কাজী অফিসের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। অপেক্ষা করছে তার ভালোবাসার মানুষটার। হাতে একটি স্বর্নের আংটির বক্স যেটা সে তার টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছে। ছেলেটির চোখে মুখে কষ্ট স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে তো ওয়াদা করেছিলো আসবে। ২ ঘন্টা হতে চলেছে এখনো আসছে না কেন? ডান হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ির সময় দেখলো। মাগরিবের আজান দিয়ে দিবে আধা ঘণ্টা পর। তার মা আর বোন হয় তো বাসায় অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের। মেয়েটিকে কল দেওয়া হয়েছে, ফোন বন্ধ। আর একটু অপেক্ষা করা যাক। এমনও তো হতে পারে তার বাবা মা তাকে আটকে ফেলেছে তাই আসতে পারছে না। কম অত্যাচার সহ্য করে নি মেয়েটা। সে তো ভেবেছে মেয়েটাকে বিয়ে করে অনেক সুখে রাখবে। হয় তো আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। কেটে গেলো আরো এক ঘন্টা। পাশের মসজিদ থেকে সবাই বের হচ্ছে নামাজ পড়ে। ৩ ঘন্টা অপেক্ষার ফল সে পেলো। মেয়েটি আসলো না। এইবার ছেলেটি হার মানলো। হঠাৎ ফোনের টন বেজে উঠলো। তারাহুরো করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে মা কল দিয়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে কল রিসিভ করে কানে ধরলো-
“হ্যাঁ আম্মু বলো”
“অনেকক্ষণ তো হলো কোথায় তুই? আর আমার বৌমা কোথায়?”
“মা… আসলে…আসলে হলো টা কি…”
“কী হয়েছে মাশরাত? তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“মা..মা ও আসেনি”
মাশরাতের গলা ধরে আসলো। একটা ঢোক গিলে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। ছেলের কথা শুনে মা চুপচাপ বসে রইলো। পাশে মালিহা আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মা চোখ ঘুরিয়ে মালিহার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। মায়ের চোখ দেখে মালিহা কিছুটা বুঝতে পারলো। মা বললো-
“এখন বাসায় আয়, হয় তো কোনো সমস্যা হয়েছে। ওর মা বাবা তোদের সম্পর্ক মেনে নেয় নি জানিসই তো। আগামীকাল গিয়ে ওর সাথে দেখা করে নিস। এখন সাবধানে বাসায় আয়।”
মাশরাত “হুম” বলে কল কেটে দিলো। মা ঠিক বলেছে হয় তো কিছু হয়েছে তাই আসে নি। আগামীকাল গিয়ে দেখা করে নিবে। মাশরাত তার মোবাইলটা পকেটে রেখে আংটির বক্সটা খুলে একবার দেখে নিলো। ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি ফুটিয়ে বক্সটা বন্ধ করে দিলো। বক্সটা পকেটে রেখে ধীরপায়ে হাঁটা ধরলো বাসার উদ্দেশ্যে।
বাসায় পৌঁছে মাশরাত লম্বা নিশ্বাস ফেলে দরজায় টোকা দিলো। সাথে সাথে মালিহা দরজা খুললো। মেয়েটা হয় তো দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। এক নজর বোনকে দেখে মুচকি হেসে মাশরাত ভেতরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে মালিহা ঘুরে বললো-
“ভাবী আসলো না কেন ভাইয়া?”
