ক্যানভাস_ লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু পর্ব : (১৯)

0
622

#ক্যানভাস_
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৯)

আগে কখনও শ্রাবণ মেঘকে জড়িয়েও ধরেনি হাতটাও ধরতে চায়নি। আর আজকে শ্রাবণ মেঘকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে আবার এখন হাত ধরতে চাইছে। মেঘ আজ শ্রাবণের মাঝে সেই আভাসটাই পেয়েছে যা দ্বারা মেঘ বুঝতে পারে শ্রাবণ ধীরে ধীরে মেঘের মায়ায় নিজেকে ডুবাচ্ছে। মেঘের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দেখে শ্রাবণ আবারও মেঘকে বলল,

_কী হলো? ধরো আমার হাত।
_হ্যাঁ ধরছি।

মেঘ নিজের হাত বাড়িয়ে শ্রাবণের হাতটা স্পর্শ করে। আস্তেধীরে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। শ্রাবণ মেঘকে নিয়ে সবার সামনেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। মেঘ শক্ত করে শ্রাবণের হাতটা ধরে আছে কেউ বকা দিবে এইভেবে।

৪৭!!
শ্রাবণ আর মেঘকে ভেতরে ঢুকতে দেখে আদনান, সামি, ইরা তিনজনই অবাক হয়ে যায়। আদনান তো ভয়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছে। মেঘকে এইভাবে দেখে ইরা রাগী চোখে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান মাথা নাড়িয়ে না করে। ইরা মেঘের কাছে যাওয়ার আগেই মেঘের মা ওদেত দুজনের সামনে পৌঁছে যান। শ্রাবণের থেকে মেঘের হাত ছাড়িয়ে সবার আগে মেঘের গালে ঠাস করে চড় দেন। মেঘ গালে হাত দিয়ে চোখের জল ফেলছে। মেঘের মা মেঘকে বললেন,

_তোকে নিয়ে আমরা চিন্তায় দিনরাত ঘুমাতে পারি না। যদি আমাদের কলিজার টুকরোটার কোনো বিপদের আঁচ পাই। তুই নিজেই ভালো করে জানিস কিছু লোক তোকে মরিয়া হয়ে খুঁজছে। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে শ্রাবণের কাছে গেলি ভালো কথা। কাউকে তো সাথে নিতে পারতি তোর সেফটির জন্য। আরে বোকা মেয়ে কেন বুঝিস না তুই? রাস্তাঘাটে তোর জন্য বিপদ অপেক্ষা করে আছে। আর তুই কি না নিজেই বাড়ির বাইরে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছিস।
_আ’ম সরি মা।
_সরি বললেই সব শেষ হয়ে গেল। একবার আমাদের কথা ভাববি না তুই। তোর কিছু হলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচবো? সেই ছোট মেয়েটাকে কাল স্বামীর ঘরে পাঠাতে হবে এটা ভাবলেই আমার বুক কেঁপে উঠে। সেখানে ওই বাজে লোকগুলো তোকে রোজ রোজ ফলো করে। ভাবতে পারিস তুই, আমাদের কতটা কষ্ট হয় তোর জন্য! মা হলে ঠিকই বুঝবি মায়ের মনে কতটা চিন্তা হয় সন্তান এক মুহূর্ত বাইরে থাকলে।

মেঘের মা কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। মেঘ মায়ের কান্না সামলাতে হুট করেই জড়িয়ে ধরে মা’কে। বারবার সরি বলতে থাকে নিজের অপরাধের জন্য। মা ও মেয়ে দুজনই কাঁদছে। ইরা দুজনের কাছে গিয়ে বলল,

_বড়মা আর কেঁদো না প্লিজ। আজকে বাড়িতে একটা সুখের উৎসব আর তোমরা মা-মেয়েতে মিলে বাড়িসুদ্ধ লোককে ইমোশনাল করে দিচ্ছ। এটা কিন্তু একদমই ঠিক হচ্ছে না। আমাদের ও তো ইচ্ছে হয় এইভাবে মায়ের বুকে মাথা রাখতে।

