ক্যানভাস পর্ব : (২২)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
৫৬!!
রাত দুটো। মেঘ আর আবির গল্প করছে আর জ্যোৎস্না বিলাস করছে। হঠাৎই দরজায় খটখট শব্দ হয়। আবির ভাবলো নিজের চ্যালাপেলা হবে হয়তো। তাই মেঘকে মোড়ায় বসিয়ে রেখে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সাথে সাথে আবির থমকে দাঁড়ায়। পালানোর কোনো সুযোগ থাকে না আবিরের কাছে। পুলিশ খুব সহজেই আবিরকে গ্রেফতার করে ফেলে। পুলিশকে দেখে মেঘ আবিরের কাছে এগিয়ে যায়। তারপর আবিরকে বলল,
_তোর মতো যারা বোকা, তাদের জন্য এইভাবেই ফাঁদ পেতে রাখতে হয়। তোকে ধরিয়ে দিতে আমাকে এই কয়েকটা ঘণ্টা মিথ্যে অভিনয় করতে হয়েছে। তুই সারাজীবন জেলে পঁচে মরবি। সেই ব্যবস্থা সামির চাচ্চু করে রেখেছে। আর একটা কথা পরিষ্কার করে শোনে যা। আমার জীবনে শুধু একজনই ছিল, আছে আর থাকবে। সে শুধুই আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমার নয়, আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সঙ্গী। আমার ভালোবাসা।
_খুব বেশি চালাকি করে ফেললে।
_চালাকির এখনও অনেক বাকি। এবার শান্তিতে জেলে বসে দিন গুনতে থাক। কবে তোর মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসে কে জানে।
_কঠিন সাজা পাবে তুমি।
_সে তো তুই আমাকে অনেক সাজা দিয়েছিস। এবার সাজাটা তুই’ই ভোগ কর।
মেঘ ইরাকে জড়িয়ে ধরে। পুলিশ আবিরসহ আবিরের সকল চ্যালাপেলাদের এরেস্ট করে ফেলে। মেঘ পুলিশকে থেংকস জানায়। পুলিশ বিদায় নিলে, মেঘ, ইরা আর আদনান একসাথে গল্প করতে করতে গাড়িতে উঠে। মেঘের হাত’পা এখনও কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ইরা মেঘের দিকে পানি বাড়িয়ে দিল। আদনান গাড়ি থামালে মেঘ রাস্তায় নেমে মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে নেয়। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে গাড়িতে উঠে। মেঘ ইরার কাঁধে মাথা হেলিয়ে দেয়। ইরা মেঘের গালে হাত রেখে মেঘকে বলল,
_সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর বুদ্ধির জোরেই আজ ওই পাষাণটার হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিস। যদি না ঠিক টাইমে ওই ম্যাসেজটা আমি খেয়াল করতাম। সবই আল্লাহর ইশারা। তোর ম্যাসেজের মাধ্যমেই লোকেশন ট্র্যাক করা সহজ হয়ে যায়।
_আমার জন্য এতো রাতে তোদের খুব কষ্ট করতে হলো।
_চুপ থাক। এই ক’দিন বাড়ির সবার উপর দিয়ে কী গেছে সেটা আমরা সবাই জানি। আদনান ভাইয়া, আমি, সামি, নওরিন সবাই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম তোর জন্য। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, তোকে ওরা উঠিয়ে নিলো কীভাবে?
মেঘ মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। তারপর ইরা আর আদনানকে বলল,
_সেদিন রাতে তুই আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই একজন ওয়েটারের ছদ্মবেশে আমার রুমে ঢুকে। ভেতরে ঢুকে সে এটাই বলে, তুই নাকি জুসটা পাঠিয়েছিস তার মাধ্যমে। আমি সব না ভেবেই জুসটা খেয়ে নেই। প্রচণ্ড পানি পিপাপা পেয়েছিল। ওই জুসটা খাওয়ার পর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলাম, আমি বড় ধরনের একটা চক্রান্তের স্বীকার। চারিদিকটা অন্ধকার দেখছিলাম। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, আমি কী করবো? কীভাবে এই নরক যন্ত্রণা থেকে বের হবো। এতদিন ও আমার হাতপা বেঁধে রেখেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ রুম চেঞ্জ করে অন্য জায়গায় নিয়ে আসলো। আবার হাতের বাঁধনও খোলে দিলো। এসব কী শুধুই ওর প্ল্যান নাকি অন্যকিছু?
