#ক্যানভাস_
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৮)
রাস্তার মোড় থেকে একটা সি. এন. জি নিয়ে মেঘ নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে বেরিয়ে গেল।
সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য যখন ইরা মেঘকে ডাকতে এলো তখন ইরা সারা মুখ ফাঁকা দেখতে পায়। চারিদিক তন্নতন্ন করে মেঘকে খুঁজতে থাকে। রুমে না পেয়ে একজন একজন করে বাড়ির পরিচিতদেরকে মেঘের কথা যখন জিজ্ঞেস করবে তখন আবার ভাবলো সবার টেনশন বেড়ে যাবে, যখন সবাই শুনবে বিয়ের কনে ঘর থেকে হাওয়া। ইরা কোনো উপায় না পেয়ে দ্রুত মেইন গেইটের সামনে যায়। সিকিউরিটি গার্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, ‘বাড়ি থেকে কাউকেই বের হতে দেখেনি সে।’ ইরা আর কিছু জানতে না চেয়ে বাড়ির ভেতরে আসে। তারপর সামির কাছে যায়। সামি তখন রুমে আদনানের সাথে গল্প করছিল। ইরার গম্ভীর আর চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখে সামি আর আদনান দুজনই ভয় পেয়ে যায়। সামি কিছু বলার আগেই ইরা বলল,
_মেঘকে দেখেছ তোমরা?
_কই না তো। আমি তো দেখিনি। আদনান তুমি দেখেছো?
সামির কথা শুনে আদনান হালকা কাশি দিল। তারপর এক গ্লাস পানি ডগডগ করে গিলে ইরাকে বলল,
_দু’ঘণ্টার ভেতর ফিরছে।
_মেঘ বাড়ির বাইরে!
_হ্যাঁ।
_কীভাবে গেল? সিকিউরিটি গার্ড তো বলল সে দেখেনি। আর তুমি যখন জানো মেঘ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে তাহলে এতক্ষণ আমাকে জানাওনি কেন? এখন আমি কী জবাব দিব বড়মাকে?
_দেখ ইরা, এই মুহূর্তে মেঘকে হেল্প করাটা আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়েছে। তাই আমি ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হেল্প করেছি। আর আমি জানি, সবাই জানার আগেই মেঘ ফিরে আসবে।
_কোথায় গেছে সেটা তো বলো?
_কোথায় আবার যেখানে বউ হয়ে যাবে সেখানে।
_শ্রাবণ ভাইয়ার কাছে।
_হ্যাঁ।
_কালকেই তো বিয়ে, আজকেই বের হওয়াটা কী খুব দরকার ছিল? সারা বাড়ি ভর্তি মেহমান। একবার ইনি, আবার তিনি, এরকম করে যে কতজন মেঘ দেখতে চাইলো তার হিসেব নেই। তার উপর সকালের নাশতাটাও করেনি মেঘ। এইভাবে সবার আড়ালে যাওয়ার কী দরকার ছিল ওর?
_চারিদিকে সিকিউরিটি। পুলিশের পাহারা। যদি মেঘ এটা বলতো যে, সে শ্রাবণের সাথে দেখা করতে চায়। তাহলে কি কেউ ওকে বাড়ির বাইরে পা রাখতে দিত?
_যেত না বাইরে। এইভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন?
_আরে বাবা যখন তোমার বিয়ে হবে। কিংবা যখন তুমি কাউকে ভালোবাসবে। তখন বুঝবে মেঘ কেন? কীসের টানে? আজ এত তাড়াহুড়ো করে, সবাইকে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে গেল।
_এখন সবাইকে কী জবাব দিবো?
_ভেবো না। তিনজনে মিলে সবাইকে কিছুক্ষণ মাতিয়ে রাখি। দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। আর এর ভেতরে মেঘও বাড়িতে চলে আসবে। আমার আবার বিকেলে শ্রাবণের বাসায় থাকতে হবে।
_ঠিক আছে।
তিনজনে মিলে একসাথেই নিচে নামলো। আদনান সামিকে নিয়ে ধীরেধীরে সোফায় গিয়ে বসে। ইরা ডাইনিং টেবিলের কাছে যেতেই মেঘের মা ইরাকে বললেন,
_ইরা মেঘ আসেনি।
_বড় মা, মেঘ তো শ্রাবণ ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলছে তাই আসেনি।
_দাঁড়া আমি ডাকলে ঠিকই আসবে।
মেঘের মা সিঁড়ির কাছে যেতেই ইরা তাড়াতাড়ি আদনানকে ওনার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আদনান ওনার সাথে ভাব জমিয়ে উল্টো পাল্টা কথাবার্তার মাঝে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু ওনার একটাই কথা মেঘকে তাড়াতাড়ি নাশতা দিতে হবে। তারপর আবার মেঘকে সব নিয়ম মেনে গোসল করতে হবে। অনেক ঝামেলা। পরে না হয় ফ্রি হয়ে শ্রাবণের সাথে কথা বলে নিবে। কিন্তু, এখন খাওয়া দরকার। আদনানকে রেখে ওনি আবার উপরে যেতে নিলে আদনান ওনাকে বলল,
_আন্টি আপনি তো খুব বোকা টাইপের মহিলা।
_কী বললি পাজী ছেলে?