মাশরাত সোফায় হেলান দিয়ে বসে মালিহার দিকে তাকালো। এই প্রশ্নের উত্তর তো সেও জানে না। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে মা মাশরাতকে দিলো। তিন নিশ্বাসে পানি শেষ করে মাশরাত উঠে দাঁড়ালো। হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো-
“আমি জেনে নেই আগে তারপর তোকে বলবো। এই নিয়ে আর কারো টেনশন করতে হবে না। আমি কালই খোঁজ করবো আর রাতেও কল দিয়ে দেখবো নি।”
মা মাশরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মাশরাত ছোটো বেলা থেকেই অনেক দায়িত্বশীল। বাবার মৃত্যুর পর মাশরাতই তার মা বোনকে সামলিয়েছে। ছেলেটার মনে কষ্ট থাকলেও কাওকে বলে না। একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু মেয়েটার মা বাবা মেনে নেয় নি কারণ মাশরাত এখনো তার পড়াশোনা শেষ করে নি। এখন তার আর্থিক অবস্থাও ভালো না। টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। তাই মেয়েটা বলেছিলো বাবা মা কে না জানিয়ে বিয়ে করবে। পালিয়ে যাবে মাশরাতের সাথে। মাশরাত প্রথম না বললেও পরে মেনে নেয় মায়ের কথায়। মা যে ভীষণ ভালোবাসে মেয়েটাকে। মাশরাত কিছু না বলে তার ঘরে চলে আসলো। মোবাইল চার্জে বসিয়ে ড্রয়ার থেকে জামা বের করে বাথরুমে চলে গেলো। গোসল করে এসে খাটে বসলো। একটা কল পর্যন্ত আসে নি। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মাশরাত ঘরে এসে অনেকবার কল দিলো। কিন্তু মোবাইল বন্ধ বলছে। মাশরাত একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মোবাইল রেখে খাটে শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ গুঁজে রইলো। চোখ গড়িয়ে হঠাৎ পানি ঝরতে লাগলো। ভালোবাসা কেমন অনুভূতি তাই না? শক্ত থেকে শক্ত মনকে গলিয়ে দেয়।
পরের দিন….
মাশরাত সকাল সকাল নাশতা করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। যেভাবেই হোক তার জানতে হবে গতকাল সে আসে নি কেন। মাশরাত তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের বা পাশটায় বার বার মোচড় লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে পা বাড়ালো। তিন তলা সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে দেখে তার ফ্ল্যাটে তালা দেওয়া। মাশরাত অবাক না হয়ে পারলো না। এই সময় কোথায় যেতে পারে তারা? হঠাৎ পেছন থেকে কেও বলে উঠলো-
“কাকে চাই?”
মাশরাত পেছনে ফিরে দেখে একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। মাশরাত সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আন্টি তারেক মামাদের ফ্ল্যাটে তালা কেন জানতে পারি? তারা কোথায় গিয়েছে আপনি জানেন?”
“তারা তো গতকাল গ্রামে চলে গেলো। তার মেয়ের নাকি বিয়ে।”
মাশরাত আকাশ থেকে পরলো। সে কি কানে ঠিক শুনছে? একটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-
“উনার মেয়ের বিয়ে..মানে তা..তাবাসসুমের?”
“হ্যাঁ উনার তো একটাই মেয়ে তার নাম তাবাসসুম। আচ্ছা তুমি কে? আত্মীয় হলে তো তোমার জানার কথা তাবাসসুমের বিয়ে।”
মাশরাত কিছু বললো না। তার মাথা ঝিম ঝিম করছে। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলে। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেলো। মাশরাত হেলেদুলে রাস্তায় হাঁটছে। তার যে পা চলছে না। মনে হচ্ছে শক্তি কমে গিয়েছে পায়ের। তাবাসসুমের বিয়ে কিন্তু সে তো বলেছিলো বিয়ের জন্য অনেক আগেই না করে দিয়েছে। মাশরাত দাঁড়িয়ে গেলো। হচ্ছেটা কী তার সাথে সে বুঝতে পারছে না। আজ পড়াতে যেতে পারবে না। হঠাৎ করেই অসুস্থ লাগছে শরীরটা। মাশরাত মোট ছয়টা টিউশনি করে। সবাইকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো আজ আসতে পারবে না। ধীরে ধীরে হেটে বাসায় গেলো। মালিহা সোফা গুছাচ্ছিলো। মাশরাতকে দেখে তারাতাড়ি ঘরে গিয়ে মাকে ডেকে নিয়ে আসলো। মা এসে দেখে মাশরাত মুখ চোখ শক্ত করে সোফায় বসে আছে। মা এগিয়ে এসে মাশরাতের পাশে বসলো। মালিহাও পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা মাশরাতের কাঁধে হাত রেখে বললো-
“কী হয়েছে মাশরাত?”