_দেখ যা হয়েছে ভুলে যা। এসব ভেবে বর্তমানটাকে নষ্ট করিস না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ওনি তোকে সুস্থ অবস্থায় আমাদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন।
মেঘ আবারও ইরার কাঁধে মাথা রাখে। আদনান মেঘকে বলল,
_আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি যে, তোমাকে তিনি ওই বদমাশটার হাত থেকে বাঁচিয়ে আসার সুযোগ দিয়েছেন। এখন আর এসব নিয়ে না ভেবে নিজের আর্টসকে সময় দাও। আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে তোমার হাতে, তোমার কম্পিটিশনের জন্য।
মেঘ অবাক হয়ে বলল,
_এতো তাড়াতাড়ি।
_তুমি কতদিন বন্দি ছিলে জানো?
_হ্যাঁ, দশদিন তো হবেই।
_আচ্ছা মেঘ। আবির তোমাকে কিডন্যাপ করে বেরিয়ে আসলো কীভাবে? বাসায় এতো মেহমান থাকা সত্ত্বেও কারো চোখে পড়লো না। অবাক করা বিষয়।
_আবির আমাকে বলেছে। আমার রুমের অন্যপাশে যে দরজা ও সেটাই ব্যবহার করছে। আর সেই দরজা দিয়ে পিছনের করিডর থেকে সোজা বাড়ির পিছনের রাস্তায় আসা যায়। আবির সেই রাস্তাটাই কাজে লাগিয়েছে।
_বাদ দাও। আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। আর্টসের জন্য প্রিপেয়ার্ড হও।
_হুম।
এরপর তিনজনে গল্প করতে করতে মেঘদের বাসায় পৌঁছায়। ভোর রাত হতে চললো। আর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান হবে। আদনান, ইরা মেঘকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। মেঘ ড্রয়িংরুমে ঢুকে বাবা-মাকে দেখে ঝাপটে পড়ে মায়ের বুকে। মেঘের বাবা-মা দুজনই কেঁদে যাচ্ছেন। এই ক’দিনে মেঘের চেহারা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া তো ঠিকমতো করেনি। তার উপর দিনের পর দিন আবিরের নানারকম টর্চার সহ্য করতে হয়েছে। এইজন্য মেঘ কেমন যেন হয়ে গেছে।
৫৭!!
মেঘকে মধ্যখানে ঘিরে রেখে বাকিরা সোফার চারপাশে বসে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। মেঘ বাবা-মায়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে ফ্রেশ হতে যায়। ততক্ষণে ফজরের আযান হয়ে যায়। ইরা রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্য চা নিয়ে আসে। সবাই সারারাত জেগেছিল। কারো চোখে একফোঁটা ঘুম আসেনি। চা খেলে ঘুম ঘুম ভাবটা একটু কাটবে। শরীরের আলসে ভাবটাও সরে যাবে তাই চা খাওয়াটা প্রয়োজন।
সবাই চা খেতে খেতে গল্প করছে। চা খাওয়া শেষ হলে আদনান সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। মেঘের বাবা-মা দুজনে আদনানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। আদনানের মতো সাহসী ছেলেরা এই পৃথিবীতে আছে বলেই অনেক বাবা-মা শান্তিতে বাঁচতে পারছে। ইরার একটা ফোনে, সাহস করে এতো রাতে বেরিয়ে ছিল বলেই মেঘ আজকে জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে। নয়তো আবির মেঘের বড় কোনো ক্ষতি করে দিতো।
নিজের রুমের প্রতিটা ক্যানভাসের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেঘ। নিজের হাতে তৈরি করা ক্যানভাস গুলো আজ কেমন বিষণ্ণতার মাঝে ডুবে আছে। প্রতিটা ক্যানভাসের একেকটা চিত্র মেঘকে কানে কানে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। মেঘ একটা ক্যানভাসে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর বলল,
_আমার হাতে আর কোনো শক্তি নেই। আমি কীভাবে কালকের কম্পিটিশনে জিতবো। যে আমার জেতার অনুপ্রেরণা সেই তো হারিয়ে গেল। এইভাবে আমাকে ভুল বুঝবে জানা ছিলো না। দোষ আমার একটাই। আমি নিজের পরিচয় গোপন করেছি।
প্রতিটা ক্যানভাসে হাত বুলায় আর কাঁদে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করে ক্যানভাসে লেপটে থাকা পুরোনো অনুভূতি গুলোকে। কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নওরিন দাঁড়িয়ে আছে। নওরিন দু’হাত দিয়ে মেঘের চোখের জল মুছে দিল। মেঘ নওরিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। নওরিন হয়তো মেঘের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছ। তাই তো মেঘকে সাহস দিতে এই মুহূর্তে মেঘকে সঙ্গ দিতে এসেছে। মেঘের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে বলল,
_বোকা মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেন তুই? তুই খুব ভাগ্যবান যে, তুই নিজের বাবা-মাকে আবারও ফিরে পেয়েছিস। আর শ্রাবণ ভাইয়া… সে বড্ড বোকা! যে সত্যিকার ভালোবাসাটা বুঝেও বুঝলো না। দেখ মেঘ আমাদের হাতে সময় খুব কম। কম্পিটিশনে ফার্স্ট হতে হবে তো।
_আমি যাব না রে।
_মাথা খারাপ তোর? যাবি না মানেটা কী? তোকে যেতেই হবে। আর এইবার পুরো দেশকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, চিত্রশিল্পী কাশফিয়া হাসান মেঘ নিজের ট্যালেন্টকে ধরে রেখেছে। সে নিজেদের জেলার নামকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
_আঁকবোটা কী একটু বলবি? যাকে নিয়ে আমার মনের রাজ্যে এতো রঙের ছড়াছড়ি এখন তো সেও ভুল বুঝে দূরে সরে আছে। আমি কী আঁকবো বলতে পারিস?