_ঠিকই তো বলেছি। আরে বাবা মেয়ে তাঁর হবু বরের সাথে প্রেমের দু’একটা আলাপ আলোচনা করছে আর আপনি কি না এখন তাঁদের আলাপের মাঝে বাধা দিবেন। এ যুগের ছেলেমেয়েদের নিজেদের আগামী জীবন কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে আগে থেকেই সমস্ত আলাপ আলোচনা সেরে নেয়াই উত্তম। নইলে দেখা যাবে পরবর্তীতে এ নিয়ে ওদের মাঝে অনেক ঝামেলা হবে। তাই আমি বলি কী, আপনার এই মুহূর্তে মেঘের রুমে নক করাটা ঠিক হবে না। হাজার হোক উপযুক্ত মেয়ের তো একটু প্রাইভেসি থাকেই।
_দেখেছিস বাবা আমি কতটা বোকামি করতে যাচ্ছি। আমি-ই কি না এখন আমার মেয়ের প্রেমের পথের বাধা হতে যাচ্ছিলাম। লোকে জানলে কী যে হবে?
এইবলে মেঘের মা কপালে হাত দিয়ে আবারও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান। আদনান আবারও পেছন থেকে বলে উঠল,
_কেউ কিছু জানবে না আন্টি৷ আমি কাউকেই জানাবো না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।
আদনান একটু চিৎকার করেই বলে কনুই ঝুঁকিয়ে ‘ইয়েস’ বলে দ্রুত সামির কাছে যায়। সামি আর ইরা দুজন মিলে হাসাহাসি করছে আদনানের এই কাণ্ড দেখে। কেমন করে বুঝিয়ে দিল মেঘের মা’কে। অথচ মেঘের মা কিছুই টের পেলেন না। তিনজনে মিলে এই লুকোচুরি বিষয়টা নিয়ে খুব হাসিঠাট্টা করছে।
৪৫!!
আলতো ভাবে দরজাটা খুলে আস্তে-ধীরে এক-পা এক-পা করে শ্রাবণের রুমের ভেতরে ঢুকে মেঘ। শ্রাবণ তখনও ঘুমে বিভোর। মেঘ সেন্টার টেবিলের কাছে এসে বিছানায় বসতে গিয়ে মেঘ হাতের ফুল আর ব্যাগটা সেন্টার টেবিলে রাখতেই মেঘের হাত লেগে সেন্টার টেবিল থেকে পানির বোতলটা ফ্লোরে পড়ে যায়। বেশ জুড়ে শব্দ না হলেও খানিকটা আওয়াজ হয় পুরো রুম জুড়ে। শ্রাবণ শব্দের কারণে এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। মেঘ খাটের নিচে একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। যাতে শ্রাবণ মেঘকে দেখতে না পায়।
দু’মিনিট পর যখন শ্রাবণের কোনো সাড়াশব্দ মেঘ উপলব্ধি করতে পারলো না, ঠিক তখনই বিছানায় উঠে বসে। আস্তে করে শ্রাবণের মাথাটা বালিশ থেকে নামিয়ে নিজের কোলের উপর নিয়ে নেয়। চুলে বিলি কাটতে গিয়ে মেঘের মাথায় দুষ্টুমি ভর করে বসে। মেঘ সেন্টার টেবিলে রাখা গোলাপ ফুলটা আলতো করে শ্রাবণের কপাল থেকে শুরু করে ঠোঁট পর্যন্ত ছুঁইয়ে দিতে থাকে। এইভাবে কয়েকবার শ্রাবণের ঠোঁট নিয়ে দুষ্টামি করে মেঘ। শ্রাবণের নড়চড় না পেয়ে ফুল দিয়ে শ্রাবণের সারা মুখে সুড়সুড়ি দিতে থাকে মেঘ। ফুলের স্পর্শ পেয়ে ঘুম না ভাঙলেও সুড়সুড়ির যন্ত্রণায় শ্রাবণের ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকিয়েই মেঘকে দেখতে পায় শ্রাবণ। আজকের দিনে এইভাবে এই বাসায় মেঘকে দেখে শ্রাবণের চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেল। এক লাফে মেঘের কোল থেকে সরে বিছানায় বসে শ্রাবণ। শ্রাবণের এমন ভয় ভয় চেহারা দেখতে পেয়ে মেঘ ভীষণ মজা নিচ্ছে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠে মেঘ। মেঘের হাসি দেখে শ্রাবণ মেঘকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
_তুমি এখানে কীভাবে?