ইরার কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। মেঘের মা মেঘকে ছেড়ে ইরার কাছে গিয়ে মাথায় ঠোকা দিয়ে বলেন,

_তোকে যখন বিয়ে দিবো তখন তোর দুই মা তোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। এইবার খুশি।
_কাঁদলে খুশি হবো না। বরং তোমাদের দুই মা’কে হাসি মুখে আমাকে বিদায় দিতে হবে।
_ঠিক আছে তাই হবে।
_সেই কখন থেকে রাত্রিকে বকে যাচ্ছো। হবু জামাই যে বাড়িতে এসেছে সেদিকে কি খেয়াল আছে তোমার?
_ওহ হ্যাঁ তাই তো। আমি তো ভুলেই গেছিলাম।
_শুনলে সবাই শুনলে বড় মা কী বলল।

ইরার মিষ্টি একটা কথায় মা-মেয়ের কান্না থামে। মেঘের মা তাড়াতাড়ি শ্রাবণের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসেন। শ্রাবণ অল্প একটু মিষ্টি মুখে দিয়ে আদনানকে সাথে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাবার বেলা আর মেঘের সাথে দেখা হয়নি। সবাই তখন বিয়ের কনেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই শ্রাবণ যাবার বেলা মেঘকে সামনে দেখতে পায়নি। সবাইকে সামনে রেখে মেঘের থেকে বিদায় নেওয়াটা লজ্জাজনক ছিল সেজন্য দেখা না করেই বেরিয়ে পড়ে।

দুপুর হওয়ার আগেই মেঘকে গোসলের জন্য তাড়া দেওয়া হয়। কিছু আত্মীয়স্বজন মিলে মেঘকে গোসল করানোর চিন্তাভাবনা করছিল। মেঘ এক চিৎকারে সব থামিয়ে দিয়েছে। সবার সামনে এইসব ফালতু নিয়মকানুন মেঘ কিছুতেই পালন করবে না। তাই রাগ দেখিয়ে রুমে চলে যায়। ইরা সবাইকে বুঝালো আজকাল ছেলেমেয়ে বিয়ের গোসল নিজেরাই করে নিতে পারে। কেউ যেন মেঘের কথা বিরুদ্ধে না যায়। এতে ঝামেলা বাড়তেই পারে। মেঘের জেদ সম্পর্কে সবারই টুকটাক ধারণা আছে। তাই কেউ আর বাড়তি কথা বলে না। ইরা মেঘের মা’কে বলে হলুদের বাটিটা নিয়ে মেঘের রুমে গেল। মেঘকে বাথরুমে গোসল সারতে বলে হলুদের বাটিটা মেঘের হাতে তুলে দিল। সারা শরীরে এই বাটির হলুদ স্পর্শ করতে বলল।

মেঘ ইরার কথামতো বাথরুমে একা-একাই গোসল সেরে নিল। বাইরে বেরিয়ে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সারা শরীর হলদেটে ভাব ধারণ করেছে। চেহারায় হালকা লজ্জার চাপ। মেঘ চুলের পানি মুছে টাওয়াল ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে ফোনের কাছে যায়। ফোন হাতে নিয়ে ফোন করার আগেই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রাবণের নাম্বার থেকে দশমিনিট আগেই একটা ছোট ম্যাসেজ এসেছে ‘সরি’ লেখা। আর সাথে একটা মন খারাপের ইমোজি। মেঘ ইমোজিটা দেখেই হেসে উঠে। তারপর শ্রাবণকে ফোন করে। দশমিনিট ধরে শ্রাবণ বসে বসে টাইম গুনছে। আর ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি মেঘের ফোন আসবে এইভেবে। রিংটোন বাজতে দেরী অথচ শ্রাবণের ফোন ধরতে দেরী নেই। বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করে বলল,