_এমন কিছু আঁকবি, যাতে শুধু শ্রাবণ ভাইয়া না, গোটা দেশ তাকিয়ে থাকে তোর ওই ক্যানভাসের দিকে।
_আর ক্যানভাস। আমার ক্যানভাসের সব রঙ মুছে গেছে। সেখানে আর কী রঙের ব্যবহার করবো আমি। হৃদয়ের ক্যানভাসে যে রঙের মাখামাখি ছিল, সেই রঙের প্রতিটা কোণা হতাশায় ডুবে আছে। সেখানে নতুন করে কোনো রঙ দেওয়ার মতো আমার কাছে অবশিষ্ট রঙ নেই।
_নতুন রঙ লাগবে কেন? তোর পুরোনো রঙের শক্তি দিয়েই নতুন করে ক্যানভাস সাজাবি। যে ক্যানভাসে তুই নিজেকে খোঁজে পাবি।
_পারবো না। প্লিজ জোর করিস না। আমি যাব না কম্পিটিশনে।
_কাল তুই যাবি এটাই ফাইনাল। আমি না শুনবো না। আর যদি না যাস, তোর আমার বন্ধুত্ব চিরতরে হারিয়ে যাবে।
_নওরিন! তুইও এইভাবে বললি। তোরা ছাড়া আমার যে কেউ নেই। এখন তোরাই যদি আমার সঙ্গ ছেড়ে দিস তাহলে আমি বাঁঁচবো কীভাবে?
_তাহলে বল, কাল কম্পিটিশনে যাবি।
মেঘ চোখের জল মুছে নওরিনের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
_আমার শ্রাবণকে চাই না। তোদেরকে চাই। তোরা আমার পাশে থাকলে আমি যেকোনো বাধা অতিক্রম করে জয়ের লক্ষ্যে পোঁছাতে পারবো। আমি নিজেকে সেইভাবেই তৈরি করবো এবার।
_তাহলে আমরা যাচ্ছি কালকে।
_হ্যাঁ। যাচ্ছি। আর কাল আমি জিতেই ফিরবো।
_ইন-শা-আল্লাহ! জয় আমাদের হবেই।
নওরিন মেঘকে সান্ত্বনা দিয়ে রুমের ভেতরে সাদা কাগজের সামনে মেঘকে দাঁড় করায়। জল রঙ আর তুলি তুলে দেয় মেঘের হাতে। মেঘ ক্যানভাসে রঙের ফোঁটা দেয়। কিন্তু কী আঁকবে মেঘ। অযথা দুই হাতে রঙ মাখামাখি করে পুরো কাগজটা নষ্ট করে দিল। নওরিন মেঘের এই কাণ্ড দেখে বোকা বনে যায়। মেঘকে ধমক দিয়ে বলল,
_এইটা কী করলি? কিছু না এঁকে কাগজটা নষ্ট করলি কেন?
_এটাই তো সুন্দর দেখ। সব গুলো রঙ একসাথে মিশে গেছে। এখন চাইলেও এই সব রঙকে আলাদা করা সম্ভব না। আমিও যে শ্রাবণের সাথে ঠিক এইভাবেই মিশে আছি রে। কীভাবে নিজের আত্মাটাকে আলাদা করবো আমি?