_কীভাবে আবার, আমার ডানা গজিয়েছে।
_ফাজলামি করো না। তোমাকে কেউ দেখে ফেলেনি তো? তাছাড়া তোমার বাড়িতে কড়া সিকিউরিটি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে আসলে কীভাবে তাও আজকের দিনে? কেউ দেখলে খুব ঝামেলা হবে রাত্রি।
_দেখেছে তো একজন। যে আমাকে এখান পর্যন্ত আসতে হেল্প করেছে। সে তোমার বোন পুতুল। আর আমার বাড়ি থেকে এখানে আসতে হেল্প করেছে আদনান।
_কী! আদনান? ওর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে এইভাবে তোমাকে একা ছেড়ে দিল। আর পুতুল তো বাড়ির সবাইকে সব বলে দিবে।
_রাখো তো এসব। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম সেটা বলো?
_এমন সারপ্রাইজ আমার চাই না। যে সারপ্রাইজ আমার ভয়ের কারণ হয়। যে সারপ্রাইজের জন্য কাউকে হয়রানি করতে হয়।
_আমি জানি তুমি বাড়ির সবার টেনশনের কথা ভাবছো। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার থেকেও মূল্যবান ছিল কালকের কথাটা। যখন আমি বলেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো।
_শুধু কী এই সারপ্রাইজ?
_আরো আছে। ওয়েট…
মেঘ সেন্টার টেবিলে রাখা ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে শ্রাবণের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
_আগামীকাল আমার বিয়ে। তুমি আসবে কিন্তু। তুমি না আসা পর্যন্ত আমি কবুল বলব না।
শ্রাবণ মুচকি হেসে কার্ডটা হাতে নিল। কার্ড খুলে তাতে দেখলো খুব সুন্দর করে বর কনের নাম, ঠিকানা আর বাকী যাবতীয় তথ্য দেয়া। আবার বর কনের দু’টো ছবি রাখা দু’পাশে। কনের নাম কাশফিয়া হাসান মেঘ এর জায়গায় রাত্রি হাসান লেখা। কার্ডটার ভেতর আর বাইরের অংশ দু’পাশই খুব সুন্দর আর গর্জিয়াস। শ্রাবণ মেঘকে রাগানোর জন্য বলল,
_যদি না যাই।
_সমস্যা নেই, আমার কপালে তোমার ভালোবাসা নেই এটা মেনে নিয়ে ধৈর্য্য ধরে বাকী জীবন পার করে দিব। ভেবো না, ভীতুদের মতো আত্মহত্যা আমি করবো না। আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আছে।
এইকথা বলে মেঘ বিছানা থেকে নেমে যে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল সেই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে রওয়ানা হয়। মেঘের হুট করে রেগে যাওয়াটা শ্রাবণের বেশ ভালো লাগে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে মেঘের হাত ধরে মেঘকে আটকিয়ে বলল,
_চুপিচুপি নয়, সবার সামনে গিয়ে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে তারপর বাড়ি যাবে। আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাব।
মেঘ কিছুক্ষণ শ্রাবণের চোখের দিকে তাকায়। কিছু না বলে হুট করেই জড়িয়ে ধরে শ্রাবণকে। হুটহাট মেঘের এমন জড়িয়ে ধরা খুব বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয় শ্রাবণকে। মনের মধ্যে দ্বিধা সৃষ্টি হয়ে যায় শ্রাবণের। তবুও জোর করে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে মেঘকে। শ্রাবণের এই একটুখানি স্পর্শই যেন ছিল মেঘের জন্য স্বর্গের সুখের সমান। না চাইতেও মেঘকে জড়িয়ে ধরতেই শ্রাবণের মনের ভেতরে হালকা সুখ অনুভব হলো। মেঘের মাথা উপরে তুলে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
_কালকের জন্য সব ভালোবাসা তুলে রাখলাম।
_ইশ! চলো তো নিচে যাব।
মেঘ লজ্জা পেয়ে কথা ঘুরিয়ে নেয়। শ্রাবণ মেঘের অবস্থা বুঝতে পেরে মেঘকে নিয়ে যখন রুম থেকে বের হয়, তখনই পুতুল হুট করে শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্রাবণ পুতুলকে সব বলে মেঘকে নিয়ে নিচে নামে। শ্রাবণের বাবা-মা দুজনই তখন দরকারি আলোচনা করতে ব্যস্ত ছিলেন। শ্রাবণ মেঘকে নিয়ে দুজনের সামনে গেলে শ্রাবণের বাবা-মা, শ্রাবণ আর মেঘের দিকে অবাক চোখে তাকান। পুতুলের দিকে তাকিয়ে দেখেন পুতুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের মা একটু রাগী চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় শ্রাবণকে বললেন,
_একটা দিনের জন্যও তোরা আলাদা থাকতে পারলি না। আজকেই কী দেখা করতে হলো ওদের?