_সরি।
_কেন?
_দেখা না করেই চলে এসেছি।
_তা তো করবেই। মানুষের সামনে নিজের হবু সাথে দেখা করতেই এত ভয় পাও। বিয়ে করে সারাজীবন কাটানোর মতো সাহস আছে তো তোমার?
_আমি এতটাও ভীতু নই।
_আমার জানা হয়ে গেছে।
_রাগ করো না। বললাম তো সরি।
_হয়েছে আর রাগ ভাঙাতে হবে না। কী করো?
_বউয়ের সাথে প্রেম করি।
_এত জলদি প্রেম হয়ে গেল!
_
_কী হলো শ্রাবণ?
_কিছু না।
_চুপ হয়ে গেলে যে।
_এমনি।
_আনিকাকে মিস করছো তাই না।
_একটু একটু।
_বুকে হাত দিয়ে বলো কতটা মিস করছো?
_পারব না।
_প্লিজ জাস্ট একবার ফিল করো।
_তুমি কি চাইছো আনিকা আবারও আমার জীবনে ব্যাক করুক?
_না শ্রাবণ এটা কখনোই না। আনিকা ফিরে আসলে যে আমি…
_তুমি কি রাত্রি বল?
_কিছু না ব্যস একটু কষ্ট হবে আমার।
_আমি চাই না আমার বউটা কষ্ট অনুভব করুক। তাই আমি এই মুহূর্ত থেকে আনিকার চিন্তাকে চিরতরে মুক্তি দিলাম। খুশি?
_না।
_কেন?
_নিজেকে কষ্ট দিয়ে আমাকে সুখ দিতে চাইছো কেন তুমি?
_আমি যে তোমার মাঝে সুখকে খুঁজে নিতে চাইছি। দেবে না আমায় একটু সুখের ছোঁয়া।
_তুমি চাইলে তো আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। সুখ সে তো অল্প চাওয়া মাত্র।
_কী বললে তুমি?
_কিছু না। এখন রাখলাম। আমাকে হলুদের সাজে সাজতে হবে।

শ্রাবণের কথার উত্তর না দিয়ে মেঘ কথা ঘুরিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। শ্রাবণ ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করে।

কোনোভাবে যদি নিজের অতীতের অপরাধবোধ আর আনিকার স্মৃতি বিবাহিত জীবনে প্রভাব ফেলে তখন রাত্রিকে কীভাবে ফেইস করবে? কীভাবে এই মেয়েটার নিষ্পাপ মনকে কষ্ট দিবে? নিজের অনান্তেই যদি এই মেয়েটা সামান্য কষ্টে চোখের পানি ফেলে তাহলে তার অভিশাপ সারাজীবন শ্রাবণকে বয়ে বেড়াতে হবে। কারো অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অনেক কষ্ট। এই বোঝার ভার সামলানোর ক্ষমতা বা শক্তি কিছুই শ্রাবণের নেই। নিরপরাধ ভালোবাসার যখন মৃত্যু হয় তখন একটা মনের সাথে একটা মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেই মৃত মনটাকে পুনরায় জাগাতে রাত্রি যে লড়াইয়ের মাঠে নেমেছে সে লড়াইয়ে রাত্রিকে জয়ী করতে সর্বদা শ্রাবণকে তাঁর পাশে থাকতে হবে।

৪৮!!
সন্ধ্যে হতেই মেঘকে সাজিয়ে দিল ইরা। হলুদ শাড়ি। হাত ভর্তি রিনিঝিনি চুড়ি। গলায় হার। কানে দুল। মাথায় টিকলি। পায়ে আলতা। মেঘকে দেখতে একদম অপ্সরীর মতো লাগছে। আত্মীয়-স্বজনরা মিলে ছোটখাটো একটা মেহেদী সন্ধ্যার আয়োজন করলো।