নওরিন বুঝতে পারে। মেঘ শত চেষ্টাও শ্রাবণকে ভুলতে পারছে না। মেঘের সামনে দাঁড়িয়ে সে আদনানকে ফোন করে। আদনানকে মেঘের সব কথা জানায়। আদনান সব শুনে একটা সল্যুশন দেয় নওরিনকে। নওরিন মেঘকে সান্ত্বনা দিতে তখন বলল,
_তুই তো এতো বোকা না মেঘ। তুই খুব ভালো করেই জানিস, জীবনে কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়। হারানো সম্পদটা যত দামী হোক না কেন? ব্যর্থ মানবের কাছে তার কোনো মূল্য থাকে না। তুই নিজের মনের ভেতরে নিজে নিজেই শ্রাবণকে নিয়ে একটা রাজ্য তৈরি করে ফেলেছিস, আর সেখানে শুধুই শ্রাবণের বিচরণ। তুই খুব বোকা মেঘ, যে মানুষটা তোকে ভুল বুঝে এতো দূরে সরে গেল। তুই বাড়িতে আছিস জেনে একবারও তোকে দেখতে এলো না। তোর জীবনের মূল্য যার কাছে নেই, তুই অযথা তার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস। মেঘ কাউকে ভালোবাসা ভুল হতে পারে না। কিন্তু কাউকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করাটা ভুল।
_হুম ঠিক বলেছিস। শ্রাবণও আমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল, তাই তো আজ সত্যিটা জানার পর এইভাবে পর হয়ে গেল। আমি কেন পারছি না ওকে ভুলতে? কেন আমার মনটা এখনও শ্রাবণের জন্য ছটফট করে? কেন বার বার শ্রাবণকে দেখতে ইচ্ছে করে? কেন ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে?
_ভুলে যা মেঘ। সব ভুলে যা। শুধু এটা মনে রাখ, শ্রাবণ মাহমুদ শুধুমাত্র তোর ক্যানভাসের এক টুকরো রঙের ছড়াছড়ি। যে শুধু ওই সাদা কাগজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, কারও মনের গভীরে গিয়ে সে মানুষটা কোনোদিনও দাগ কাটতে পারে না।
_কীভাবে ভুলবো আমি তাকে?
_সবটা দুঃস্বপ্ন ভেবে মেনে নিতে হবে তোকে। আগেও যেমন স্বপ্ন দেখতি এখনও দেখবি। কিন্তু সাবধান সেখানে যেন শ্রাবণের সম্পূর্ণ চেহারা না আসে। যে চেহারা তোর স্কেচে ফুটে উঠেছে সেটা ছাড়া আর কোনো চেহারাকে মনে রাখবি না তুই। এইভাবে একদিন ঠিকই তাকে ভুলে যাবি।
মেঘ কোনো জবাব দেয় না। নওরিনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে। নওরিন বিদায় নিয়ে চলে যায়। মেঘ সবগুলো ক্যানভাস টেনে ছিঁড়ে ফেলে। সবগুলো একত্রে নিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানে যায়। একটা দিয়াশলাই এনে তাতে আগুন ধরায়। দাউদাউ করে আগুনের ফুলকি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মেঘ বুকের মাঝে হাত চেপে মাটিতে বসে পড়ে।
সবগুলো ক্যানভাস পুড়ছে না, পুড়ছে তো মেঘের হৃদয়। কত যত্ন করে প্রতিটা ক্যানভাস সাজিয়েছিল মেঘ। সব গুলোতে ভালোবাসার মাখামাখি। এতো ভালোবাসা! এতো অনুভূতি! সব কি চাইলেই আগুনে পোড়ানো সম্ভব! কাগজগুলো তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু এই হৃদয়ের আঁকা শ্রাবণের ক্যানভাসটা কীভাবে পোড়াবে মেঘ? জলন্ত ক্যামভাসের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে ঢলে পড়ে মেঘ।
৫৮!!
জ্ঞান ফেরার পর মেঘ চোখ মেলে তাকায়। মায়ের কোলে শুয়ে আছে সে। মেঘ চোখ খোলার পর মেঘের মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মেঘ মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। আবারও কেঁদে ওঠে মেঘ। মেঘের মা মেঘকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে আছেন। মেঘ তবুও কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলল,
_কেন এমনটা হলো মা?
