#চতুষ্কোণ /পর্ব:-০৮
Sharifa Suhasini
যে বাবার থেকে লুকোনোর জন্য এতকিছু, সেই বাবা তাদের সব জানেন। এই প্রথম দুই ভাই নিজেদের কাজের প্রতি প্রচন্ড লজ্জাবোধ করছে। আসলে বাবারা অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু সন্তানদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে চান না বলে না জানার ভান করেন। শামীমের আর বুঝতে বাকি রইলো না, সেদিন হাসপাতালে বাচ্চাটিকে নিয়ে শামীমের প্রতিক্রিয়া দেখে রহমান খান বসে থাকেননি। একা একাই নাবিলার সম্পর্কে তথ্য বের করে এনেছেন। কিন্তু নাবিলার এই বান্ধবীটিই বা কে!
সেদিনের মত যে যার ঘরে চলে গেলেও শামীম প্রায় মধ্য রাত্রি অব্দি বাইরে বাইরে ঘুরে কাটিয়েছে। জীবনটা তার কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মত হয়ে গেল। কত আশা, কত স্বপ্ন, কত আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে সে জীবন সাজাতে চেয়েছিল। অথচ দীর্ঘ এই এক বছরের আগ্নেয়গিরির মতন সুপ্ত যাতনা তার বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে চৌচির করে দিয়েছে।
নির্ঘুম চোখে আনমনে সে যখন ঘরে ঢুকলো, নাবিলা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘরের ড্রিম লাইটটা জ্বালানো। সেই আলোতে শামীম রাফিয়ান নাবিলার মুখের দিকে মুহুর্ত কয়েক অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
কী ভীষণ মায়াভরা মুখ! এই কোমল, এই স্নিগ্ধতা দেখেই তো সে নাবিলার প্রেমে পড়েছিল। আর আজ সেই মেয়েটিই তার প্রেমের দ্বারে সর্বোচ্চ কঠোর কুঠারের আঘাতটি করলো। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে একথা তার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী? যা ঘটার, তা চোখের সামনেই ঘটেছে। শামীমের নিজের প্রতিই লজ্জা হচ্ছে।
বিয়ের আগে পুরুষ মানুষ মেয়েদের রুপ দেখে বিয়ে করে। ওই রুপের গুণ সর্বোচ্চ আত্মীয়-স্বজন এসে মুখ দেখা পর্যন্ত টিকে থাকে। এরপর দরকার পড়ে নারীর যত্ন, স্বামীর হাতে হাত রেখে পরিবারকে সামলে রাখার গুণ। একটা মেয়ের গুণ হওয়া উচিত তার প্রকৃত উচ্চশিক্ষা, আচরণ, যত্ন আর ভালোবাসা। অথচ বিয়ের আগে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় গুণ হয়ে দাঁড়ায় শুধুমাত্র নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য আর গায়ের রঙ। আর এই রুপের গুণের কদর করাটা যে কতখানি মারাত্মক ভুল- তা বিয়ের সপ্তাহ কাটলেই টের পাওয়া যায়। যা শামীম এখন টের পাচ্ছে। একেবারে হাড়েহাড়ে নয়, কোষে কোষেও টের পাচ্ছে।
নাবিলার দিকে এই মুহুর্তে আর তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না ওর। উঁহু, ঠিক ঘৃণা নয়, তবু কী যেন এক আবেগ এসে ভর করছে মস্তিষ্কে। যত পাপ হোক, যত ঘৃণা জমুক, এই মেয়েটাকে সে ভালোবেসেছিল। আর মানুষের ভালোবাসার কাছে সমস্ত ঘৃণাই যে ফিকে অনুভূত হয়।
শামীমের চোখের কিনারা বেয়ে এক ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো। সেইটুকু সন্তপর্ণে মুছে নিয়ে একবার বড় করে শ্বাস নেয় সে। বহুদিনের আটকে রাখা শ্বাস সেটুকু। সে জানে না, এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী। কিন্তু না সে নাবিলাকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারবে, আর না তার এই কর্মকে মানিয়ে নিতে পারবে। শামীম অন্যপাশে ফিরে চোখ বন্ধ করে নিলো। আর ঠিক তখনই পাশ থেকে নাবিলার কন্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে।
—আমি অনেক বড় পাপী, তাই না?