অনুষ্ঠানের পুরো সময় শ্রাবণ মেঘকে ভিডিওকলে দেখেই গেছে। নিজের মন থেকে আনিকা চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে মেঘই এখন একমাত্র রাস্তা। হয়তো মেঘই হবে শ্রাবণের আগামী দিনের পথচলার সাথী। তাই তো মেঘের প্রতি এতো টান জন্মাচ্ছে শ্রাবণের। মন থেকে আনিকার স্মৃতি মুছে ফেললেও আনিকার দেওয়া কষ্ট গুলো মুছে ফেলা শ্রাবণের জন্য কঠিন।

অনুষ্ঠান শেষে ইরা মেঘের সারাহাত ভর্তি করে মেহেদী পরিয়ে দেয়। ফর্সা হাতে লাল টুকটুকে মেহেদীর রঙটা খুব সুন্দর ফুটে উঠেছে। ইরা মেঘকে রুমে রেখে বাইরে যাওয়ার সময় সামির রুমে উঁকি দিয়ে দেখে সামি ঘুমিয়ে পড়েছে। অসুস্থ শরীরটা বেশ ক্লান্ত সামির। অনুষ্ঠানের সামির সবার সঙ্গ দেওয়া ছাড়া তেমন কাজ ছিল না। তবুও যতটা পেরেছে সবাইকে সময় দিয়েছে। ইরা সামির রুমে গিয়ে সামির গায়ে পাতলা কাঁথা চাপিয়ে দিল। সামি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ইরা সামির মাথায় হাত ছুঁইয়ে চলে আসে।

সকালে সারা বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়। চারিদিকে বাদ্য-বাজনা বাজতে শুরু করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুষ্টামি শুরু হয়। মেঘকে ঘুম থেকে তুলে ইরা অল্প খাবার খাইয়ে আবারও সাজাতে লাগে। কনে সাজাতে অনেক সময় লাগবে। তাই আগে মেঘকে সাজানো প্রয়োজন। যেহেতু মেঘকে ঘিরে আজকের আয়োজন।

সবাই চেয়েছিল একটু গান বাজনার সাথে ডান্সের আয়োজন করা হোক। কিন্তু, সামির কথা ভেবে সবাই পিছিয়ে যায়। সামি অসুস্থ শরীরে কোনো ডান্সে এট্যান্ড করতে পারবে না। তাই একজনকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান কেউ-ই ইনজয় করতে চায় না। যা করবে একসাথে করবে। ইরা যখন মেঘকে সাজাতে ব্যস্ত তখন মেঘের ফোনে কল আসে। মেঘ ভেবেছিল শ্রাবণের কাজিন পুতুল ফোন করেছে। পুতুল সারাক্ষণ মেঘের সাথে খুঁনসুটিতে মেতে থাকে। মেঘ কল রিসিভ করে যখন পুরুষ কণ্ঠ শুনলো তখন ঘাবড়ে গেল। আবিরের কণ্ঠ চিনতে মেঘের দেরী হলো না। মেঘ রাগ দেখিয়ে আবিরকে বলল,

_কী সমস্যা তোর? শান্তিতে বাঁচতে দিবি না আমাকে। এইভাবে বেহারায় মতো ফোন কেন করিস আবির?

মেঘের মুখে আবিরের নাম শুনে ইরা চট করে মেঘের ফোন কেড়ে নেয়। ফোন থেকে সিমটা সরিয়ে সেটা ফেলে দেয়। মেঘ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

_সিমটা ফেলে দিলি কেন?
_আজব! আবির যেন আর তোর কাছ ঘেঁষতে না পারে সেইজন্য ফেলে দিলাম। এতে তো তোর-ই ভালো। ওই স্টুপিডটা তোর জীবনটা নষ্ট করার খেলায় মেতে উঠেছে। আর আমি বেঁচে থাকতে সেটা হবে না।
_কিন্তু, ইরা শ্রাবণ যদি ফোনে না পায়।
_তুই আমার ফোন থেকে ভাইয়াকে কল করে নে। তাও নিজের সিমটা চাইবি না। আর ওই সিম পুনরায় উঠানোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে, নতুন সিম কিনবি।

