বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ২৯
#আনিশা_সাবিহা
বিকেল হয়ে এসেছে। ড্রয়িংরুমে কপালে হাত ঠেকিয়ে চিন্তার ভঙ্গিতে বসে আছেন মিসেস. তনয়া। উনার সামনে পায়চারি করে যাচ্ছে অনিন্দিতা। তার হাতে ফোন। ঐশানীর নম্বর বারংবার ডায়াল করেও রেসপন্স পাচ্ছে না সে। ইশান ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে অনেকক্ষণই হলো। বাড়িতে এসে এই পরিস্থিতির কথা শুনে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। গলার নিচে খাবার নামাতে পারেনি কেউই। মিসেস. তনয়া ইশানকে বারবার খেতে বললেও খায় না সে। সবাইকে রেখে কি করে একা একা খেয়ে নেবে?
–“আর কোনো আশা দেখতে পাচ্ছি না রে অনি। ঐশানীর নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। বিপদ হয়েছে। ওর মা-বাবাকে কি জবাব দেব? মেয়েটাকে ঠিক মতো আগলে রাখতে পারলাম না।”
কান্না জড়িত কন্ঠে মিসেস. তনয়া কথাগুলো বলতেই অনিন্দিতা হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে……
–“মা! তুমি একটু বেশিই ভাবছো। কান্না শুরু করো না। ভাবির কিছু হয়নি। নিশ্চয় কোনো কাজে আটকা পড়েছে।”
–“যদি তাই হতো ফোন করে অন্তত জানাতো। আমার মনে হচ্ছে নির্ঘাত মেয়েটার সাথে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু হয়েছে।”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিসেস. তনয়া।
অনিন্দিতা ফোন রেখে দ্রুত ছুটে আসে পানি নিয়ে। মায়ের হাতে পানি ধরিয়ে দ্রুত বলে……
–“ভাবির কিছুই হবে না। কান্না থামিয়ে পানি খাও। আর কিছু মুখে দাও। দুপুরে কিছুই খেলে না।”
মিসেস. তনয়ার ভাবান্তর হলো না। পানির গ্লাস মুখে নিতেই সদর দরজা পেরিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢোকে অভয়। তার চেহারার দশা দেখে সকলেই আঁতকে ওঠে। ইশান অভয়কে খবর দিতেই সে দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অভয় তখন হসপিটালে ছিল। ওর ডক্টর বন্ধুর সাথে ঐশানীর লুকিয়ে খাওয়া ঔষুধের ব্যাপারে আলোচনা করছিল সে। খবর পাওয়া মাত্র ঐশানীর কলেজেও গিয়েছিল সে কিন্তু কলেজ বন্ধ! সেখান থেকে বাড়িতে ঢুকে পড়ে সে। এলোমেলো চুল, চোখমুখ লাল, ব্লেজারের বোতাম খোলা। এককথায় ঐশানীর খবর পেয়ে অগোছালো হয়ে পড়েছে সে। ইতিমধ্যেই যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজের অস্তিত্ব! তার মনটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে বলে চলেছে….
–“এবার তুই তোর ভালোবাসা হারিয়েই ফেললি অভয়। চিরতরে হারিয়ে ফেললি।”
বুকে তার চিনচিনে ব্যাথা! বেশ কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল……
–“ঐশানী ফিরেছে?”
অনিন্দিতা ঢোক গিলে বলে….
–“না ভাইয়া। এখনো ফেরেনি।”
–“তো ও যখন কলেজে যেতে বের হচ্ছিল তখন তুই কি করছিলি? ঘোড়ার ঘাস কাটছিলি? কেন যেতে পারিসনি ওর সাথে? হ্যাঁ? বল কেন যেতে পারিসনি?”
গলা ফাটিয়ে রাগে চিৎকার করে কথাগুলো বলতেই সকলে চমকে ওঠে। অভয় রেগেমেগে চিৎকার করে কথা বলার মতো ছেলে না। এমনকি রাগলে সে রাগটাও প্রকাশ করে অবধি। আজ সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কথায় আছে, যখন বিষয়টা জীবনে ব্যাপার হয় তখন মানুষ কি করবে বা কি বলবে সকল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর অভয়ের কাছে ঐশানী তার জীবনের থেকে কম কিছু নয়।
দুইহাত দিয়ে মাথার চুল পাগলের মতো আউলিয়ে বেশ শান্ত হয়ে পড়ে সে। অভয়ের আচরণের কূলকিনারা বুঝতে পারছে না কেউই। ইশান বিস্ময়ের সুরে বলে….
–“তুই ঠিক আছিস অভয়?”