মাশরাত স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো-
“তার বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা নেই গ্রামে গিয়েছে।”
“ওহ এই ব্যাপার? এসে পড়বে তুই চিন্তা করিস না। তাবাসসুমের এইচএসসি পরীক্ষা ২ মাস পর। কতদিনই বা রাখতে পারবে গ্রামে?”
“কিন্তু মা ওর তো বিয়ে।”
মা অবাক হয়ে গেলো মাশরাতের কথা শুনে। মালিহাও থমকে গেলো। মা আবার বললো-
“মানে কী? পাগল হয়ে গেলি নাকি তুই? তাবাসসুম সেদিন কী বলেছিলো শুনিস নি? সে তোকে ছাড়া আর কাওকে বিয়ে করবে না।”
“হ্যাঁ বলেছে, কিন্তু বলা আর করার মধ্যে পার্থক্য আছে তাই না আম্মু?”
“মাশরাত নিজেকে সামলা বাবা। দেখ তোর এইভাবে ভেঙে পড়লে হবে না রে।”
“মা আমি ভেঙে পড়ছি না। আমি ভাবছি সত্যি যদি ওর বিয়ে হয়ে যায় তাহলে?”
মা কিছু বললো না। ছেলের চেহারা দেখে উনার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মাশরাত ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বললো-
“আমি জানি ও একবার হলেও কল করবে। আমি অপেক্ষায় থাকবো ওর কলের। ওর গ্রামের বাড়ি আমি চিনি না। নাহলে চলে গেতাম সেখানে। এখন সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। উনি যা করবেন আমার ও তাবাসসুমের ভালোর জন্য করবেন।”
বলেই মাশরাত তার ঘরে চলে গেলো। মা তাকিয়ে রইলো ছেলের যাওয়ার পথে। মালিহা মায়ের পাশে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো-
“ভাইয়ার সাথেই সবসময় এমন কেন হয় আম্মু? আমার ভাইটা কোনদিন সুখ পায় নি।”
মা মালিহার দিকে তাকালো। আলতো করে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো-
“যা হবে ভালোর জন্য হবে। ভাইয়ের জন্য দোয়া কর যাতে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারে তারাতাড়ি। আমার মন বলে আমার ছেলের জীবনে উত্তম কেও আসতে চলেছে। এখন শুধু তার অপেক্ষা।”
৩ বছর পর….
৫ বছরের আরমান তার ছোটো ছোটো কদম ফেলে তার বোনের ঘরে আসলো। তার বোন গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। আরমান চারপাশে চোখ বুলালো। কী করলে ওর বোন উঠবে? মাথায় আইডিয়া আসতেই তারাতাড়ি হেটে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে সরিয়ে দিলো। চোখের উপর রোদ পড়তেই আরমানের বোন কপাল কুঁচকালো। কম্বল টেনে নিয়ে মুখ ঢেকে আবার ঘুমিয়ে পরলো। আরমানের রাগ এইবার সপ্তম আসমানে উঠে গেলো। দ্রুত হেটে এসে কম্বল হালকা সরিয়ে তার বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। হঠাৎ চিৎকারের শব্দ শুনে আধুনিকতা ধরফরিয়ে উঠলো। বুকে ব্যাথা উঠে গিয়েছে তার। আরমান খিলখিল করে হেসে উঠলো। ৫ বছরের আরমান বুঝতে পারলো না আধুনিকতার কতটা কষ্ট হচ্ছে। চিৎকারের শব্দ শুনে আধুনিকতার মা তারাতাড়ি ঘরে আসলো। এসে দেখে আধুনিকতা বুকের বা পাশে হাত রেখে মাথা নিচু করে বসে আছে আর আরমান খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। মা বিষয়টা বুঝতে পেরেছে দ্রুত হেটে এসে আরমানের হাত ধরে ধমকের গলায় বললো-
“তোমাকে না বলেছি মাম্মামের সাথে দুষ্টুমি করতে না? কেন এমন করলে তুমি?”