শামীম রীতিমতো চমকে উঠে আবার পিছন ফিরে তাকালো। নাবিলা তার দিকেই চেয়ে আছে। সেই প্রথমদিনের সাক্ষাতের মত নির্মল দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির গভীরতা থেকে চোখ ফেরানোর ক্ষমতা শামীমের নেই। সে নীরবে নির্বাক চেয়েই রইলো। নাবিলা আবার বললো,
—শামীম, আমি জানি, আপনি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন যে, এই ভালোবাসা আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আমাকে দিতে পারবে না। এই উপলব্ধি আমার পূর্বে না হলেও এখন আমি সমস্তই জানছি, বুঝছি।
শামীম কোনো জবাব দেয় না। জবাব দেবার মত শব্দ তার শব্দভান্ডার নেইও। অথচ আজ যত শব্দের বিচ্ছুরণ ঘটছে,তা অপ্রত্যাশিত। এতগুলো মাস, এতগুলো দিন পর নাবিলা নিজে থেকে কথা বলছে। মুখে শামুকের খোলসের মত ঝাম দিয়ে থাকা মেয়েটা অনর্গল বলতে চাইছে। আর শামীমও আজ তাকে সেই সুযোগ দিলো। নাবিলা বলেই চলেছে,
—আপনাকে স্বামী হিসেবে দশে দশ দেওয়া যায়। আপনি সেটার যোগ্য। কিন্তু আমি যে অযোগ্য, সেটা আমি জানি। শামীম, আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবেন আশা করি। এই যে ধরুন, আমি এই কাজটা না করতাম। আপনি আমাকে প্রথমদিনের মত নিষ্পাপ দেখতেন, তারপর ধীরেধীরে ভালোবাসতেন। বুকের ভেতর যত অনুভূতি একটা মানুষের জন্য রাখা যায়, সেই সবটুকু দিয়েই ভালোবাসতেন। এরপর আমি আপনার হতাম না। ধরুন, তখন আপনি পাগলের মত হয়ে যাচ্ছেন। অথচ আপনার ভালোবাসার মানুষটি আপনার হত না। আপনি কী তখন আমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারতেন?
শামীম কিছুক্ষণ মৌন রইলো। নাবিলা আজ তাকে তুমি থেকে আপনি সম্বোধন করছে। সে টের পায়, কথা বলতে গিয়ে তার গলা আটকে আসছে। রুষ্ঠ, নিমঘ্ন, কাঁপা কাঁপা স্বরে সে জবাব দেয়,
—আমি জানি না।
শামীমের উত্তর শুনে নাবিলা হাসলো। সে হাসিটুকু যে উপহাসের, এইটুকু শামীম উপলব্ধি করতে পারে। তবু এর চেয়ে ঢের জবাব তার কাছে নেই। কী করতো সে? নাবিলাকে ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতো। অথবা বুকের ভেতর নাবিলাকে সঞ্চয় করে সম্মুখে অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসার সুদ দিত কেবল। তার চেয়ে অধিক আর কীইবা করতে পারতো সে?
নাবিলা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। এরপর জড়িয়ে ওঠা কন্ঠস্বরে বললো,
“ভালোবাসা বৃক্ষের মত। বৃক্ষের শেকড় যেমন, ঠিক তেমনই এর অনুভূতিটা একটাই। কিন্তু এর পরিণাম হাজার রকম, যেভাবে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা, ফল-ফুল বেড়ে ওঠে। কোনোটা লম্বা, কোনোটা খাটো, কোনোটা কোঁকড়ানো। ভালোবাসার পরিণামেও কেউ সুখী হয়, স্বর্গ পায়, অভিজ্ঞতা পায়, আর কেউ পাগল হয়। আমার পরিণামে শেষ ঘটনাটুকু ঘটেছে। আমি মাহদীকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়েছিলাম। সেই উন্মাদনায় তাকে ছাড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো বস্তু আমার চোখে দৃশ্যমান হয়নি। আমার জীবনে আমি মাহদীকে ভোরের নিস্তব্ধ সূর্যের মত ভেবেছিলাম, যাকে ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম লেগেছিল। শামীম, পরিবারের চাপে পড়ে আমি সত্যিই নিজের জীবনকে শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে, প্রেমে অন্ধ হয়ে তীব্র এক জিদ চেপে বসলো-যাকে ভালোবাসি, তার স্মৃতিটুকু আমার চাই। আমার আজন্মকালের দৃষ্টিক্ষমতায় তার অস্তিত্ব আমার চাই। আর সেকারণেই বিয়ের আগে আগে আমি এই কাজটি করেছিলাম। এখানে আপনার ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। বিয়ে করে এবাড়িতে আসার আগে আমি তো জানতামই না, আপনি মাহদীর ভাই। এবাড়িতে এসে সেদিন প্রথম তাকে দেখলাম, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আমি আর কাউকে গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। আপনাকে আমার ধারেকাছেও আর ঘেঁষতে দিইনি। আমি চেয়েছিলাম, ইন-ভিট্রোর ভ্রুণটা বেড়ে ওঠার আগেই আমি আপনার সাথে অন্তরঙ্গ হবো। বাচ্চাটি বাঁচবে আপনার ছায়াতলে। অথচ মাহদীকে দেখার পর আমার পৃথিবীটা এত বিচ্ছিরিভাবে ওলট-পালট হয়ে গেল যে, আমি আপনাকে দূরেই সরিয়ে দিলাম। বেমালুম ভুলে গেলাম, আপনাকে দূরে সরালে এই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমার এসব কর্মে মাহদীর কোনো যোগসূত্র নেই। সে খাঁটি মধুর মতই পবিত্র।
শামীম চুপচাপ নাবিলার কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। নাবিলাকে তিরস্কার করা উচিত, নাকি উল্টো তাকেই সান্ত্বনা দেওয়া উচিত-এটুকু তার জানা নেই। সে নিজেকে বারবার নাবিলার স্থানে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। অথচ দাঁড় করাতে পারছে না। আবেগ আর বিবেকের রেষারেষিতে বারবার টলে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ সে বুঝতে পারে, নাবিলার পরিস্থিতি বুঝতে পারার বা গ্রহণ করার কোনোটির ক্ষমতাই তার নেই। ঘুমের ভান করে লম্বা একটা হাই তুলে সে বললো,
—কাল আমরা এবাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠবো। আমার এক আপার বান্ধবীর বাসা। দুই রুমের ফ্ল্যাট। তোমার মাকে বলে দিও, উনি এসে তোমাকে হেল্প করবেন। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।
৫.