অভয় শান্ত ভঙ্গিতে সকলের দিকে তাকায়। ইশানের প্রশ্ন উপেক্ষা করে অনিন্দিতাকে কটাক্ষ করে বলে ওঠে…..
–“কখন বেরিয়েছিল ঐশানী?”
–“ওই ভাইয়া তুই পরপরই বেরিয়েছিল।” (ভয়ে ভয়ে)
–“ওহ তাহলে অনেক সকালে! আর আমি একটু আগে খবরটা পেলাম! কেন? বলো! মা, এতোক্ষণেও তোমরা আমায় কিছু জানাও নি কেন? এতোটা ইরেসপন্সিবল কি হও তোমরা?”
সকলে অভয়ের চিৎকারে কুঁকড়ে যায়। মিসেস. তনয়া অসহায় ভঙ্গিতে বলেন….
–“আমি মানা করেছি কারণ তুই চিন্তা….. ”
–“থাক! এখন আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি। ইশান, তুই কি যাবি?”
ইশান দ্রুত মাথা দুলিয়ে উঠে আসে। অভয় ততক্ষণে বেরিয়ে যায়। ইশানও যায় পিছু পিছু।
গাড়িতে দুজনে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় অভয়। গ্যারেজ পেরিয়ে গাড়ি মেইন লোহার গেইট অবধি পৌঁছাতেই গেটের সামনে এসে একটা অটো থামে। অটো থেকে অভয় ও ইশানকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে আসে ঐশানী। হাতে তার এডমিট কার্ড সহ আরো কাগজপত্র। ইশানের মুখ অটোমেটিকলি খুলে যায়। অভয় গাড়ি থামিয়ে দিয়ে ঐশানীকে ভালো করে দেখে নেয়। হ্যাঁ, ওটা ঐশানীই! গাড়ির দরজা খুলে ঝড়ের গতিতে ঐশানীর সামনে অভয় দাঁড়িয়ে পড়ে। অটোর ভাড়া মিটিয়ে সামনে তাকাতেই ভড়কে উঠে দুই ধাপ পিছিয়ে যায় ঐশানী। বিকেল গড়িয়ে চারিদিকে আলো প্রায় নিভে এসেছে। এসময় এভাবে অভয়কে একটা অবয়বের মতোই লাগবে! ভালো করে ঐশানী লক্ষ্য করে মানুষটা অভয়।
–“ওভাবে কেউ দাঁড়ায়? ভূত টূত ভেবে যে কেউ পালিয়ে যাবে। আমার মতো সাহস দেখিয়ে সবাই মুখটা ভালো করে দেখবে না আপনার।”
–“কোথায় ছিলে?”
অভয়ের কথাগুলো ভূতুড়ে ভূতুড়ে শোনালো। গলাটা ভীষণ ভার! ঐশানী এক হাত দিয়ে সব কাগজ ধরে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে একটু উঁচু হয়ে অন্যহাত দিয়ে অভয়ের গাল ও চুল স্পর্শ করে বলে….
–“এই আপনি সত্যিই অভয় তো? নাকি কোনো ভূত শ্যামলা ঘোড়ার রুপ ধরে এসেছে। গলার স্বর কেমন যেন শোনাচ্ছে।”
–“ইশান! তুই গাড়ি নিয়ে ভেতরে যা। আমি ওকে নিয়ে পড়ে আসছি।”
ইশানের বুঝতে দেরি লাগল না যে ঐশানীর ওপর দিয়ে অভয় নামক ঝড়টা উপচে পড়তে চলেছে। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল….
–“স্বামী-স্ত্রী এর চুল ছিঁড়াছিঁড়ির মাঝে আমার না থাকায় ভালো। শেষমেশ আমাকে নিয়েও চুল ছিঁড়াছিঁড়ি লাগবে তখন আমার যতটুকু চুল অবশিষ্ট আছে তাও থাকবে না। তখন আমাকে বিয়ে করবে কোন যুবতী?”
গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে গ্যারেজের ভেতরে ঢুকে গেল ইশান।
ঐশানী অভয়ের হাবভাব বুঝতেই পারছে না। লোকটার কি হয়েছে? সরু চোখে তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে….
–“কি হয়েছে আপনার? কোনো সমস্যা? এমন লাগছে কেন আপনাকে?”
কথাটা শেষ হতে না হতেই ঐশানীর ডান গালে সজোরে চড় পড়ল। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়ে গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকায় সে। বুঝার চেষ্টা করল আজ সে কি এমন করেছে যার কারণে অভয়ের হাতে তৃতীয় বারের মতো চড় খেতে হলো? বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়েছে বলে? অস্ফুটস্বরে বলে….