আরমান কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে ফেললো। আধুনিকতা চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
“থাক আম্মু ওকে কিছু বলো না। ও তো বাচ্চা মানুষ।”
মা আধুনিকতার দিকে তাকিয়ে বললো-
“তুমি ওকে আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর বানিয়ে ফেলেছ।”
“আমার একমাত্র ছোটো ভাই ও। ওকে আদর দিব না তো কাকে দিব শুনি?”
“হয়েছে হয়েছে, এখন বলে তুমি ঠিক আছো তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ”
আধুনিকতার কথা শুনে মা নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেললো। তারপর আরমানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
“আবার বলছি আরমান মাম্মামের সাথে দুষ্টুমি করবে না।”
আরমান মাথা নাড়ালো। মা চলে গেলো ঘর থেকে। আধুনিকতার বেশ মায়া হলো আরমানের চেহারা দেখে। কেমন চুপসে গিয়েছে বাচ্চাটা। আধুনিকতা আরমানের হাত ধরে পাশে বসালো। আরমান মাথা নিচু করে বসে রইল চুপচাপ আধুনিকতা মুচকি হেসে বললো-
“কী হয়েছে আমার ছোটুর?”
আরমান আধুনিকতার দিকে তাকিয়ে বললো-
“সরি মাম্মাম”
“আমার ছোটু সরি বলছে কেন?”
“আমি সবসময় দুষ্টুমি করি তাই।”
“আম্মুর কথায় মন খারাপ করো না বাবু। আম্মু এইভাবে বলেছে।”
আরমান মাথা নাড়ালো। আধুনিকতা হেসে আরমানকে জড়িয়ে ধরলো। হাজার কষ্ট হোক কিন্তু তার ছোটো ভাইটাকে একবার জড়িয়ে ধরলে তার মন ভালো হয়ে যায়। আরমান তার ছোটো ভাই কিন্তু নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। আরমান আধুনিকতার থেকে ১৭ বছরের ছোটো। আরমান যখন পেটে ছিলো তখন লোকে অনেক মন্দ কথা বলেছে। কিন্তু আধুনিকতা প্রতিবাদ করতে ভয় পায় নি। জীবন যেহেতু তাদের অন্যের কথায় কেন কান দিবে? আধুনিকতা আরমানের মাথায় চুমু দিয়ে গালে হাত রাখলো।
“এখন গিয়ে নাশতা করো, মাম্মাম ব্রাশ করে আসছি।”
আরমান মাথা নাড়িয়ে খাট থেকে নেমে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আধুনিকতা কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজেকে শান্ত করলো। বুক ব্যাথা করছে তার। এখন তো আরমানের দোষ দেওয়া যাবে না। সে তো জানে না আধুনিকতার হার্ট খুব দুর্বল। আধুনিকতা বিছানা ছেড়ে নেমে জামা নিয়ে বাথরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানা গুছিয়ে ঘর থেকে বের হলো। ড্রইংরুমের সোফায় বসে তার দাদাই খবরের কাগজ পড়ছে। আধুনিকতা মুচকি হেসে দাদাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। তার এইটা দৈনিক কাজ। দাদাই হেসে আধুনিকতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তখনই পাশ থেকে কেও বলে উঠলো-
“আমার মর্নিং গিফট?”
আধুনিকতা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। বাবা দু’দিন আগে অফিসের কাজের উদ্দেশ্যে বাহিরে গিয়েছিলো। আজ ফিরেছেন। মুখে বড়ো হাসি ফুটিয়ে দ্রুত হেটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
“আব্বু কখন আসলে তুমি?”
“২ ঘন্টা হবে, তুমি আজ এত তারাতাড়ি উঠলে যে?”
“আজ আমার ভার্সিটির প্রথমদিন।”
“প্রথমদিন মানে? তুমি ভার্সিটি যাচ্ছো কেন তুমি তো এখনো অসুস্থ।”
বাবা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। আধুনিকতা হেসে বললো-
“উফফো আব্বু ৩ বছর রেস্ট নিয়েছি আর পারবো না। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি।”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু না, আমার পড়া গুলো পিছিয়ে গিয়েছে। আর আমার বাস্কেটবলের ট্রেনিং….”