_মা প্লিজ রাত্রিকে বকো না। আমি ওকে আসতে বলেছি।
_বিয়ের কনেকে তুই বিয়ের আগের দিন বাড়ি থেকে আসতে কেন বললি? পাড়া প্রতিবেশী যদি উল্টো পাল্টা কিছু ভাবে?
_তাতে কী আসে যায়। আমরা দুজন যদি দুজনের সাথে মিলেমিশে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি তাহলে পাড়া প্রতিবেশীর কথা কেন আমাদের কানে তুলবো? ওদের কথার ইগনোর করা উচিৎ। কে কী ভাবলো তাতে আমার কী?
_তারপরেও তোদের আরেকটু ধৈর্য্য ধরা উচিত ছিল।
_তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আ’ম রিয়েলি সরি।
_থাক থাক, আর সরি বলে দরদ দেখাতে হবে না। সর তো আমি আমার বউমাকে দেখব।
শ্রাবণের মা শ্রাবণকে খানিকটা দূরে সরিয়ে মেঘের কাছে এগিয়ে যান। মেঘের মুখোমুখি হতেই মেঘ পা ধরে শ্বশুর-শ্বাশুরি দুজনকে সালাম করে নেয়। শ্রাবণের মা মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে মেঘকে বললেন,
_বেশ করেছ তুমি এখানে এসেছ। তোমার যখনই মন চাইবে তখনই আসবে। আর কাল থেকে তো তুমি এই বাড়িতেই সবসময় থাকবে। আমাদের সবার মাঝে, সবাইকে ঘিরে। শুনো আমার ওই পাজি ছেলেটা যদি তোমার উপর রাগ দেখায় তাহলে সোজা আমার কাছে এসে নালিশ করবে। আমি ওকে বকে দিব।
_জ্বি আন্টি।
_বোকা মেয়ে আন্টি কেন ডাকছো? এখন থেকে তো আমি-ই তোমার মা। আমাকে মা বলেই ডাকবে।
_ঠিক আছে মা।
শ্রাবণ মায়ের এমন রূপ দেখে ভীষণ রকম অবাক হয়। রাগ দেখিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল,
_দেখলে বাবা দেখলে। তোমার ওয়াইফ নিজের ছেলের থেকেও ছেলের বউকে বেশি ভালোবাসে। এখন যেন রাত্রি ওদের সব। আমি কী কেউ না, না কি?
_ভাবিস না। তোর আদরের পঞ্চাশ পার্সেন্ট এখন বউমার ধকলে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সেটা একশতে রূপ নিতে বেশিদিন লাগবে না।
_কী! আমাকে বুঝাচ্ছো না কি রাগাচ্ছো?
_নিজেই বুঝে নে।
শ্রাবণকে রাগিয়ে শ্রাবণের বাবা-মা দুজনে মিলে মেঘকে নিয়ে গল্প রাখতে লাগলেন। পুতুলকে বললেন এক গ্লাস শরবত আর মিষ্টি নিয়ে আসতে। মেয়েটা এই বাড়িতে প্রথমদিন পা রাখলো। সামান্য মিষ্টি মুখে দেওয়া প্রয়োজন। শ্রাবণের মায়ের কথা শুনে পুতুল দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে শরবত আর মিষ্টি নিয়ে এসে মেঘকে খাইয়ে দিল।
৪৬!!