–“আ…আপনি….”
পুরো কথাটা বলতেই দেয় না অভয়। গর্জে ওঠে সে….
–“শাট আপ! একদম চুপ। কি ভাবো তুমি নিজেকে হ্যাঁ? মিনিমাম সেন্স টুকুও মাথার মধ্যে নেই? ও তা থাকবে কি করে? তোমার মাথায় তো সারাদিন এটা ঘুরতে থাকে যে, আমার থেকে কি করে মুক্তি পাওয়া যাবে? আমার থেকে কি করে ছাড়া পাবে? তাই না? আরে আমার কথা বাদ দাও। বাড়িতে মা আছে, অনি আছে। অন্তত ওদের কথা একবার ভেবে দেখতে। একবার কল করে বলতে পারতে তোমার আসতে দেরি হবে। তুমি জানো? তোমার চিন্তায় ওরা খাবার অবধি খেতে পারেনি। মা তো কান্না করতে বসেছে।”
ঐশানী হতভম্ব হয়ে যায়। আবারও বলতে নেয়…..
–“আমি কল করতে পারিনি আমার ফোন…..”
–“হুঁশশ! কোনো সাফাই গাইবে না। এখন যা বলার মাকে গিয়ে বলো। লেটস গো!”
ঐশানীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অভয়। বাড়িতে ওরা ঢুকতেই ঐশানীকে দেখে যেন সকলে প্রাণ ফিরে পায়। সতেজ হয়ে ওঠে। মিসেস. তনয়ার কাঁদো কাঁদো মুখে হাসি ফুটে ওঠে। উচ্ছ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে পড়েন উনি। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন…..
–“ঐশানী!”
ঐশানীকে টানতে টানতে এনে সামনে ছুঁড়ে ফেলে অভয়। রেগেমেগে বলে…..
–“এইযে তোমার ইরেসপন্সবল ছেলের বউ। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে একবারও ফোন করার প্রয়োজনবোধ কর নি। তার জন্য তোমরা না খেয়ে বসে ছিলে। কি জিজ্ঞেস করবে তোমরাই করো।”
বলেই আবারও ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে যায় সে।
মিসেস. তনয়া এগিয়ে এসে ঐশানীর দিকে তাকিয়ে বলেন…..
–“একটা কল করতে পারতে। তাহলে এভাবে চিন্তা হতো না আমাদের।”
–“আমাকে কেউ বলারই সুযোগ দিতে চাইছে না। আমি এডমিট কার্ড নিয়ে রিনির বাড়িতে গিয়েছিলাম। এতোদিন কলেজে যেতে পারিনি। পড়ার জন্য নোট নিতে গিয়েছিলাম। আর আমি তো আপনাদের কল করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু গতকাল ফোনে চার্জ দেওয়া হয়নি। ফোনটা বের করতে আবার হুট করে কাঁদায় পড়ে যায়। তবুও কল করতে পারতাম কিন্তু আপনাদের কারোর নম্বরই আমার মুখস্থ নেই।”
–“তাহলে তোমার মা-বাবার নম্বর তো মুখস্থ ছিল ভাবি। তাদের কল করে জানিয়ে দিতে বলতে।”
অনিন্দিতার বলা কথাগুলো মাথাতেই আসেনি ঐশানীর। এক হাত দিয়ে নিজের কান ধরে সকলের সামনে বিনীত সুরে বলে…..
–“আই এম সরি। আমি বুঝতে পারিনি এতোটা দেরি হবে। আর আপনারা এতোটা চিন্তা করবেন। আর বিশেষভাবে মা! আপনাকে সরি। কিছু খেয়ে নিন। আর কখনো এমন হবে না।”
মিসেস. তনয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। হতাশ হয়ে বললেন….
–“সরি বলে কি হবে? দোষটা হয়ত আমাদেরই। আমরাই হয়ত তোমার আপন হতে পারিনি। এটা আমাদের দোষ। রেনু, আমার খাবারটা ঘরে নিয়ে আয়।”
বলেই আস্তেধীরে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করলেন মিসেস. তনয়া। উনার কথায় অভিমানের ছাপ পেলো ঐশানী। সত্যি সে আজ বড্ড বোকামি করে ফেলেছে। সকলকে চিন্তায় ফেলেছে। নিজেকে মনে মনে বকতে থাকে সে। অনিন্দিতা ঐশানীর উদ্দেশ্যে নরম সুরে বলে….
–“মা একটু অভিমান করেছে। দুঃখ পেয়েছে। তাই ওসব বলে ফেলেছে। চিন্তা করো না। একটু সময় দাও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কিছু খেয়েছো?”