মেঘ আর কিছু বলে না। সবাই ওকে নিয়ে এতো চিন্তা করে যে, সবার ভালোবাসা থেকে মেঘ খুশিতে কেঁদে ফেলে। মেঘের এই কান্নাটা সুখের কান্না। ভাই-বোন, মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব সবার এতো ভালোবাসা যার সাথে আছে তাঁর ক্ষতি করার সাহস আবিরের মতো সামান্য খুনিরও নেই। ইরা ভরসার চোখে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘ হেসে উঠে।

শ্রাবণ মেঘের ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে কিন্তু, ফোন বরাবরের মতো বন্ধ আসছে। আদনান শ্রাবণকে এতো টেনশনে দেখে জিজ্ঞেস করল,

_তোর আবার কী হলো?
_দেখ না, রাত্রির ফোন নাম্বার বন্ধ আসছে। ওর কোনো বিপদ হয়নি তো।
_বন্ধ তো ইরার ফোনে ট্রাই কর। দেখ ইরা কী বলে।
_ঠিক বলেছিস।

শ্রাবণ তাড়াতাড়ি ইরার ফোনে কল দেয়। ইরা ফোন সোজা মেঘের কানে তুলে দেয়। মেঘের সাথে একটু কথা বলতে পারায় শ্রাবণের অশান্ত মনটা একটু শান্ত হয়। শ্রাবণ বুঝতে পারে, ধীরে ধীরে সে কারও মায়াজালে নিজেকে জড়াচ্ছে। এই মায়া যেন চিরকাল অটুট থাকে। এই সম্পর্কটা যেন, প্রতিটা সম্পর্কের মতো বিশ্বাস, ভালোবাসা আর ভরসার হয়। হয়তো আনিকার মতো করে রাত্রিকে ভালোবাসা শ্রাবণের জন্য কঠিন, কিন্তু চেষ্টা তো করা যায়। শ্রাবণ সেটাই করছে।

৪৯!!
সন্ধের দিকে বরযাত্রী আসতে শুরু করে। বাসা ভর্তি মেহমান। নওরিন অনেক আগেই এসেছে। আদনান, শ্রাবণের সাথে বরযাত্রী হয়ে এসেছে। কাজী বিয়ের কাজ শুরু করবে। কনের এজেন্ট নেওয়ার জন্য সবকিছু রেডি। ইরাকে পাঠানো হয়, মেঘকে নিয়ে নিচে আসার জন্য। ইরা রুমে ঢুকার পথে সামির সামনে পড়ে যায়। ইরা পাশ কেটে চলে যেতে চাইলে আমি ইরার হাত ধরে আটকে নেয়। ইরা জোর করে হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে। সামি ততই জুড়ে হাত চেপে ধরে। সামির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে ইরা। কিন্তু, সামি ইরার হাত ছাড়তে নারাজ। সামি ইরাকে বলল,

_হাত ছেড়ে দিব, শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
_বলুন।
_কাল রাতে আমার রুমে কেন গিয়েছিলে?
_আমি তোমার রুমে কেন যাবো?
_তোমার প্রতিটা স্পর্শ আমার পরিচিত। যদিও আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তারপরেও বুঝতে পেরেছি কেউ আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে এসেছে। আর সে হাতের স্পর্শ আমার খুব চেনা। কেন জানি না মনে হয়, এই হাতের স্পর্শ আমি আগেও পেয়েছি।
_ভুল ভাবছো। কাল আমি মেঘের রুমে ছিলাম। এখনও তাই যাচ্ছি। মেঘকে নিয়ে নিচে নামতে হবে, বিয়ের কাজ শুরু হবে। প্লিজ হাতটা ছাড়ো।
_ঠিক আছে যাও।