“তুমি বাস্কেটবলের নাম পর্যন্ত মুখে আনবে না।”
বাবা রাগী কন্ঠে বললো কথাটা। আধুনিকতা চুপসে গেলো। কষ্টে তার গলা ধরে আসছে। এই একটাই তো প্রিয় খেলা তার। বাস্কেটবল, যে খেলায় আধুনিকতা কলেজ লাইফে চ্যাম্পিয়ন ছিলো। তখনই দাদাই বললো-
“তোমার বাবা ঠিক বলেছে আধুনিকতা। এই বাস্কেটবলের কারণে তুমি সেদিন… তাই আমরা চাই তুমি এই খেলা আর খেলবে না।”
আধুনিকতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। বাবা আধুনিকতাকে বুকে টেনে নিলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“তুমি আমাদের পরিবারে একমাত্র মেয়ে। তোমার কিছু হয়ে আমাদের কী হবে বলো।”
আধুনিকতা বাবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিলো। বাবা আধুনিকতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
“নাশতা করে নাও আজ আমি তোমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসব।”
আধুনিকতা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। বাবা ঘুরে হেটে গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। আধুনিকতা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। গলা ধরে আসছে প্রায়। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কলেজের স্মৃতি যখন সে প্রথমবার গোল্ড মেডেল জিতেছিল বাস্কেটবল খেলায়। তখনই মা ডাকলো আধুনিকতাকে। আধুনিকতা কোনো মতো নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলো।
অন্যদিকে…..
চিলড্রেন পার্কে আজ ভীষণ নীরব। বাচ্চাদের স্কুল খুলে গিয়েছে তাই অনেকজনই আজ আসে নি। মাশরাত বেঞ্চে বসে বিশ্রাম করছে। মালিহা বলেছে মাশরাতের পেট নাকি বেরিয়ে গিয়েছে এই ২ মাস বাসায় বসে থেকে। যেহেতু মাশরাত একজন বাস্কেটবল প্লেয়ার তার দরকার নিজেকে ফিট রাখা। তাই আজ থেকে জগিং শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে উঠে দাঁড়ালো। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে হাঁটা ধরলো। মাশরাত ভাবছে টিউশনির পাশাপাশি আরো কিছু কাজ করতে পারলে ভালো হত। যেহেতু তার পড়াশোনা শেষ আর এখনো চাকরি খুজে পায় নি তাই অন্য কোনো কাজ করলে ভালো হয়। আর কতদিনই মালিহা আর্ট স্কুলে চাকরি করে সংসারে টাকা দিবে। তার বোনের উপর সংসারের চাপ মাশরাত সহ্য করতে পারে না। যদিও সে টিউশনি করে টাকা দেয় সংসারে। তবুও বোনের জন্য তার মন কাঁদে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো নিউজপেপার কিনে নেওয়া যাক। পার্কের ভেতরেই নিউজপেপার বিক্রেতা আসে। উনার থেকে একটা নিউজপেপার কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলো। মালিহা স্কুলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে দেখে মাশরাত দাঁড়িয়ে পকেটে কী যেনো খুঁজছে।
“কী হলো তোমার?”
“৫০ টাকা রেখেছিলাম পকেটে পাচ্ছি না।”
“এখন কি তোমার টাকা লাগবে?”
“না, কিন্তু হঠাৎ কোথায় গেলো বুঝতে পারছি না।”
“সমস্যা নেই ভাই হয় তো রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। দোয়া করো যেনো কোনো দরিদ্র মানুষ পায় টাকা টা।”
মাশরাত মুচকি হেসে মালিহার গাল ধরে টানলো। মালিহা মাশরাতকে ভেতরে যেতে বলে চলে গেলো স্কুলের উদ্দেশ্যে।
মাশরাত ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসলো নিউজপেপার নিয়ে। মা নাস্তা বাড়ছে আর মাশরাত নিউজপেপারে চোখ বুলাচ্ছে। নিউজপেপার সরিয়ে নাশতার দিকে তাকিয়ে মাশরাতের মন খারাপ হলো। শুকনো রুটি গতকাল রাতেট আলুভাজি দিয়ে। ২ মাস হলো মাশরাত সংসারে টাকা দিতে পারছে না ঠিক মতো। মাশরাতের মন খারাপ হলো খুব। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখলো। নিউজপেপার পড়তে পড়তে নাশতা করে নিলো।
“চা দিব?”