–“হ্যাঁ ওই রিনির বাড়িতে হালকা খাইয়ে দিয়েছে।”
–“তাহলে ওপরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর ভাইয়া অনেক রেগে আছে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলো। রাগ ভেঙে যাবে।”
ঐশানী মাথা নাড়ায়। অনিন্দিতা রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়।
বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে শাড়ি পড়ে এসে হাফ ছেড়ে বসল ঐশানী। চেহারায় তার উদাসীন ভাবটা লেগে আছে। যেন সে কিছু নিয়ে বড়ই উদাসীন। বাইরে বয়ে যাওয়া জোড়ালো বাতাস ঘরটাকে ঠান্ডা করে দিলেও ঐশানীর মন অবধি কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। বাইরে হয়ত কিছুক্ষণ পর ঝড় উঠবে। তবে ঐশানীর মনে ঝড়টা শুরু হয়ে গেছে। চোখে পানি টলমল করছে। মুখ নড়াতেই ডান গালে ব্যাথা পায় ঐশানী। গালে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে….
–“ইশশ… ওই হাতুড়ি মার্কা হাত দিয়ে মারলে কি গাল আর থাকে? গালটা থেঁতলে যায়নি এটাই অনেক।”
কিছুক্ষণ থেমে বাইরের পরিবেশ দেখে আবারও বলে…..
–“বাইরে তো ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। শ্যামলা ঘোড়া কি আজ বাড়ি আসবে না?”
মুখ থেকে কথাটি না ফুরাতেই দরজা খোলার শব্দ ভড়কে গিয়ে দুটো গালে হাত দিয়ে ঢেকে বসে থাকে ঐশানী। অভয় সেদিকে লক্ষ্য না করে টাওয়াল নিয়ে চলে যায় সোজা ওয়াশরুমে। হাফ ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য বাঁচলেও কিছুক্ষণ পরেই অভয় বাথরোব পড়ে বের হতেই আবারও আগের মতো গাল ঢেকে বসে থাকে সে। অভয়ের চোখের দিকে তাকানোরও সাহসটুকু পাচ্ছে না সে। অভয় আরো ইচ্ছে করেই তার সামনে সামনে পায়চারি করে নিজের চুল মুছছে। তবুও তাকাতে পারছে না ঐশানী। হয়ত তার রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। পাওয়ায় স্বাভাবিক। অভয় দুম করে ঐশানীর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। কেঁপে উঠে তাকায় ঐশানী। অনুভূতি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভয়ের দিকে। সযত্নে ঐশানীর গালে হাত রাখে অভয়। তার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে নড়তেও ভুলে যায় ঐশানী। বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলে….
–“খুব লেগেছে?”
–“আপনার ওই ডাম্বেলের মতো হাত আমার গালে পড়লে লাগবে না?” (ভীতি নিয়ে)
–“রাগটা দমাতে পারিনি। তুমি কি জানো? তোমায় না পেয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল তুমি আমার থেকে দূরে চলে গেছো। তোমাকে আর চোখের দেখাও দেখতে পারব না। যতটুকু ছুঁতে পারি ততটুকুও পারব না। আমাকে একটা কল করে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো?”
–“আপনার ফোন নম্বর আমার কাছে আছে? কখনো দিয়েছেন?”
অভয় চুপ করে গেল। তারপর বলল….
–“তুমিও তো কখনো আগ্রহ দেখিয়ে ফোন নম্বরটা নিতে আসোনি। তাহলে তুমিই ভাবো আমাদের সম্পর্কের গভীরতা!”
–“সম্পর্কে গভীরটা ফোন নম্বর বা অন্যকিছু দিয়ে হয় না। সম্পর্কে গভীরতা মন দিয়ে হয়। আর আমি মনে করি এই গভীরতাটুকু আমাদের মাঝে যথেষ্ট আছে।”
অভয় একটু এগিয়ে গিয়ে উপুড় হয়ে ঐশানীর ডান গালে যেখানে মেরেছে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ঐশানী এতে খামচে ধরে অভয়ের হাত। চোখমুখ খিঁচে ফেলে সে। ঐশানীর মুখোমুখি হয়ে অভয় তার দুটো হাতই ওর কানের নিচে চেপে ধরে। তার চোখে শীতলতার আবেশ! কন্ঠেও রয়েছে শীতলতা।
–“তাহলে তুমি বলছো আমাদের মাঝে সম্পর্কের গভীরতা আছে? এ কেমন গভীরতা ঐশানী? যেখানে তুমি আমায় কিছুই বলতে চাও না? যেখানে তুমি আমায় ভরসা করে নিজের মনের সকল কথা উজাড় করে দিতে পারো না?”