পরদিন সকাল হতেই শামীম ঘরের টুকটাক জিনিসপত্র বেশ তোড়জোড় করেই গোছানো শুরু করলো। নাবিলার শুধু মায়ানকে কোলে নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। গত রাতে শামীম তাকে সব গুছিয়ে নিতে বললেও আজ নিজে থেকেই নাবিলার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি নাবিলাকে সে এখান থেকে সরিয়ে নিতে পারবে, ততই শান্তি। অন্তত বাবা রহমান খান ঘরে ফেরার আগে। গতকাল রাতে বাবা নাবিলাকে নষ্টা মেয়ে বলেছেন,কাল ওসব শুনতে মন্দ লাগেনি। কিন্তু এই মুহুর্তে কেন জানি ওর কানে শুধু ওই শব্দটিই বাজছে। আর সেই বাজনার ঝনঝনানি আজ আর ভালো লাগছে না, বরং অসহ্য লাগছে। কোনো মেয়েকে নষ্টা বলার অধিকার তার বাবার নেই, কোনোভাবেই নেই। অথচ বাবা তো সত্যি কথাটাই বলেছেন। তবুও বাবার কথা মানতে ওর কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে, তা শামীম জানে না।
সবকিছু প্যাকেট করা হয়ে গেলে শামীম একটি পিকাপ ডেকে সেটাতে তোলার ব্যবস্থা করলো। আতিয়া ভাবি শামীমকে বার কয়েক রুটি, কলা আর ডিম পোচ খাবার জন্য জোরাজুরি করছেন। কিন্তু শামীম খেলো না। প্লেট ধরে এনে নাবিলার সোফার কোনায় এনে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, “ঝটপট খেয়ে নাও”। নাবিলাও আর সঙ্কোচ করলো না। বাচ্চা হবার পর থেকেই রাক্ষসের ক্ষুধা তার পেটে। বেশিক্ষণ খাবার না পেলে পৃথিবীটাই আস্ত একটা খাদ্যবস্তু মনে হয় তার। কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে।
নাবিলার খাওয়াটা আতিয়ার চোখে ভালো লাগে না। সেই ভালো না লাগার কারণটাও তার কাছে ঠিক বোধগম্য হয় না। আতিয়ার জন্যই তো মাহদী ওরকম উৎসাহিত হয়ে স্পার্ম ডোনেশন করতে যেত। নিঃসন্তান দম্পতির জন্য সেই তো ভেবেছিল। আর সেই মানুষের ভ্রুণ যদি নাবিলার কোলে মনুষ্যের বাচ্চা হয়ে খেলা করে, তবে তা এখন মেনে নিতে এত খারাপ লাগছে কেন ওর? শুধু চোখের সামনে স্বামীর উত্তরসূরী দেখতে পাচ্ছে বলে?
আতিয়া নিজেও সে উত্তর জানে না।
সে টেবিলের উপর নাস্তার প্লেট সাজিয়ে মাহদীকে বেশ কয়েকবার নাস্তা করার জন্য ডাকলো। কিন্তু মাহদী ঘরের ভিতর থেকে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাবিলাকে দেখামাত্রই আর বের হলো না। শুধু নাবিলা নয়, শামীমের সামনেও সে আসছে না। ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার শামীম খেয়ালও করেছে। অথচ মাহদীর এখন অফিসের সময়,প্রতিটা সেকেন্ড অপব্যয় করলেও অফিসে পৌঁছাতে তার দেরি হয়ে যাবার কথা!
(চলবে…)