার নিয়ে এসেছে। আধুনিক্তার পাশে বসতেই আধুনিক্তার ঘুরিয়ে এক নজর মাকে দেখে আবার নিচের দিকে তাকাল। মা পোলাও লোকমা করতে করতে বললেন-
“জানো আধুনিক্তা আমি আমার বিয়েতে একদমই কান্না করি নি।”
আধুনিক্তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। মা লোকমা তুলে দিয়ে বললেন-
“কারণ আমি খুব ভয়ে ছিলাম, সব বলবো তুমি একটু করে খেয়ে নাও।”
আধুনিক্তা চুপচাপ লোকমা মুখে তুলে নিলো। মা আবারো বললেন-
“কারণ হচ্ছে আমি আর্মি, পুলিশ খুব ভয় পেতাম। মাশরাতের বাবা আর্মি ছিলেন। এইটা জানার পর আমার আত্মার পানি শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিয়ের পর সেই আর্মি মানুষটাকেই ধমক দিয়ে কাজ করাতাম।”
আধুনিক্তা ফিক করে হেসে দিলো। তার কাছে বিষয়টা খুব মজাদার লাগলো। মা আধুনিক্তাকে খাইয়ে দিতে দিতে সব বললেন উনা জীবনের সম্পর্কে। মাশরাত ঘরে এসে এমন দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসলো। গরম লাগছে তার খুব। তাই গেঞ্জি টাওজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। ফিরে এসে দেখে মা নেই মালিহা আধুনিক্তার চুল খুলে দিচ্ছে। মাশরাত মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে খাটে বসলো। আধুনিক্তাকে রাগানোর জন্য বলল-
“এলোমেলো চুলে এখন তোমাকে ডাইনিদের মতো লাগছে।”
আধুনিক্তা কিছু বলল না। মাশরাত বুঝতে পারলো ওর মন খারাপ। তাই আর কথা বাড়াল না। মালিহা আধুনিক্তার চুল খুলে দিয়ে আধুনিক্তার জামা বের করে দিয়ে চলে গেল। আধুনিক্তার ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসছে। বাথরুমে গিয়ে গোসল করে বের হলো। মাশরাতের রুমের চারপাশ চোখ বুলালো। মাশরাত আধুনিক্তার চাহনি দেখে বলল-
“এসি ছিল, কিছুদিন আগে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খুলে ফেলেছি। কোনো মতো দিন কাটাও, বেশী না ১ সপ্তাহর পরই নতুন এসি লাগাবো।”
“তোমার গরম লাগে না।”
“না, আমার অভ্যেস আছে। বিয়ের তারাহুরোর কারণে এসি কিনতে পারি নি। আগের এসি আর ঠিক হবে না। তাই ভেবেছি একেবারে নতুন কিনবো।”
আধুনিক্তা হেটে এসে মাশরাতের পাশে বসলো। মাশরাত আধুনিক্তার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে আধুনিক্তা মাথা মুছে দিতে লাগলো। তা দেখে আধুনিক্তা হেসে বলল-
“এখন থেকেই এতো যত্ন? মানতে হবে সঠিক মানুষকেই বেছেছি নিজের জন্য।”
“১০ টা না ৫ টা না একটা মাত্র বউ আমার। জানো ছোটো থাকতে আব্বুকে দেখতাম আম্মুর এভাবে যত্ন নিতে৷ আব্বুকে আমি মাত্র ৪ বার দেখেছি জীবনে। আর মাত্র ১ বছর ২১ দিন সময় কাটিয়ে টোটাল উনার সাথে।”
“মিস করতে না?”
“হ্যাঁ, উনি বেস্ট আর্মি, বেস্ট বাবা, বেস্ট স্বামী, বেস্ট মানুষ ছিলেন উনার জীবনে। তাই আমি ভেবেছি আব্বুর মতো বেস্ট মানুষ হয়ে দেখাব।”
“মা আমাকে বলেছেন উনাদের সম্পর্কে। আমি অনেক খুশী তুমি এমন একজন মানুষের ছেলে যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।”
“আর আমি গর্বিত উনার ছেলে হয়ে।”
আধুনিক্তা মুচকি হেসে মাশরাতের বুকে মাথা রাখলো। মাশরাত আধুনিক্তার কপালে চুমু দিয়ে বলল-
“চলো নামাজ আদায় করে নেই।”
আধুনিক্তা মাথা নাড়াল। দুজন মিলে নামাজ পড়ে নিলো। আধুনিক্তা খাটে বসে বাবার নাম্বারে কল দিলো। বড্ড মিস করছে তাদের৷ মাশরাত খাটের অন্যপাশে বসে গালে হাত দিয়ে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। আধুনিক্তা হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলে কল কাটলো। মোবাইল ঘাড় ঘুরিয়ে মাশরাতকে দেখে মুচকি হাসলো। মাশরাত গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আধুনিক্তা মাশরাতের কপাল ছোঁয়া চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে চুমু দিলো। মাশরাত খোপ করে ধরে ফেলল আধুনিক্তাকে। আধুনিক্তা চমকে উঠলো। মাশরাত আধুনিক্তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে।
“এইভাবে হঠাৎ কেও ধরে? আমি এখনই স্ট্রোক করে ফেলতাম।”
“আজ বিয়ে হলো আমাদের। এই অলক্ষুণের কথা বলো না।”
আধুনিক্তা হেসে মাশরাতের ধরে টানলো।
“বার বার আমার গাল ধরে টানছো কেন?”
“লিখিত ভাবে আজ থেকে তুমি শুধুমাত্র আমার। আমার যা ইচ্ছা করবো।”
“তাহলে তো তুমিও একমাত্র আমার। আমিও যা ইচ্ছা করতে পারবো।”
আধুনিক্তা চোখ উপরের দিকে তুলে ভাবতে লাগলো।
“ভাবা শেষ হলে তারাতাড়ি বলুন ম্যাডাম। সময় চলে যাচ্ছে।”
“আপনি একমাত্র আমার হলে আমিও একমাত্র আপনার। কিন্তু..”
“কিন্তু কি?”
“আমার উপরে একটা কথা বলতে পারবে না।”
মাশরাত আফসোসের নিশ্বাস ফেলল।আধুনিক্তা ছোটো ছোটো চোখ করে মাশরাতের গলা চেপে ধরলো। মাশরাত হেসে আধুনিক্তাকে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে পরলো। আধুনিক্তার চুলগুলো তার চেহারায় এসে পরেছে। মাশরাত আধুনিক্তার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল-
“ভালোবাসি মিস ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন।”
“ভালোবাসি দুই মিস্টার ট্রেইনার।”
মাশরাত আধুনিক্তার নাকের সাথে নাক ঘষে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। বালিশের নিচে হাত দিয়ে রিমোট বের করে লাইট বন্ধ করে দিলো। এইবার আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন তাদের ডিস্টার্ব করতে হবে না??
চলবে…..