ঐশানী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সরে বেডের ওপরে পা উঠিয়ে বসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলে…..
–“আমার মাঝে এমন কোনো গোপন কথা নেই যে আপনাকে বিশেষ করে কিছু বলতে হবে।”
–“আছে। তুমি বলতে চাও না। কারণ আমাদের বিয়েটা বিয়েই মনে করো না। প্রতিটা মূহুর্তে মুক্তি চাও। আচ্ছা বিয়ের এতোদিন হয়েও তোমার মনে আমি জায়গা করে নিতে পারিনি? যেমন তুমি আমার মনে পেরেছো? ছিটকে এক কোণে ফেলে দিয়েছো মোহ নামক জিনিসটাকে।”
ঐশানী নির্বাক হয়ে হাঁটুতে হাত রেখে বসে থাকে। উত্তর আর মেলে না। উত্তর না পেয়ে শান্ত অভয় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ঐশানীর বাহু ধরে টেনে নামিয়ে আনে। তার বাহু জোরে চেপে ধরে বলে…..
–“আমি কি এতোটাই খারাপ স্বামী হিসেবে? এতোটাই অধম? যে তুমি আমাকে মেনে নিতে পারো না? বলো?”
ঐশানী না বোধক মাথা নাড়ায়। মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে বলে…..
–“না আপনি খুব ভালো মানুষ অভয় কিন্তু….. ”
–“এই কিন্তু! এই কিন্তু শব্দটা আমার আর তোমার মাঝখানে পাঁচিল। ভালো মানুষ বললে না আমায়? হয়ত এটাই আমার দোষ। তাই না? তুমি বোঝো না? তোমার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি পাগল। অতিতে যাই হোক না কেন #বেলা_শেষে_শুধু_তুমি। বর্তমান, ভবিষ্যত শুধু তুমি।”
ঐশানী চোখ বন্ধ করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অভয়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে….
–“বাথরোব ছেড়ে কাপড় পড়ে নিন।”
অভয় ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ছেড়ে দেয় ঐশানীকে।
–“স্বামী মানে পৃথিবীর সব থেকে বড় বন্ধু! যাকে সবকিছু বলা যায়। কিন্তু তুমি তা মনে করো না। করলে আমার কাছ থেকে এতো বড় বিষয় লুকিয়ে যেতে না।”
ঐশানী আশ্চর্য হয়ে যায়। অভয় কি বলতে চাইছে। তার কোনো গোপন কথা? আগ্রহের সাথে বলে….
–“কি কথা?”
–“এরমানে এখনো তুমি সব লুকিয়েই যাবে। অনেক হয়েছে এবার আমি জানতে চাই! জানতে চাই কীসের এতো লুকোচুরি।”
বলেই অভয় দ্রুত নিজের ফোন বের করে একটা ছবি বের করে ঐশানীর সামনে ধরে। সেখানে স্পষ্ট ঐশানীর প্রতিনিয়ত খাওয়া ঔষুধের ছবি। একবার ছবি আরেকবার অভয়ের দিকে লক্ষ্য করে ঐশানী। অভয় কি সব জেনে গেল। তবুও সে দৃষ্টি সরিয়ে না জানার ভান করে বলল…..
–“এসব কি?”
–“নাটক করা বন্ধ করো। এটা কি তুমিও জানো। এই ঔষুধের ছবি আমি তোমার থেকেই পেয়েছি। আর ডক্টরের কাছ থেকে জানতে পেয়েছি এই ঔষুধ তারাই সেবন করে যাদের একটা কিডনিতে সমস্যা থাকে বা একটা কিডনি থাকে না। তাদের অন্য একটা কিডনি নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। আর সামান্য সমস্যা হলেই ঔষুধ সেবন করতে হয়। তোমার কি হয়েছে ঐশানী।”
মুখে হাত চেপে ধরে টলটলে চোখে চেয়ে থাকে ঐশানী। যা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল সেটাই ঘটল। অবশেষে। অভয় জোরে চেঁচিয়ে বলে…..
–“এখন আমি জানতে চাই ঐশানী। আজ আমাকে তোমায় সব বলতেই হবে। এট এনি কস্ট!”
ঐশানী বুঝে গেল চুপ থেকে আজ আর কোনো লাভও হবে না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল…..
–“তাহলে শুনুন। আমার একটা কিডনি নেই।”
অভয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। থেমে থেমে বলে….
–“মানে?”
–“সায়ান…..!!”
চলবে……
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]