অনেকটা সময় ধরে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে মেঘ এবার বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ায়। মেঘের মা নিজের হাতে থাকা সোনার বালা দু’টো মেঘের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
_আজ থেকে এই বালা জোড়া তোমার হাতে থাকবে।
_মা এসব আবার আমাকে দেয়ার কী দরকার?
_আমার বউমাকে কী আমি কিছু দিতে পারি না?
_না মা তা নয়, আপনাদের সবার ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থাকতে চাই আমি। এইসব গয়না পরতে আমার তেমন ভালো লাগে না।
_জানি, তারপরেও এই বালা আজকে থেকে তোমার। এটা একজন মায়ের থেকে তাঁর মেয়ের জন্য প্রথম উপহার।
_আমি এই বালা সারাজীবন আগলে রাখব। এবার আমি আসি মা। বাসায় কেউ কিছু জানে না।
_ভয়ের কিছু নেই শ্রাবণ তোমাকে পৌঁছে দিবে।
শ্রাবণের মা শ্রাবণকে বললেন মেঘকে বাড়িতে ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে দিতে। শ্রাবণ রেডি হয়ে মেঘকে নিয়ে বের হয়। মেঘ দু’জনকে আবারও সালাম করে বিদায় নেয়। গাড়িতে এসে বসতেই পুতুল দৌঁড়ে এসে মেঘের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
_আংকেল আর খালামনিকে বুঝিয়ে নিয়েছি। আমার পাওনাটা ঠিকভাবে দিয়ে দিও। যদি কিছু গড়বড় হয় তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।
_একদম গড়বড় হবে না ননদিনী। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। কাল এখানে এসেই সব ঠিকভাবে দিয়ে দিব।
_লক্ষী ভাবি। আল্লাহ হাফেজ।
_আল্লাহ হাফেজ।
পুতুল চলে গেলে শ্রাবণ গাড়ি স্টার্ট দেয়। ড্রাইভ করতে করতে শ্রাবণ কেবল আড়চোখে মেঘকেই দেখছিল। মেঘ যখন বুঝল শ্রাবণ ওর দিকে চুপিচুপি তাকাচ্ছে তখন ইচ্ছে করেই মাথার উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর অভিনয় করে। শ্রাবণ কিছু বললে মেঘ আর শুনে না। মেঘ এটা বুঝায় যে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মনখারাপ করে শ্রাবণ একা-একাই গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করে।
আনিকা পাশে থাকলে এই মুহূর্তটা অনেক সুন্দর কাটতো। আনিকার অভ্যাস সবসময় শ্রাবণের একটা হাতের বাহু টাইট করে ধরা। আজ বড্ড মিস করছে শ্রাবণ আনিকাকে। মেয়েটাকে শেষবারের মতো হলেও একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। জানে এই ইচ্ছে আর পূরণ হবে না। তাই নিজের অপূর্ণ ইচ্ছাটাকে নিজের মনের গভীরেই মেরে ফেলতে চায় শ্রাবণ। ভুলে যেতে চায় আনিকার সমস্ত স্মৃতি, এমনকি আনিকার প্রতিটা স্পর্শও ভুলতে চায়। নতুন করে বাঁচতে চায় শ্রাবণ রাত্রিকে নিয়ে। রাত্রির নিষ্পাপ মনের ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে চায়। তাই তো নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য রাত্রিকে বিয়ে করা। সামান্য সুখ দিয়ে হলেও রাত্রিকে ভালো রাখা, এটাই এখন শ্রাবণের একমাত্র লক্ষ্য।
ভাবতে ভাবতেই গাড়ি ব্রেক করে শ্রাবণ। হাতটা সরাতে গিয়ে বুঝতে পারে মেঘ খুব টাইট করে শ্রাবণের বাহুটা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা দিয়ে আছে। ঘুমন্ত মেঘের মায়াবী মুখটা দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। এই মুখে কেমন যেন একটা মায়া জড়িয়ে আছে। শ্রাবণ আগে সেটা খেয়াল না করলেও এখন খুব করে তা লক্ষ্য করে। মেঘকে সোজা করে বসিয়ে ডাক দেয়। ঘুম থেকে তুলে গাড়ি থেকে নামে শ্রাবণ। তারপর মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
_আমার হাতটা ধরো রাত্রি।
শ্রাবণের এমন কথা শুনে মেঘ কেবল অদ্ভুত দৃষ্টিতে শ্রাবণকে দেখতে থাকে।
চলবে…