সামি ইরার হাতটা ছেড়ে দিল। ইরা দ্রুত মেঘের রুমে যায়। রুমে গিয়ে ইরা থমকে দাঁড়ায়। রুমের চারিদিক অগোছালো। মেঘের চিহ্ন টুকুও রুমে নেই। ইরা এক চিৎকার দিয়ে সামিকে ডাকে। সামি ইরার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে। ইরার কান্না দেখে ইরার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে সামি ইরাকে বলল,

_ইরা কী হয়েছে? কাঁদছো কেন? মেঘ কোথায়?
_মেঘ রুমে নেই। শুধু এই চিঠিটা পড়ে আছে।

ইরা সামির হাতে একটা চিঠি দেয়। চিঠিকে লেখা,

টেনশনের কিছু নেই। মেঘ যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে নিরাপদে থাকবে। আমি মেঘকে এতটাই ভালোবাসি যে, ওকে অন্যের হতে দেখবো এটা কীভাবে হয়? তাই ওকে তুলে নিয়ে গেলাম।

___আবির চৌধুরী।

সামি চিঠিটা নিয়ে নিচে নামে। বিয়েবাড়ি মুহূর্তেই মেঘের শোকে অস্থির হয়ে পড়ে। শ্রাবণ যখন চিঠিটা পড়লো, তখন ওর অবাক হওয়ার ধাপটা কেবল বেড়েই গেল। এইভাবে মেঘ রাত্রি সেজে ওকে ধোকা দিবে, এটা শ্রাবণের ভাবনায়ও ছিল না। সামি, আদনান মিলে শ্রাবণকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু শ্রাবণ বুঝতে চায় না। সবার সামনে চিৎকার করে বলল,

_সব মেয়েরা যেমন ছলনাময়ী হয়, রাত্রিও ছিল তাই। বিশ্বাস করেছিলাম ওকে আমি। আর ও কী না আনিকার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করালো। এখন তো আমার এটা মনে হচ্ছে, এইসব ছিল আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার প্ল্যান। মেঘ ইচ্ছে করেই আজকের এই দিনটা আমাকে উপহার দিল। অসুবিধা নেই, এর শাস্তি মেঘও পাবে। রাত্রি সেজে আমাকে ধোঁকা দিয়ে নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখলো। কী দরকার ছিল আমাকে মিথ্যে বলার? আবিরের সাথে ও রিলেশনে জড়িত, এটা আগে আমাকে বলে দিলে হতো। এইভাবে এতো নাটক করার প্রয়োজন ছিল না।

শ্রাবণের কথা শুনে আদনান ঠাস করে শ্রাবণের গালে চড় বসিয়ে দেয়। তারপর টানতে টানতে শ্রাবণকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

মেঘের পরিবারের সবাই মিলে মেঘকে খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকটা পুলিশকে জিজ্ঞেস করা হলো, অথচ কেউ খেয়াল করলো না। একজন অপরিচিত লোক এসে কীভাবে মেঘকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল। বাসার সবাই দিশেহারা। সামি তাড়াতাড়ি নিজের চাচ্চুকে ফোন করে মেঘের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটা জানিয়ে দেয়। সামির চাচ্চু পুলিশের আরেকটা টিমকে মেঘদের বাড়িতে পাঠান। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়।

দুর্ভাগ্য এতো ঘাটাঘাটি করেও পুলিশ কোনো ইনফরমেশন পেল না। মেঘের সিম তো আগে থেকেই বন্ধ। ইরার বোকামির ফলে, মেঘকে এখন খোঁজার কোনো লোকেশন ট্র‍্যাক করা যাবে না। যদি মেঘের কাছে ফোন থাকতো তাহলে হয়তো কোনোভাবে লোকেশন বের করে মেঘকে খোঁজার কাজ সহজ হতো। কারও কাছে কোনো রাস্তা খোলা নেই। মেঘকে ফিরে পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ।

এক সপ্তাহ এভাবেই পেরিয়ে যায়। সারা বাড়ি মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সবাই দিনরাত এক করে মেঘকে খোঁজছে। কিন্তু, আফসোস! মেঘকে খোঁজে পাওয়া যায় না।

চলবে…

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here