মাশরাত নিউজপেপার পড়তে পড়তেই না বললো। হঠাৎ শেষ পৃষ্ঠায় মাশরাত একটা আর্টিকেল দেখতে পেলো। একটা ভার্সিটিতে বাস্কেটবল ট্রেইনার লাগবে। ৬ মাস ট্রেইনিং দিতে হবে খেলোয়াড়দের। প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা দিবে। মাশরাতের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হয় তো সে জবটা পেয়ে যেতে পারে। দাঁড়িয়ে বললো-
“মা আমি একটা ইন্টারভিউর জন্য যাচ্ছি।”
“হঠাৎ তোর ইন্টারভিউ কোথা থেকে আসলো?”
“মাত্র পেপারে দেখলাম। আমি আসছি ওয়েট।”
মাশরাত দৌড়ে তার ঘরে গেলো। আলমারি থেকে তার মেডেল, বেস্ট প্লেয়ারের সার্টিফিকেট গুলো একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে বাহিরে বের হলো। মা টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বললো-
“কিসের কাজ সেটা তো বলে যা।”
“বাস্কেটবল ট্রেইনার। এখন আসছি দোয়া করে যাতে কাজটা পেয়ে যাই।”
মাশরাত দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো। ছেলেটার এত নেশা কেন এই খেলার প্রতি মা বুঝতে পারে না।
মাশরাতের জব কনফার্ম হলো। কলেজের প্রিন্সিপাল ও চেয়ারম্যান মাশরাতের মেডেল, সার্টিফিকেট দেখে ইমপ্রেস হলো।
“আমরা চাই আগামী পরশুদিন থেকেই আপনি আমাদের বাস্কেটবল প্লেয়ারদের ট্রেইনিং শুরু করুন।”
প্রিন্সিপালের কথায় মাশরাত হেসে মাথা নাড়ালো। চেয়ারম্যান বললো-
“বাস্কেটবল, এই গেইমটা আমার পছন্দ না। কারণ এই গেইমটার কারণে আমাদের পরিবারের কেও একজন মরতে মরতে বেঁচেছে। আমি চাই আপনি একটু সাবধানে সবাইকে ট্রেইনিং দিবেন যাতে কেও আহত না হয়।”
“জ্বী স্যার আমি সবার খেয়াল রাখবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”
“যেহেতু আপনি ছেলে মেয়ে উভয়কে ট্রেইনিং দিবেন তাই পরিশ্রম বেশী করতে হবে।”
“স্যার আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।”
“সাউন্ডস গুড।”
“আসি তাহলে আজ”
“জ্বী”
মাশরাত উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে সালাম দিয়ে অফিস রুম থেকে বের হলো। আজ সে ভীষণ খুশী। অনেকদিন পর ভালো একটা কাজ পেয়েছে। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডায়ালে গিয়ে চিরচেনা নামটায় ক্লিক করে কানে ধরলো। ফোনের ওপার থেকে গত তিন বছর ধরে যা বলে আসছে আজও তাই বললো। তাবাসসুমের ফোন আজও বন্ধ পেলো মাশরাত। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মোবাইল পকেটে রেখে মাশরাত আকাশের দিকে তাকালো। চোখের সামনে তাবাসসুমের চেহারা ভেসে উঠলো। এমন মায়াবী চেহারা মাশরাত আর কারো দেখে নি। তার চোখে তাবাসসুম একদম নিখুঁত একজন মানুষ। মেয়েটার ঠোঁটের কোণার সেই মুচকি হাসিটা যে বড্ড মিস করে মাশরাত। এই তিন বছরে একবারো কাঁদে নি মাশরাত। হয় তো আবার দেখা মিলবে তাবাসসুমের। হয় তো তখন দেখবে তাবাসসুম অন্য কারোর স্ত্রী। মাশরাত সেই মুহূর্তের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছে।
#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১