_লক্ষ্মী মা আমার। এইসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিস না। নতুন করে আবারও জীবন সাজাতে হবে তো।
_হ্যাঁ, নতুন করে বাঁচবো বলেই তো সব অতীত মুছে ফেললাম। ওর সমস্ত চিহ্ন এই ঘর থেকে মুছে দিলাম। ভালো করিনি বলো।
_খুব ভালো করেছিস। আয় কিছু খেয়ে নিবি। তারপর আবার নতুন করে ক্যানভাস সাজাবি। কাল যেতে হবে তো কম্পিটিশনে।
মেঘ মাথা নাড়িয়ে মায়ের সাথে বসে অল্প কিছু খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায় চেহারাটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। হঠাৎ খেয়াল হলো হাতে শ্রাবণের মায়ের দেওয়া সেদিনের সেই চুড়ি গুলো। এখনও এই স্মৃতি হাতে জড়িয়ে রাখার কোনো মানেই খুঁজে পায় না মেঘ। হাতের চুড়ি গুলো খুলে ইরাকে ডেকে ইরার হাতে চুড়ি তুলে দিল। ইরা অবাক হয়ে মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
_কী করবো এগুলো আমি?
_আন্টির জিনিস আন্টির কাছে ফিরিয়ে দিবি।
_ঠিক আছে।
ইরা রুম থেকে বাইরে যেতে পা বাড়িয়েছিল মাত্র, তখনই মেঘ ইরাকে বলল,
_সামি কেমন আছে?
_একটু পর নিজেই দেখে নিস।
ইরা চলে গেলে মেঘ চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। রঙের তুলির কাছে গিয়ে সেগুলো আবারও হাতে নিল। চোখ বন্ধ করে আঁকার চেষ্টা করলো, কিন্তু চোখ খুলে মেঘ হতাশ। সারা ক্যানভাস হিজিবিজিতে পরিপূর্ণ। এমন আর্ট যদি কম্পিটিশনে আঁকতে যায় তাহলে মেঘের জেতার আশা থাকবে না। নতুন কী আঁকবে সেই ভাবনাটাই মেঘের মনে উঁকি দিতে লাগলো।
সন্ধ্যেবেলা সামি আসার পর সবাই মিলে অনেকটা সময় ধরে আড্ডা দেয়। মেঘকে স্বাভাবিক করতে সবরকম চেষ্টা সবাই মিলে করছে। মেঘের জীবনটা যাতে আবারও নতুন করে রাঙিয়ে দেওয়া যায় সেই ভাবনাটাই এখন সবার মনে।
সামনেই টেলিভিশন চালিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডায় মনোযোগ দিল সবাই। হঠাৎ নিউজফিডে কালকের কম্পিটিশন নিয়ে নিউজ দেখে মেঘ সামি দুজনের মন খারাপ হয়ে যায়। সামির মুখ ভার দেখে মেঘ খুব জোরে জোরে হাসতে থাকে। মেঘের হাসি সামিকে ধুম করে রাগিয়ে দিল। রাগে কটমট করতে করতে সামি মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
_তোমার এই খুশি দেখে মনে হচ্ছে তুমি মন থেকেই চাইছিলে এমন কিছু হোক।
সামির কথা শুনে মেঘের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। মেঘ চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিউজ দেখতে মনোযোগ দেয়। তারপর আনমনেই বলে উঠে,
_তুমি জানো না সামি, কালকের জন্য আমি একটুও প্রস্তুত নই। এখন যখন কম্পিটিশনটা বাতিল হয়েই গেল তখন আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়টাও খুব সহজ হলো। আমি কখন থেকেই ভাবছিলাম এই কম্পিটিশনে আমি অংশ নিব না। কে জানে, হয়তো আমি চাই না বলেই এই কম্পিটিশনে অযথাই গণ্ডগোল বাঁধলো। নয়তো সারাদেশ যেখানে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে সেখানে আমার না অনুপস্থিতিতে কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা না। যাই হোক, এবার তাহলে আমি প্রস্তুতি নিতেই পারি।
মেঘের কথায় সামি অনেকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ মেঘের মনটাকে বুঝার চেষ্টা করে। ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারে মেঘের চোখ দুটো থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। সামি নিজের দ্বিধা সরাতে মেঘকে বলল,
_কীসের প্রস্তুতি?
_সময় আসলে বুঝতে পারবে। আপাতত আমাকে এই ক’দিন সাহায্য করো। একমাত্র তুমিই পারো আমাকে বাঁচাতে।
_কীভাবে?
_কালকে বলবো।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে সামিকে বিদায় দিয়ে মেঘ নিজের রুমে বসে থাকে। বিছানার মাঝখানে হাঁটুতে মুখ গুজে রুম সম্পূর্ণ অন্ধকার করে বসে বসে সমস্ত রাত্রি পার করে দেয়।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।